অচেনা মন

শুক্লা মালাকার
গল্প
অচেনা মন

বেলুনের স্তুপ নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে ইমন। আজ ওর মেয়ে রাশি পাঁচ বছর কমপ্লিট করল। বাড়িতে পার্টি রেখেছে। প্রচুর চাপ। রাহুল পার্টির হুজুগ তুলে দিয়ে দিব্যি নাচতে নাচতে গত পরশু অফিস ট্যুরে ইম্ফল চলে গেছে। সব ঝক্কি সামলাতে হচ্ছে ইমনকেই। কাল থেকে অফিস ছুটি নিয়েছে।

–   বৌদি!

–   বলে ফেল কী বক্তব্য তোমার! বাড়ি যাবে তো? দেখছ কত কাজ!

–   যা যা বলেছিলে সব হয়ে গেছে তো।

–   খুব ভালো কথা। এবার তাহলে রাশির ঘরে গিয়ে বেলুনগুলো লাগিয়ে ফেল। একসঙ্গে তিনটে করে বেঁধে সারা ঘরে টাঙিয়ে দাও।

বেজার মুখে বেলুন নিয়ে রেখা চলে গেল। খুব ভালোমেয়ে রেখা। প্রায় চার বছর কাজ করছে। প্রথম দিকে খুবই অপরিষ্কার ছিল। বলে বলে ইমন ওকে হাইজেনিক করে ফেলেছে।  ও যখন এসেছিল, রাশি বছরখানেক, সারাদিন ওর কাছে রেখে যেতে হতো। বাধ্য হয়েই  পরিচ্ছন্নতার জ্ঞান দিতে হয়েছে। মাথা পরিষ্কার, খুব চটপট সব কিছু শিখে নিয়েছে। না হলে রোজ রোজ লোক খুঁজতে হতো। কলকাত্তাইয়ান বিহারি পরিবারের মেয়ে রেখা। দেখতে সুন্দর। ঠিকঠাক ভাবে থাকলে বস্তিবাসী বলে মনে হবে না। লেখাপড়া করেছে ফাইভ অব্দি। রাশির সঙ্গে বসে ইংরেজি অক্ষর শিখছে। ইমনই বলেছে শিখতে, পরে কাজে লাগবে। সবই ভালো মেয়েটার, কিন্তু বড্ড তরল। কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে। সারাক্ষণ কেবল  বকবক আর বকবক। কি আর করা, এটুকু সহ্য করতেই হয়।

–   বৌদি বেলুন লাগালো হয়ে গেছে। এবার যাই আমি?

–   কেন বাপু, অত তাড়া কিসের?

–   বা রে! না গেলে রেডি হয়ে আসব কী করে? সাড়ে চারটে তো বাজে প্রায়। তুমি যে  বললে লোকজন সব ছটার মধ্যে এসে যাবে।

–   কী মেয়ে রে তুই! জন্মদিন তোর না রাশির! আচ্ছা যা, তাড়াতাড়ি চলে আসবি। এসে  রাশিকে তুলে খাইয়ে দিস। একটু পরে হোটেল থেকে খাবার আসবে, সেগুলো সব টেবিলে সাজাতে হবে মনে থাকে যেন। চটপট যা। আর শোন! একটু ফিটফাট হয়ে আসিস, না  হলে সব নাক কুঁচকোবে। আমার কাছে থাকিস আমার প্রেস্টিজটা রাখিস।

পৌনে ছটা নাগাদ রাহুল এলো।

–   সব রেডি? সরি লেট হয়ে গেল। কি করব বল, ফ্লাইট লেট ছিল। এদিকের কি খবর?

–   সব হয়ে গেছে দাদা। তুমি কিছু চিন্তা কোরো না। এই দেখ কেকও সাজানো হয়ে গেছে। রাশিমনিও রেডি। আর আমাকে দেখ! একদম ফিটফাট, না?

রাহুল প্যাটপ্যাট করে রেখার দিকে তাকিয়ে আছে।

–   তুই থাম! যা রাশির কাছে যা। তুমিও যেমন রাহুল! ওর কথা গিলছ।

–   দারুন ব্রাইট লাগছে তো রেখাকে! তারিফের গলায় বলে ফেলল রাহুল।

–   সেই দেরি করলে তো? আর বকবক কোরো না। হারি আপ! এখুনি সবাই এসে পড়বে।

চরম অস্বছন্দ একটা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে চাইছে ইমন। রেখাকে ফিটফাট আসতে বলেছিল নিজেই। কিন্তু ও সেজেগুজে আসাতে এত সুন্দর লাগছে যে ইমন বিপন্ন বোধ করছে। রাহুল চলে গেলে অজান্তেই এক চিলতে ঈর্ষাতাপ মনকে এফোঁড় ওফোঁড় করে গেল।

লোকজন হই হট্টোগোল সব কিছুর মাঝেও ইমন টের পাচ্ছিল ওর একটা মন রেখার আশেপাশে ঘুরছে। লোকজনের কৌতূহল এমনিতেই বেশি। গসিপ খুঁজে খুঁজে বের করে। রেখার রূপ  আজকের বিষয়। রেখাটাও আজ বড় বেশি চমকাচ্ছে। খামোকা কেন যে ওকে গ্রুম করতে গেল! আজ ও যা কিছু পড়েছে, সব কিছুই বিভিন্ন সময়ে ইমনেরই দেওয়া। কাজটা ভালো করে   তাই নিজের মতো গড়পিটে নিতে চেয়ে এ কী বিপদ ডেকে এনেছে! চার্টাড ফার্মের চাকরি করা  উচ্চশিক্ষিত হায়ার মিডল ক্লাস আজ নিতান্ত এক বস্তিবাসী মেয়ের কাছে হেরে যাচ্ছে! পুরোটা সময় ধরে অচিন কুঠুরীতে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে পড়ছে অশান্তি।

সবাই চলে গেলে ঘুমন্ত রাশিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ইমন রেখার কাছে এলো। ও পার্টির লেফটওভার গুছিয়ে তুলছে।

–   কী করছিস? মাংসটা অভেনে গরম করছিস কেন? গ্যাসে কর। আর বাটি ছিল না?  এতে ধরবে সব রাইস? এতদিনেও কিছু শিখলি না।

অহেতুক বকাবকি করছে বুঝতে পারছে ইমন, কিন্তু কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না।

–   খামোকা ওকে নিয়ে পরেছ কেন আজ? কুল ডাউন ইমন। বুঝতে পারছি একা একা সবটা করেছ, বেশি চাপ হয়ে গেছে।

কিছু একটা হয়েছে বুঝে রাহুল পরিস্থিতি সামলানোর  চেস্টা করল।

–   হ্যাঁ দাদা দেখ না, শুধু শুধু রাগ করছে বৌদি। তখনও সবার সামনে এমনি এমনি বকল। টিস্যু দিয়ে রাশির মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিলাম, বৌদি ভেবেছে পেপারটা নোংরা। আচ্ছা বল, রাশিকে নোংরা পেপার দিয়ে মুখ পোঁছাব আমি?

–   চুপ কর! বেশি কথা বলিস না। কত পরিষ্কার তুমি, জানা আছে। এতদিন ধরে বলে  বলে হাইজিনটাও পুরো শেখাতে পারলাম না। আর রাশি রাশি করছিস কেন? বেবী বল!  বড্ড সাহস হয়েছে। আদর দিয়ে মাথায় তুলেছি। গলার পর্দা আরো একটু চড়ল। কিছু শেখ না শেখ সাজগোজটা ঠিক শিখেছ। কী করে বাবুদের চোখে পড়তে হয় সেটা তো আমি শেখাই নি রে!

–   কী আজেবাজে বলছ? রাহুল জোর করে থামাল।

হোঁচট খেল ইমন। ওর নিজের ভেতর এমন নোংরা থাকতে পারে, জানা ছিল না। রাহুলের  সামনে ছোট হয়ে যেতে হলো ভেবে শরীরে বিশ্রি জ্বালাপোড়া। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল রেখার  ওপর।

–   কাল থেকে তোকে আর আসতে হবে না। এ মাসের এখনো এগার দিন বাকি, তবুও গোটা মাসের মাইনে দিয়ে দিচ্ছি। আর আসিস না।

দু’হাতে জড়ো করা কাগজের টুকরো নিয়ে রেখা কেঁদে ফেলল।

–   কি করেছি বৌদি? তুমি যেভাবে বল সব কাজ সেভাবেই তো করি গো! রাশি, না না বেবীকে এক বছর থেকে বড় করেছি। বড্ড মায়া পরে গেছে। ওকে না দেখে থাকব কি  করে? ওকে কে দেখবে? আমার হাতে ছাড়া খেতে চায় না তো!

–   তোমাকে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার মেয়ের ব্যাপারে তুমি কবে থেকে ভাবতে লেগেছ?

–   আমার ভাইদুটোকে ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়েছি বৌদি। আমি না এলে যে ওদের পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। তুমিই তো বল, সবাইকে পড়াশোনা করতে হয়।

রেখার কান্না দেখে একটু নরম হলো ইমন। বাক্যের চোরা ঝাঁঝ কিন্তু কমলো না।

–   ভালো স্কুলে পড়িয়ে ভাইদের কি বাবু বানাবি নাকি? তোদের এই দোষ, একটু লাই  পেলেই মাথায় উঠে যাস।

ঘরে এসে আলমারি খুলে টাকা বের করতে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে চোখ গেল ইমনের। বিম্বিত নিজেকে দেখে করুণা হলো। কেন যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল আজ! কোনো কালেই  রূপসী ছিল না সে। আলগা একটা লালিত্য আর মেধার বিচ্ছুরণে ইমন বরাবরই স্মার্ট। একটা বাচ্চা মেয়ে, যার জন্ম পারিপার্শ্বিকতা পরিবার পরিবেশ শিক্ষা কিছুই নেই, শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত ওই রূপটুকু দিয়ে চোয়াড়ে মার্কা নিষ্ঠুর এক ইমনকে টেনে বের করে আনল?

শুক্লা মালাকার। লেখক। নিবাসঃ কলকাতা, বাংলা। ২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন ওয়েবব্জিন এবং পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..