অকৃতজ্ঞ

মৃণালিনী
ছোটগল্প
Bengali
অকৃতজ্ঞ

গেট দিয়ে বাড়িতে ঢোকবার ও বের হবার সময় প্রায়ই মহিলাটির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ইশিতার বাড়ির ঠিক বিপরীত দিকে বাড়িতে ভাড়া থাকে। আগে সেভাবে মহিলাটিকে খেয়াল না করলেও আজকাল দিনে বেশ কয়েকবার দেখা হয়ে যায়। মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা ম্লান হাসিতে কি যেন একটা বলতে চায়।

ইশিতার মা অসুস্থ। বৌদির হাতে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব। বৌদি হাসি মুখে বাড়ি এবং বাইরে সমস্ত কাজ, এমনকি বাইরের বাজার পর্যন্ত সে নিজে হাতে করে। কাজের প্রয়োজনে দিনে কয়েকবার তাকে বাইরেও বের হতে হয়। আর বাইরে বের হলেই বিপরীত বাড়ির সেই মহিলাটি সঙ্গে গেটে দেখা হয়ে যায়। সকাল হোক বা বিকেল গেটেই তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন। তাই না চাইলেও চোখাচোখি হয়। ইশিতার বৌদি ব্যস্ততার মধ্যেও একটু হেসে বাড়ির ভেতর চলে আসে।

মহিলাটি বেশ লম্বা, অতিরিক্ত রোগা বলেই বোধহয় লম্বা লাগে বেশি। শ্যামবর্ণ রঙ রোদে পুড়ে প্রায় তামাটে হয়ে গিয়েছে। পড়নের শাড়িতে দারিদ্র্যতার ছাপ স্পষ্ট, তার করুন চোখ দুটো যেন ইঙ্গিতে তারই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন একটা খুঁজে চলেছেন, তার খোঁজ চলতেই থাকে মাসের পর মাস।

একদিন বৌদি তার কোলের মেয়েটিকে নিয়ে গেট দিয়ে বের হচ্ছে। হঠাৎ সেই মহিলা ছোট মেয়েকে দেখে নিজে থেকে এগিয়ে এসে বলল, ‘মায়ের সঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছো বুঝি।’

বৌদি হেসে বলল, ‘না। ওর দাদুভাইয়ের কাছে যাবে জেদ ধরেছে।’ বলে চলে গেল।

একটি ছোট কথা দিয়ে শুরু হলেও কয়েকদিনের মধ্যে জানা গেল মহিলাটি ভাড়া থাকে। স্বামী নেই। দুটো ছেলেই তার বেঁচে থাকবার একমাত্র অবলম্বন। বড় ছেলে টেবিল টেনিস খেলায় বেশ ভালো। সংসারের অভাবের কথা জেনে কোচিং সেন্টারের স্যার টাকা নেয় না। কিন্তু শুধু ভালো খেললেই তো হবে না, মাধ্যমিক পাশ করা চাই অথচ বই কেনবার টাকা নেই।

মহিলার কথা শুনে মায়া হল। ছেলেটি এত ভালো অথচ শুধু টাকার জন্য বই কিনতে পারছে না। দাদার সঙ্গে আলোচনা করে সে বই কিনে দিল। এমনকি প্রাইভেট টিউটরের টাকা দিতেও রাজী হল। বড় ছেলে খেলার সঙ্গে সঙ্গে মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করল।  মহিলাটির আনন্দে বৌদিকে জানিয়ে পরবর্তী সময়ের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নেবার জন্য অনুরোধ করতেই বৌদি খুশি মনে রাজি হয়ে গেল। মহিলাটির আনন্দের  সীমা থাকল না। দিন যেতে লাগল। কোলের ছেলে বড় হতে হতে, তার বড় ছেলে দেখতে দেখতে কলেজের পরীক্ষায় পাশ করল। এদিকে ভালো খেলোয়াড়, সুতরাং খুব তাড়াতাড়ি সে চাকরি পেয়ে গেল। মহিলাটিকে এখন আর আগের মতো গেটের সামনে দেখা যায় না। তিনি তার সংসারে ব্যস্ত। তার ছোট ছেলেও এখন খেলা শিখছে।

এদিকে ইশিতার দাদার মেয়ে পূর্বা বড় হয়েছে। ছ’বছরের পূর্বাও টেবিল টেনিস শিখছে।  কিন্তু কিছুতেই স্যারের শেখানো টিকস তার মাথায় ঢুকছে না। ক্লাবে প্র্যাকটিস ঠিক মতো করেও ম্যাচগুলোতে হেরে যাচ্ছে। ফাইনালে জুনিয়র লেভেলে বারবার হেরে বাচ্চা মেয়েটির খেলার প্রতি আতঙ্ক দেখা দিল। টেবিল টেনিসের নামে পূর্বার মনে ভয় দানা বাঁধতে শুরু করল।

একদিন বৌদি সেই মহিলাটিকে গেটের সামনে দেখতে পেয়ে বলল, ‘আপনার ছেলে তো খুব ভালো খেলে, যদি আমার মেয়েটাকে একটু প্যাক্টিস করিয়ে দেয়।’ বৌদির কথা শেষ না হতেই মহিলাটি বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। বাবু এবার ছুটিতে এলেই আমি পাঠিয়ে দেব।’ বাবু এল এবং একদিন বৌদির ছোট মেয়েটির সঙ্গে খেলা প্যাক্টিস করল। পূর্বা নতুন দাদাটির সঙ্গে প্যাক্টিস করে অনেককিছু আয়ত্ত করে নিল। গল্পে গল্পে হাসিমুখে তার চোখমুখের আতঙ্কের ছাপ অনেকটাই মিলিয়ে গেল। সেও দাদার কাছে শিখবে বলে অপেক্ষা করতে লাগল।

এরপর, বড়ছেলেটি আর এল না। বৌদি অনেকদিন, অনেকবার অনুরোধের উত্তরে তিনি বললেন, ‘এবার এলেই পাঠিয়ে দেবো।’ দিন মাসে পরিবর্তিত হল। বৌদি তার বাড়িতে গিয়ে অনুরোধ করাতে মহিলাটি জানালেন, ‘ছেলে এখন বাইরে চাকরি করে। একদিনের জন্যে আসে। তাই সময় পায় না।’ বৌদি আশায় দিন গোনে। গেটের সামনে দেখা হলেই মহিলাটি বৌদিকে এড়িয়ে ভেতরে চলে যায়।

এদিকে রোজ রোজ মেয়ের খেলাতে হেরে যাওয়া, চোখের জল, চোখে ভয়-আতঙ্ক শুধু বৌদি বা দাদাকে নয়, পুরো পরিবারের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃদ্ধ বাবা আদরের নাতনির অবস্থা দেখে রাতে ঠিক মতো না ঘুমিয়ে জেগে থাকে। জেগে থাকে এখন সবাই। কারণ পূর্বা নীচের ঘরে প্যাক্টিস করতে যেতে চায় না। তাকে অনেক বুঝিয়ে পাঠানো হয় কিন্তু বাড়িতে প্যাক্টিসেও সে বল মিস করে, ভয় ও আতঙ্কে সে সাধারণ শটগুলোকে ঠিকমতো বুঝতে পারে না। প্রত্যেকবার ম্যাচ হেরে যায়।

এদিকে টুর্নামেন্ট শুরু হচ্ছে। সুতরাং বাড়িতে এক আলোচনা চলছে। সবার চোখেমুখে ছোট্ট মেয়েটির মানসিক যন্ত্রণা ছাপিয়ে উঠেছে। ইশিতা পূর্বাকে কোলে নিয়ে অনেকরকম ভাবে বোঝাতে শুরু করল। প্যাক্টিস প্রসঙ্গে বৌদির মুখ থেকে অপরজিতের বাড়িতে থাকা মহিলা এবং তার ছেলের গুণের বৃত্তান্ত উঠে এল।

ইশিতার মনে পূর্বার অবস্থা শেলের মতো বিঁধছিল। বাড়িতে কাউকে কিছু না জানিয়ে সে দৌড়ে গেল সেই মহিলাটির কাছে। অচেনা মহিলাটির সামনে হাত জোর করে অনুরোধ করল। মহিলাটি ইশতার সঙ্গে তার বড় ছেলের পরিচয় করিতে দিতেই সে বড়ছেলের কাছে অনুরোধ করল, ‘সময় পেলে একটু যদি বাচ্চা মেয়েটির সঙ্গে খেলো, তাহলে ওর হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস আবার হয়তো ফিরে আসবে। যত টাকা চার্জ করবে আমি তোমাকে দেব ভাই।’ ছেলেটি কোন প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে ব্যস্ততার অজুহাতে পাশের ঘরে চলে গেল। মহিলাটি ছেলের এই আচরণ ঢাকতে বলল, ‘আপনি তো কলেজে পড়ান। আপনার কথা অনেক শুনেছি কিন্তু কোনদিন কথা হয়নি। আপনাদের কত ঋণ আছে বাবুর ওপর, তা কী আর শোধ করা যাবে? আপনি নিজে এসেছেন বাচ্চা মেয়েটির জন্যে, বাবু অবশ্যই যাবে।’ ইশিতা মহিলাটির কথা শুনে বিশ্বাস করে বাড়িতে এসে সবাইকে জানাল। পূর্বা এখন ঠিকঠাক শিখতে পারবে, অন্তত তার মনে ভয় থাকবে না। কিন্তু এক সপ্তাহ চলে যাবার পর বাবু এল না।

পরের ম্যাচে আদরের মেয়েটি হেরে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। ইশিতা বৌদিকে জিগ্যেস করল, ‘ছেলেটি আসবে বলেও এলো না।’

বৌদির গাল বেয়ে তখন জল গড়িয়ে পড়ছে। আস্তে গলায় বলল, ‘আসবে আর কোনদিন না।’

কথাটা কানে যেতেই বলল, ‘মানে?’

কিছুদিন আগে মহিলাটির সঙ্গে গেটে দেখা হয়েছিল। আমি কিছু বলবার আগেই বলল, ‘বাবু বলছিল, একজনকে শেখালে ওর পোষাবে না। তুমি যদি কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী জোগার করতে পারো, তাহলে ওর শেখাতে কোন আপত্তি নেই।’

কথাটা কানে যেতেই ঘরের সবাই বৌদির মুখের দিকে তাকাতে দেখল। প্রত্যেকের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছিল। পূর্বা কাঁদতে কাঁদতে ইশিতার কোলে এসে বসতেই সে ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে দেখল, মহিলাটির ঘরে আলো জ্বলছে। সন্ধের অন্ধকারে তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল।

মৃণালিনী। কবি। 

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ