অতৃপ্ত আত্মা

পলি শাহীনা
গল্প
Bengali
অতৃপ্ত আত্মা
  1. অন্ধকারাবৃত মেঘলা আকাশ। বাতাসে মন কেমন করা উদাস কান্নার সুর। রোজকার মত নিয়ম করে সূর্য উঠলেও গোটা শহর ঘুমিয়ে আছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার পর থেকে নিউইয়র্ক শহর যেন রাতদিন জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা, মানুষজন নেই। ল্যাম্পপোস্টগুলো বুক চিতিয়ে সাহসী মানুষের মতো একা দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ীর অপ্রয়োজনীয়, বিরক্তিকর শব্দ নেই। গাছের ফাঁকফোকর গলে পাখীদের কিচিরমিচির শব্দ ছাড়া, অন্য কোন শব্দ নেই বললেই চলে। প্রকৃতিতে এখন বসন্ত হাওয়া বইছে। ফুল ফুটেছে, জোড়া ঘুঘু বাসা বাঁধছে ভালোবেসে, সবুজের সমারোহে ছেয়ে আছে চারপাশ, এত এত সৌন্দর্যের ভীড়েও মানুষের কোলাহল ছাড়া সবকিছু শূন্য লাগছে। ফ্যাকাসে দিন হলেও প্রকৃতির বসন্ত আমেজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, নাবালক সকালটির পরতে পরতে।

শোভার সবসময় বিশ্বাস করে, মুখ ছাড়া আয়না যেমন অকেজো, তেমনি মানুষ ছাড়া প্রকৃতির রূপও অর্থহীন।

সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি দিন  আজ। শোভার অকাল প্রয়াণে প্রকৃতি, আসমান -জমিন সহ চারপাশ মনমরা হয়ে আছে। খানিক আগে কান্না হয়ে ঝরলো আকাশ, কেঁদে কেঁদে প্রকৃতি যেন কিছুটা হাল্কা হলো।

শোভার দেহ থেকে আত্মা মুক্তি লাভ করেছে গত রাতে। যদিও মুক্তির প্রার্থনায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ শোভা চায়নি, এখুনি জগৎ ছেড়ে চলে যেতে। ওর উপর অর্পিত একমাত্র সন্তান পিয়ালের সকল দায়িত্ব পালন শেষে, শান্তিতে চিরনিদ্রায় যেতে চেয়েছিল। তুচ্ছ জীবনে শোভার কোন ইচ্ছে পূর্ণতার মুখ দেখেনি। জীবনভর স্বপ্নদের টুটে যেতে দেখেছে। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়াই ছিল ওর জীবন।

জীবদ্দশায় প্রায়শই শোভার মনে হতো, জীবন আসলে স্রষ্টা প্রদত্ত শাস্তি বৈকি আর কিছুই নয়। অসহায় মানুষগুলো গোপনে কাঁদে, অত্যাচারিত হয় সবলের কাছে, দূর্বলভাবে হেরে যাওয়া শেষে বলে সবি নিয়তি! এই নিয়তির নীতিমালা ইচ্ছেমতো নির্ধারণ করেন সৃষ্টিকর্তা। তাঁর মর্জিমাফিক বাঁচতে হয়, তাঁর ইচ্ছেতে মরতে হয়। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ – সবি তাঁর হাতে।

বৃষ্টি শেষে আশপাশের ঝাপ্সা অবস্থা কেটে সূর্য তেতে উঠলেও ঠান্ডা বাতাস বোধ হচ্ছে। ত্রস্ত পৃথিবী সূর্যের রুপালি আলোয় স্নান করে কিছুটা স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। শোভা চোখ বন্ধ করে চলে যায় তার ছোটবেলার আলোমাখা মুহূর্তগুলোতে। পৌষ- মাঘের শীতের সকালে যখন এমন ঠান্ডা বাতাস বয়ে যেত, তখন শোভা মায়ের বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকতো, মা কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরতো। সরল -সুন্দর মায়ের বুকের ওমে ঘুমিয়ে পড়তো। চোখ মুদে নিংড়ে নিংড়ে অনুভব করছে শোভা ফেলে আসা জীবনের সুখ। মায়ের আদর শোভাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমেরিকা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ বাংলাদেশে, সে ছোট্ট গ্রামে। যে গ্রামের আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, তাল, কামরাঙ্গা, চালতা, বরই, বাতাবিলেবু আর, অতি প্রিয় হাস্নাহেনা, বেলি ফুলের মন মাতানো ঘ্রাণ এসে লাগছে এখন শোভার নাকে। পরিচিত ঘ্রাণের তীব্রতায় শোভার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। ওর ভীষণ ইচ্ছে করে শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে খালি পায়ে মায়ের হাত ধরে হাঁটতে, বাবার চাদরের ওমে সাইকেলে বসে স্কুলে যেতে।

বাবা-মায়ের সঙ্গে কাটানো জীবনের শ্রেষ্ঠ সুন্দর খাঁটি সোনার দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে ওর। আলোয় ডুবানো ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো ছবি হয়ে শোভার চোখের সামনে ভাসতে থাকে।

শোভার মনের আকাশজুড়ে স্মৃতির ঝড়-ঝাপটা বয়ে চলছে। মেঘে ঢাকা আকাশের বিদ্যুৎ চমকানোর মত ওর মনেও স্মৃতিরা গর্জন তুলছে। স্মৃতি মানুষের জীবনের এক অতি মূল্যবান সঞ্চয়। স্মৃতি হাসায়, স্মৃতি কাঁদায়, স্মৃতি আবার ভাসিয়েও নিয়ে যায়। স্মৃতির ভেলায় ভাসতে ভাসতে মানুষ যে কোথা হতে কোথায় চলে যায়, সে নিজেও জানেনা। মানুষ অনেক সময় স্মৃতি ভুলতে বসলেও, পারিপার্শ্বিকতা সেটি হতে দেয় না। জীবনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে মানুষ চোখ বন্ধ করে স্মৃতির মহাসাগরে ডুবে যায়।

স্মৃতির অরণ্যে কেউ অতীতকে খোঁজে, কেউ খোঁজে বর্তমানকে! যেমন শোভা এখন খুঁজছে অতীতকে। ওর চোখের পর্দায় স্বপ্নের মত ভেসে এলো শোভনের মুখোচ্ছবি আর বৃষ্টি ভেজা মধু মাখা কিশোরী বেলা।

স্কুল ছুটি হলে যদি কোনদিন মনে হতো আকাশে মেঘ জমেছে কিংবা বৃষ্টি হবে, সেদিন শোভন ছাতা হাতে রাস্তার উপর গাছের নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো। শোভাকে দেখামাত্র ছাতা এগিয়ে দিয়ে বলতো, ‘ এই নে ছাতা! একদম বৃষ্টিতে ভিজবি না কিন্তু! এত দেরি করলি কেন! অনেকক্ষণ ধরে তোর জন্য দাঁড়িয়ে আছি! ‘

শোভা বৃষ্টিভেজা জুবুথুবু শোভনের মুখের দিকে তাকিয়ে তার চোখের ভাষা অনুবাদ করতে থাকে! শোভনের ভেজা চোখজোড়া জুড়ে শুধু শোভার ছবি ফুটে উঠেছে। শোভার মুখের রং বদলে যায় ভালোলাগার অপার আনন্দে।

বন্ধুদের সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে চড়ুইভাতি খেলা, কবিতা, গান আর পুতুলের বিয়ে নিয়ে মেতে থাকতো শোভা। শোভনের ভরাট কন্ঠের কবিতা পড়ার ধ্বনি এখনো কানে বাজে। শোভনের সকল ব্যস্ততা থাকতো শোভাকে ঘিরে, সারাক্ষণ ওর মাঝেই ডুবে থাকতো। জণারণ্যেও অপলক শোভার দিকে তাকিতে থাকতো। যেন শোভার মন যুগিয়ে চলাই ছিল শোভনের জীবনের একমাত্র ব্রত।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে সবাই ছুটিতে আরাম আয়েশে দিনাতিপাত করছে। হঠাৎ একদিন শোভার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে, জ্বরে পুড়তে থাকা কপালে হাত রেখে শোভন বলেছিলো, ‘ তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠ! শহরে কোচিং করতে যাওয়ার আগে সবাই মিলে আবার চড়ুইভাতি খেলবো, পুতুলের বিয়ে দেব, মাংস -পোলাও খাবো, চতুর্দিক আলোকিত করে হাসবো, গাইবো, কবিতা পড়বো! ‘

শোভা যখন সুস্থ হয়ে উঠে, ততদিনে শোভন শহরে চলে যায়। শোভনের উদ্দেশ্যে লেখা কাঁচা হাতের কবিতাগুলো ওকে শোনানোর জন্য শোভা অস্থির হয়ে উঠে।

চাল, ডাল, আলু, তেল-  শোভনের দেয়া কলম দিয়ে চড়ুইভাতির ফর্দ বানাতে থাকে, আর অপেক্ষা করতে থাকে শোভা। একটা শীতলপাটি বিছানো বারান্দায় চড়ুইভাতির ফর্দ হাতে, নিঃসীমতায় চেয়ে থেকে শোভনের অপেক্ষায় শোভার মন বিরহের আগুনে পুড়তে থাকে। ওদের আর কোনদিন দেখা হয় না। বেঁচে থাকার সময়েও শোভনের জন্য সদা মন পুড়তো, জীবন শেষেও তাকেই মনে পড়ছে! শোভার বিশ্বাস দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান শেষে দ্রুতই শোভনের সাথে দেখা হবে ওর! নতুন পৃথিবীতে ওরা সতেজতায় নতুন জীবন শুরু করবে!

স্মৃতি হলো চাপা কলের মতো। হাতল ধরে যত চাপতে থাকে, তত জলের মত উপচে পড়ে। জীবন নামক অদৃশ্য কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে, শোভার এখন সমুদ্র সম অবসর মিলেছে। অবসরে ও চাপা কলের হাতল ধরে চাপছে আর কঠিন জীবন বেলায় কাটানো স্মৃতির জাবর কাটছে।

হাসপাতালে শোভার মৃতদেহ ঘিরে থাকা মানুষগুলোর কাউকে ও চেনা না, তাঁরা কেউ ওর আপনজন, পরিবার বা আত্মীয়- স্বজন নয়। তবুও তাঁরা শোভার মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। গত দু’দিন ধরে ওকে ছায়ার মত ঘিরে রাখা, ওকে বাঁচানোর সব চেষ্টা করা, ডাক্তার, নার্সরা ওর মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। মায়া খুব খারাপ জিনিস। না চাইলেও এটি মানুষকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে। শোভার দেহ হাসপাতাল থেকে মর্গে নেয়ার ব্যবস্থা চলছে।মানুষ মরণশীল। মানুষ মারা যাবে এটি জগতের অন্যতম ধ্রুব সত্য! প্রতিটি জীবনকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যু জীবনের অতি স্বাভাবিক অবধারিত প্রক্রিয়া। এ থেকে পরিত্রাণের কোন পথ নেই জীবনে। মৃত্যুতে জীবন পূর্ণতা পায়। মৃত্যু আদতে মানব জীবনের স্বাভাবিক পরিপূর্ণ চক্র বৈকি আর কিছু নয়৷ কার জীবনের সমাপ্তি কখন, কিভাবে, কোথায় ঘটবে, তা কেউ জানে না।

গত দু’দিন আগেও শোভা জানতো না, হাসপাতালের পথে বাসা থেকে এটাই তার জীবনের শেষ যাত্রা। আর কোনদিন সে বাসায় ফিরে আসতে পারবে না। একমাত্র পুত্র পিয়ালকে বুকে জড়িয়ে ধর‍তে পারবে না। সংসার, আদরের সন্তান, এই বর্ণিল পৃথিবী ফেলে ওকে বিদায় নিতে হবে।

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত শোভার দেহ সৎকারের অপেক্ষায়, আরো অনেক মৃত দেহের সঙ্গে লাইনে পড়ে আছে। মৃত্যুর মিছিল চলছে । এত এত মৃতদেহ, হাসপাতাল, ফিউনারেল হোম, সর্বত্র শোকে ভেঙে পড়েছে সবাই।    নভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড -১৯ এর বিস্তার রোধ করার অন্যতম উপায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অংশ হিসেবে, সীমিত আনুষ্ঠানিকতায় শোভার দেহ সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে।

মায়ের মুখ দেখার জন্য, মাকে একটু স্পর্শ করার জন্য শোভার একমাত্র সন্তান পিয়ালের আহাজারিতে আকাশ- বাতাস বিদীর্ণ হলেও, দেখার কোন সুযোগ নেই। মায়ের মুখ শেষবারের মতো দেখতে না পারার কষ্টে, পিয়াল মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে মারাত্মকভাবে।

দেহ এবং আত্মা দুটো আলাদা জিনিস। দেহ মরে যায়, পঁচে যায়। দেহ লোকালয় হতে বিচ্ছিন্ন হয় কিন্তু আত্মা বিচ্ছিন্ন হয় না। শোভার মৃত্যু তাকে পরিবার, সন্তান থেকে আলাদা করে দিলেও, তার আত্মা সবার মাঝেই ঘুরছে। দেহ থেকে আত্মা সরে যাওয়ার পর থেকে শোভা সবাইকে দেখছে, সবকিছু দেখছে, কিন্তু ওকে কেউ দেখছে না।

পিয়ালের কষ্টে শোভার মন পুড়ছে। জীবনের কঠিন অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার দিনগুলোতে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ও বেঁচে ছিলো। নিজে জ্বলেপুড়ে ছাই হলেও, কোনদিন ছেলেকে কষ্ট দেয় নি। কত স্বপ্ন ছিল শোভার! ছেলে বড় হয়েছে, ছেলেকে নিয়ে ও বিশ্বের নানান দর্শনীয় জায়গাগুলোতে বেড়াতে যাবে। মুখোস পরা জীবনের অন্ধকার দিনগুলো থেকে ছুটি নিয়ে খুব বেড়াবে ছেলের সঙ্গে । নদী, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, রৌদ্র মাখা সবুজে প্রজাপতি হয়ে উড়বে। দিগন্ত ছোঁয়া নীল আকাশের বুকে, মেঘের নিচে সুখের ভেলায় সমুদ্র ছুঁয়ে পেজা তুলোর মতন উড়বে। পৃথিবী যখন চাঁদের আলোয় স্নান করবে, শোভা তখন ছেলের সঙ্গে আকাশে খই এর মতো ফুটতে থাকা তারা গুনবে। মা- ছেলে মিলে আনন্দের সাগরে হাবুডুবু খাবে।

জীবন ওদেরকে সে সুসময় দেয় নি। এসব শুধুই আজ কল্পনা। আদতে, সুসময়ের সঙ্গে সম্ভবত মানুষের দেখা হয় না। সুসময় বিমূর্ত। সুসময়কে ধরা, ছোঁয়া যায় না। সুসময়ের আশায় মানুষ বেঁচে থাকে ; কিন্তু সুসময়কে  উপভোগ করতে পারে না।

শোভার স্বামী আনোয়ার হোসেন একজন স্বৈরাচারী, লোভী মানুষ। বিয়ের আগে শোভার ধারণা ছিল নেশা বলতে মদ, জুয়া, নারী এসবকেই বুঝায়, কিন্তু বিয়ের পর ও বুঝতে পারে মদ, জুয়া, নারী ছাড়াও জগতে আরো অনেক ধরণের নেশা রয়েছে। যে কোন নেশা-ই ভয়ংকর। একটি নেশা থেকে আরেকটি নেশা কোনভাবেই কম বিধ্বংসী নয়। প্রতিটি নেশাই জীবনের সুখ-শান্তি কেড়ে নেয়। আনোয়ারের অর্থ সম্পদের নেশা কেড়ে নিয়েছিলো শোভার জীবনের সুখ-শান্তি, হৃদ স্পন্দন।

অর্থের জন্য এমন নেশাগ্রস্ত মানুষ শোভা আগে কোনদিন দেখে নি। আনোয়ারের একেবারে অপ্রয়োজনীয় অর্থের নেশা দেখতে দেখতে শোভার মনে হতো, অর্থ আনোয়ারকে কিনে ফেলেছে। আনোয়ার আসলে অর্থের মালিক হতে পারেনি। কারণ অর্থ জীবনের জন্য, অর্থের জন্য তো জীবন নয়। যে অর্থ জীবনের সুখ কেড়ে নেয় সেটি আসলে অনর্থ!

অদরকারী অর্থ, সম্পদ আহরণের নেশায় মজে থাকা আনোয়ার কোনদিন স্ত্রীর শরীর, মনের খোঁজ রাখে নি। সংসার কখনো কখনো কারো কারো জীবনে একটা অভ্যাস ছাড়া আর কিছুই নয়। ভালোবাসা, যত্ন, স্নেহ, মমতা ছাড়াও সন্তান আসে সংসারে, যেমন পিয়াল এসেছিল শোভার কোলজুড়ে। পিয়ালকে বুকে ধরে একাকী  একটি জীবন ও কাটিয়ে দিয়েছে নীরবে। স্বামী ছিল অভ্যাস আর কিছু নয়।

গোটা জীবন কাটিয়ে শত চেষ্টা করেও শোভা মনে করতে পারছেনা, স্বামীর সঙ্গে কাটানো কোন সুখকর মুহুর্তের কথা। অথবা স্বামীর বিশেষ কোন ভালোবাসা, আহ্লাদের কথা। অথচ, আজন্ম শোভা ভালোবাসার কাঙ্গাল ছিল। বোধ জ্ঞান হবার পর থেকে ও স্বপ্ন দেখতো, আদর-ভালোবাসায় আগুন যেভাবে উনুনে জড়িয়ে থাকে, শ্যাওলা যেমন করে পুকুরের জলে ভেসে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে সেও স্বামীর বুকে মিশে থাকবে।

কথায় বলে, মানুষ চায় এক হয় আরেক। দূর্ভাগ্যবশতঃ শোভার জীবনেও সেটিই ঘটেছে। সে যেমন করে জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছে তার কিছুই বাস্তব জীবনে পায় নি। অসঙ্গতি, হাহাকার বুকে নিয়ে ইহকাল কাটিয়ে দিয়েছে।

করোনা ভাইরাস আতংকে গোটা বিশ্ব যখন চিন্তিত, শোভা তখন নিশ্চিন্তে আছে! জীবদ্দশায় রোজ নিয়ম করে বারবার মরার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে শোভা আজ মুক্ত হয়েছে!

একজীবন কাটিয়ে এসে শোভার অনুভূতি, ‘জীবন আসলে একটি ফাঁকি! ‘

শোবার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে আনোয়ার বিড়বিড় করে চলছে আপনমনে। শোভার মৃতদেহ শক্ত কফিনের আবেস্টনিতে পড়ে আছে, তার আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়ীর আনাচ-কানাচে, পরিবারের মানুষদের মাঝে। আনোয়ার কি বলছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছেনা ও। বদমেজাজি, অহংকারী মানুষটাকে করোনা ভাইরাসের মত অদৃশ্য অনুজীবের কাছে নুয়ে পড়তে দেখে শোভা অবাক হয়, হাসি পায়। প্রতিবাদের শক্তি থাকলেও, সমাজ, সংসারের সমর্থনের অভাবে স্বামীর পুরুষালি বর্বরতা সহ্য করে, শোভার পুরো জীবন কাটে আতংকের মধ্য দিয়ে। মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করার এই এক অদ্ভুত পরিণতি! মেয়েদের ইচ্ছে, ভালোলাগা, পছন্দ কিংবা মতামতের বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এখনো কোন মূল্য নাই। নিজের নয় অন্যের মন যুগিয়ে চলার জন্যই যেন মেয়েরা জন্মেছে দুনিয়াতে।

বিয়ের আগে বাবা কিংবা ভাই, বিয়ের পর স্বামী, শেষ বয়সে সন্তানের সিদ্ধান্তে মেয়েদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। একটা মেয়ে কখন হাসবে, কখন কাঁদবে, কখন জাগবে, কখন ঘুমাবে – সবি নির্ধারণ করবে ওরা! এককথায় মেয়ের অভিভাবক সবসময় অন্যজন হবে! একটা মেয়েকে তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দিবেনা এই দেশ, সমাজ, সংসার, কেউ না। একটা মেয়েকে ধুঁকে ধুঁকে মরে যেতে দেখলেও, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে  সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র তাঁকে নিজের মত করে স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিতে নারাজ। যেখানে মেয়েদেরকে নিজের মত করে বাঁচতে দেয়ার স্বীকৃতি দেয়া হয় না, সেখানে মেয়েদের জীবন তো দূর্বিষহ হয়ে উঠবেই। পৃথিবী নামক গ্রহটি মেয়েদের জন্য ভয়ংকর এক জায়গা! এই গ্রহ ছাড়তে পেরে শোভা খুশি!

দাম্পত্য জীবনে আনোয়ার শোভার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতো না। ঘরের বাইরের লোকজনের সামনে ধমক দিয়ে কথা বলতো। মানসিক যন্ত্রণায় শোভা মনের শক্তি হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ক্রমশ। কোন বিষয়ে শোভার মতামত নেয়া তো দূরের কথা, ওকে জানাতোও না। জীবনভর শোভা ঠকে গিয়েও, সম্মানের ভয়ে সন্তানের জন্য স্বামীর  সঙ্গে শুধু আপোষ করে গেছে।

শোভা-আনোয়ার দম্পতি সংসার নামক সামাজিকতার পোষাক পরে থাকলেও, কেউ কারো আপন হয় নি কোনদিন।

জীবদ্দশায় শোভা শেষ কবে আনোয়ারের মুখের দিকে তাকিয়েছে, মনে করতে পারছে না আজ আর। আসলে সংসারটা তাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া সূর্যোদয়ের পরপর আনোয়ার বেরিয়ে যেত ঘর থেকে, ফিরতো মাঝরাতে। ফলশ্রুতিতে, ওদের তেমন একটা দেখা হতো না, কথাও হতো না।

আজ শোভার আত্মা আনোয়ারকে খুব কাছে থেকে দেখছে। মূলতঃ তাকে চিন্তাগ্রস্ত দেখে ও পাশে যায়।  আনোয়ারের মাথায় চুল নেই বললেই চলে, যে কয়েকটি আছে সেগুলোও ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। চোখের ভারী চশমা দেখে বুঝা যায় কাচের পুরুত্ব অনেক বেড়েছে৷ উপরের মাড়ির দাঁতগুলো ঠিকঠাক থাকলেও, নিচের মাড়ির কয়েকটি দাঁত পড়ে গেছে। নকল দাঁত বসালেও স্পষ্ট বোঝা যায়। হাত, মুখের চামড়া ভেদ করে কালচে শিরা গুলো স্পষ্ট দেখা যায় বেশ দূর থেকেই। লালচে মুখ দেখে মনে হচ্ছে প্রেসার বেড়েছে। ওকে খুব ভীত দেখাচ্ছে। স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ ভীত হয়।

আনোয়ারের এমন বেহাল দশা দেখে, হুড়মুড়িয়ে শোভার অনেক কথা মনে পড়ে গেলো। একটু জ্বর হলেই শোভাকে কি যে যন্ত্রণা দিতো। মাঝরাতে ক্লান্ত শোভাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ফেলতো, ঘুমাতে দিতো না আর। কতক্ষণ বলতো পা টিপতে, কতক্ষণ মাথা, এমন করে শোভার আর ঘুম হতো না।

কিন্তু শোভার শরীর খারাপ হলে ফিরেও তাকাতো না সে। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ ছিল ও। শোভা একা একা খেতো, ঘুমাতো, একা বাইরে যেত। গল্প করাতো দূরে থাক, শোভার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাও স্থিরভাবে বলতো না। প্রথমদিকে শোভার খারাপ লাগলেও পরের দিকে গা সওয়া হয়ে যায় ; কিংবা অন্য কোন উপায় না থাকায় সহ্য করে নিতে বাধ্য হয়। অর্থ-বিত্তের মোহে নিমজ্জিত স্বামীর অবহেলা, তুচ্ছতা সয়ে সয়ে, শোভার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। জীবনভর পুড়তে পুড়তে মৃত্যুতে সে মুক্তি পায়!

শোভার পরিচিত কিছু লোকজন আনোয়ারের বেশ ভক্ত ছিল। খবর নিয়ে সে জানতে পারে, ব্যক্তির ভক্ত নয়, তার অর্থের ভক্ত ছিল তারা। জীবনের অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে করতে শোভা একসময় অনুভূতিহীন হয়ে পড়ে। কোন কিছুতেই তার কিছু আসতো যেতো না। সে জেনে গেছে, অবাক করা তার এই জীবনে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির দেখা হবে না কখনো।

প্রকৃতি কখনো কাউকে ছাড় দেয় না। প্রকৃতি তার হিসেব কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেয় সময়মতো। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বিষন্ন পৃথিবীর মন খারাপের এই সময়ে, ঘরের সব বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে বসে অনুশোচনার আগুনে জ্বলছে আনোয়ার। তার মুখে হাসি নেই, চোখে স্বপ্ন নেই, মনে শক্তি নেই। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে বর্তমানে আইসোলেশনে আছে।

বাড়ী-গাড়ী, অর্থ-বিত্ত সবকিছু থাকার পরেও কোনকিছু আজ প্রয়োজনে আসছে না। তাকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না। সে উপভোগ করতে পারছে না। কিছুই তাকে শান্তি দিতে পারছে না। তার পাশে কেউ নেই। কবরস্থানের নিঃস্তব্ধতা ঘিরে রেখেছে তাকে আষ্টেপৃষ্টে।

কোথাও কোন সমস্যা হলেই সব দোষ শোভার উপরে চাপিয়ে দেওয়া আনোয়ার, আজ হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তার নির্যাতন মুখ বুঁজে সহ্য করার মানুষ আজ ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।

শোভার আত্মা মনের সুখে বসন্তের হালকা বাতাসে উড়ছে, আর গলা ছেড়ে প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত গাইছে –  এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে, দেহমনের সুদূর পাড়ে হারিয়ে ফেলি আপনারে, গানের সুরে আমার মুক্তি উর্ধ্বে ভাসে…

সুর মুগ্ধ করে। শোভার সুরের মূর্ছনায় গলা মিলিয়ে গাইছে ভ্রমর, পাখি, প্রজাপতি। তিরতির বাতাসের শরীরজুড়ে তাদের সুর উড়ছে, খেলছে। গানপাগল শোভা কান পেতে বিভোর হয়ে শুনছে, প্রকৃতির চমৎকার সুরেলা পরিবেশনা।

জোস্না ভেজা প্রান্তরে আচমকা শোভা পরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে পায়। কে এভাবে আদর করে ডাকছে তাকে নাম ধরে! ও ব্যকুল হয়ে ছুটতে থাকে শব্দের পিছে পিছে। ও যত কাছে যায় শব্দ তত দূরে সরে। ভীষণ চেনা ঘ্রাণ এসে লাগে নাকে। বাবা-মায়ের গায়ের ঘ্রাণ শোভা এবার চিনতে পারে। বাবা-মায়ের বুকে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে।

রাতজাগা একটা পাখী শোভার সামনে দিয়ে উড়ে যায়, পাখীর ডানার বাতাসে ওর নাক থেকে বাবা-মায়ের ঘ্রাণ হারিয়ে যায়। বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ও অস্থির হয়ে উঠে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে বাবা-মায়ের সঙ্গে বহুল আকাংঙ্খিত সে মিলনের জন্য।

‘মৃত্যুর পর যত দ্রুত সম্ভব আমার লাশ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিও, আমার বাবা-মায়ের কবরের পাশে আমাকে দাফন করো। ‘

মায়ের বলা কথাগুলো এবং মায়ের জীবনের শেষ ইচ্ছের কথা পিয়াল ভাবছে, আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনবরত কাঁদছে।  অনেক চেষ্টা করেও পিয়াল মায়ের মৃতদেহ বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারেনি। করোনা ক্রান্ত এই সময়ে এটি অসম্ভব। এখন বাংলাদেশ কোনভাবেই মৃতদেহ গ্রহণ করবে না, বিদেশ থেকেও যেতে দিবেনা। পিয়ালকে হাউমাউ কাঁদতে দেখে শোভার কষ্ট হয়। পিয়াল খুব একা কাঁদছে। কেউ পাশে নেই স্বান্তনা দেয়ার। কেউ নির্জনে থেকে একা, আবার কেউ ভীড়ে থেকেও একা। শোভা নির্জনে একা, পিয়াল সজনে থেকেও একা। মা ছাড়া এই একাকী বৃত্তে পিয়াল যেন দ্রুত নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, শোভা কায়মনোবাক্যে সেটি প্রার্থনাটি করে। পিয়ালের অশ্রু সাগরে শোভা ডুবে যেতে থাকে, একা এবং একা।

মৃত্যুর পর বাবা-মায়ের সঙ্গে পাশাপাশি চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়া – এটি ছিল শোভার জীবনের শেষ ইচ্ছে। করোনা ভাইরাসের কারণে জীবনের শেষ ইচ্ছেটাও অপূর্ণ থেকে যেতে দেখে তার খুব খারাপ লাগে। মৃত্যুর আগে যেভাবে প্রচন্ড জ্বর এবং শ্বাস কষ্টের মাঝে একটু বাতাসের জন্য ছটফট করছিলো, তেমনিভাবে এখন শোভার আত্মা ছটফট করছে বাবা-মায়ের পাশে শায়িত হওয়ার জন্য।

করোনা ভাইরাসের আধিপত্যের কাছে গোটা বিশ্বের ইতিহাস যেখানে বদলে যাওয়ার পথে, তখন শোভার শেষ ইচ্ছে যে আলোর মুখ না দেখবেনা, তা সে নিশ্চিত জেনে গেছে। ওর বুকের পাঁজর ভেদ করে  দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। রাগ হয় আনোয়ারের উপরে। কত অনুনয় করে বলেছে, বাইরে না যেতে। বুঝিয়ে বলেছে, এইসব অবরুদ্ধ দিন একদিন শেষ হবে, আলোর দিন বেশি দূরে নয়, সহসাই খুলে দেয়া হবে সমস্ত শৃঙ্খল। আনোয়ার শুনেনি কোন কথা। সে ডুবে ছিল অর্থ-বিত্তের মোহে। লকডাউন মানে নি। প্রতিদিন বাইরে গিয়েছে, অফিস করেছে। ভাইরাস নিয়ে ঘরে ফিরেছে। শোভা সংক্রমিত হয়েছে।

শোভার মনে প্রশ্ন জাগছে, তার অকাল প্রয়াণে কে দায়ী – করোনা ভাইরাস নাকি তার স্বামী?

আসলে, মানুষ-ই মানুষের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। স্বামীর লোভের বলি হলো স্ত্রী। শক্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী আনোয়ার, ছেলে পিয়াল বেঁচে গেলেও, দূর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণ শোভা বাঁচতে পারে নি করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে।

নিঃস্তব্ধতার বাহুতে চেপে রাত্রি গাঢ় হয় চুপসে যাওয়া সময়ের আঙিনায়। শোভার বুকের গহীন হতে দীর্ঘশ্বাস মিছিলের মত বেরিয়ে আসে। অন্তর্দাহ বেড়ে চলছে। আকাশের দিকে তাকায় শোভা। খানিক আগের উড়তে থাকা হালকা মেঘেরা ঘণ হয়ে আসে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি নামে।

এ কি শোভার দীর্ঘশ্বাস নাকি শুধুই বৃষ্টি! কে জানে!

শোভার তেষ্টা পায়। তবে এই তেষ্টা জলের জন্য নয়। ওর বুকজুড়ে অন্য তেষ্টা ভর করে। মন খারাপ হয়। শোভাকে যদি যথাসময়ে হাসপাতালে নেয়া হতো, ও যদি একটু মানসিক প্রশান্তি পেতো, তাহলে হয়তোবা এই করোনা সময়ের দুর্দিনে ও বেঁচে যেত৷ সারাজীবন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছে শোভা।

ওর আফসোস হয় আজ জীবন এবং সুস্থ সময়ের জন্য। স্বাভাবিক সময়ে প্রাণ বিয়োগ হলে বাবা-মায়ের পাশেই তো শেষ ইচ্ছানুসারে শায়িত হতে পারতো। ইচ্ছেটিও পূর্ণতা পেতো।

গভীর বেদনাবোধে নিমজ্জিত শোভা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আপনমনে আওড়াতে থাকে – একলা আসা একলা যাওয়া, মাঝখানের সময়টুকু শুধুই ভ্রম, মায়া।

কি তুচ্ছ এই মানবজীবন। অদেখা এক ভাইরাসের কাছে স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ মানুষ জাতি বন্দী হয়ে পড়েছে। অতি ক্ষুদ্র এক শক্তির কাছে তারা অসহায়। তবুও তাঁদের দম্ভের শেষ নেই।

রাতের নিকষ কালো অন্ধকার আস্তে আস্তে হালকা হয়ে আসছে। অন্ধকারের পাহাড় ডিঙিয়ে আলোর রেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। শোভা মুগ্ধ হয়ে পৃথিবীর বদলে যাওয়া রুপ দেখছে। তার বিদায়ী মুহূর্ত খুব সন্নিকটে। বিদায়ের মুহূর্তটি খুব কষ্টের, ভারী লাগছে।

জীবনভর দুঃখ, অন্ধকার, অপূর্ণতা, যন্ত্রণা একা একা সয়ে যাওয়া শোভা কেন জানি বিদায়ের মুহূর্তে খুব ভেঙে পড়েছে। নিজেকে সামাল দিতে পারছে না। প্রচন্ড অসহায় বোধ করছে।

মায়া জিনিসটাই খারাপ। জীবন সবসময় নীরবে মায়ার খেলা খেলে যায়। জীবনে গড়ে উঠা সম্পর্কগুলো প্রয়োজন মেটাতে তৈরি হয়, সে প্রয়োজনকে মাকড়সার জালের মত বেঁধে রাখে মায়া।

প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়, পড়ে থাকে মায়া। পিয়াল মায়ের হাত ছাড়া খেতে চাইতো না, রাতে মায়ের হাতের আদর ছাড়া ঘুমাতো না, ঘরে ফিরেই মা মা বলে চিতকার করে গোটা বাড়ীতে হৈ চৈ ফেলে দিতো, মা কে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেতো।

একদিন পিয়াল ঘরে এসে দেখে মা বাথরুমে। ছেলের স্বভাব ঘরে ফিরেই মা কে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরা। ছেলের চিতকারে শোভা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে, ভেজা কাপড়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। পিয়ালের কাপড়চোপড় ভিজে যায়। এমতাবস্থায় মা- ছেলে একসঙ্গে হেসে উঠে। শোভার মনে পড়ে সে মধুর দৃশ্যের কথা। সম্ভবত মানুষ একমাত্র প্রাণী যাকে স্মৃতির ভারি বোঝা বয়ে বেড়াতে হয় সর্বদা।

মা পাগল পিয়াল গত চার দিন থেকে মা কে ছাড়া একা একা বাঁচতে শিখে গেছে। মানুষের শোকের আয়ু খুব অল্প হয়। শোক, দুঃখ মানুষ খুব লম্বা সময় ধরে বয়ে বেড়াতে পারে না। বেশি সময় ধরে দুঃখ বয়ে বেড়ালে মানুষ বেসামাল হয়ে উঠবে। পরিস্থিতির সঙ্গে বদলে যাওয়া, স্বাভাবিক হওয়া মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট।

জগতে কারো জন্য কিছু আটকে থাকে না। পিয়াল অঝোরে কাঁদছে বলে, বিদায়বেলায় শোভার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু শোভা জানে কিছুদিন পর পিয়াল ভুলে যাবে তাকে ; ঠিক যেমন করে মৃত্যুর কয়েক মাস পরে শোভা ভুলে গিয়েছিলো তার মা কে।

অন্য আরো অনেকের সঙ্গে শোভার মৃতদেহ ছুটছে অচেনা গোরস্থানের পথে। বুকে আগুন জ্বলে – ছোটবেলায় মায়ের মুখে এই কথাটি শুনেছিলো শোভা। তখন কথাটির অর্থ না বুঝলেও বড় হয়ে বুঝেছে। বাইরের আগুন দেখা যায়, বুকের আগুন দেখা যায় না। উনুনের আগুনের চেয়েও বুকের আগুন জ্বালায় বেশি। বুকের আগুনে জ্বলে মানুষ ছাই হয়ে যায়। জীবন নামক শৃংঙ্খল থেকে অবশেষে শোভা মুক্তি পেলেও, বাবা-মায়ের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে না পারার কষ্টে ওর বুকে আগুন জ্বলছে,  আত্মা শেষ বেলায় এসেও ছটফট করছে।

একটি জীবন পোড়ে, শুধুই পোড়ে
আকাশ মেঘ বৃষ্টি এবং ঝড়
ফুলছে নদী যেন তেপান্তর
চতুর্দিকে শীতল সর্বনাশে
পেয়েছে যাকে পায়নি কোনদিনও
একটি জীবন পোড়ে, কেবল পোড়ে
আর যেন তার কাজ ছিল না কোনো।

পৃথিবী যখন শোভাকে বলছে বিদায়…বিদায়…

তখন শোভার বুকের গহীনে ঝর্ণার মত শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটি করুণ সুরে বাজতে থাকে।

[প্রকাশকের নোট: অসম্পাদিত। লেখায় কোনো বানান ও ব্যাকরণ ভুল থাকলে পরবর্তীতে সম্পাদনা করা হতে পারে ]

পলি শাহীনা। গল্পকার। জন্ম বাংলাদেশ। বর্তমান নিবাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..