প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
পূর্ব-খাব
ঘুমাতে যাবার আগে সে কিছু একটা ভেবেছিল। বিছানায় যাবার পর অনেকবার চেষ্টা করেও মনে করতে পারেনি। তার বদলে বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল একটা নদী এবং তার বুকের উপরে ভেসে থাকা একটা মৃত চাঁদ। ক্যানভাসে মৃত চাঁদের মরা আলো মাথায় জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। এই হতাশায় ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে নিজেকে আবিষ্কার করে, কোন এক নদীর উপরে একটা চাঁদ হয়ে বসে আছে; ক্ষুধায় ক্লান্ত, তৃষ্ণায় কাতর। একটু পানির জন্য সে নদীর দিকে হাত বাড়ায় কিন্তু তার হাত সে একচুলও নাড়াতে পারে না। হাতটা পাথরের মত ভারী হয়ে আছে। তখন তার মনে পড়ে, সে একটা মৃত চাঁদ। ঐ নদীটার জন্য অপেক্ষা করতে করতে একদিন সে মরে গিয়েছিল। মৃত্যুর পরে ঐ নদীর উপর তাকে সমাহিত করা হয়।
উত্তর-খাব
বাসে করে দূরে কোথাও যাচ্ছিলো অনল হক। পরিচিত কেউ ছিল তার সাথে। ঠিক কে ছিল তা মনে পড়ছে না। মিহি মহাসড়ক। দেশের মহাসড়কগুলো বেশ চকচকে হয়ে উঠেছে। দারুন চালাচ্ছে ড্রাইভার। হেলেদুলে চমত্কার ছন্দে। অবলীলায় একের পর এক গাড়ি ওভারটেক করে যাচ্ছে। গতির কাছে কেউ পাত্তাই পাচ্ছে না। একেবারে রাস্তার রাজা! যাত্রীরা সবাই ভ্রমণানন্দ উপভোগ করছে। ছন্দের দোলায় গতিটা কেউ তেমন টের পাচ্ছে না। অধিকাংশই ঝিমুনির তালে ছন্দের দোলাটা নিচ্ছে। কেউ কেউ বাইরের গতিময় প্রকৃতি, গ্রাম, জনপদ, আকাশ, নদী, জলাশয় উপভোগ করছে।
অনল হক ড্রাইভারের ঠিক পাশের সিটে বসে গতি এবং ড্রাইভিং উপভোগ করছে। সামনে একটা লাল-সবুজ কাভার্ড ভ্যান, নিজেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, পেটের ভেতর ভারী মাল ঠাসা। কাভার্ডভ্যানটাকে ওভারটেক করতে যাচ্ছে। একই গতিতে। একই ছন্দে। ঠিক তখনই, বিপরীত দিক থেকে আরেকটা বাস ছুটে আসছে। নিশ্চিত সংঘর্ষ। মুহুর্তের সিদ্ধান্ত। অনল হক ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। কাভার্ডভ্যানের আড়ালে গিয়ে চোখ বন্ধ করে কান পেতে রইল। এক্ষুনি সংঘর্ষ হবে, প্রচন্ড ধাতব শব্দে। চোখ বন্ধ করেই দৃশ্যটা দেখলো- দুমড়ানো মুচড়ানো দু’টো বাস! মানুষের আর্তচিৎকার! রক্ত! রক্ত! রক্ত! কিন্তু সংঘর্ষ হল না। বদলে কষে ব্রেক চাপার শব্দ! টায়ারের লম্বা ঘর্ষণ ক্যাএএএচচচ্চ্চ্। মুহূর্তের নিরবতা। রাবার পোড়ার গন্ধ! এরপর অনেক মানুষের হৈ চৈ চিৎকার ভেসে এল। কাভার্ড ভ্যানটাও দাঁড়িয়ে পড়েছে। অনল হক এগিয়ে কাভার্ড ভ্যানটার সামনে গিয়ে ঘটনা বোঝার জন্য উঁকি দিল। দুটো বাস মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। একেবারে মুখোমুখি! মাঝখানে কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব। কেউ কাউকে স্পর্শ করেনি পরিস্কার। বিপরীত দিকের বাসের ড্রাইভার জানালা দিয়ে মুখ বের করে চিত্কার করে খিস্তি ছাড়লো। ওওই খাঙ্কিমাগীর পুত…। অনল হকের বাসটা একটু পিছিয়ে, ডানে কেটে আবার চলতে লাগল। যেন কিছুই হয়নি, একটা মামুলি ব্যাপার! মনে হচ্ছে, অনল হককে না নিয়েই চলে যাবে। তার ধারণা, সে কখন নেমেছে তা ওরা কেউ খেয়াল করতে পারেনি। এমনকি হেলপারও। অনল হক চিত্কার করে ডাকল হেলপারকে। ড্রাইভার গাড়ি থামাল। সে দৌড়ে গিয়ে উঠলো। গাড়ি আবার যথারীতি চলতে শুরু করেছে। ড্রাইভারের কোন বিকার নেই। সিটে গিয়ে বসলো অনল হক।
যাত্রিদের কেউ কেউ ড্রাইভারকে বকাঝকা করতে লাগলো। কড়া ব্রেকের শব্দ আর তীব্র ঝাঁকুনিতে ততক্ষণে সবার ঝিমুনি-ঘুমভাব কেটে গেছে। কেউ কেউ ঘুম ঘুম চোখে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে। ড্রাইভার নির্বিকার, গাড়ি চালাচ্ছে।
কিছু দুর যেতেই গাড়ির গতি কমে গেল। রাস্তার ডানে-বামে টলকাতে লাগলো। প্রথমে মনে হচ্ছিল ড্রাইভার মজা করছে। কিন্তু না, আসলে গাড়ির উপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই। এবার রাস্তার বাইরে নামিয়ে দিল। কোন রকমে উঠে এল সেখান থেকে। যাত্রিরা আতঙ্কিত কিন্তু চুপচাপ! গাড়ি এলোমেলো ভাবে চলছে। যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে, মারাত্মক কিছু। এবার রাস্তার পাশে একটা খেজুর গাছের সাথে প্রায় সংঘাত হতে হতে হল না। গাছের সাথে গাড়ির বডি ঘেষটে, কুইকুই আওয়াজ তুলে কাঁপতে কাঁপতে আবার রাস্তায় উঠল। এবার যাত্রিরা হৈ হৈ করে সবাই দাঁড়িয়ে গেল। সবাই গাড়ি থামাতে বলছে। ছোট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়িটা থেমে গেল, রাস্তার প্রায় মাঝখানে।
অনল হক ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো, কি হল আপনার, কি সমস্যা?
ড্রাইভার কিছু বললো না।
অনল হক আবার তাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি গাড়ি চালাতে পারবেন?
ড্রাইভার দু’দিকে মাথা নেড়ে জানলো, না, সে পারবে না।
যাত্রিরা সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তবু অনেকে নানান প্রশ্ন করে তাকে নাজেহাল করতে লাগলো। কিন্তু ড্রাইভার চুপ, কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছে না।
যাত্রিরাও সকলে তাজ্জব। কি হল লোকটার হঠাৎ করে! সারাপথ এত ভাল চালিয়ে, এখন কি হল! কেউ কেউ তার জন্য সহানুভূতিসুলভ ইশশ্-আশশ্ করল, তার সুস্থতা কামনা করল! বেচারা! কেউ কেউ মদারু মাতাল বলে গালি দিতে লাগলো। শুকরিয়া আদায় করল, নিরাপদে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে বলে।
কি আর করা! যাত্রিরা সবাই একে একে নেমে যেতে লাগল। শেষ গন্তব্যও অবশ্য আর বেশি দূরে নয়। অনল হকও নেমে যাচ্ছিলো। ড্রাইভার তাকে ডাক দিয়ে আস্তে করে বলল, ভাইজান, আমার মালিকির কাছে এটা ফোন কইরি আমার অবস্থাডা এটু কবেন? বলেই, হরহর করে ফোন নম্বর বলে গেল।
অনল হক তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে, নাম্বার টিপে ড্রাইভারের সাথে মিলিয়ে নিল।
মালিকের নাম আসলাম সিদ্দিকী। নামটা লিখে, নম্বরটা সেভ করে রাখলো অনল হক।
যেখানে নেমেছে সে জায়গাটাকে তার বেশ চেনা মনে হল। খুলনার কোনো একটা এলাকা। ফেরিঘাট। রূপসা ফেরিঘাট। কিন্তু নদীটা কোথায়? রূপসা? ঘোলা জল? দেখা গেল না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে অনল হকের। চারদিক কেমন কূয়াশা কূয়াশা, আলো-আঁধারি। আবছায়া! সবই দেখা যাচ্ছে আবার কিছুই দেখা যাচ্ছে না! বাসের সামনে রাস্তায় পড়ে আছে এক পঙ্গু ভিক্ষুক। জীর্ণ পোশাক। কাতর চোখে অনল হকের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা চাইলো। অনল হকের মনে হল, ভিক্ষা নয় অন্য কিছু চাইছে লোকটা। তার সামনে কোন ভিক্ষার থালা নেই, থলে নেই! অনল হক যখন বাসের দিকে ঘুরে তাকিয়ে পঙ্গু ভিক্ষুককে অতিক্রম করছিল। তখন সে দেখল, তার দিকে এগিয়ে আসছে বাসের হেলপার ছেলেটা। গায়ে একটা সাদা মত জামা। গলায় রংচটা গামছা। একহারা লম্বা গড়ন। চাপাবসা লম্বাটে মুখ। উস্কোখুস্কো তামাটে চুল। বখতিয়ার খলজির মত আজানু লম্বিত হাত। অনল হক ভাবল, সে কিছু বলতে চায়। কিন্তু না, একটা রহস্যময় হাসি ছুঁড়ে দিয়ে ঘুরে আবার গাড়িতে উঠে পড়লো।
অনল হকের কাঁধে কোন ব্যাগ ঝুলানো আছে কিনা মনে করতে পারছে না। মনে হচ্ছে ভারী একটা কিছু আছে। সে হাটছে একটু ঝুঁকে ঝুঁকে। রাস্তার দু’পাশে দোকানগুলো জংধরা, প্রাচীন। এটা কোন শহর? একটু আগেইতো মনে হচ্ছিল খুলনার রূপসা ফেরিঘাট। তবে কি ড্রাইভার তাদের কোন ভুল গন্তব্যে নিয়ে এসেছে? আশেপাশে কেউ নেই। মুহুর্তের মধ্যে সবাই কোথায় চলে গেল? আবছায়ার ভিতরে একা একা হাঁটছে অনল হক। আবছায়াটা উপভোগ্য। ঝাপ বন্ধ সারি সারি দোকান। ঝাপের টিনে তামাটে জং। ঘরে ঘরে তালা ঝুলে থাকতে দেখে তার হাসি পেল। জনমানবহীন শহরে কার জন্য, কে তালা লাগিয়েছে? মানুষ একটা আজব প্রাণী। সারাক্ষণ নিরাপত্তা নিরাপত্তা করে, উদ্বিগ্ন। অথচ মানব জীবনের নাই তিন সেকেন্ডের ভরসা! নিরাপত্তা তালায় নিজেই নিজেকে বন্দি করে। একটা দোকানের সাইনবোর্ডে বড় করে তালাচাবি আঁকানো। নিচে লেখা, আসলাম তালাঘর। তালাঘর! চাবিঘর নয়! সম্ভবত এই দোকানে তালা বিক্রি হয়।
তক্ষুনি অনল হকের ড্রাইভারের কথা মনে পড়ল। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে আসলাম সিদ্দিকী নামটা কন্টাক্ট লিস্টে খুঁজতে শুরু করলো। না, কন্টাক্ট লিস্টে নেই। তাহলে কি সেভ করা হয়নি? এরপর কললিস্ট চেক করলো। না, সেখানেও নেই। আবার খুঁজলো। না, নেই!
আসলাম সোডা নামে একটা নম্বর সেভ করা আছে। সে সোডা নামের একটা এনজিওতে কাজ করে। অনল হকের বন্ধু সোহেলের সহকর্মী। সোহেলের সুত্রে তার সাথে অনল হকের দু’একবার কথা হয়েছে। সে একটা অদ্ভুদ লোক। ভৈরবে তার বাড়ি। ভৈরবের আঞ্চলিক টানে ও টোনে কথা বলে। এনজিও’র কাজের ফাঁকে বকরী ঈদে সিজনাল চামড়ার ব্যবসা করে। তার মধ্যে একটা মুগ্ধ করার মত সারল্য আছে। কোন এক কুরবানী ঈদের পর, সোহেলের কোন একটা প্রয়োজনে, তার সাথে অনল হকের দেখা করতে হয়েছিল।
সময়টা ছিল সন্ধ্যা। তখন আসলাম সোডার চরম ব্যস্ত সময়। চামড়া কেনা। লবন মাখানো। চামড়া বেচা। দালালদের টাকা দেয়া। মহাজনের কাছ থেকে টাকা তোলা। সে বছর চামড়ার দর পড়ে গিয়েছিল। সে কম টাকায় অনেক বেশি চামড়া কিনতে পেরেছিল। ফলে লেনদেনও করতে হয়েছিল বেশি। তবু সে অনেকটা সময় অনল হকের সাথে চা-সিগারেট খেতে খেতে গল্প করেছিল। গল্পের অধিকাংশটা জুড়েই ছিল চামড়া। মাঝে মধ্যে একটু আধটু এ প্রসঙ্গ সে প্রসঙ্গ। অনল হক দারুন মজা পেয়েছিল তার সাথে আলাপচারিতায়। চামড়ার বাজার এবং ব্যবসা অনেক কিছু জানা হয়েছিল তার। ভাবছিল, পরের বছর থেকে চামড়ার ব্যবসা শুরু করবে। বেশ লাভজনক ব্যবসা। আসলাম সোডা তাকে বলেছিল, পৃথিবীতে আর কোন ব্যবসা করে এতো দ্রুত ধনী হওয়া সম্ভব না। উদাহরণ হিসেবে, সে কয়েকজন কোটিপতি চামড়া ব্যবসায়ীর নাম বলেছিল হরহর করে, যারা চামড়ার ব্যবসা করে জিরো থেকে হিরো হয়েছে। সাথে ফিসফিস করে যোগ করেছিল, বুঝছেন ভাইজান, এরাই চামড়ার জগতের আল্লা-খোদা। চামড়ার দর এরাই ঠিক কইরা দেয়। সহজ ব্যবসা, ভাইজান! নিজের কিছু পুঞ্জি আর মহাজনের লগে ভালো সম্পর্ক। ব্যস! এইবার ধুমায়া কামেইতে থাকেন।
আসলাম সোডা এখন কোথায় আছে? সেকি চামড়ার ব্যবসা করে জিরো থেকে হিরো হতে পেরেছে? সেকি এখন একটা লাল এলিয়ন গাড়িতে চড়ে, অন্ধকার গ্লাসের ভিতরে ঘুরে বেড়ায়? গ্লাস নামিয়ে অনল হকের মত লোকাল বাস থেকে নেমে আসা চেনা কাউকে ডেকে বলে, এই যে অনল হক বাই, আসেন, গাড়িত উডেন, কই যাবেন? লন নামায় দিয়াসি। আসলাম সোডাকে ফোন করার কোন ইচ্ছা হল না। আসলাম সিদ্দীকির নম্বরটা মনে করার চেষ্টা করাও বৃথা মনে হল।
হাঁটতে-হাঁটতে ভাবতে-ভাবতে অনল হক কোথায় চলে এসেছে তা সে টের পায়নি, খেয়ালও করেনি। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল, চারিদিক ফাঁকা। ঘরবাড়ি, মানুষজন, গাছপালা কিছুই নেই। ধূ ধূ মাঠ! এতো একটা জনমানবহীন প্রান্তর। এখানে কখন কিভাবে এলো? চারিদিকে বিরান মাঠ! ঘরবাড়ি নেই! বৃক্ষ নেই! ফসল নেই! সবুজ নেই! ধূসর! যতদূর চোখ যায়, ধূসর! এতো মরুভূমি! এটা কোন এলাকা? উত্তর বাংলার কিছু এলাকার দৃশ্য অনল হকের চোখে ভেসে উঠতে লাগলো। ডিমলা? ডোমার? বিরল? বোদা? সাপাহার? ধামুইরহাট? গোদাগাড়ি? না, কোথাও এরকম বিরান প্রান্তর দেখেনি।
ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ কিছু দালান-কোঠা চোখে পড়লো, দূরে। আরে! ওখানেতো অনেক মানুষ মনে হচ্ছে! অনেক মানুষের ভীড় দেখা যাচ্ছে। কি হচ্ছে ওখানে? মরীচিকা নয়তো? মরুভূমিতে বালির উপর রোদ পড়ে চিকচিক করে। দুর থেকে তা স্বচ্ছ জলের ঢেউয়ের মত মনে হয়। তৃষ্ণার্ত মানুষ সেই জলের দিকে ছুটে যায়। কাছে গিয়ে দেখে বালি। যত ছোটে তত তার তৃষ্ণা বাড়ে। যত তৃষ্ণা বাড়ে তত সে দুর্বল হয়। যত দুর্বল হয় তত বেশি মরীচিকা দেখে। মরীচিকার পিছে ছুটতে ছুটতে একসময় পিপাসায় বুক ফেটে মরে যায়। অনল হক ভাবতে থাকে, মরুভূমিতে মরীচিকায় বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। কিন্তু দালান এবং মানুষগুলোকে এতো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে, মরুভূমির মরীচিকার কাহিনীকে একটা হাস্যকর রূপকথার গল্প মনে হয়।
এগুতে লাগলো অনল হক। কিছুটা পথ যেতেই চোখে পড়লো, বিশাল এক এলাকা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাঁশের খুঁটির সাথে তিন লাইনে বাঁশ বাঁধা। দেখে মনে হচ্ছে, খুব শক্ত বেড়া। দুর্ভেদ্য। সে আরও এগিয়ে যায়। এবার চোখে পড়ে, বিশাল লম্বা লাইনে ঠাসাঠাসি করে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে যাত্রা-সার্কাস না’কি? এই বিরান প্রান্তরে যাত্রা-সার্কাস দেখতে এতো লোক? অবশ্য ইদানিংকালে যাত্রা-সার্কাসের প্যান্ডেল এরকম জনমানবহীন প্রান্তরেই হয়। মধ্যরাতে সেখানে হাজার মানুষের ঢল নামে, উত্তেজক গান আর তীব্র শীৎকারের সাথে অর্ধনগ্ন নাচের আসরে, কমপুঁজির জুয়ার দানে! কিন্তু লোকজনের ভাবগাম্ভীর্য দেখে অনল হকের যাত্রা-সার্কাসের চিন্তা উবে যায়। কিছু লোক লম্বা লাঠি হাতে লাইনের শৃঙ্খলা ঠিক করছে।
এবার পরিস্কার দেখা যায়, বেড়ার ভেতরে লক্ষ মানুষ কিলবিল করছে। সেদিক থেকে গম গম আওয়াজ ভেসে আসছে।
কে যেন অনল হকের কানে কানে বলে গেল, এইটা লীগের সমাবেশ। ক্ষমতায় আসার পর প্রথম সমাবেশ এইটা।
তাই না’কি! তাই না’কি! বলে কি? আমরা কেউ কিছু জানলাম না!
ঘটনা বোঝার জন্য অনল হক দ্রুত আরও সামনে এগিয়ে যায়। আর লাইনে দাঁড়ানো এরা কারা?
এরা সব মহালীগ। লীগে যোগ দিতে যাচ্ছে।
তাই নাকি! তাই নাকি!
লাইনের লোকগুলোর দিকে অনল হক নজর দিয়ে তাকায়। তেল-চর্বিওয়ালা নারী-পুরুষ সব। তাদের সুন্দর মোলায়েম ত্বক থেকে আভা ছড়াচ্ছে। থলথলে মাংসল দেহ। অনেককেই চেনা মনে হয়। সবাই মহালীগের নেতা। সাবেক মন্ত্রি, এমপিসহ অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। টিভিতে, পত্রিকায় প্রায়ই এদের চেহারা দেখা যেত। অনল হক অনেককেই চিনতে পারছে। লাইন ভেঙ্গে নাদুসনুদুস দু’জনকে বিশেষ তত্বাবধানে সামনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একজনের মুখে কয়েকদিনের না কামানো খোঁচাখোঁচা পাকা দাঁড়িগোফ। চোরের মত মাথা নিচু করে আড়চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর অভিনেতার মত মুচকি মুচকি হাসছে। আরে! এরাতো মহালীগের মন্ত্রী ছিল! বড় মন্ত্রি! একজনতো প্রায়ই বলতো, মহালীগকে ক্ষমতা থেকে নামাতে পারে এমন কোন শক্তি আর বাংলায় অবশিষ্ট নেই। এরাও লীগে যাচ্ছে!
অনল হক একটু এগিয়ে বাঁশের বেড়ার আরও কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ভিতরে মানুষ কিলবিল করছে। ভিতর থেকে যে গুঞ্জরণ ধ্বণিটা ভেসে আসছে সেটাকে কিন্তু ঠিক মানুষের গুঞ্জরণ মনে হচ্ছে না। অনল হকের সন্দেহ হয়। সে আরও ভাল করে তাকায় ভিড়ের দিকে। তাইতো! আরে! এরাতো অদ্ভুদর্শী প্রাণী সব! সবার গায়ে একইরকম আলখেল্লা ঝোলানো। আলখেল্লার দুই পাশ পাখির ডানার মত উঁচু। দেখে মনে হচ্ছে, চাইলেই ডানা মেলে উড়ে যেতে পারবে। অদ্ভুদ! আর সবাই কেমন ঝুঁকে ঝুঁকে হাটছে। যেন কেউ কাউকে দেখছে না। সকলে একই রকম টুপি পড়ে আছে। কারোরই মাথা এবং মুখ দেখা যাচ্ছে না। মাথা আছে বলেও মনে হচ্ছে না। এদের চলাফেরা ও আচরণ দেখেও মনে হচ্ছে এদের মাথা নাই। সবাই একইরকম ঝুঁকেঝুঁকে চলছে। একইরকম স্থুল গতি ও ছন্দ। চলছে তো চলছেই। একেবারে ঘটনাহীন চলাফেরা।
হাশরের ময়দানের কথা মনে পড়ে গেল অনল হকের। হাশরের ময়দানেও কি সব পাপীতাপী মানুষ এভাবে চলাফেরা করবে? হাশরের ময়দানে কি মানুষের মাথা থাকবে? কি বলা আছে ধর্মগ্রন্থে? শুধু ইয়া নফসি ইয়া নফসি করার জন্য মাথা থাকার কি দরকার! নিশ্চই থাকবে না। ধর্মগ্রন্থে ঠিক কি নির্দেশণা দেয়া আছে তা অবশ্য অনল হকের মনে পড়লো না।
তার প্রায় পাশেই দাঁড়ানো দু’জন লোক কিছু একটা বিষয় নিয়ে ভিষণ বিতর্কে লিপ্ত। দেখে মনে হচ্ছে, এরা অনেকক্ষণ ধরেই এখানে দাঁড়িয়ে বিতর্ক করছে। ওদের অঙ্গভঙ্গি বলছে, এটা একটা জানবাজি তর্ক। কেউ কাউকে ছাড়বে না। ভিষণ আক্রমণাত্মক। কি নিয়ে বিতর্ক করছে ওরা? অনল হক কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। মুলত দু’টো নামই দু’জনের মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে ঘুরেফিরে। দু’টো নামের ফাঁকে ফাঁকে অন্য কিছু নামও শোনা যাচ্ছে। একজন বলছে গান্ধি, আরেকজন বলছে জিন্নাহ। না, গান্ধি। না, জিন্নাহ। না, প্যাটেল। না, লিয়াকত? না, গান্ধি। না, সোহরাওর্দী। না, জিন্না এই চলছে। এই বিতর্কের অবসান হবে কেমন করে? কিন্তু দু’জনের চোখ একইদিকে নিবিষ্ট। অনল হকও সেদিকে তাকালো। ওটাতো একটা বিশাল মঞ্চ। সমাবেশের শেষের দিকে। বেশ দুরে। আবছা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। ধোয়াশা ধোয়াশা মঞ্চের উপর দাড়িয়ে কেউ একজন উত্তেজিত বক্তৃতা করছে। কে ঐ বক্তা? এই নিয়েই তারা তুমুল বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে।
অনল হক ভাল করে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করলো। কে লোকটা? না, চেনা যাচ্ছে না। একটা ছায়া মনে হচ্ছে। নেচে নেচে লাফিয়ে লাফিয়ে কিছু একটা বলছে। এখান থেকে তার কিছুই শোনা যাচ্ছে না। বিশাল মঞ্চের ফাঁকা পর্দায় একক পুতুল নাচ মনে হচ্ছে। ততক্ষনে দুই বিতার্কিক হাতাহাতি শুরু করেছে। কিন্তু মুখে অবিরাম চলছে, গান্ধি জিন্না, জিন্না গান্ধি, গান্ধি জিন্না, জিন্না, জিন্নাহ্. . . .।
তুমুল হাতাহাতি! কেউ তাদের থামাতে এগিয়ে আসছে না। দেখতে দেখতে তাদের ঘিরে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেলো। সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছে। হাতাহাতি ততক্ষণে কুস্তিতে পরিণত হয়েছে। দু’জনে জড়াজড়ি করে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। জড়ো হওয়া লোকজন মাঝে মাঝে হাততালি দিচ্ছে এবং একসাথে জিকির তুলছে, জিন্নাহ্! গান্ধি! গান্ধি! জিন্নাহ্! বলে। যে যখন উপরে থাকছে লোকজন তার নামেই জিকির তুলছে। জিকিরের রব শুনে বোঝা যাচ্ছে এই গান্ধি উপরেতো এই জিন্না। ভিড় থেকে ক্ষণে ক্ষণে সমস্বরে চিত্কার ভেসে আসছে। গান্ধি গান্ধি! জিন্না জিন্না। গান্ধি জিন্না। গান্ধি। জিন্না। জিন্নাহ্…
এসময় ভিড় ঢেলে একজন লোক আসরে ঢুকে পড়লো। তাকে ঢুকতে দেখে সবাই সমিহ নিয়ে সরে দাঁড়ালো। সামরিক পোশাক পরা বিরাট জওয়ান সে। কুস্তিরত দুই পালোয়ানের ঘাড় দুই হাতে চিপে ধরে দাঁড় করিয়ে বলল, দেখতো ওরা কারা? সবাই সেদিকে তাকালো। দেখা গেলো, একটি কাঁঠাল গাছের নিচে গুটিকয় ধাড়ি ছাগল নিবিষ্ট মনে খুঁটে খুঁটে কাঁঠাল পাতা খাচ্ছে। সবাই মুগ্ধ স্তম্ভিত! বিস্ময়াবিষ্ট নেত্রে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো বিশালদেহি লোকটির দিকে। সবাই কি অনল হকের মতই ভাবছে, লোকটি বীর না যাদুকর?
সবার যখন বিস্ময়ে ঠোঁট ঝুঁলে পড়েছে। তখনই তিনি তার সিংহের মত দেহ সিংহের মত চেহারা নিয়ে সিংহের মত হুংকার ছাড়লেন।
তাহলে, এই পেতে চাও তোমরা? কতগুলো ছাগল যাদের কাঁঠাল পাতা খাওয়াই উত্তম, তাদের কথায় তোমরা চলতে চাও? তাদের কথা মেনে নিতে চাও? মেনে নিতে চাওও? বলে, ব্যাপক একটা ধমক দেন সকলের উদ্দেশ্যে। সমস্বরে আওয়াজ উঠে, না না নাআআআ…। তাহলে লড়তে হবে। রক্ত দিতে প্রস্তুত হতে হবে। জয়ের আনন্দ আর আত্মবিশ্বাসে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। পরিপূর্ণ মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হবে। কার আছে হিম্মত? কে এই আনন্দ পেতে চাও? কে এই আত্মবিশ্বাসে ফুঁটতে চাও, নাচতে চাও, বাঁচতে চাও? সমস্বরে সকলে আওয়াজ তোলে, জয় হিন্দ। জঅঅয় হিন্দ।
লেফট্ রাইট লেফট্, লেফট্ রাইট লেফটৃ। হাতে হাতে রাইফেল। ছন্দে ছন্দে এগিয়ে চলেছে লেফট্ রাইট লেফট্, লেফট্ রাইট লেফট্। বিশাল বাহিনী পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। লাইনে লাইনে সৈন্য। হাতে হাতে রাইফেল-বেয়নেট। এই শব্দ অনল হককে উন্মাতাল করে তোলে। এখনি শত্রুর বুকে রাইফেল চালাতে ইচ্ছা করে। অনল হক তার রাইফেলের ট্রিগার টিপে ধরে। দ্রিম দ্রিম শব্দে চারদিক প্রকম্পিত হয়। কেউ একজন তাকে নিবৃত্ত করে। অনল হক এগিয়ে যায়, বুক টান। দৃঢ় পদক্ষেপ। এগিয়ে যায় বিশাল বাহিনীর সাথে। সামনে কমান্ডার।
অনল হকের সামনে শুধুই তার কমান্ডার। কমান্ডারের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে কেঁপে কেঁপে উঠছে ধরণী। কেঁপে উঠছে তার কোমরে ঝুলানো ছোট্ট সুন্দর চামড়ার চকচকে হোল্স্টার। পিস্তলের কালো হাতলটি বাইরে চকচক করছে উদ্ভিন্নযৌবনার পর্দাভেদী বক্ষের মত। কমান্ডার কোন কথা বলছেন না। তার দৃষ্টি সুদূরের দিকে। পদক্ষেপে সেই সুদূরকে জয় করার গতি, সেই দৃঢ়তা। প্রতি পদক্ষেপে অনল হকের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে সেই গতি, দৃঢ়তা। সে ভাবতে থাকে সামনে কমান্ডার থাকলে সে একাই বিশ্ব জয় করতে পারে। তখনি সে চারদিকে একটা শুনশান নিরবতা অনুভব করে। পিছন থেকে এতোক্ষন ধরে যে সম্মিলিত পদশব্দ উঠছিল, উঠছিল সম্মিলিত রণহুহুঙ্কার তা আর শোনা যায় না। মনে হয়, সে আর কমান্ডার ছাড়া এই কুচকাওয়াজে আর কেউ নেই।
অনল হক সন্দেহের চোখে ঘুরে তাকায় পিছনে। কেউ নেই, কিছু নেই। সে কমান্ডারের দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়ে। কমান্ডার হাসে। অদ্ভুদ হাসি। মনে হয় এরকম হাসির কাছে পৃথিবী নির্দ্বিধায় নতজানু হতে পারে। অনল হক সে হাসির প্রেমে পড়ে যায়।
একসময় কমান্ডার একটি বটবৃক্ষের নিচে এসে দাঁড়ায়। শীতল হাওয়ার পরশ বুলিয়ে তাদের অভ্যর্থণা জানায় বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষের তলে মনে হয়, আলো আছে, আলো নেই। যাদুকরী আলো-ছায়ার খেলা চলছে এখানে। এই খেলা ভালো লাগে অনল হকের। এই আলোছায়ার খেলার মধ্যেই অনল হক দেখে বটবৃক্ষের ছায়ায় একপাশে দু’টো ঘোড়া বাঁধা। একটা ধবধবে সাদা, একটা টকটকে লাল। লম্বা লেজে মোটা ঝাড়ুর মতো সিল্কি পশমগুলো চিকচিক করছে। লেজে অস্থিরতা। দুটো ঘোড়াই ছটফট করছে। এখনি ছোটার জন্য প্রস্তুত। এরকম তাজা তেজি ঘোড়া অনল হক আগে কখনও দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। কমান্ডার ঘোড়ার দিকে এগিয়ে যায়। বাঁধন খুলে সাদা ঘোড়াটার গায় হাত বুলিয়ে আদর করে। ঘোড়াটা মাথা নুইয়ে শরীর কুচকিয়ে চামড়ায় শিহরণ তুলে তুলে আদর নেয়। কমান্ডার একলাফে তার পিঠে চড়ে বসে। অনল হকও কমান্ডারের ঢঙ্গে লাফিয়ে চড়ে বসে লাল ঘোড়াটার পিঠে। লাগামে হালকা টোকা দিয়ে হাঁকিয়ে দেয় ঘোড়া।
কমান্ডারের সাদা ঘোড়ার পিছনে ছুটতে থাকে অনল হকের লাল পঙ্খিরাজ। সত্যিকারের পঙ্খিরাজ। মনে হয় উড়ে চলেছে সে। অনল হক কতদিন ঠিক এমন একটা ঘোড়া চেয়েছে! যার পিঠে চড়ে সে সবুজ প্রান্তর, বন-বাদার, পাহাড়-নদী-উপত্যকা, লোকালয়ে ঘুরে বেড়াবে। বিস্তীর্ণ প্রান্তরের অপরূপ সৌন্দর্য সে নয়ন ভরে দেখবে। প্রাণভরে উপভোগ করবে।
আজ অনল হক কমান্ডারের সাথে লোকালয়ের পর লোকালয় পাড়ি দিতে থাকে। পাড়ি দেয় সবুজ-ধূসর প্রান্তর। জনমানবহীন সুবিশাল সেসব প্রান্তর। পাড়ি দেয় অজস্র ছোট-বড় নদী-জলাশয়। কোনটার জল কাঁচের মত স্বচ্ছ, কোনটা ঘোলা, কোনটার রং পান্নার মত, কোনটা মুক্তা, কোনটা নীল ব্যথার মত, কোনটা পান্ডুর ম্লান, কোনটা কিশোরীর হাসির মতো উচ্ছল ফেনায় ফেনায় প্রবাহমান। গিরি-পাহাড়, উপত্যকা পাড়ি দিয়ে তারা একটি রানওয়েতে এসে থামে।
ভেজা স্যাঁত্স্যাতে দীর্ঘ রানওয়ে। চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো সাঁজোয়া যান। রাইফেল-বেয়নেট কাঁধে স্যাঁত্স্যাতে সৈনিক। প্রখর দৃষ্টি তাদের। গম্ভীর মুখ। একটি পিঁপড়াও তাদের দৃষ্টির ফাঁক গলে বেরুতে পারে না। তবু এই সৈনিকরাও যুদ্ধক্ষেত্রে অকাতরে প্রাণ দেয়, প্রাণ নেয়। পরাজয়ের গ্লানী নিয়ে অস্ত্র সমর্পণ করে। জয়ের উল্লাসে উন্মত্ত হয়।
লেফট্ রাইট লেফট্ রাইট লেফট্…। কমান্ডার এক বিরাট বিমানের সিড়ি বেয়ে তার পেটের দিকে উঠে যেতে থাকে। আর অনল হক একা হতে থাকে, একা হতে থাকে। কমান্ডার বিমানের দরজায় দাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসে। সেই অদ্ভুদ হাসি। অনল হকের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যেতে থাকে। বিমানের দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ে একটা ধবধবে সাদা কবুতরের ডানার মতো। কমান্ডার বিমানের পেটে হারিয়ে যায়। অনল হক আর কিছু ভাবতে পারে না। তার চোখের সামনে তখন আগুন। আগুনের লেলিহান শিখা। তার ঘর পুড়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে লকলকে লাউয়ের ডগা, পুঁইয়ের মাচা, উঠানের লালশাক, ডাটা শাক, ঢেঁড়সের ঝাড়, মরিচের ফুল। অনল হক তার মাকে খোঁজে তার বাবাকে খোঁজে। কেউ নেই! কোথাও কেউ নেই!
কাশবনের ঝোঁপে তার মাকে আবিস্কার করে। ভয়ে সাদা হয়ে যাওয়া মা তার দিকে তাকিয়ে, হাসে না কাঁদে? অনল হক নিশ্চিত হতে পারে না। তখনই তার বাবা এসে তার পাশে দাঁড়ায়। তার কাঁধে হাত রাখে। আস্থার হাত। যে আস্থা নিয়ে বনগাঁয়ের বন পরিস্কার করেছিল অনল হক আর তার বাবা। বিষাক্ত সাপ-পোকা-জোঁকের ঝাঁড়, বাঘ-ভাল্লুকের আস্তানা ভেঙ্গে গড়েছিল নতুন বসতি। তার মাও বসে থাকেনি ঘরে, যোগ দিয়েছিল তাদের সাথে সমানে সমান কাস্তে কোঁদাল হাতে। এই লড়াই জেতা বসতি, এই মমতার আশ্রয় ছেড়ে যেতে হবে। এদেশ না’কি এখন হিন্দুর দেশ। এদেশ ছেড়ে তাদের পালাতে হবে। চলে যেতে হবে যেখানে মুসলমানের দেশ আছে।
নৌকায় তার মা, তার বাবা, তার বৃদ্ধ দাদা-দাদী। চারিদিকে অভাব, ভীষণ অভাবের কাল। থৈ থৈ জল দশদিগন্তে। কাজ নেই, ভাত নেই। গোমতির পাড়ে কেউ কারো দিকে চোখ তুলে তাকায় না। ঘরের মায়া তখন ক্ষুধার কাছে পরাজিত। একদিন সবাই নৌকায় চড়ে বসে। এই মরার দেশে আর নয়। নৌকায় রান্না, নৌকায় খাওয়া। নৌকা চলে। কোথায় চলে, তা কেউ জানে না। গন্তব্য অজানা। শুধু একটা খবর তারা জানে। উজানে অনেক উর্বর জমি আছে। চাষ করলে সোনা ফলে। নৌকা চলে, চারিদিকে শুধু জল আর জল। কোন নদী থেকে তারা কোন নদীতে এসে পড়ে, জানে না। একদিন নৌকায় জ্বালানী ফুরায়, খাদ্য ফুরায়। তবু নৌকা থামে না। বৈঠা কখনও তার বাবার হাতে কখনও তার দাদার।
আজ তার বাবা নৌকায় বসে সেইসব ঘরছাড়া দিনের গল্প করে। একটা বিরাট নদী থেকে যখন ছোট একটা নদীতে তারা ঢুকে পড়ে। তখনই তার দাদার পেটে ব্যথা উঠে। ব্যথায় ছটফট করতে থাকে। পেটের ব্যথা। পেটের ব্যথা। ভীষণ ব্যথা। এইতো সামনেই কোন উজান দেশে নৌকা থামবে। মাঠের পর মাঠ জুড়ে সোনালী ফসল ফলবে। হরিবাবুর গোলার মত অনেকগুলো গোলা ভরা ধান হবে। দলে দলে কিষান এসে তার ক্ষেতে কাজ করবে। তাদের জন্য ভাত-মাছ-মাংস-ডাল রান্না হবে। পেট পুরে খেয়ে তারা অনল হকের বাবার নামে প্রশংসা করতে করতে বাড়ি ফিরে যাবে। হাড়কিপটে হরিবাবুর মত একপেটা খেতে দিয়ে কিষানের অভিশাপ নেবে না। অন্নের অভাবে তাদের আর কোনদিন ক্ষুধার যন্ত্রনায় পেটে ব্যথা হবে না। কিন্তু অনল হকের দাদা চোখ উল্টিয়ে নিস্তেজ হয়ে যায়। পিতাকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে অনল হকের বাবা চোখের জলে বুক ভাসাতে ভাসাতে বৈঠা মারে। আরো জোরে বৈঠা মারে। উজানের নৌকায় তবু তেমন গতি আসে না।
ভাটির দেশে আর যাবে না অনল হকের বাবা, এই তার শপথ। এক কাপড়ে তার মা নৌকায় উঠে বসে। বনগাঁয়ের স্বপ্ন, পড়ে থাকে বনগাঁয়। পাঁচ বছরে তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসার পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। কারা পোড়ায়? কেন পোড়ায়? তা সে জানে না। আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। অনল হকের ভাই বোনেরা উদাস নয়নে বসে থাকে নৌকার পাটাতনে। কেউ কোন কথা বলে না। সবাই যেন নিরবতার শপথ নিয়েছে। কেউ সে শপথ ভাঙছে না। শুধু নৌকার সাথে জলের ঢেউ এসে ছলাত ছলাত শব্দ তোলে। তার বাবা অবিরাম বৈঠা মারে। জলে বৈঠা মারার শব্দ হারিয়ে যায় ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দের ভিতর। তার মায়ের ফোঁপানির শব্দ শোনে শুধু জলের ঢেউ আর সন্তানদের রক্তের স্রোত।
উজানের দেশেই বুঝি অপেক্ষায় বসে আছে সেই দেশ। যেখানে তাদের ঘরে আর কেউ আসবে না আগুন দিতে। চিরশান্তির দেশ। মুসলমানের দেশ। কিন্তু কতদূরে সেই দেশ? কোথায়? নৌকার কোন যাত্রী জানে না তার খবর, তার ঠিকানা। উজান ঢেলে ঢেউয়ের সাথে ছলাৎছল ছলাৎছল ছলনার খেলা খেলতে খেলতে এগিয়ে যায় একটা ম্লান ডিঙ্গি নৌকা।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..