অনুতাপ

ইমেল নাঈম
কবিতা
Bengali
অনুতাপ

অনুতাপ

প্রহসনগুলো বিমূর্ত আবরণে সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখগুলো ঝাপসা হয় ক্রমশ। ঘটনা বিবরণ ফিকে হয়ে বিবর্ণ। স্মৃতির দরজা আটকে যায়— দুঃস্বপ্ন রোজ তাড়া করে ফেরে আমাকে। প্রেম এক প্রহসন। বিপদের আদি বিন্দুতে না দাঁড়ালে কেউ বলতে পারে না— কে কার… কতটা আপন? মূর্ছনা মুছে যাক, কেউ তো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।

শৈল্পিক ব্যথারা জাগ্রত হয় চন্দ্রাহত রাতে। নীরবতাকে আঁকড়ে ধরে সময়কে চাষাবাদ করি কিছু মৌন মুহূর্তে। অহেতুক শব্দ চাষে উড়িয়ে দিচ্ছি যাবতীয় শব্দভাণ্ডার। নিজের জন্য লিখছি না কোনো শব্দ। যাপিত জীবনে নেই কোনো ভূমিকা। ভ্রান্তি নিয়ে কাটছে। অবহেলায় কাটছে ভুলের মৌসুম। মুখবইতে লিপিবদ্ধ অজস্র বিলাপের ভিড়ে একা।

একাকিত্বে গিলে খাচ্ছে। ভাতঘুমের শেষে তারিখে উপভোগ করি অসহায়ত্ব। দরজা খুলে দেখে নিচ্ছি কাল্পনিক সব আয়োজন। উড্ডীন সময়ে উড়ে চলেছি— নির্বাক সময়ের হাতেখড়িতে কেটে যায় জীবন সুতো। ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো উড়ে যায় আকাশে। সেটিকেও লিখে রাখি কবিতায়— নিঃস্ব মানুষের চোখে লিখে নিচ্ছি জীবনের সকল অপঠিত কালো অধ্যায়।

করতলজুড়ে জ্বলছে—
হাতের ইশারায় ঝুলছে লাশ—
প্রেমিক নাকি আততায়ী এই প্রশ্নবাণে জর্জরিত কবি কিংবা কবিতা…

 

ইমেল নাঈম

নির্বিকার কিছু মুহূর্ত, মৌন অবস্থার ভাণ্ডার
গল্পে অচেনা অধ্যায়ের আঁকিবুঁকির শুরু
নীরবতার পোর্ট্রেটে প্রহসনসমেত
মুখগুলো খসে যায় ভালোবাসার অভ্যাসে

অধ্যায়গুলো অপঠিত, মুখটিও অচেনা
নামহীন, প্রকাশিত, অপ্রকাশিত সত্য
দুর্বোধ্য কিছু অংক সমীকরণ শেষে
হেসে ওঠে জীবনের ধারাপাত,

এখন আমাদের মৌনব্রত হবার বয়স
ভুলের প্রাচীর ধ্বংস করার সময়…
আত্মহননের মুহূর্তগুলো পালিয়ে যাচ্ছে
অবসাদগ্রস্ত জীবনকে ভাগ করি স্কেলে

প্রতিদিন মেপে দেখি মিটার,
মাত্রা ১.১ ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়
মাত্রা ২.৪ একাকীত্ব’র ১০৮ করছি শুধু
মাত্রা ৩.৫ অন্ধকার ভালোলাগে
মাত্রা ৪.২ শব্দ নেই, কথা নেই…

নিজের ভিতরটা ক্রমাগত পালিয়ে যাচ্ছে
আলোর বিপরীতে অন্ধকার আঁকড়ে ধরি
নির্ভেজাল মুহূর্তগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে
বকেয়ার পাতায় আরো একটি হিসাব জন্মে।

নিঃসঙ্গ ক্যারাভান

ভেসে আসে… নাফনদীর দুঃখ আঁকছে পাহাড়
সারি সারি মুখ পেরিয়ে আসে ঠিকানা
মুখরিত জীবনের প্রতিটি স্তর ডুবে যায়
ইশারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে নিজভূমে।

কল্পবিজ্ঞানের মতো আবেশ। ভেসে যায় নৌকা
সাম্রাজ্যহীন রাজার মতো মুখ— চোখ ঢাকে
কোনো সাড়া শব্দ নেই, প্রতীক্ষা নেই,
শরীর লিখে রাখছে জীবনের অন্ধ অধ্যায়।

বিজ্ঞান ভুল। ইতিহাসের প্রতি পাতায় শুধু রক্ত
পরাজয়কে কলঙ্কিত করছে অমোচনীয় কালিতে
রক্তক্ষয়ে কেটে যাচ্ছে স্বপ্নের গোপন চাষবাস
অপরিপক্ব মাটি লিখছে আঘাতের পর আঘাত।

ভাষাটুকু অচেনা থাকে, ভিজে যায় উর্বর জমিন
তীব্র ঝড়ে উড়ে যায় জীবনের সকল অধ্যায়
নীরবতা লিখে রাখছে ভুলের আদিম সমীকরণ
গুহাচিত্রে সভ্যতার প্রথম নিদর্শন হয়েও ম্রিয়মাণ…

পানিতে ভেসে আছে, দূরে ক্রমশই ঝাপসা
অনুভূতি নিয়ে ডুবে যাচ্ছে রঙিন নৌবহর
থামবার আগে শেষবার অংক মিলাই
ক্যারাভান গেছে
কতদূর— কতপথ
কতসময়— ব্যর্থতার দলিল নিয়ে

একদিন সূর্যাস্তের সাথে মিলে যাবে সব হিসাব
ক্যারাভান তখনো পৌঁছবে না তার গন্তব্যে।

 

অন্ধ, বধির রাষ্ট্রের গান

(উৎসর্গঃ মিঞা কবিতার কবিদের)

প্রতিদিন কবিতার মৃত্যু আঁকতো ছেলেগুলো
চোখ বুজলে অবচেতনে আসতো ডিটেনশন ক্যাম্প
তন্দ্রা ভাঙলে দেখতো সাজানো পৃথিবীতে
মিথ্যে মায়ার খেলায় ভেসে যায় চেনা মানুষ…

তারা লিখতো যাপিত জীবনের দুঃখবোধ
অপ্রাপ্তির খাতায় অমোচনীয় কালিতে লিখতো রাষ্ট্র
অধিকার শব্দটিকে বারবার ওভাররাইট করতো
কান্না লুকিয়ে হাসতো— অনিশ্চিত জীবনের
গ্রাফ এঁকে দেখাতো জীবন কচুরিপানার মতো
ভেসে যায় রাষ্ট্র’র গা ভেসে অচেনা পথে প্রান্তরে।

ডিটেনশন ক্যাম্প দেখতে কেমন— তারা জানে না,
কাল্পনিক কালিতে যাই লিখছে তাতেই ভীত রাষ্ট্র,
খাতাকলমে, বিশাল বিশাল বই ঘেঁটে
বের করে আনছেন, সেকশন, সাবসেকশন…
টুকে দিচ্ছেন আইনের মারপ্যাঁচের জটিল ঘেরাটোপ
অথচ ছেলেগুলো কবিতার মৃত্যু লিখতো রোজ

অভয় দিয়ে বলি— রাষ্ট্র, ভয় পাবেন না একদম—
কবিতা মৃত আমেরিকা, স্পেনে, মেক্সিকোতে
কবিতার ভাত নেই মধ্যপ্রাচ্যে, তৃতীয় বিশ্বে…
ছেলেগুলোকে নির্ভয়ে লিখতে দিন
তারা কথা বলুক, নিপীড়িত জনসমষ্টির
তারা আঁকুক আপনার মৃত্যু কবিতার খাতায়।

 

এবং নিরবধি

(উৎসর্গঃ অর্পিতা চ্যাটার্জী)

এভাবেও নিঃসঙ্গতার পথ পাড়ি দেওয়া যায়!
নিজের জন্য রাখো নি একফোঁটা মুহূর্ত
জীবনকে উড়িয়েছো রঙচটা আবেশে
সময়গুলো সাদাকালো, ফ্যাকাসে আলোয়
দেখে নিই পৃথিবীর অযুত রঙ

সঙগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়,
প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে দৌড়ে পালায়
মাইম শিল্পীর মতো স্ট্যাচু হয়ে
চোখ দিয়ে মেপে নিচ্ছে তোমাকে
আর, অজান্তে লিখছে মায়াকাব্য

ক্রমাগত শব্দগুলো উড়ে যাচ্ছে
এক শহর থেকে অন্য শহরে
নীরবতা ভাঙছে—
উড্ডীন সময় দেখছি—
ঘোর জাগানিয়া চোখ…

কেবল দৌড়ে চলে যায় সামনে
সমানে লুকোচুরি খেলায় ব্যস্ত
ভাঙাগড়ার খেলায় হারছে
নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে একদিন
হারিয়ে যাবে হরপ্পা সভ্যতায়

ইতিহাসও ক্লান্তিকর যাত্রায় লিখবে
প্রেম আর ভালোবাসার গোপন সূত্রগুলো।
অথচ, পাঠহীন, পাঠকহীন সময়
হা করে থাকবে সবটা গিলবার জন্য।

 

অচ্ছুৎ গল্প

মূর্ছনায় কেটে যায় নিযুত সময়
কাটাকুটিতে কাটছে ব্যস্ত জীবন,
ভুলের গলি পেরিয়ে দেখি ধানক্ষেত
জীবন কারাবন্দী পাখি—

মুক্ত আকাশ পর হতে হতে ক্লান্ত
সীমারেখা টেনে থেমে যায় নীল চোখ,
নদীপথ ধুঁকছে নাব্যতা হারিয়ে
বিভ্রান্ত জীবন ডাকে দূরের বিন্যাসে।

থেমে যাবার আগমুহূর্তের রূপকথা…
ব্যর্থ জানালায় প্রেমিকের শিস বাজে,
পাখিরা মৌনব্রত শেষে গেছে উড়ে
মায়াবী সময় কথার ফানুস যেন

দিকভ্রান্ত সময়ের সালতামামি আঁকছি।
নেশায় ব্যস্ত চোখ, সৌন্দর্য দেখে ক্লান্ত,
অবশিষ্ট থাকে দীর্ঘ ঘুমের ভূমিকা
নির্যাস শেষে অপেক্ষমাণ ঘুড়ি জীবন

ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি ক্ষত সময়ের প্রলেপ
নিজেকে আড়াল করছি দু’চোখের
নির্যাস সময় ব্যস্ত আত্ম কথোপকথনে
ছুটে যাওয়া সময়কে হাতড়ে ফিরি।

অথচ জীবন প্রবহমান নদী—
কেবল; পাড় ভাঙার কথা ভেসে আসে
জোয়ার ভাটার গল্পটি বড্ড অচ্ছুৎ।

ইমেল নাঈম। কবি। জন্ম ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬। বসবাস চট্টগ্রাম শহরের হালিশহরে। পড়াশোনা: বিবিএ, এমবিএ শেষ করে বর্তমানে সিএ পড়ছেন। তার পাশাপাশি কর্পোরেট জবও করছেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিনটি। প্রকাশিত বইঃ দেয়ালের ও'প্রান্ত পেরিয়ে (২০১৫, চৈতন্য প্রকাশনী), দূরবীন চোখ (২০১৮, চৈতন্য প্রকাশনী), সুদূরে শূন্যস্থান (২০১৯, স্বরচিহ্ন প্রকাশনী)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..