প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
বুকের কাছে একটা কষ্ট হয়। সদ্য যেন কেউ খামচে দিয়েছে। আজ অভিজিত তোমার বাড়িতে এসেছিলাম। ফোনে যোগাযোগ করে তবেই বেরিয়েছিলাম। তবুও তুমি রইলে না। তোমাদের বাড়িতে আমাকে কেউ বসতে বলে নি। অবশ্য মুখের উপর দরজা একেবারে বন্ধ করে দেয় নি। আমি যেন বেশ খানিকটা জোর করেই তোমাদের বাইরের বসার ঘরে রয়ে গেলাম। একবার তোমার পিসি এসে জিজ্ঞেস করলেন, চা খাবো কি না। একটু ভেবে বললাম, অভি আসুক, তারপর খাবো। পিসি বললেন, অভির ফেরার ঠিক নেই। পুজোর জামাকাপড় কিনতে গিয়েছে। আমি একটু শক্ত হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের জল সামলাতে লাগলাম।
আজ আমিও ভেবেছিলাম অভি তোমাকে নিয়ে পুজোর উপহার কিনতে যাব। তোমাকে শার্ট প্যান্ট দেব। তোমার মাকে দেব শাড়ি। পিসিকে দেব গায়ে দেবার চাদর।
অভি আমার, তুমি আমার ফোন নিচ্ছ না। ফোনের যান্ত্রিক কণ্ঠ কেবলই বলে চলেছে যে, অভি ব্যস্ত।
অভি, তুমি এত ব্যস্ত হয়ে পড়বে, আমি কিন্তু বুঝতে পারি নি।
তোমার মা দুবার এসে দেখে গেলেন আমি পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে সিমেন্টের পাকা মেঝে খোঁড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিংবা অকারণে আঁচলটা হাতে জড়াচ্ছি।
অভি আমি তোমার মাকে বললাম না, আজ তাঁর ছেলেকে নিয়ে আমার পুজোর বাজার করতে যাবার কথা ছিল।
অথচ, এই ভদ্রমহিলার তলপেটে খুব ব্যথা হতে থাকলে অভি তুমি আমায় ফোন করেছিলে। আমি জানতাম, এইরকম বয়স হলে অনেক মহিলার জরায়ু নেমে আসে। একটা সময় জরায়ু বাদ না দিয়ে উপায় থাকে না। তখন সার্জারির প্রয়োজন।
হাসপাতালে বলে কয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। ডাক্তারবাবুকে বলেছিলাম বাড়িতে বড্ড বিপদ। অন্য নার্সদের বলেছিলাম, আমার হবু শাশুড়ির শরীর খারাপ।
অভি, তোমাকে যখন বললাম, তোমার মাকে গাইনি ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব, তুমি বললে, কেন, গাইনি কেন? তোমার পিসিও অবাক। এই বয়সে গাইনি ডাক্তার দেখাতে হবে? কেবল অভি তোমার মা আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আমায় সেখানেই নিয়ে চলো। তাড়াতাড়ি করে আমি ওঁর খুব দরকারি জিনিসগুলো একটা ব্যাগে পুরে নিচ্ছিলাম। শিশুর মতো আকুল হয়ে অভি তুমি বলেছিলে, তুমি কি এখনই মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেবে?
ডাক্তার জানাকে আমি অনেকদিন ধরেই জানতাম। ওটি নার্স হিসেবে ওঁর সাথে কাজও করেছি। ওঁর পরামর্শে ওঁর নিজস্ব নার্সিং হোমে নিয়ে গিয়েছিলাম তোমার মাকে। অপারেশন থিয়েটারে আমি নার্স হিসেবে হাত লাগালাম। অভি তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে, জানি, তোমার চার্জটা লাগবে না। কিন্তু সার্জন সাহেবের টাকাটা?
আমি আঙুল দিয়ে তোমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলেছিলাম, দ্যাখোই না।
বড়ো গাইনি সার্জনের ফি আর পেশেন্টের বেডভাড়া আমি শুধে দিয়েছিলাম বেশ কয়েকটি ছুটির দিনে ডাক্তার জানার নার্সিং হোমে ফ্রিতে ডিউটি করে দিয়ে। তোমাকে সে সব বলি নি।
অভি, তোমার পিসি জানতেন না, নার্স হতে গেলে বি এস সি নার্সিং পড়তে হয়। নার্সদের সাথে আয়াদের যে বিশেষ কোনো তফাত তফাৎ থাকতে পারে, সেটা তিনি বুঝতে পারতেন না। একদিন বলে বসেছিলেন তুমি এত মিষ্টি একটা মেয়ে, একটু পাশটাশ দিলে কোনো ভদ্র কাজ করার সুযোগ পেতে। আমার কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছিল। তোমার মা পরিস্থিতি সামলে দিয়ে বলেছিলেন, তা যাই হোক না কেন, আমাদের সুমিকে ডাক্তাররা খুব ভরসা করে। কিন্তু তিনিই কি খুব একটা জানতেন, একজন নারীকে নার্স হয়ে উঠতে গেলে কী প্রচেষ্টা করতে হয়?
অভি তুমিও কি জানো?
আসলে অপারেশন থিয়েটারে সার্জন ডাক্তার সাহেবদের সাথে আমরা, ওটি নার্সেরা একটা অর্কেস্ট্রা টিমের মতো কাজ করি। অপারেশন থিয়েটারে সার্জন ডাক্তাররা ঢোকার আগেই আমরা পেশেন্টকে সার্জারির জন্য তৈরি করি। আগে থেকেই তাকে সামলে সুমলে রাখি। প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকিয়ে রাখা। আর পেশেন্ট পার্টির হাজার জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়া।
আরে অসুখ হয়েছে তোমার আপনজনের। সময় থাকতে পেশেন্ট নিজে খেয়াল করেনি। ওষুধের দোকানে গিয়ে খুশিমতো ওষুধ কিনে খেয়ে নিয়েছে। তোমরা বাড়ির লোকজনও খেয়াল করো নি পেশেন্ট কোনো দিন ডাক্তার দেখায় নি কেন? নিজের বাপ মায়ের ব্লাড গ্রুপ কি, কোন্ ওষুধে অ্যালার্জি আছে, তা জানে না নব্বই শতাংশ ছেলেমেয়েরা। তুমিও জানতে না। সত্যি কি না বলো অভি?
অপারেশন থিয়েটারে অভিজ্ঞ সার্জন হাত বাড়ালেই দক্ষ ওটি নার্স সঠিক সরঞ্জামটি তাঁর হাতে তুলে দেন। বিনা বাক্যব্যয়ে চলতে থাকে জটিল অপারেশন। অর্কেস্ট্রা টিমের মতোই ছন্দে লয়ে বাঁধা স্ক্রিপ্ট। ভাল সার্জন জানেন ভাল নার্সের কদর।
অভি, তুমি এসব জানো না। জানার প্রয়োজন বোধ করো নি।
আমার সঙ্গে কিভাবে তোমার আলাপ হয়েছিল, সে কথা কি আজ তুমি আর মনে রেখেছ?
তোমার বন্ধুদের একজনের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। আমাকে দেখে তোমার ভালো লেগে গিয়েছিল। বন্ধুকে দেখতে তুমি বার বার আসতে। আর আমায় খুঁজতে। এখন সে সব ভুলে যাচ্ছি।
তোমার বন্ধুকে দেখতে এসেছিলে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলে। যদি আমায় দেখতে পেয়ে যাও। তাই। আমি টের পেয়েছিলাম। আরো টের পেয়েছিলাম তোমার পকেটে পয়সা ছিল না। আর বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে আসো নি। টের পেয়েছিল আমার চব্বিশ বছরের চোখ। আমি তোমাকে বলেছিলাম আমাদের একটা ক্যান্টিন আছে। তুমি আমাকে বলেছিলে, তোমার খিদে নেই। আমি জানতাম, তুমি মিথ্যে বলেছিলে। আমি বলেছিলাম এই দুপুরে দুটো না খাইয়ে আমি তোমায় ছাড়ব না।
কেন বলেছিলাম, তার কোনো যুক্তি নেই। যে অবস্থায় পড়লে বছর তেইশ চব্বিশের একটা মেয়ের ভিতর যুক্তিবোধ আর কাজ করে না, আমি সেই অবস্থায় চলে গিয়েছিলাম।
আমি আমার কুমারী মনের সবটুকু দিয়ে তোমাকে আপন জেনেছিলাম। যখন ভেবে ফেলেছি, তোমার কাছে নিজেকে নিঃশেষে তুলে দেব, এমন সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। তুমি জানো, আমাদের সমাজে অনেকেই নিতান্ত বিপজ্জনক অবস্থায় না পড়লে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে না। প্রথমে তুকতাক, টোটকা, চটি বই পড়ে কবিরাজি, হেকিমি, এইসব করে টরে যখন ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো হয়ে পড়ে, সেই সময় লোকজন ডাক্তার দেখাতে যায়। ডাক্তার তাকে নানারকম পরীক্ষা করে সত্যি সত্যি কি হয়েছে জানার চেষ্টা করলে সে বিরক্ত হয়। লোকের কাছে শুনেছি এমন সব ডাক্তার নাকি ছিল, যারা মানুষের নাড়ি টিপে তার কি কি রোগ আছে জেনে ফেলে। কাউকে আবার নাড়িও টিপতে হয় না, কপাল দেখলেই তিনি সব বুঝতে পারেন। এইসব শুনে নানারকম পরীক্ষা করাতে মানুষের ভিতর একটা অনীহা কাজ করে।
তুমি জানো, আমার দেশের লোকজন একই সাথে ভাগ্য ও কর্মফলে বিশ্বাস করে। ভাগ্যে যা আছে তা হবে, বলার সাথে সাথে “সঅব কর্মফল” বলতে এদের বাধে না। যে কোনো একটা কাজের একটা ফল হয়, তুমি তা জানো। আগুনে হাত দিলে হাত পোড়ে। কিন্তু রীতিমতো সাবধানতা আর দরকারি ব্যবস্থা নিয়ে দারুণ আঁচের বয়লারে বেলচা করে কয়লা এগিয়ে দেয় মানুষ। আবার চলন্ত রেলগাড়ি মাঝরাতে বেলাইন হয়ে কামরা পালটি খেয়ে ঘুমন্ত অবস্থায়ই মানুষ মারা যেতে পারে। একেও কি ভাগ্য বলবে? নিজের ত্রুটি, পরের ত্রুটি আর আকস্মিকতা, এই অনেক রকম জিনিস মিলিয়ে মিশিয়ে নানা অভাবনীয় কাণ্ড হয়ে যায়।
আমরা ওপর ওপর অনেক কিছু দেখি, আর সেই চটজলদি দেখতে গিয়ে ভুল করে বসি। আমরা সবাই আমাদের নিজের দিক থেকেই যে কোনো বিষয় দেখি। অন্যের দিক থেকে দেখতে কেমন লাগে, তা ভাবতে চাই না। সরকারি হাসপাতালে নিজের লোক ভর্তি থাকলে মানুষ অন্য সব কাজ ছেড়ে প্রথম কয়েক দিন পড়ে থাকে হাসপাতালে। অন্য সমস্ত কাজ থেকে পেশেন্ট পার্টি নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একমনে হাসপাতালের কাজ লক্ষ্য করে চলে বলে হাসপাতালের অনেক ত্রুটি ও খামতি তাদের চোখে পড়ে। অন্য সব জায়গায় যে নানাবিধ ঘাটতি আর সীমাবদ্ধতা নিয়েই যে সমাজের চলা, সে তখন পেশেন্ট পার্টির খেয়াল থাকে না। সরকারি হাসপাতাল যে সমাজ বহির্ভূত কোনো জায়গা নয়, সমাজের সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়েই যে হাসপাতাল চলছে, এটা মানুষ ভুলে যায়। শ্মশান বৈরাগ্য বলে একটা কথা আছে জানো। ওর মানে হল, শ্মশানে গিয়ে মৃতদেহ সামনে রেখে জীবনের স্থায়িত্বহীনতা নিয়ে মানুষের কিছু উপলব্ধি হতে থাকে। যেটা কিন্তু একান্ত আবেগতাড়িত আর অনেকটাই সাময়িক। শ্মশানের আবহাওয়া মানুষের মনে ওইরকম একটা বৈরাগী ভাব চাগিয়ে তোলে। কিন্তু আবেগটার শিকড় গজায় না। খানিকক্ষণ ডালপালা ছড়িয়ে নিয়ে, শ্মশানের পরিবেশ থেকে বেরিয়ে পড়লে সেটা উবে যেতে সময় লাগে না। যে কোনো ভাবনার মজবুত শিকড় না থাকলে, তার ওই উবে যেতে বেশিদিন লাগে না।
সরকারি হাসপাতালে নিজের লোক চিকিৎসাধীন থাকলে কিছু মানুষের মধ্যে হাসপাতাল নিয়ে একটা অতিরিক্ত ভাবনা চেপে বসে। এটা নেই কেন, ওটা হয় না কেন, এই বলে মাথাগরম করে ফেলায় কিছু মানুষ অভ্যস্ত। একটা পরিবেশ ও পরিস্থিতি যে বহুদিনের চেষ্টায় গড়ে ওঠে, আর যে কোনো পরিকাঠামোর চাপ নেবার একটা সীমাবদ্ধতা থাকার কথা, সেটা কেউ কেউ বুঝতে চায় না।
একজন বয়স্ক পেশেন্ট মারা গিয়েছেন। পঁচাত্তর বছর বয়সে মৃত্যু হলে আমাদের দেশে তাকে অকালমৃত্যু বলতে পারব না। একে তো ভদ্রলোকের লিভার সিরোসিস ছিল। তার উপর ডেঙ্গু। ভদ্রলোক এসেই ছিলেন আধমরা অবস্থায়। অনেক পেশেন্টকে চিকিৎসা দেবার মতো পরিকাঠামো আমাদের আছে কি না, তা বিচার না করেই লোকে আমাদের দোষ দিতে অভ্যস্ত।
আমি ছিলাম মেল ওয়ার্ডের নার্স।
সেদিন পেশেন্ট দেখছিল ড. রৌনক। ও আমাদের মেডিক্যাল কলেজের পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট। পড়াশুনায় চৌকস হলে কি হবে, ছাব্বিশ বছর বয়সেও জীবনকে তার অনেকটা জানা বাকি ছিল। পেশেন্টের বাড়ির লোককে যে সদা সর্বদা সত্যি কথা বলা যায় না, বা বললে বিপদ হয়, এটা ওর মাথায় ছিল না।
আমি জানতাম ড. রৌনক ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। কিন্তু তার সাথে জানতাম, ও একটু মাথা গরম। আর ও আমার চেয়ে বয়সে একটু বড় হলেও ওকে আমি কেন যেন খুব স্নেহ করতাম। এই ছাত্ররা আজ এখানে আমাদের সাথে কাজ করছে। প্র্যাকটিকাল অনেক বিষয়ে এদের থেকে আমরা কম জানি না। তবু এরা খুব দ্রুতগতিতে আমাদের টপকে বহুদূরে চলে যাবে, এই বাস্তবতা আমাদের একটু গুটিয়ে থাকতে বাধ্য করত। আমার কান ছিল খুব খাড়া। আর আমি কখনো কখনো রৌনক ফোনে কারো সঙ্গে কথা বললে, অপর প্রান্তে কে আছে, টের পেতাম। আমি আন্দাজে জানতাম, রৌনকের বাবা মায়ের মধ্যে কিছু একটা সমস্যা ছিল। সেটাই কখনো কখনো ড. রৌনককে আনমনা করে দিত। খ্যাপাটে হয়ে উঠত ব্রিলিয়ান্ট ছেলেটা। তখন ওর গলার স্বর রুক্ষ, আর যাবতীয় বিরক্তি ঝরে পড়ত ওর চোখে।
পঁচাত্তর বছরের লিভার সিরোসিস হিস্ট্রির পেশেন্ট ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হলে তার যে জীবনের খুব বেশি আশা থাকে তা তো নয়। কিন্তু, এক্ষেত্রে ডাক্তার দের সাবধানী উত্তর হল, আমরা খুব চেষ্টা করছি। আপনারাও খুব করে ভগবানকে ডাকুন। ডাক্তার হয়েও সমস্যা হালকা করতে ভগবানকে মাঝখানে ব্যবহারের অনেক সুবিধা। অঘটন ঘটে গেলে পেশেন্ট পার্টি ভগবানের ইচ্ছে ধরে নিয়ে শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু ড. রৌনক প্রথম দিনেই পেশেন্ট পার্টিকে বলেছিল আধমরা একটা লোককে এনে ভাল করে দাও বললেই হয়? আমরা ম্যাজিশিয়ান নাকি?
আশ্চর্যের কথা, বাংলার মানুষ ম্যাজিকেই বিশ্বাস করে। অসুখ ঠেকাতে হাততালি দেয়, আলো নেবায়, প্রদীপ জ্বালায়। যতদিন পারে হোমিও ওষুধ খেয়ে গিয়ে রোগটা পাকিয়ে তবেই হাসপাতাল মুখো হয়। ওদের জগতে ইঞ্জেকশন, আলট্রাসোনোগ্রাফি আর কবচ তাবিজ একই জিনিস। তবে কবচ তাবিজ যারা দেয়, পেশেন্ট মরলে তাদের মারধোর করার খবর শুনিনি। আর ডাক্তার পেটাতে বাংলার মানুষ সিদ্ধহস্ত। একটা ভালো ছাত্র যে গাড়ি বাড়ি পুতুল বৌ পাবার জন্যেই মন দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, ওকালতির স্বপ্ন দ্যাখে, আইএএস পরীক্ষায় পাস করার চেষ্টা করে, এই সহজ সত্যটা বাংলার আম জনতা বুঝতে চায় না। তারা ধরেই নেয়, এরা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হবে বলেই গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে ঘুরছে। তাই ডাক্তারদের উপর মানুষের বিস্তর আশা। কয়েনের অপর পিঠে ডাক্তারি পাশ করা ছাত্রের আশা যে একটি ভালো কেরিয়ার, তা সাধারণ মানুষ হিসেবের মধ্যেই রাখে না।
লিভার সিরোসিস এবং ডেঙ্গু নিয়ে পঁচাত্তর বছরের অর্ধচেতন পেশেন্ট ভরতি হলে তার ভবিতব্য কি হতে পারে, তা চোখা চোখা ভাষায় পেশেন্ট পার্টিকে বলে রেখেছিল ড. রৌনক। তখন থেকেই পেশেন্ট পার্টির ধারণা ছিল রোগীর প্রতি তার কোনো সমবেদনা নেই। রোজ রোজ গাদা গাদা পেশেন্ট যাকে দেখে যেতে হয়, কিছুটা ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট না থাকলে তার পক্ষে একজন পেশেন্টকে একটা স্রেফ সংখ্যার বেশি কিছু ভাবা অসম্ভব। ডাক্তাররাও তাই ভাবেন। আমরা নার্সরাও তাই ভাবি। প্রত্যেকটা পেশেন্টকে এক্সক্লুসিভ যত্ন নিয়ে মনে রাখাটা আমাদের প্রফেশনাল স্কিলকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। জানো অভি, “দীপ জ্বেলে যাই” সিনেমাটার কথা মনে পড়ছে। কিন্তু আমরা পেশেন্ট পার্টির সঙ্গে কথাটা বলি সন্তর্পণে। কেননা, কাজের শেষে আমি একটা সাধারণ মানুষ। প্রতি মুহূর্তে আমায় কেউ সুরক্ষা দেবে না।
রৌনক ভুলটা ওখানেই করেছিল। পঁচাত্তর বছর বয়সের একটা লিভার সিরোসিসের পেশেন্ট মারা গেলে সেই মৃত্যু যতই দুঃখের হোক না কেন, সম্ভাবনাতত্ত্বের নিরিখে তা আদৌ আশ্চর্য নয়, এই সরল সত্যটা রৌনক হেঁকে বলতে গিয়ে গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলল।
একটা অমন বয়স্ক লোকের মৃত্যুর বদলা নিতে দু ট্রাক ভরতি লোক গ্রাম থেকে কলকাতায় চলে আসতে পারে রৌনক ভাবতেই পারে নি। আসলে পিছনে শাসক রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে এটা হওয়াও শক্ত। তো রৌনককে ওরা মরিয়া হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর রৌনক তাদেরকে গিয়ে বলে বসল, আমিই ড. রৌনক, কি করবি করে নে।
অভি, আমি যেন ছাব্বিশ বছরের ড. রৌনকের মধ্যে ছাব্বিশ বছরের তোমাকে মুহূর্তের জন্য দেখতে পেয়েছিলাম। তাই পেশেন্ট পার্টির ফুঁসে ওঠা লোকগুলো রৌনককে ঘিরে ধরে মারতে শুরু করলে আমি গিয়ে যেন আমার অভিকেই জড়িয়ে ধরে বাঁচাতে চাইলাম। বিশ্বাস করো অভি, আমি তোমার, তোমার বয়সী ছেলেদের ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়সটাকেই জড়িয়ে ধরলাম। ওরা রৌনককে এলোপাতাড়ি মারছিল। আমি ডাক্তার পরিবহ মুখার্জির কথা শুনেছিলাম। শুনেছিলাম তাঁকেও এ রকম মারধোর করে খুলি তুবড়ে দেওয়া হয়েছিল। ডাক্তার পরিবহ জীবনে আর সার্জারির ছুরি কাঁচি ধরতে পারবে কি না সন্দেহ। আমি রৌনকের মাথাটা বাঁচাতে চাইছিলাম। সার্জারির ছুরি কাঁচি ধরার ক্ষমতা চলে গেলে ডাক্তারের আর রইলটা কি?
আমি ডাক্তার রৌনককে জাপটে ধরে মারমুখী জনতাকে কাকুতি মিনতি করছিলাম, ওকে ছেড়ে দিন। ওর কোনো দোষ নেই। সেই সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে দু একটা হাত আমার বুকে খামচে দিচ্ছিল। স্কার্টের নিচ থেকে হাত ঢুকিয়ে আঙুল সেঁধিয়ে যাচ্ছিল গোপনাঙ্গে। আমার যেন তখন আর দেহবোধ ছিল না। মনে হচ্ছিল আমার একটাই কর্তব্য, ডাক্তার রৌনককে বাঁচানো। আমি রৌনককে জড়িয়ে ধরে আছি, সেই ছবিটা ভিডিও হয়ে ভাইরাল হয়ে তোমার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। না, শুধুমাত্র তোমার কাছেই নয়। অনেক লোকের কাছেই শুনলাম, আমি নাকি বেশ্যা। নইলে, সবার সামনে ডাক্তার রৌনককে বুকে জড়িয়ে রাখলাম কি করে! তোমার মনে পড়েছিল সত্যজিৎ রায়ের একটা ফিল্মের কথা। প্রতিদ্বন্দ্বী। ধৃতিমান চ্যাটার্জির অভিনয়টা ভাল। কিন্তু তুমি অন্তর্বাস পরা ক্যাবারে গার্ল শেফালিকে দেখে মনে করেছিলে সব নার্সের ভিতরেই একটা করে লতিকা থাকে।
লতিকা যে নার্সিং পেশায় একটা ব্যতিক্রম, সেটা তুমি বুঝতে চাইলে না। আমার প্রথমটা খুব কান্না পেয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, আমার জীবনের সবটুকু শেষ হয়ে গেল। পরে ভেবে দেখলাম, তুমি আমাকে রক্তমাংসের একটা থলে ঠাউরে বসে আছো, যেখানে হাত বাড়ালেই যৌনতা মিলবে। আর ড. রৌনককে বুকে চেপে আছি, ভাইরাল হওয়া এই ভিডিওটা তোমার কাছে আমাকে বেশ্যা বানিয়ে ফেলল। আমি যে তোমাকে ক্ষুধাকাতর দেখে নিজেদের ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছিলাম, তোমার মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলাম, সব তুমি কী আশ্চর্য রকমে ভুলে যেতে পারলে। আজ পুজোর আগে তোমাকে, তোমার মাকে জামাকাপড় কিনে দিতে এসে তোমার আমার সম্পর্কের আসল চেহারাটা আমার সামনে ধরা পড়ল। ডাক্তার রৌনককে বুকে চেপে আছি, এমন একটা মিথ্যে ভিডিও ভাইরাল হয়ে আমার সমস্ত ভালবাসা, আন্তরিকতা মুছে গিয়ে, তোমার চোখে সত্যি হয়ে রইল শুধু লতিকা। ব্রা আর সায়া পরে সিদ্ধার্থের বিস্ফারিত চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে থাকা লতিকা।
কিন্তু আমি লতাপাতা নই। আমি স্বাবলম্বী মেয়ে। তুমি আমার সাথে থাকলে খুশি হতাম অবশ্যই। কিন্তু মিথ্যে একটা সম্পর্ক নিয়ে খুশি হয়েও কোনো লাভ নেই। যা মিথ্যে, তা কোনোদিন না কোনোদিন ধরা পড়তই। ততদিনে হয়তো তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়ে গিয়েছে। কিংবা আমার গর্ভে তোমার বাচ্চা সাঁতার কাটছে। তখন বাঁধন কেটে বেরোতে অনেক জটিলতা হত। এ বেশ হল। ভিডিওটা মিথ্যে ছিল। কিন্তু সে আরেকটা বড় মিথ্যেকে অনাবৃত করে দিল। একটা নার্সের সাথে তোমার সম্পর্কের মিথ্যে। এই মিথ্যের আওতা থেকে বেরিয়ে আমি এখন সত্যকে নতুন করে ছোঁবো। আমার বুকদুটো কেউ চটকে দিচ্ছে। স্কার্টের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে একটা হাত। কিন্তু আমি ডাক্তার রৌনককে বাঁচাতে মরিয়া। অন্য কোনো কিছুই আমাকে ব্রত থেকে সরাতে পারছে না। আমি সত্যকে আমার ভেতর থেকে গড়ে তুলছি। নতুন করে চিনতে চাইছি। শুধু মনে থেকে যাবে পুজোয় তোমাকে পোশাক কিনে সাজাবো বলে তোমার বাড়িতে আমি এসে বসে আছি। আর তুমি কোথায় গা ঢাকা দিয়েছ।
আগুনের সামনে তোমার আড়াল খুঁজে নেওয়া ছাড়া উপায় রইল না।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..