অতসী

মৃদুল শ্রীমানী
ছোটগল্প
Bengali
অতসী

অতসীকে আমরা কজন অসতী বলতাম কেননা ও মাধ‍্যমিক পরীক্ষায় আমাদের সকলের চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। আমাদের কোএডুকেশন স্কুল ছিল। পড়াশোনা করতে চাওয়া মেয়েরা বেশিরভাগ ছিল রোগাটে ও দুর্বল গড়নের। তারা বিশ্বাস করত যে ছেলেদের বুদ্ধিশুদ্ধি মেয়েদের থেকে বেশি। একমাত্র অতসী ছিল অন‍্য রকম। একরোখা আর একগুঁয়ে। আমরা স্কুলে পড়ার পরেও কোচিং ক্লাশে পড়তে যেতাম। বাড়িতে আসত হরলিক্স, বোর্ণভিটা আর ব্রেনোলিয়া। অতসীর বাবা ছিল দক্ষ আলুচাষি। আলুর পাশাপাশি সে লোকটা বাড়ির লাগোয়া বাগানে তাক লাগানো সাইজের ফুলকপি বাঁধাকপি ওল মুলো ফলাতো, আর জেলার উদ‍্যান মেলায় সবজি চাষ বিভাগে সেরা পুরস্কার ছিনিয়ে নিত। ফুলের বিভাগে যারা প্রাইজ পেত, কানাঘুষোয় শুনেছি, তারাও অতসীর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করত।
আমরা কালচার বলতে বাবু কালচার বুঝতাম, এগ্রিকালচার বুঝতাম না। চাষ জিনিসটা আসলে ছোটলোকের কাজ, আর চাষা মানে নির্বোধ মূর্খ ব‍্যক্তি, এটা আমরা যেমনটি বুঝতাম, আমাদের ক্লাসের মাস্টারের দলও তাই বুঝতেন। তাই স্কুলে অতসী সর্বদা আমাদের চাইতে নম্বর কম পেত। মাস্টার মশায়রা তার খাতায় ইচ্ছে করে নম্বর কমিয়ে রাখতেন। এটা আমরা জানতাম। কিন্তু মুশকিল হল অতসীও এটা জানত। তাই সে খোলাখুলিভাবে চ‍্যালেঞ্জ দিয়েছিল, জীবনের সব পরীক্ষা এই ইশকুলের চার দেওয়ালের মধ‍্যে হবে না খোকাবাবুরা।
আমরা তার “খোকাবাবু” শব্দটার ব‍্যবহারে ভীষণ রাগ করলাম। টেস্ট পরীক্ষায় সে আমাদের চাইতে নম্বর কম পেলেও, মাস্টারের দল আমাদের সতর্ক করলেন, ও মেয়ে কিন্তু তোদের হারিয়ে দেবে। একটা মেয়ে হয়ে ও মনে হচ্ছে তোদের সবাইকেই টপকে যাবে। আমরা সাংঘাতিক ভাবে ভয় পেয়ে গেলাম। একটা মেয়ে, শুধু তাই নয়, সে আবার আমাদের মতো ডাক্তার বা উকিলের বাচ্চা নয়, চাষির ঘরের ছুঁড়ি, সে যদি বোর্ডের পরীক্ষায় কাত করে দেয়, তাহলে পোড়ামুখ দেখাব কি করে!
আমাদের সাথেই ভয় পেয়ে গেলেন আমাদের অভিভাবকেরা। সকালে বিকেলে মুঠো খানেক কাজুবাদাম ও কিশমিশ বরাদ্দ হল। মায়েরা হরলিক্স গুলে পড়ার টেবিলে পৌঁছে দিয়ে যেতেন ঘণ্টায় ঘণ্টায়। জ‍্যেঠিমারা সরস্বতী ও গঙ্গাস্তবের উপরে আবার হনুমান চল্লিশা পড়তে শুরু করলেন। জ‍্যেঠুর দল খোঁজ খবর শুরু করলেন গ‍্যারান্টিযুক্ত ও বিফলে মূল‍্যফেরত সর্বসিদ্ধিদাত্রী ও মনস্কামনাপূরণ কবচ কোথায় মিলবে। বাবারা পড়ার ঘরের বাইরে টহল দিতেন। আমরা পড়ার টেবিলে বসে কেবলই অতসীকে গালি দিতাম, বলতাম, অসতী, অসতী, অসতী, তোর মুখে তিন লাথি।
আমাদের সকলের সকল প্রচেষ্টাকে দুয়ো দিয়ে অতসী গোটা জেলায় র‍্যাঙ্ক করল। তখনকার দিনে ছাপানো গেজেট প্রকাশ হত। বাবা কাকা জ‍্যেঠারা অতসীর রোল নম্বর নোট করে রেখেছিলেন। সবাই মিলে বার বার করে রোল নম্বর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন অতসী আমাদের সব কজন পরীক্ষার্থীকে অনেকটাই ছাড়িয়ে গিয়েছে। বাবা কাকার মুখ থমথম করছিল। নীরবতা প্রথম ভাঙলেন জ‍্যেঠামশায়। একটা মেয়েমানুষের কাছে তোদের সব কটার নাক কাটা গেল, ছি ছি তোদের জ‍ন‍্য দেখছি আমায় থুতু ফেলে ডুবে মরতে হবে! মা ঘোমটার আড়ালে থেকে বললেন, সে মেয়ে ভাল করে পড়েছে তাই ভাল নম্বর পেয়েছে। মেয়ে বলে কি ভাল রেজাল্ট হতে পারে না? আমাদের ব্রাহ্মণ বাড়িতে ভাশুরের মুখে মুখে ভাদ্দর বৌ কথা বলবে এটা অভাবনীয় ছিল। মায়ের জবাব শুনে জ‍্যেঠামশায় হতবাক, বাবা নিরতিশয় লজ্জিত। শুধু কাকামণি মাকে ধমকে উঠে বললেন, তুমি মেয়েমানুষ হয়ে পুরুষদের মধ‍্যে কথা বলতে এসেছ কেন?
আমি মাধ্যমিক পাশ করে গিয়েছি বলেই আমার সদ‍্য সদ‍্য পুরুষ শ্রেণীতে প্রমোশন হয়েছে। মা টের পেয়ে গেলেন তাঁর কোলের ছেলে বড় হয়ে গেছে। এখন থেকে সে পুরুষালি ভঙ্গিতেই কথা বলবে।
আমাদের স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম চালু ছিল। আমাদের উদ্বেগ ছিল যে বেশি নম্বর পাওয়া অতসী ক্লাসে এসে বসলে আমরা মুখ লুকোবো কেমন করে!
সে সমস্যার সমাধান করে দিলেন মাস্টারেরা। তাঁরা কোনো কায়দা করে অতসীর বাবাকে বোঝালেন, ছেলেদের সঙ্গে একসাথে পড়াশুনা করতে থাকলে মেয়েদের পাঠে মনঃসংযোগ করতে বিঘ্ন হয়, কেননা, ষোলোর পর মেয়েদের নারীত্ব পুরুষদের তুলনায় দ্রুত গতিতে বিকশিত হতে থাকে।
অতসীর ছোটো ছোটো দুটি ভাই ছিল। তার বাবা মা তাদেরকে শিক্ষিত করে তুলতে বেশি উৎসাহিত ছিলেন। বাবা মা অতসীকে সোজাসুজি বলে দিলেন আর পড়াশুনা করে লাভ নেই। সেই তো পরের বাড়ি যেতেই হবে। বস্তুত পরের সংসারের ভাবী গৃহবধূকে লেখাপড়া করানোর জন্য অর্থবরাদ্দ করা তাঁদের চোখে নিতান্তই বোকামি বলে প্রতিভাত হয়েছিল।
অতসী অন‍্য কোনো স্কুলের কোনো প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের উৎসাহে অনেক দূরের একটি স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে ভরতি হলে, আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
আমাদের আরো সুখশান্তির ব‍্যবস্থা করে দিলেন স্বয়ং ঈশ্বর। আমরা জানতাম ভাল করে পড়াশুনা করলে একটা শক্তি উৎপাদিত হয়। কিন্তু জ‍্যেঠামশায়ের কাছে জানা গেল সে শক্তি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের অতীত হয়ে লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাবে কাজ করে না। সে শক্তি পুরুষের অনুকূল হিসেবে কাজ করে, আর মেয়েদের প্রতিকূল হয়ে ওঠে। পড়াশুনা করতে থাকা মেয়েদের সম্পর্কিত পুরুষের শরীরের বিরুদ্ধে সে শক্তি কাজ করে। সেই মেয়েরা বিবাহিত হলে, সেই শক্তির বিরুদ্ধ প্রভাবে তার স্বামী মরে। বিবাহিত না হলে, তার অভিভাবক বাবা বা দাদা মরে। পাশ্চাত্য বিজ্ঞানসন্দর্ভে এহেন উপপাদ‍্যের কিছুমাত্র সমর্থন না থাকলেও, প্রাচ‍্যের পুণ‍্যভূমিতে এই উপপাদ‍্যের সমর্থনে দাঁড়িয়ে গেলেন বিধাতাপুরুষ স্বয়ং। আলুচাষি হিসেবে অতসীর বাবা যে বড়ো মাপের ঋণ নিয়েছেন, তা তিনি বাড়িতে জানান নি। আর সেই কর্জ পেতে তিনি বাড়ির দলিল বন্ধক দিয়েছিলেন। চাষি পরিবারের লোকজন হামেশাই চাষের জন্য ঋণ নিয়ে থাকে। আর আমাদের দেশের চাষ সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। অনেক ছোটো ছোটো রায়তের জমি ব‍্যবস্থা নিয়ে অতসীর বাবা আলুচাষ করে মস্ত দাঁও মারবে ভেবেছিল। বিধাতাপুরুষ অতসীর শিক্ষানুরাগে প্রবল রুষ্ট হয়ে ঝড় ও শিলাবৃষ্টি পাঠিয়ে বিস্তীর্ণ চাষের ক্ষেত নয়ছয় করে দিলেন।
এই বিপদের উপরে ব‍্যাঙ্কের তরফে ঋণশোধের জন‍্য তাগাদার উপর তাগাদায় অতসীর বাবা গলায় দড়ি দিয়ে জুড়োলেন।
মেয়েরা লেখাপড়া করলে তার নিকট সম্পর্কের পুরুষের যে ঠিক কি হয়, সে ব‍্যাপারে জ‍্যঠামশায়দের শাস্ত্রবাণী ঠিক ঠিক ফলে গেল দেখে আমরা দারুণ পুলকিত হলাম। এরপর অতসীর জ্ঞাতিদের পরামর্শে তার মা জোর জবরদস্তি করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। অতসীর মাকে তার কাকা জ‍্যেঠারা বোঝাতে পেরেছিলেন টানাটানির সংসারে একটা পেট কমলেও সেটা একটা সাশ্রয়ই বটে। মেয়ে মানে যে স্রেফ একটা বোঝা, তা অতসীর মা জানতেন। শুনেছি মেয়ের প্রচণ্ড আপত্তি সত্ত্বেও মারধোর করে তিনি মেয়েটাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেন। না, বিয়ের সময় কোনো পণ দিতে হয় নি। রুগ্ন, দরিদ্র পরিবারের বয়স্ক মানুষটির যে বিয়ে হচ্ছে, এতেই বরের আত্মীয় স্বজন খুশি হয়েছিল। বিয়ের পর অতসী যে কোথায় হারিয়ে গেল কেউ টের পাই নি।
ইতিমধ্যে আমি চোখের ডাক্তার হয়েছি। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ উকিল, আবার কেউ সরকারি দলের কর্মকর্তা। মধ‍্যে মধ‍্যে আমরা নিজেদের মধ্যে বসি। আমাদের পরস্পরের মধ‍্যে যথেষ্ট সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। আমরা দেশের পরিস্থিতি, চীনের বিপদ, পাকিস্তানের শয়তানি, বাঙালির উপর সকলের হিংসা, রসগোল্লা ও নিমের পেটেন্ট ইত‍্যাদি নিয়ে গল্প করতে থাকি। তার পর আমরা রাজ‍্যে মুসলমানদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে খেদ প্রকাশ করি। তারপর আমরা আজকাল মেয়েরা কিভাবে প্রদর্শনবাদে অভ‍্যস্ত হয়ে পড়েছেন, সে নিয়ে সারগর্ভ আলোচনা করি। আমাদের আলোচনা প্রায় প্রতিবার গিয়ে ঠেকে যায় অতসীতে। অতসীর কি হল, আধবুড়ো রুগ্ন স্বামী নিয়ে তার কি হাল, সেই নিয়ে আমরা গবেষণা করি। কিন্তু তা গবেষণার আক্ষরিক অর্থেই রয়ে যায়।
অতসীর খোঁজ মিলল একদিন। সেবারও মাধ‍্যমিকে আমাদের এলাকার একটি ছেলে অত্যন্ত ভাল ফল করেছে। আমাদের ব্লকের বিডিও নিজে আমায় ফোনে অনুরোধ করলেন ছাত্রটিকে সরকারি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত হতে হবে। শুনলাম প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন আমাদের ব‍্যাচের সেই বন্ধুটি, যিনি সরকারি কর্মকর্তা। আগামী দিনে যাঁর মন্ত্রী হবার সম্ভাবনা প্রবল। বিডিও ভদ্রতা করে বললেন, আমায় নিয়ে যেতে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। আমিও বিনয় দেখিয়ে বললাম, এইসব অনুষ্ঠানে যাওয়া আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা। আমার তো গাড়ি আছে। আপনি চিন্তা করবেন না।
যথাসময়ে অনুষ্ঠান কক্ষে গিয়ে পৌঁছনোর পর দেখলাম এলাকার বিশিষ্টজনেরা অনেকেই এসে গিয়েছেন। কেবল আমার যে বন্ধুটি সরকারি দলের কর্মকর্তা, তিনি তখনও হাজির হননি বলে
অনুষ্ঠান শুরু হতে পারছে না। বিডিওর হয়ে সব কাজ দেখাশুনা করছেন বিদ‍্যালয় পরিদর্শক মশায়। তাঁকে বললাম, কই, যার ভাল রেজাল্ট উপলক্ষে এত আয়োজন, সে ছাত্রটি কই?পরিদর্শক মশায় একগাল হেসে বললেন, সে খুব পড়ুয়া ছেলে। কেউ যাতে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এদিক ওদিক নিয়ে চলে না যায়, তাই বিডিও সাহেব তাকে অ্যান্টি চেম্বারে পুরে আটকে রেখেছেন।
হেসে বললাম, সে কি, নামকরা ক্লাব আর পলিটিক্যাল পার্টি শুনেছি দামি প্লেয়ারদের এভাবে আটকে রাখে।
পরিদর্শক বললেন, না , সে ছেলের সাথে আমি যখন যোগাযোগ করতে গিয়েছিলাম, সে বলেছিল, এত সামান্য ব‍্যাপারে উৎসব করা ঠিক নয়। আমার মুখে সে খবর পেয়ে বিডিও সাহেব ঠিক করেছিলেন, অনুষ্ঠানের দিন আগেভাগেই ওকে বাবা বাছা করে ভুলিয়ে তুলে আনবেন। যাতে শেষ মুহূর্তে ছেলেটা এদিক ওদিক সরে না পড়ে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, এ তো সাংঘাতিক ছেলে!
পরিদর্শক বললেন, হ‍্যাঁ, বিডিও সাহেব কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। সরকার থেকে পুরস্কার দেবার আগে যাতে বেসরকারি লোকজন ওকে পুরস্কার দিয়ে ফেলতে না পারে, ওপরমহল থেকে তেমন সংকেতও আছে।
সব শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেছিল। মনে ভাবলাম ছোঁড়াটাকে দেখতে হচ্ছে!
সরকারি কর্মকর্তা এলে তাঁকে নিয়ে বিডিও অনুষ্ঠান কক্ষে দেখা দিলেন। তাঁর পিছু পিছু রোগাটে গড়নের ছাত্রটি। তার পিছনে থানার ওসি। পরিদর্শক মশায়ের গল্পের সূত্রে আমি বেশ বুঝতে পারলাম, ছেলেটিকে বিডিও চোখে চোখে রাখছেন। বিডিও হল্ এ ঢোকার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। তবু লৌকিকতার খাতিরে আমাকে দাঁড়াতে হল। ভাল করে ছেলেটার মুখটা নজর করে তার চোখের ভিতর আমি আমাদের কিশোরকালের প্রতিপক্ষ অতসীকে দেখতে পেয়ে গেলাম।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই আমার বন্ধু, যিনি আজ সরকারি কর্মকর্তা, তিনি আমাকে ভাষণ দিতে অনুরোধ করলেন।
আমি জানতাম এলাকার বিশিষ্ট চিকিৎসক হিসেবে আমাকে কিছু বলতেই হবে, তবু আমাকেই যে প্রথম বক্তব্য রাখতে হবে, তা আমি আন্দাজ করি নি।
আমি আমার বক্তব্যে বললাম, পড়াশুনা করে জীবনে দাঁড়ানোর কথা, আর দেশ ও দশের উপকার করে সার্থকতা উপলব্ধি করা। একের পর এক বক্তারা বলতে উঠলেন। বিডিওর ইঙ্গিতে জয়েন্ট বিডিও তাঁদের কাছে গিয়ে নিচুস্বরে বক্তব্য সংক্ষেপে সারতে অনুরোধ করে চললেন। এরপর এল পুরস্কার দেবার পালা।
পুরস্কার প্রদানের পর বিডিও সাহেব ছেলেটিকে বললেন পুরস্কার পেয়ে তার কেমন লাগছে বলতে।
সে ছেলে যখন বলতে শুরু করল, তখন গোটা হল নিশ্চুপ, পিন পতনের শব্দও যেন শোনা যাবে।
সে বলল, মাধ্যমিক একটি অতি সাধারণ পরীক্ষা। প্রতি বৎসর প্রতি রাজ‍্যের বোর্ডের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় স্তরের বোর্ড এই ধরনের পরীক্ষা নেয়। প্রতি বৎসরই কেউ না কেউ ফার্স্ট হয়। তারপর তাদেরকে অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই এই সামান্য কৃতিত্বের জন‍্য এত সময় ও অর্থব‍্যয় করার যুক্তি নেই। এইটুকু শুনে আমার বাল‍্যকালের বন্ধু, আজকের সরকারি কর্মকর্তা আমার কানে কানে বললেন, অতসীকে তোর মনে পড়ে? এ তারই ছানা। জাত কেউটে।
ছেলেটি বলল, আমাদের ছড়ায় বলে, লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে। তাই গাড়িঘোড়া চড়ার শখ থাকলে একটু কষ্ট করে পড়াশুনা করা উচিত। কিন্তু জিনিয়াস হবার ইচ্ছে থাকলে ইশকুল কলেজের ধার পাশ মাড়ানো উচিত নয়। দুনিয়ার প্রকৃত জিনিয়াসরা বস্তুগত সমৃদ্ধিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন। মহাত্মা গান্ধী ব‍্যারিস্টার ছিলেন। কিন্তু এমনভাবে চলাফেরা করতেন, তাঁকে লোকে ন‍্যাংটা ফকির বলত। রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধি দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইংরেজ শাসকের মুখের উপর ছুঁড়ে ফেলতে সাহস করেছিলেন। চৈতন্যদেব বাংলায় টিঁকতে না পেরে ওড়িশায় চলে গিয়েছিলেন, বুদ্ধদেব অক্লেশে ছেড়ে গিয়েছিলেন রাজভোগ।
বড় বড় মানুষ অনেক স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ঔপন্যাসিক লিও টলস্টয়ের নাম বারে বারে নোবেল পুরস্কারের জন‍্য সুপারিশ করা হলেও তাঁকে নোবেল দেওয়া হয় নি। আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি তত্ত্ব সারা দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদার্থবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও নোবেল কমিটি তাঁর যুগান্তকারী গবেষণাকে গণ‍্য করতে চাননি। শেষে মুখরক্ষার জন‍্য অন‍্য একটি গবেষণার নাম করে আইনস্টাইনকে নোবেল দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং ইতিহাস সাক্ষী, ভাল নম্বর ও ভাল সংবর্ধনা, কোনোটাই প্রশ্নাতীত নয়। সম্মান প্রদর্শন করা উচিত জিনিয়াসদের। আর আমি জিনিয়াস নই। সুতরাং আপনারা সংবর্ধনা দিতে চাইলেও আমি সে সম্মানের যোগ্য নই। আমি এ ভার ব‌হনে অক্ষম। আমাকে আপনারা মার্জনা করবেন।
এই বলে অতসীর ছেলে গটগট করে স্টেজ থেকে নেমে চলে গেল। মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন বিডিও। দর্শকসভাতেও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আমি আর আমার সরকারি কর্মকর্তা বন্ধু মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি। এমন সময় বিডিও উঠে মাইকে বললেন, আমি সামান্য ক্ষমতায় এলাকার একটি ছেলের ভাল নম্বর পাওয়াকে উদযাপন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে প্রচেষ্টা যে কাউকে অখুশি করবে ভাবতে পারিনি। তাই এই ব্লকে পরবর্তী স্থানাধিকারীর যদি আপত্তি না থাকে, তাকে আমরা পুরস্কৃত করতে চাই। একটি ছেলে চটপট এল, আর গদগদ মুখে পুরস্কার নিয়ে নেমে গেল। কিন্তু সবাই বুঝতে পারছিল অনুষ্ঠানটা খানিকটা সময় আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে।
বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে গা এলিয়ে দিয়ে ভাবছিলাম বাঙালির যে ছেলে দামি চাকরি ছেড়ে দিয়ে, নিরাপদ জীবনের আশ্বাস ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছেন, যাঁর উদ্দেশে প্রতি বছর এলাকার নানা অনুষ্ঠানে পতাকা উত্তোলন করতে যাই, তা করার যোগ্যতা আমার কতটুকু আছে!
আমি কখনো কখনো দিবাস্বপ্ন দেখতাম অতসী এসেছে আমার চেম্বারে। বলে উঠতে পারছে না, সংসার চালাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি মানিব‍্যাগ থেকে সেদিনের সমস্ত রোজগারটা ওর হাতে গুঁজে দিতে দিতে বলছি, তুই মনে রাখবি, তোর দায়বিপদে আমি পাশে আছি। আমার ভিতর সামান্য একটা আত্মতৃপ্তি খেলে বেড়ায়। কিন্তু অতসী একদিনের জন‍্যও এসে দাঁড়াল না।
সে মেয়ে এসে দাঁড়াল অনেক দিন পরে। অতসীর বর প্রথম পুত্র সন্তানের জন্মের কিছুদিন পর আরেকটির জন্মের আয়োজন করে মারা পরে। শোকাহত গর্ভবতী অতসী খোকাকে সামলে, নিজের গর্ভস্থ সন্তানটির যত্ন বিশেষ নিতে পারে নি। অথবা অন‍্য কোনো জটিল সমস্যা থেকে অতসীর দ্বিতীয় সন্তান জন্মেছিল সমস্যা নিয়েই। পরে আমি খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছিলাম, ডাউন সিনড্রোম আসলে একটা জেনেটিক ডিজঅর্ডার। একুশ নম্বর ক্রোমোজোমের একটা বাড়তি কপি বানিয়ে ফেলে প্রকৃতি এই সমস্যা ডেকে আনে। এই বাচ্চাদের বুদ্ধি বিকাশ সেভাবে হয় না। শারীরিক গঠন‌ দেখলেই অসুস্থতা চোখে পড়ে। এদের হৃৎপিণ্ডের সমস্যাও দেখা যায়। অতসী কোনো গতিকে আইসিডিএস কেন্দ্রে একটি রাঁধুনির কাজ জুটিয়ে সেই সম্বল করে সংসার চালায়। আমার কাছে সে মেয়ে কখনো সাহায্য চাইতে এল না বলে আমি তাকে ভুলতে চাইলাম। আর যতো আমি তাকে ভুলে যেতে চাইলাম, তত বেশি বেশি করে তাকে আমায় মনে রাখতে হল। বোর্ডের পরীক্ষায় একটা মেয়ে আমাদের চেয়ে অনেকটা বেশি নম্বর পেয়ে জীবনে আইসিডিএস কেন্দ্রের রাঁধুনি হয়ে ওঠা ছাড়া আর কিছু করে উঠতে পারেনি এ যেমন সত‍্য, তার চেয়ে বেশি সত‍্য যে সেই অতসীর বড়ছেলে মায়ের মতোই চমৎকার রেজাল্ট করেছে। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি সত‍্য যে সে ছেলে বুঝতে পেরে গিয়েছে এইস্তরের পরীক্ষায় প্রতিবছর কেউ না কেউ ফার্স্ট হয়, আর পরে তাদের অনেককেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিন্তু এগুলি নিয়ে আমার সমস্যা ছিল না। আমার সমস্যা হল ওই যে ছেলেটা জিনিয়াসদের যেভাবে টেনে আনল, যেভাবে তথ‍্যগুলো মুখের উপর ছুঁড়ে মারল, তা সহ‍্য করা আমাদের মতো সুখী সন্তুষ্ট মানুষের কাছে খুব অস্বস্তিকর।
আমার জ‍্যেঠামশায় বলতেন, আমরা ব্রাহ্মণরা জন্মেছি ব্রহ্মার উত্তমাঙ্গ থেকে। উত্তমাঙ্গ মানে মাথা। অস‍্যার্থ, বিদ‍্যাচর্চার যা কিছু গৌরব, সব ব্রাহ্মণদের থাকুক। জ‍্যেঠামশায় শেখাতেন শূদ্রেরা ব্রহ্মার পায়ের থেকে জন্মেছে। আমাদের দেশের প্রাচীন কালের ব্রাহ্মণরা এইজন্য শূদ্রের লেখাপড়ার অধিকার মঞ্জুর করেন নি। শূদ্র বেদপাঠ করলে তার কানে গলিত ধাতু ঢেলে দেবার বন্দোবস্ত করেছেন পূর্বজরা। শূদ্র তপ‍শ্চর্যা করলে তার মুণ্ডচ্ছেদের আয়োজন করেছেন নরোত্তম রাম। শূদ্রের কথায় আমরা অতসীর কথা ভাবতাম। তারা ছিল সৎচাষি। চাষি শব্দের সংস্পর্শে সৎ শব্দের তাৎপর্য গিয়েছিল ফিকে হয়ে। শূদ্র হয়ে এত গভীরভাবে চিন্তা করার সামর্থ্য দেখানোয় আমি ভেতরে ভেতরে রীতিমতো বিরক্ত হয়েছিলাম।
দলিত শূদ্রের ঘরে জন্মে মেধাবী বালক ব্রাহ্মণ শিক্ষকের পদবি গ্রহণ করে অম্বেডকর হয়ে উঠুন, এই ছিল আমার মনোগত ইচ্ছা। কিন্তু সকল প্রকার বৈষয়িক চিন্তাকে ধিক্কার দিয়ে অতসীর ছেলে যেভাবে বুদ্ধ ও গান্ধীর ত‍্যাগব্রতী মূর্তির মহত্ত্ব তুলে ধরল, তা আমাকে রীতিমতো বিপন্ন করে দিয়েছিল। শুরু থেকেই ছেলেটা আক্রমণাত্মক ভঙ্গি নিয়ে ফেলল। বলে দিল লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে। আমাদের সময়েও আমরা একথা শুনেছি। কিন্তু এ যে একটা ধিক্কারের বিষয়, এভাবে আমরা ভাবি নি। আমরা ফেসবুকে ছবি দিলে পিছনে একটা দেখনসই গাড়ি রাখি। গলায় ঝোলাই মোটা সোনার চেন। দামি রেস্তোরাঁয় ঝলমলে প্লেটে খাবার সাজিয়ে সেই ছবি ফেসবুকে দেখাই। আমি যে সুখী, এই বিজ্ঞাপন আমরা দেখিয়ে যেতে থাকি অক্লান্ত আগ্রহে। আর অতসীর ছেলে তার বিপরীত মেরুতে গিয়ে দাঁড়াল।
একটা হদ্দ গরিবের ছেলে হয়ে যেভাবে সে আমাদের সবাইকে ছোট করে দিতে চাইল, সেটা আমার গায়ে লাগল। বিডিওর ওপরেও আমার রাগ হল। কেন আগে থেকেই বাঁদরটার সম্পর্কে খবরাখবর না নিয়ে তাকে তুতিয়ে পাতিয়ে আনা হল? তাকে খাতির করে ডেকে আনার কারণেই তো সে গোটা ব‍্যাপারটাকে বানচাল করে দিতে পারল!
রাত একটু গড়াতে আমি আমার সরকারি কর্মকর্তা বন্ধুটিকে ফোন করে বললাম, এই যে অতসীর ছেলেটা আমাদের সবাইকে প্রকাশ‍্যে এভাবে বেইজ্জত করল, এটা তুই মুখ বুজে মেনে নিলি?
বন্ধু বলল, তো ওখানে ওকে আমি দুটো কানমলা দিলে তোর খুব ভালো লাগত? মনে রাখিস, সব কিছুর একটা পলিটিক‍্যাল অ্যাঙ্গেল থাকে। অতসীর ছেলে এ রকম না হলেই আমি অবাক হতাম। ওর সঙ্গে আগে ভাগে স্পষ্ট করে কথা কয়ে না নিয়ে ওকে ডাকা বিডিওর উচিত হয়নি। দোষ বিডিওর।
তার পর বলল, আজ আমার কাছে ভাল মাল এক পেটি এসেছে। তোকে পাঠিয়ে দিই?
ওকে বললাম, হোস্টেল থেকে ছেলেটা কদিনের জন‍্য এসেছে। এখন এসব না। কদিন যাক।
দিনের পর দিন কেটে যেতে থাকল। আমি শুনেছি অতসীর ছেলে মন দিয়ে পড়াশুনা করে যাচ্ছে। ক্রমে ক্রমে ওর কথা আমি ভুলে গেলাম। ইতিমধ্যে আমি কবার গাড়ি বদলে ফেলেছি। মহকুমা সদরে একটা দেখনসই ডুপ্লেক্স বাংলো হয়েছে আমার। আর আমার বন্ধু এখন মন্ত্রী। কিন্তু করোনা এসে আমাদের রাজ‍্যের সবকিছু ওলট পালট করে দিল। রোগের জীবাণুকে চোখে দেখা যায় না। আর ভাইরাস তো আরো এককাঠি বাড়া। সে না জ‍্যান্ত, না মরা! প্লেগ, কলেরা, যক্ষ্মা, জলাতঙ্ক, গুটিবসন্ত কম বিপজ্জনক রোগ ছিল না। কিন্তু তখন সোশ্যাল মিডিয়ার এই দাপট ছিল না। এখন কার পৃথিবীতে মুহূর্তে কথা চালাচালি হয়ে দাবানল সৃষ্টি হয়। আমার স্ত্রী যখন জানলেন ইউরোপের দেশে দেশে এই রোগের প্রকোপে পথেঘাটে লোকজন মরে পড়ে থাকছে, তখন তিনি আমার চেম্বার করা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, অনেক ডাক্তারি করেছ, এখন আমি আর পেশেন্ট পার্টিকে বাড়িতে অ্যালাও করব না। তোমাকেও বাড়ির বাইরে পা রাখতে দেব না।
গরিব সবজিওয়ালা মাছওয়ালা সাইকেল ভ‍্যানে করে বাড়িতে এসে জিনিসপত্র দিয়ে যেত। দোতলার বারান্দা থেকে ডিটারজেন্ট গোলা জল ভরতি বালতি নামিয়ে সে সব উপরে তোলা হত। মেডিক্যাল জার্নাল পড়া ছেড়ে আমি ডিটারজেন্ট গোলা জলে সবজি কতক্ষণ ভিজল, তার হিসাব রাখা শুরু করলাম।
শুনতে পেতাম সরকারি ডাক্তার নার্সেরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলেছেন, অথচ কাজের শেষে তারা বাড়িতে ফিরতে চাইলে সমস্যা হচ্ছে। যাঁরা ভাড়াবাড়িতে থাকেন, বাড়িওয়ালা সেইসব ডাক্তার নার্সকে অবিলম্বে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে।
কোথায় নাকি খোদ বিডিওকে বাড়িওয়ালা ভাড়াবাড়িতে পা রাখতে দেয়নি। হেনস্থা করেছে।
ভাবলাম, আমাদের রাজ‍্যের হলটা কি? যে মানুষগুলো সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে প্রাণ হাতে করে চলছে, তাদেরই উপর হেনস্থা!
আমার স্ত্রী আমাকে চোখ পাকিয়ে বললেন, যেখানে যা হচ্ছে হোক। তুমি মোটেও মাথা ঘামাবে না।
আমি তাঁকে বললাম, না গো, একজন ডাক্তার হিসেবে আমি রোগবালাই নিয়ে চিন্তা করা ছাড়তে পারি না। রোগ সম্বন্ধে সচেতনতা দরকার। সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। কিন্তু এ দেশে যা হচ্ছে, তা পাগলামি। কোনো সভ‍্যদেশ ডাক্তার নার্সদের গায়ে হাত তোলার কথা ভাবতেই পারে না।
আমার কথা শুনে গিন্নি এমনভাবে চোখ পাকালেন যে ভয়ে আমার হাত পা পেটের মধ‍্যে সেঁধিয়ে যেতে চাইল।

শেষ দুপুরে নিচ থেকে কে একটা নারীকণ্ঠ ডাকাডাকি করছে। আমি দোতলার ব‍্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, নিচে দাঁড়িয়ে আছে অতসী।
মুহূর্তে বুকের ভিতর ধড়াস করে উঠল। শয়নে স্বপনে কতদিন চেয়েছি অতসী ভিক্ষার জন‍্য হাত বাড়িয়ে দাঁড়াক আমার দুয়ারে।
তাহলে আজই কি সেই দিন!

ডাক্তারবাবু, একটু নিচে আসবেন?
বললাম, কার কি হয়েছে অতসী? দাঁড়া, আমি এখুনি নামছি।
চোখ পাকিয়ে ধমক দিল বউ। এই করোনার বাজারে মোটেও তোমার পেশেন্ট দেখা চলবে না!
নিচ থেকে অতসী বলল, নামতে হবে না ডাক্তারবাবু। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার একটা কথা শুনুন।
তার কথা শুনে আমার পুরুষালি অহং সম্বিৎ ফিরে পেল। স্ত্রীর রক্তচক্ষু হেলায় অগ্রাহ্য করে নিচে নেমে দরজা খুলে নরম কণ্ঠে বললাম, আয় অতসী, ভিতরে আয়, বোস্।
না ডাক্তার। আজ সকালে আমার বড়ছেলে মরেছে। আমি তার বডি নিয়ে শ্মশানে শ্মশানে হন‍্যে হয়ে ঘুরছি। কিন্তু কোথাও পোড়াতে দিচ্ছে না।
আমি কি ঠিক শুনছি? অতসীর বড় ছেলেটা মারা গেছে। মা হয়ে সে এই দুপুর রৌদ্রে খবরটা আমাকে দিতে এসেছে।
ওই দ‍্যাখো ডাক্তার, ওই শুয়ে আছে আমার ছেলে।
দেখলাম একটু দূরে একটা রিকশা ভ‍্যানে শাদা ধুতির উপর একটা মৃতদেহ। তাকে ছু়ঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর একটা ছেলে। দেখলেই বোঝা যায়, ও ছেলেটা ডাউন সিনড্রোমের শিকার। বললাম, কী হয়েছিল তোর ছেলের?
বিশ্বাস করো ডাক্তার, ওর করোনা হয় নি। ব্লাড ক‍্যানসার ধরা পড়ল, তখন চব্বিশ বছর বয়স। ছেলে আমার ম‍্যাথমেটিক্সে মাস্টার্স করল। রেজাল্ট বেরোনোর কদিন পরে পরীক্ষা করে জানতে পারলাম কারসিনোমা। অ্যাডভান্সড স্টেজ।
আমি বিস্ফারিত চোখে শুনতে থাকি। অতসী বলে যাচ্ছিল, আমি বোম্বে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওরা বলেছিল বিশেষ কিছু করার নেই আর। তারপর করোনা এসে গেল। হাসপাতালে নিয়ে যেতাম ছেলেকে। কিন্তু চিকিৎসার নামে অষ্টরম্ভা, করোনার জন‍্য সবাই ভয়ে মরছে। ওকে ছুঁয়ে দেখতে পর্যন্ত চাইত না। শেষের দিকে ছেলে যেতে চাইত না। বলত, সবাই ঘেন্না করে মা‌। আমি দেখেছি তোমার আর একটাও গয়না নেই। বাড়িটা ভাইয়ের জন‍্য থাকুক মা।… এই দ‍্যাখো ডাক্তার, ছেলে আমার ক‍্যানসারে মরেছে, এই তার পেপার্স। করোনায় মরেনি সে। তবু কেন শ্মশানে নিতে দেবে না? একটা বিহিত করো তুমি।
আমার চোখে জল বেরিয়ে এল। বুদ্ধের কাছে কিশা গোতমী এসে বলেছিল, আমার মরা ছেলেকে বাঁচিয়ে দাও। এই মা তা বলছে না। বলছে, আমার বাছা করোনায় মরে নি। ওর কেন অন্ত‍্যেষ্টিতে বাধা হবে?
আমি আমার সেই বন্ধুটিকে স্মরণ করলাম, যে একজন মন্ত্রীর খুব কাছের লোক। অতসীর বড়ছেলেটা মারা গেছে শুনে সে গুম হয়ে রইল।
বলল, বেঁচে থাকতে কিছু বললি না, মরে গেলে আমি কি করে কি করব।
বললাম, দেশের লোকে খেপে উঠে বলছে করোনার মড়া পোড়াতে দেব না। অথচ ও তো করোনায় মরে নি! আর ডেডবডিতে তো করোনা থাকে না, তোরাই বলছিস। ভাই, এই মৃতদেহের সৎকারের ব‍্যবস্থা তোকে করে দিতেই হবে।
মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ফোন আসায় বিডিও আর ওসি দাঁড়িয়ে থেকে সৎকার করিয়ে দিলেন। এসডিও ঘণ্টায় ঘণ্টায় আপডেট চাইলেন।
রোগা শরীরটায় বিশেষ কিছু ছিল না। চটপট দাহকর্ম শেষ হয়েছিল।

মৃদুল শ্রীমানী। কবি। জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। প্রকাশিত বই: 'জমি জরিপ,  কি দেখে জমি বাড়ি কিনবেন,  ফ্ল্যাট ও বাড়ি,  তথ্য জানার অধিকার', 'মানুষের বাঁচার অধিকার সংক্রান্ত- মেয়েদের আইন', 'সে একটি পল্লবিত...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ