অচিন্ত্য ঘুমিয়ে পড়েছে

এইচ বি রিতা
ছোটগল্প
Bengali
অচিন্ত্য ঘুমিয়ে পড়েছে

বিছানায় শুয়ে মৃদু হাসি মুখে অচিন্ত্য তাকিয়ে আছে সিলিং ফ্যানটির দিকে। শব্দমুক্ত লাইট কিট সহ সিলিং ফ্যানটি গত বছর কিনেছিল অচিন্ত্য, ওয়েফেয়ার থেকে মাত্র ৯০ ডলারে।
সাদা ক্রিস্টল ফ্যানটি দিয়ে একসাথে বাতাস,আলো দুটোর কাজই চালিয়ে নেয়া যায়। আবার আলো না জ্বালিয়ে ফ্যানের কাজও চলে, ফ্যান বন্ধ রেখে আলোও জ্বলে।

সিলিং ফ্যানটা কেনার পর সেঁজুতি খুব বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘এটার কোন দরকার আছে কি?’

কোথায় যে কীসের দরকার হয় অচিন্ত্যের, তা কখনো সেঁজুতি পরখ করে দেখেনি। নখ কেটে দেয়া, চুল ঠিক করে দেয়া, গমের রুটি করে খাওয়ানো সবই তো করছে। সংসারটা বলা যায় সে-ই ধরে রেখেছে। অভিযোগের কোন সুযোগ নেই। বরং অচিন্ত্যকে নিয়ে সেঁজুতির অভিযোগের পাল্লা বেশ ভারী। তবে দুইজনের মাঝে সমঝোতাও বেশ। একই ছাদের নিচে অথচ দুই মেরুর দুই বাসিন্দা যেন। একজন যখন জানালার পাশে বসে কফিতে চুমুক দেন, অন্যজন তখন উদাসী মনে এলোমেলো। মাঝখানে শুধু কাঠের দেয়ালই নয়, ইট পাথরে তৈরি এক বিশাল উঁচু পিলার টপকিয়ে মনে হয় যেনো মুক্তির অপেক্ষায় থাকে দু’জন। পাখির ডানা আছে বলেই তো উড়তে পারে। মানুষের সেই ডানা নেই, তাই পোষা পাখির মতোই মানুষ সংসারের দায়বদ্ধতায় আটকে থাকে।

অচিন্ত্য খুব আবেগী, অভিমানীও বটে। অচিন্ত্যের কল্পনায় প্রায়শই আসে এক রাজকন্যা। সেই রাজকন্যার নাম রেখেছে সে -রিয়া। রিয়াকে নিয়ে তার যতসব আবেগ উথলে পড়ে একাকি সময়ে। কখনো রিয়া তার ঝাঁকড়া এলোমেলো চুল টেনে দেয়। কখনো তার হাসিতে মুগ্ধ হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ে থাকে। মাঝেমাঝে জানতে চায়, তোমার হাসি এতো সুন্দর কেন অচিন্ত্য? অচিন্ত্য তখনো হাসে।
রিযা আবারো জানতে চায়,অচিন্ত্য খেয়েছে কিনা, ঘুমালো কিনা। রিয়ার সাথে অচিন্ত্যের সময়টুকু খুব সুন্দর কাটে। আহ্লাদী অচিন্ত্য কখনো বায়না ধরে একটি আওয়াজের। রিয়াও যেন উদগ্রীব হয়ে থাকে আওয়াজ দিতে, কখনো নিতে। একটি আওয়াজ, মধুর, পবিত্র, আত্মার বন্ধনে দু’জনকে সুখের সাগরে ভাসিয়ে দেয় বিষণ্ণ সময়ে। অচিন্ত্যের যত শোক-তাপ, সবটাই ভাগাভাগি করে তার সাথে। কল্পনার মানুষটিকে আজকাল অচিন্ত্যের কাছে সত্যি বলে মনে হয়। মনে হয় যেন সত্যিই কেউ আছে তার পাশে যে অচিন্ত্যের সকল লুকানো ক্ষোভ কষ্টগুলো খুঁটে খুঁটে বের করার চেষ্টা করে। অচিন্ত্যও গড়গড় করে বলে যায় কত কথা।

আজকাল অচিন্ত্যের ভীষণ ভয় হয় রিয়াকে হারিয়ে ফেলার। রিয়ার সাথে যেন তার চিরকালের একটা শিকড় গাড়ার চুক্তি। দিনের সকল ব্যস্ততার মাঝেও অচিন্ত্য একা কিছুটা সময় বের করে নেয়। সে সময়ট কেবল রিয়ার জন্য। রিয়ার সাথে খুঁটিনাটি আলাপনের জন্য।
তবু বাস্তবে ফিরে আসতে হয় অচিন্ত্যকে। দায়িত্ব, সংসার সবকিছুতেই নিজের ভূমিকা রাখতে হয়। কল্পজগতের রিয়া তাকে সুখ দেয়, স্বস্তি দেয়। এ-ও বা কম কি।

মন-এক অদ্ভুত অদৃশ্য কিছু যা স্পর্শের বাইরে হলেও ভাীষণভাবে উপলব্ধিযোগ্য। মৃত্যুর পরেও জীবনের ধারণাটি অনেকের কাছে স্বজ্ঞাতভাবে উপলব্ধিযোগ্য, কারণ মানুষের মানসিক জীবনটি তাদের দেহ থেকে আলাদা বলে মনে হলেও, মানুষের দেহগুলি পচে যাওয়ার পরও মানুষ আত্মার কল্পনা করতে পারে। সেই আত্মার সম্পর্কই দিন দিন পোক্ত হয় অচিন্ত্যের-রিয়ার সাথে।
অচিন্ত্য ভাবে, হলেই বা ক্ষতি কী! এই যে আত্মার বন্ধু রিয়া – রোমান্টিক এবং প্ল্যাটোনিক উভয়ই, সেটাও তো তাকে প্রিয়, সুরক্ষিত এবং সম্পূর্ণরূপে বোঝার অনুভূতি দিচ্ছে। এ সম্পর্ক শুধুমাত্র একটি রোমান্টিক আত্মার সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত নয়, এটা আবেগ এবং রসায়নের সত্যিকার অর্থও রাখে। সম্পর্ক সবসময় সহজ হয় না, মানুষ একসাথে উত্থান-পতনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সেই অভিজ্ঞতাও জীবনের অংশ, অস্বীকার করার উপায় নেই।

“তোমার ঔষধ নেয়া হয়নি অচিন্ত্য।”
সিলিং ফ্যান থেকে চোখ নামায় অচিন্ত্য। সেঁজুতি দাঁড়িয়ে আছে অষুধ হাতে। দায়িত্বের সবটুকুর ছাপই রয়েছে সেঁজুতির চোখে মুখে। তবু কোথায় যেন বিচ্ছিন্নতা, ঠিক বুঝেও বুঝে উঠতে পারেনা অচিন্ত্য।
“ওহ হ্যাঁ। ভুলেই গিয়েছিলাম।”
“এ তো নতুন নয়।”

বলেই সেঁজুতি পানির গ্লাসের সাথে অষুধগুলো এগিয়ে দেয়। অচিন্ত্য বাধ্য ছেলের মতো মুখে দিয়ে ঢোক গিলে নেয়। তারপর তাকিয়ে থাকে সেঁজুতির দিকে। সেই বিশ বছর আগের চোখের ভাষা আজ তার পড়তে কষ্ট হয়। একই মানুষ, একই ঘরে বসবাস, একইভাবে সব চালিয়ে নেয়া, তবু একে অন্যকে আজ চিনতে কষ্ট হয়।

“তুমি খেয়েছো সেঁজুতি?”
“নাহ! আজ শরীরটা ভালো লাগছে না। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।”
“কেন কী হয়েছে?”
“তেমন কিছু না। এমনি।”
“ওহ। আচ্ছা।”

সেঁজুতি কক্ষের বাতিটা নিভিয়ে দেয়। তারপর নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়ায়।
“শোন সেঁজুতি।” অচিন্ত্য ডাকে।
“কী?” সেঁজুতি ঘুরে তাকায়।
“নাহ! কিছু না। যাও, তুমিও রেস্ট নাও।”

সেঁজুতি চলে যায় কিছু না বলে। অচিন্ত্য কিছু একটা বলতে চেয়েছিল তাকে। কী সেটা? না খেয়ে ঘুমাতে যাবে সেঁজুতি, বলল শরীরটাও ভালো লাগছে না। খারাপ লাগছিল কী সেঁজুতির জন্য? তবে সেটা কেন জানান দিলো না অচিন্ত্য? অভিমান না অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ? ঠিক বুঝতে পারে না অচিন্ত্য।

(২)
রাত ১২টা প্রায়। অচিন্ত্য একবার সেঁজুতির কক্ষে উঁকি দেয়। নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে সেঁজুতি। গায়ের কাঁথাটা বুক বরাবর। সেটা গলা পর্যন্ত টেনে দেয় অচিন্ত্য। ভীষণ মায়াবী চেহারা তার। এই মায়াময় চেহারার জন্যই একদিন তার প্রেমে পড়েছিল অচিন্ত্য। তখন শহর জুড়ে অটামের ঝরে পড়া রঙিন পাতাদের কলরব। কাজ শেষে বাড়ি ফিরার আগে পাশের পার্কের বেঞ্চে বসেছিল অচিন্ত্য। এমন সময় এক বাদামি গায়ের তরুণী দৌড়ে এসে তার কাছে জানতে চায়, পঞ্চাশ ডলারের ভাঙতি আছে কিনা। অচিন্ত্য কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এমন মিষ্টি মায়বী চেহারা খুব কম নজরে পড়েছে তার। তারপর কিছু বলার আগেই তরুণীটি বললো, আচ্ছা লাগবে না।
“কেন লাগবে না? এই যে ভাঙতি চাইলেন মাত্র?”
“হ্যাঁ চেয়েছি। কিন্তু আপনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আপনার পকেট খালি।”
অচিন্ত্য অবাক হলো। মেয়েটি কী করে জানলো তার পকেট খালি? আসলেই তো তার পকেটে আজ কোন ক্যাশ নেই।

সেই থেকেই অচিন্ত্য রোজ কাজ শেষে পার্কের বেঞ্চে বসে থাকতো। মেয়েটিও আসতো রোজ ছোট ভাইটিকে নিয়ে খেলতে। দেখা হতো, চোখে চোখে কথা হতো। তারপর ভালোলাগা, ভালোবাসা। এক সময় প্রেমের বসন্ত ফুটে উঠলো দু’জনের মনে। আর সেই মেয়েটির সাথে আজ ২০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে, সেঁজুতি নাম তার।

অচিন্ত্য নিজ কক্ষে ফিরে যায়। বিছানায় গা এলাতেই রিয়ার কথা মনে পড়ে। মনের দরজা খুলে রাখে অচিন্ত্য রিয়ার জন্য। কখন রিয়া আসবে, তারপর পাশে বসে চুলগুলো টেনে দিবে। কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে গল্প শোনাবে। গল্প শুনতে শুনতে অচিন্ত্য ঘুমিয়ে পড়বে।
আজ অচিন্ত্যের খুব ঘুম পাচ্ছে। সাথে মাথাটাও ঘুরছে। অদ্ভুত এক অস্বস্তি। আজ রিয়াকে বলবে, চুল টেনো না, মাথায় একটু হাত বুলিযে দাও রিয়া। রিয়া মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে দুস্টুমি করবে। অচিন্ত্য সেই দুষ্টুমির সুখটুকু আরো বাড়িয়ে দিবে। মুখের উপর মুখের ছায়া পড়বে। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে সংঘাত হবে।
অচিন্ত্যর অস্বস্তি বাড়ছে। ঘুম পাচ্ছে খুব। আজ কী হলো! রিযা না আসতেই ঘুম চলে আসছে কেন চোখের পাতায়!

(৩)
ঘুম ভোরে ঘুম ভাঙে সেঁজুতির। এটা তার বহু বছরের অভ্যাস। এমনকি ছুটির দিনেও সে ভোরে জেগে উঠে। উঠেই বারান্দায় রাখা গাছের টবগুলোতে পানি ঢালে। সেঁজুতির সংগ্রহে আছে স্নেইক প্ল্যান্ট, স্পাইডার প্ল্যান্ট, এলোভেরা, পিচ লিলি, স্ট্রিং হার্ট, মনস্টেরা ডেলিসিওসা। সাওদার্ন মেক্সিকোর
গ্রীষ্মমন্ডলীয় বনাঞ্চলের মনস্টেরা ডেলিসিওসা-সেঁজুতির সবচেয়ে পছন্দের একটি প্ল্যান্ট। বিশেষ করে চকচকে, পিনেটের, হৃদয় আকৃতির পাতাগুলো তার মন কাড়ে। এই পাতাগুলো অচিন্ত্যর ও খুব পছন্দ। সে-ই পছন্দ করে কিনে এনেছিল সেঁজুতির জন্য এক জন্মদিনে। এই একদিকে দু’জনের পছন্দের খুব মিল। যদিও যত্নের ব্যাপারে সেঁজুতিই সব করে। তবে তার সব পছন্দের গাছগুলো অচিন্ত্যই কিনে দেয়।

গাছেদের যত্নের পর সেঁজুতি নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত হয়। কখনো টোস্ট ব্রেড, কখনো ক্রুসান। সাথে কলা আর কফি। সহজ নাস্তাতেই শুরু হয় তাদের দিন। তারপর দুইজনে মিলে একই সাথে অফিস যায়। যেতে যেতে গাড়িতেই নাস্তা সেরে নেয়। আবারো একই সাথে বাড়ি ফিরে দুইজন। কাজ করছে তারা একই ব্যংকে, শহর ছেড়ে ৪০ মিনিটের পথ।

রোজকার মতো আজও সেঁজুতি নাস্তা তৈরি করছে। এদিকে ৭টা বেজে গেছে। অচিন্ত্য এখনো বিছানা ছেড়ে উঠেনি। কিচেন থেকে বার বার ডেকেও সাড়া পাচ্ছে না। এদিকে সেঁজুতি কাপড় পড়ে অফিসের জন্য তৈরি।

কিছুটা বিরক্তি নিয়েই সেঁজুতি এগোয় অচিন্ত্যের কক্ষে। অচিন্ত্য শুয়ে আছে কাৎ হয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে। সেঁজুতি কিছুটা উচ্চকণ্ঠেই ডাকলো, অচিন্ত্য! এই অচিন্ত্য! তুমি এখনো উঠোনি, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!

অচিন্ত্য সাড়া দিচ্ছে না। নড়ছেও না।

সেঁজুতি এবার গা’য়ে ধাক্কা দেয। অচিন্ত্য মুখ উপুড় হয়ে পড়ে যায়। সেঁজুতি আঁতকে উঠে। ধপ করে বিছানায় বসে গা’য়ে হাত দিতেই টের পায়, তার সারা গা ঠাণ্ডা নিস্তেজ। মুখের বাম পাশের মাংস পেশি কালচে রঙা হয়ে কিঞ্চিৎ ঝুলে আছে।

সেঁজুতি চিৎকার করে ডাকতে থাকে, অচিন্ত্য! এই অচিন্ত্য! কথা বলো! কথা বলো অচিন্ত্য! সেঁজুতি তার সারা শরীর ঝাঁকি দিতে থাকে।

অচিন্ত্য কথা বলে না। অচিন্ত্য ঘুমিয়ে পড়েছে।

এইচ বি রিতা। কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক। জন্ম বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায়। বর্তমান নিবাস কুইন্স, নিউইয়র্ক। তিনি নিউইয়র্ক সিটি পাবলিক স্কুল শিক্ষকতায় জড়িত রয়েছেন দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে। পাশাপাশি কাজ করছেন দৈনিক প্রথম আলোর উত্তর আমেরিকা ভার্সনে। এছাড়াও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ