অনির কবিতা

জহিরুল ইসলাম অনি
কবিতা
অনির কবিতা

আমি নারী, অয়ি নারী;
দেবতা ও দেবী, নারী ও পুরুষ,
মানুষ অমানুষ, ও মহাপুরুষ,
মহা-বিশ্বের তারকার প্রাণ- গর্ভ’তে সঞ্চারী,
ঈশ্বরও যার মন বোঝে নাই- সে মন বুঝতে পারি।
আমি নারী, সেই- নারী।

আদিতেও আছি, শেষ ও মাঝে আছি।
সে সমাজে আছি, এ সমাজে আছি।
এখনো তোমাকে পূর্ণতা দিতে- আমাকেই প্রয়োজন,
আমি মানবিক, আমি মানসিক,
রূঢ় সময়ের জীবন রসিক,
আমি দশ দিক, আমি বৈদিক,
আধুনিকা আমি, অন্তর্যামী,
আমি- বুঝি প্রলোভন,
ভবিষ্যতের- ভ্রূণ বীজ নিয়ে- কে কতটা সনাতন।

আমি চক্রেশ্বরী।
কাল, মহাকাল, তিন কাল ভ্রমি গরুড়ের পিঠে- চড়ি,
আমার ইতিহাস- আমি এই কালে বই হাতে নিয়ে পড়ি।
‘নন্দিনী আমি, বন্দিনী আমি,
বিলাসিনী আমি, বিনোদিনী আমি,
আমি সেই শঙ্করী,
‘সুরবর-হর্ষিণি,
দুর্ধর-ধর্ষিণি,
দুর্মুখ-মর্ষিণি- হর্ষরতে’
চন্দ্রাসহোদরী- প্রকৃতির মেয়ে।
‘ত্রিভুবন-পোষিণী, শঙ্কর-তোষিণী,
কল্মষ-মোষিণি- শৈলসুতে’
আমি জানি- আমি কে।

আমি গান্ধারী,
মহাকালধারী,
নরকের ভয়- আমি আগে ছাড়ি,
গন্দম ফল জেনে বুঝে খাওয়া- আমি সে প্রথম হাওয়া।
আদমের চেয়ে ঢের আগে জেনো- আমার প্রজ্ঞা পাওয়া।
তাই ত্যাগ করি স্বর্গের লোভ,
পরোয়া করিনি স্রষ্টার ক্ষোভ,
সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকে-
নিজেকে রাখিনি- বেঁধে, ঢেকে রেখে,
দেবতার পাশে দেবী হয়ে সেই- বাকেরের আমি মুনা,
চিরকাল, আমি অধুনা।
আমি শিল্পের কাছে স্বর্গের মতো-
ধর্মের কাছে গুনাহ্‌।

আমিই ভবিষ্যৎ,
আমি কেটে দেই তোমার ভিতরে- সম্ভাবনার পথ।
তোমার এ অতীত, এ বর্তমান,
তুমিতো জানো না- এ আমারই দান,
বীজের আগামী- শুধু জানি আমি,
আমি যে- সে বীজতলা।
আমি রোহিণী, অজিতবলা।
প্রজ্ঞপ্তী- নামে সরোবরে হংস বাহনে চলা,
কংসধামের আমি- মহামায়া,
অমৃতা, দীপ্তা, আমি কালজায়া,
অসি, কুঠার আর চন্দ্রহাস ও দর্পণধারি নারী,
আমি দেবী- দুহিতারী।
আমাকে চেয়েছে রাজা- মহারাজা,
যুদ্ধে মরেছে কত শেহজাদা,
কত যে দেখেছি- ধ্বংস প্রাসাদ,
সাপে কিলবিল- নীল নিশানাথ,
গভীর বনের অন্ধকারে বাঘের চোখেতে রাত-
ঝলসাচ্ছিল অরণ্যচারী- শুক্লাতিথির চাঁদ।

আমি লাত-
আমি উজ্জা, মানাত;
মদন-মোহন-বিদ্যার হাত,
হেরা, হেস্তিয়া, আফ্রোদিতি,
শিবের শিবানী, আমি রাধাপতি,
মহেশ ভাবিনী, আমি ইন্দ্রাণী,
শমন-ত্রাসিনী, আমি রুদ্রাণী,
অরিষ্ট-নাশিনী,
হরা হররানী,
তুমি অতটুকু শব্দ শোনোনি- যা কিছু হয়েছি, জানি।
দেবতার আমি দুর্বলতা, আল্লার শয়তানি।
আমি কারো দাসী, কারো রাণী।

হিমাচলের আমি- সে পার্বতী,
বসুমতী আমি- ঋতুমতী আমি,
ভদ্রা, ও ভগবতী।
সূর্যের সাথে প্রেম ছিলো আর বিষ্ণুর সাথে রতি।
পুরুষদত্তা ভারতী,
ডান হাতে ধরি চক্র এবং বাম হাতে শতঘ্নী,
আমি না জায়া, না- ভগ্নী,
আমি দেবী চঞ্চলা।
দেবগণ ডাকে সুরেশ্বরী,
প্রিয়ঙ্করী, শিব-সহচরী,
কান্তিকরী- মন্দোদরী,
আমি সঙ্গিনী- শ্রী, ভাস্করী,
মালিনী, ঈশানী, শান্তা, বিমলা,
চৌষট্টির একেকটি কলা,
লুকিয়ে রেখেছি- হয়নি’কো বলা,
মানসী হয়ে যে সিংহে চলা,
ময়ূরবাহনে কাবেরী সুবেশী,
আসনেতে উৎপলা;
আমি, সেই দেবী- চঞ্চলা।

গীত লহরীতে আমি ছয় রাগ,
তাই বাঙময় পৃথিবী অবাক,
নটরাজ দেব কৈলাস ছেড়ে- হয়েছিলো শুনে ঋণী,
এই ঝুমুরের রিনিঝিনি।
নাগিনী ছিলো যে বাহন আমার,
পুরাণের সাত কাহন আমার,
কতকাল গেলো আরবি ঘোড়ায়- দিনে ও অন্ধকারে!
কতকাল আমি আগুন হয়েছি- মহাশ্মশানের ধারে।
পীনোন্নত যে- আমি পয়োধরা-
বোরকা হিজাবে ঢেকেঢুকে পরা,
মাথার উপরে আকাশের তারা, পায়ে সাহারার বালি,
আমি- সংহারকালী।

নারীর যতটা রূপ হতে পারে- আমি নারী তার সবই,
আমি কালী- ভৈরবী।
ভক্তকে দেই উৎকট ভীতি, অন্তে- রূপ ও শ্রী;
এই গুহ্যকালী কি বিশ্রী?
অমৃত নিঃসৃত রসে যে প্লাবিত বামহস্ততে ধৃত,
খুলির পাত্রে পান করেছি যে প্রেমিক হয়েছে মৃত,
নরমাংস বা মদ হাতে আমি- তবু দেবী স্বীকৃত,
বাংলাতে ভালো বুঝবে না সব, শিখোগে সংস্কৃত,
শিবের বুকেতে পা রেখে নগ্ন আমাকে দেখেনি যারা,
তারা জানবে কি কালী দেবী হয়- কীভাবে সালংকারা!
উন্নত এই স্তনযুগলেতে- মুণ্ডমালার হার,
এত খুলি! কার? কার?
অষ্টধা কালী- এই দেশে আরো জন্মানো দরকার।
সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়গ থাকবে হাতে,
ত্রিনয়নী কালী- দিগম্বরী, হেঁটে যাবো মাঝ রাতে।

আমার যোনিতে ডুব দিয়েছিলে- তুমি ও তোমার পিতা,
আমি, পতিতা- বারবনিতা।
হাজার বছর শয্যা করেছি- সহমরণের চিতা,
আমি- অমিতেরও হই- মিতা।
আমি দয়িতা- শুচিস্মিতা।

প্রীতি সংসারও করি-
আমি,
প্রাণ সংহারও করি-
ভুবনমোহিনী কখনো দু’হাতে ভল্ল কুঠারও ধরি।
আমি ভবানী ও ঈশ্বরী।
হতে জানি আমি- স্বামীর অহং,
বাউল বসন- গেরুয়ার রঙ,
বুকের মাংস দিয়ে শকুনের- মিটিয়েছি লোভ ক্ষুধা,
আমি হরিণী, কান্তা, সুধা।
কখনো অজিতা, সুরতারকা,
শ্যামা, মহাকালী, কালী বা কালিকা,
আমি নারায়ণী, ত্রিলোকতারিনী
দনুজদলনী, ত্রিলোকপালিনী,
কপালিনীদূগা, বিমুক্তকারিণী,
সৃজনকারিণী, আমি কপালিনী,
কালভয় নাশ, কালপ্রিয়া, রমা,
পরমাত্মিকা- আমি প্রিয়তমা,
আকাশের সব তারা দিয়ে আমি- পরেছি এ হার গলায়,
নরক অগ্নি পাথেয় হয়েছে- আঁধার- আকাশে- চলায়।
সাত বেহেস্ত- পায়ের তলায়।

আমি দেবী দশভুজা,
প্রেম, কাম, আমি – পূজা,
আমি মীনপরী অম্বুজা,

আমার- পদ্মে,
কমলে- দু’পা,
আমি সত্যা ও শতরূপা,
মেধারূপিণী বা কলঙ্কিনী –
সীতা বা বুদ্ধিরূপা,
কামের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আমি- রামকে করেছি ঋণী।

রাম জানে নাই- সে মর্ষকাম,
কামে থেকে আমি- কত নিষ্কাম,
রাম পেতো যদি- আমার সে কাম
যে কোনও নারীর বলো- কোনও নাম,
সে নারীর হাঁটে শ্রীরাম হতো- দশবার বিকিকিনি।
রাম- রাবণ আর লক্ষ্মণ আমি খুব ভালো করে চিনি।

আর,
আমি জানি- আমি কে।
কখনো রোষীনি, কখনো শোষিণি-
মিলনে তোষিণী, বিরহে দোষিণী-
ভালো-মন্দের অংক কষিনি- এই প্রকৃতির মেয়ে।

দিতিসুত- দুর্মদ- সিংধুসুতে।
আমি জানি, আমি কে!

বাউল, কিষাণী, গেরামের বধূ, আমি সে শ্যামের সুর,
আমি, কাঙ্ক্ষিত- কোহিনূর।
আমি সে মন্ত্র, আমি সে সাধনা,
ভেল্কি- টোনা যাদুর।
আমি লালনের ঘরে- একসাথে থাকা-
লক্ষ যোজন দূর।

আমি রাধা, আমি নারী,
সেই আমি দেখো- প্রীতিলতা হই, হতে পারি- মাতাহারি,
বুকে যুদ্ধের আহাজারি।

আমি- সতী, আমি- রেবা,
আমি কুইন অফ- সেবা,
আমি সিন্ধু, সরস্বতী,
আমি ফসলের- জল দিতে জানি, জানি বন্যার ক্ষতি,
আমি, ব্রাত্যর মনে- জ্যোতি,
আমি, দ্বিমত ও সংস্থিতি,
আমি, বেহুলা, নেফারতিতি,

আমিই ধর্ম, আমিই কর্ম, আমিই সংস্কৃতি,
আমি, অসুরের মনে ভীতি।
পৃথিবীতে যত- মনের খেলায়, শেষমেশ আমি জিতি,
আমি নরম, গরম, মরম;
আমি চরম পরিস্থিতি।

আমি, শুকতারা, ভোর বেলা,
যেই রমণীকে- খেলা বলে চেনো- সেই আমি- ইসাবেলা।
ক্লিওপেট্রা যে সিজারের ছিলো,
কাদম্বরী যে চিঠি লিখেছিলো,
সে আমি- এখনো অমনি,
আমি সাঁওতাল- রমণী।

আজো প্রেমে পড়ি- তোমার জন্য,
বনলতা আমি, আমি লাবণ্য,
আমার গল্প- হিমালয় চুড়া জয় করে দিন দিন,
আমি- ওয়াসফিয়া নাজনিন।

আমি- সনাতন, আমিই- হিন্দু;
আমিই গঙ্গা, আমিই- সিন্ধু,
শ্বেতপদ্মতে পুষ্পোপশোভিতা,
বাল্মিকি থেকে অনির কবিতা,
আমাকেই গেছে লিখে,
শুধু, আমাকে পড়তে শিখে।

আমি ছাড়া আর কোনও নারী নেই,
যাকে ভালোবাসো, সেও আদিতেই-
আমারি অংশ, ভগ্নাংশ,
ছিটে ফোটা ভাগ দেই,
আমি যে নারীর কেন্দ্রে- বিন্দু, এটা জানে সব মেয়েই।
আমি তাদেরও-তো ইতিহাস,
যার মালঞ্চে রবীন্দ্রনাথও হতে চেয়েছিলো দাস,
জ্যাকের বাজিতে জিতে যাওয়া আমি- রোজ ডোওসন তাস,
ডুবে যাই আমি, ভেসে উঠি আমি – আবাস ব্রহ্মলোকে,
তুমিতো এসব শব্দ বোঝো না, তাইতো পড়িনি চোখে।
যা আগে ছিলাম, আজো তাই আছি,
যদিও ঝাপসা তবু কাছাকাছি,
বুকশেলফের পাশে গিয়ে দেখো- জমে আছে কত ধুলো,
ধরলে না তুমি, পড়লে না তুমি, কালের ধুলায় ছুলো।

তবু আছি আমি সুখী,
বিষ্ণুপ্রিয়া, পদ্মপ্রিয়া, আমি সে পদ্মমুখী,
আরো বহু নাম, সবই মনোলোভা,
বিভা, শুচী, শুভা, ব্যোমকেশী, প্রভা,
সমুদ্রতনয়া, পদ্মভবা,
বিল্বনিলয়া, হরিপ্রিয়া, জয়া
পদ্মনাভপ্রিয়া, ধর্মনিলয়া,
শ্রদ্ধা, পদ্মা, দিত্যা।
চন্দ্রবদনা, , চন্দ্রা, অনঘা,
কান্তা, অদিত্যা।
বুঝবে আমাকে এইসব নামে?
আমি বাস করি যে সর্বনামে?
স্বাহা, স্বাধা, দীপা, সুরভি, ধনদা,
ধন্যা, ক্ষীরোদা, করুণা, বরদা-
পদ্মালয়া, উদারঙ্গা,
ইন্দিরা, জয়প্রদা,
হরিদ্রা, বসুধা, পদ্মাক্ষীর,
সেই- আমি বসুপ্রদা।

এইটুকু নয়, এইটুকু নয়,
আরো আরো আরো আছে পরিচয়,
এক একটি নামের অর্থ বুঝতে- নিজেকে ভাঙতে হবে,
নারীকে- কিছুটা বুঝবে তবে।
এক একটি নামের অর্থ ধারণা-
আমি জানি তুমি করতে পারো না,
কীভাবে বুঝবে বলো?
মৃন্ময়ে যারা চিন্ময় দেখে- তাদের সাথে কি চলো?
এ ভাষা- কী ভাবে বুঝবে বলো?
গভীর- ব্যাপক- বহু ব্যাকরণ-
অনেক কাহিনী- অনেক কারণ-
প্রাণ কর্মতে মিল উৎসারণ-
তারপর হতো নাম,
আমার প্রতিটি নামের মধ্যে- কর্মেরই পরিণাম।

তাই জানি- আমি কে!
নাদ ব্রহ্ম বা ওঙ্কার ধ্বনি করেছিলো যেই মেয়ে,
আমি সেই- আমি- সে,
বাহন ময়ূর, সঙ্গী ব্রহ্মা, হাতে শঙ্খের—প্রতীক।
আনাড়ি নারীও এই লেখা পড়ে- নিজেকে শুধরে নিক।
সেও জেনে নিক- তার পরিচয়,
যতটুকু জানে- ততটুকু নয়,
নারী দেবী ছিলো- দেবতার ভয়,
সেও করেছিলো- মহাকাল জয়,
পৃথিবী দিয়েছে- মহা সম্মান,
পারো যদি খুঁজে- শোনো সামগান,
শ্যামা সংগীত, মহিষাসুরা,
যে নারী শোনেনি- সেও আধুরা,
যে নারী জানে না নিজের শক্তি- বেদ পুরাণের যুগে,
তারাই আজকে- পুরুষের কাছে- অসহায় হয়ে ভুগে।
আমি নারী- এই জগৎতারিণী,
পুরুষোত্তমে বিমলারুপিণী,
মহাগৌরী, সিদ্ধাদাত্রী,
জগৎচিন্তামনা ও ছাত্রী,
বিভূতি, সিদ্ধি, জ্ঞানের পাত্রী,
হিরন্ময়ী ও ব্রহ্মচারিণী,
মঙ্গলাদেবী, সুপ্রসন্না,
প্রকৃতির আমি প্রকৃত কন্যা।

আমি নারী- সেই নারী,
যে অসভ্যতাকে গর্ভে ধরেছি- কেটে দেবো তার নাড়ি,
বলবো বাছা’কে টা টা,
তোর এই উল্টো পায়েতে হাঁটা,
‘পুরুষতন্ত্র’ গুহ্যকালীর- হওগে বলির পাঁঠা।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ