ফিরে এসো
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
দমকা হাওয়ায় জানালার পাল্লাটা প্রচন্ড শব্দে বার কয়েক দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেতেই বিষণ্ণতায় ঘোর লেগে থাকা নাদিরা এক লাফে খাট থেকে নেমে তা বন্ধ করতে ছুটে যায়। আকাশে ঘন কালো মেঘের তীব্র গতি, বাতাস বইছে জোরে সোরে। এই বুঝি ঝড় বৃষ্টি শুরু হবে। জানালার পাল্লাটা টেনে বন্ধ করতে গিয়ে অকস্ম্যাৎ থেমে গেল সে-যাক না ভেসে ঝড়ে সব কিছু আজ। প্রকৃতির এই ঝড় থেকে বেঁচে কি লাভ, তার নিজের জীবনের ঝড় থামাবে কে? এই ভাবনায় সে থেমে গেল। ঝড়ের প্রচন্ডতায় জানালা ভেদ করে আসা দুরন্ত বাতাসে লন্ডভন্ড হতে চলেছে ঘরের ভিতরের সব কিছু।
প্যারালাইজড বাবার সংসারটা যখন নাদিরার কাঁধে এসে পড়ে তখন তার বয়স আঠারো ছুঁই ছুঁই। মা তো গত হয়েছেন অনেক আগেই। বখাটে ছোট ভাইটার অহেতুক আব্দার, বাবার চিকিৎসার খরচ আর সংসারের টানা পোড়েনে বিধ্বস্ত সে। অনেক দেন দরবার করে এস এস সি পাশ নাদিরা বাবার অফিসের ক্লার্কের চাকুরীটা জুটিয়েছিল। ভাগ্যিস মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকু ছিল, নইলে বানের জলে ভেসে যেতে হতো। সেই আশ্রয়টাকে আজ ঝড়ের তান্ডব থেকে বাঁচাতে ইচ্ছে করছে না তার।
দশ বছর কঠিন এক সংগ্রামের মধ্যদিয়ে নিজেকে যোগ্য করে তুলেছে নাদিরা। এম.এ আর এম.বি.এ-এই বিশাল চ্যালেঞ্জ তাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে প্রতিটা মূহুর্তে নানা বঞ্চনার মধ্য দিয়ে। নিজেকে কখনো ক্লান্ত ভাববার অবকাশ পায়নি সে, উদ্যম নিয়ে এগিয়ে গেছে। কিন্তু শুধু একজন নারী বলে সে তার যোগ্য জায়গায় স্থান করে নিতে পারেনি। কলিগ আর ইমিডিয়েট বসের লোলুপ দৃষ্টি তো ছিল অবধারিত। বিভিন্ন ভাবে তারা ওকে প্রলুব্ধ করতে চেয়েছে, স্পর্শ করতে চেয়েছে, অশুভ ইঙ্গিত করেছে। এত অল্প বয়সে জীবন যুদ্ধে নেমে কত যে নোংরা মানুষ সে দেখলো তার হিসেব নেই। কিন্তু নিজেকে সব কিছু থেকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল নাদিরা। অথচ আজ সেই দীর্ঘ সংগ্রামের সফলতার অহঙ্কার টুকু ধরে রাখতে পারলো না। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনিচ্ছায় মাংস লোভী এক জানোয়ারের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতেই হলো। এই গ্লানির ঝড় কে থামাবে? জানালাটা বন্ধ করতে গিয়ে নাদিরা এই ঝড়ের তান্ডবের মাঝেই নিজেকে শপে দিতে চায়।
যে শাহেদ তার জীবনে পরম আশীর্বাদ হয়ে এলো, তার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহসটা সে হারিয়ে ফেললো আজ। জীবন যুদ্ধে নাদিরা যখন কিছুটা ক্লান্ত-অবসন্ন ঠিক সেই সময় শাহেদ কি চমৎকার বিনয়ী প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল তার জীবনে, নাদিরা ফেলতে পারেনি। সকল দায়িত্ব হাসি মুখে আপন কাঁধে তুলে নেয়া শাহেদ পরম কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছিল তাকে। এক রকম জোর করেই সে তাকে চাকুরী থেকে ছাড়িয়ে নিলো বাবার সেবা করার জন্য। অথচ বাবাকে আর বাঁচানো গেল না। বাবাকে হারিয়ে নাদিরার কষ্টের দগ দগে দিন গুলো অতিক্রান্ত হবার আগেই তরতাজা প্রাণবন্ত শাহেদ এক দিন স্ট্রোকে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। নাদিরা দিশেহারা। নূতন আর এক সংগ্রামের মুখোমুখি সে! ঠিক সেই সময় ত্রাণ কর্তা হয়ে সামনে এলেন শাহেদের বস আসাদ সাহেব। নাদিরাকে তার অফিসে বসালেন। নাদিরা কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল যেন।
শাহেদের চিকিৎসা বাবদ যা ব্যয় হতে লাগলো তার জন্য আসাদ সাহেবের শরণাপন্ন হতে হলো নাদিরাকে। আর এই দূর্বলতাই হয়ে গেল আসাদ সাহেবের মোক্ষম অস্ত্র। কারণে-অকারণে নাদিরাকে ডেকে পাঠায়, গল্প করতে চায়, শাহেদকে দেখার ছলে বাসায় এসে নাদিরার সাথে সময় কাটাতে চায়। আসাদ সাহেবের এই সব কর্মকান্ড নির্বাক শাহেদ বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখে আর নিরবে চোখের জল ফেলে। নাদিরার জন্য তার বুকে প্রচন্ড হাহাকার, মেয়েটাকে কত কষ্টে ফেলেছে সে অথচ হায়েনারা তাকে ছিড়ে ছিড়ে খেতে চাইছে। পরম কৃতজ্ঞতায় নাদিরাকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে রাখে শাহেদ। কিন্তু নাদিরার নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষমতা তার নেই। এই অক্ষমতার জন্য শাহেদ কতটা কষ্ট পায় তা নাদিরা বোঝে আর অসহায় ভাল মানুষটার জন্য নিরবে চোখের জল ফেলে। প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে নাদিরা নির্বাক শাহেদের বুকে মুখ লুকিয়ে পরম সুখানুভবে নিজেকে নূতন করে আবিস্কার করে।
আসাদ সাহেবের বাড়াবাড়িটা আজ চুড়ান্ত আকার ধারণ করলো। ছুটির দিনের এই বিকেল বেলা বাসায় এসে নাদিরার নারীত্বকে চরম অপমান করলো সে। নাদিরার জন্য নির্বাক শাহেদের কিছুই করার থাকল না। নিজের আপমান আর শাহেদের কষ্টের অনুভুতি নাদিরাকে বিধস্ত করে ফেলে। দুহাতে মুখ ঢেকে শাহেদের থেকে কিছুটা দূরত্বে নির্বাক বসেছিল সে। চরম অপমানের জ্বালা এবং লজ্জা সেই সাথে জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়ার গ্লানি তার ভিতরের মানুষটাকে কুরে কুরে খেতে থাকে। ঠিক সেই সময় বাতাসের তোড়ে জানালাটা দেয়ালে ধাক্কা খেতে থাকে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নাদিরা জানালাটা আটকাতে ছুটে গিয়েও থেমে যায়, বরং তার ইচ্ছে করে দেয়াল ভেঙ্গে ফেলে ঝড়ের প্রবেশটাকে নির্বিঘ্ন করে দেয়। এভাবেই কয়েকটা মূহুর্ত কেটে যায়। দূরে বাজ পড়ার শব্দটা মিলিয়ে গেলে তার কানে আসে এক অস্ফুট গোঙ্গানীর শব্দ, চির চেনা অতি প্রিয় কন্ঠস্বর- না…..দি…..রা…..
আচম্বিতে পিছন ফিরে তাকিয়ে নাদিরা দেখে শাহেদ একা বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে দুহাত বাড়িয়ে তাকে চিৎকার করে ডাকার চেষ্টা করছে আর তার গন্ড বেয়ে ঝরে পড়ছে শ্রাবণের অবিশ্রান্ত ধারা। নাদিরার কয়েক মুহুর্ত আগের ভাবনাটা হঠাৎ পাল্টে যায়। পরাজয় আর অপমানের গ্লানি নিমিশেই উধাও হয়ে যায়। জীবন যুদ্ধে সফল সৈনিকের দৃঢ়তায় ছুটে এসে সে শাহেদকে গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরে। তখনো ঝড় চলছে প্রকৃতির আর দুটো প্রাণবন্ত মানব মানবীর আগুন আলিঙ্গণ থেকে সৃষ্টি অগ্নি ঝড়।
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
ভার্সিটির বাস ধরতে হয় আমাকে খুব সকালে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটেই রিকসা। তারপর বাস। হাঁটা…..
আজকের সন্ধ্যাটা থমকে যাওয়া মেঘেদের। ঝিরিঝির বৃষ্টি ছিল দিনভর। ঢাকা শহরের পথঘাট জল কাদায় মাখামাখি।…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..