অন্যরকম ভারতে একদিন

সঞ্জীব নিয়োগী
মুক্তগদ্য
Bengali
অন্যরকম ভারতে একদিন

“পূর্ণিমার চাঁদ যেমন একটু একটু করে ক্ষয় হতে হতে মরে গেল, আমার ভাইয়ের কলিজাও রোজ একটু একটু খেয়ে আজ শেষ করে দিল বাবু ছেলেটাকে…” গ্যাব্রিয়েল মুর্মু খাটিয়ায় বসে আমাদের মুখোমুখি, সজনে গাছের ছায়ায়। তার চেয়ে দুই বছরের ছোট ভাই, বছর ত্রিশের টগবগে যুবক জবাহর মুর্মুর শবদেহ তখনও বাড়ির উঠোনে রাখা। মাটি দেবার প্রস্তুতি চলছে। এদিক ওদিক পাড়া প্রতিবেশীর জটলা।

গ্যাব্রিয়েলের বিবরণ থেকে যা বুঝলাম, জবাহর মুর্মু তুখোড় ফুটবল খেলোয়াড় ছিল। ওদের বাবা গত বছর মারা গেছেন। তাদের সৎ মা ‘ডাইনি’। একে একে সবাইকে খাবে। এর আগে গ্যাব্রিয়েলের মেয়েকে ‘খেয়েছে’। দুটো বাছুর আর কয়েকটা হাঁসও খাওয়া হয়ে গেছে ডাইনি মায়ের।

তাড়ির মরশুম শেষের মুখে, বৈশাখ পেরিয়ে জৈষ্ঠ ঢুকে গেছে, মাইকেল বললো, কাল রবিবার। আমরা সারাদিন সাইকেল চালিয়ে মর্জি মাফিক ঘুরব। প্রস্তাবটা মন্দ লাগেনি। ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ জেলার রাজমহল হিলস এর পাদদেশে যেসব গ্রাম, ঠিক হলো তারই কয়েকটা গ্রামে হবে আমাদের নিবিড় ভ্রমণ। আট দশ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে আমরা প্রথম এক গ্রামে থামি ও গ্যাব্রিয়েলের মুখোমুখি হই। আমার সাথে এদের কোনও পূর্বপরিচয় ছিল না। ফুটবল খেলার সূত্রে মাইকেলের সাথে জবাহরের নাকি ক্ষীণ একটা যোগাযোগ ছিল। জবাহরের শবদেহ সাক্ষী রেখে উঠোন সংলগ্ন তাল গাছ থেকে তাড়ির ‘লাবনী’ নামিয়ে, পরিজন ও প্রতিবেশীর উপস্থিতিকে সম্মান জানাতে সেই পানীয় পরিবেশন করা হলো।

গ্যাব্রিয়েলকে বিদায় জানিয়ে আমরা খুব তাড়াতাড়ি মালভূমির একেবারে কোল ঘেঁষা এক মায়াবী গ্রামে ঢুকে পড়লাম। মাইকেল তার একটা মিথ্যে পরিচয় আমাকে মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিল। আর রহস্যময় হেসে বলেছিল, গ্রামে গ্রামে ঘোরার সময় বিশেষত কোনও মেয়ের সামনে আমি যেন তার আসল পরিচয় ফাঁস না করি। তার মেয়ে বন্ধুর অফুরন্ত সংখ্যা অনেকের কাছেই ঈর্ষনীয় ছিল।

সারাটা সকাল খালি পেটে কাটিয়ে আমরা প্রথম এই গ্রামে কিছু খাবারের মুখ দেখতে পাই। সুন্দর আলপনা দেওয়া এক মাটির ঘরের বারান্দায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছি, এমন সময় ভেতর থেকে বছর ত্রিশের এক যুবক বেরিয়ে এসে আপ্যায়ন করলেন। নুন মাখানো ভুট্টা সেদ্ধ আর ঘরে বানানো মহুয়া। ভদ্রলোকের আগে থেকেই পানাহার চলছিল। কথায় কথায় জানা গেল, তার নাম কমলনাথ টুডু। তিনি বিহারের কোনও এক ব্লক অফিসের বিডিও। ছুটিতে বাড়ি এসেছেন। কাছাকাছি পোস্টিং হলে ভালো হয়, ওখানে খুব অসুবিধে আর মাফিয়া রাজ। আজ রাতে কালো মুরগি জবাই করা হবে ট্রান্সফারের কামনায়। গুনিন ওঝার কথা মতো আরও কিছু উপাচার রেডি করতে হয়েছে। আমরা যেন একটুও খাদ্য ফেলে না যাই। আজকের পবিত্র দিনে আমরা অজানা অতিথি যে আসলে যীশুর পাঠানো দেবদূত সেটা বুঝতে তার ভুল হয়নি মোটেও।

কমলনাথের সাথে করমর্দন করে সাইকেলে উঠতে যাব, দেখি সর্বনাশ! পেছনের চাকা পুরো বসে গেছে। গ্রামের শেষ প্রান্তে পাওয়া গেল ভুট্টো শর্মাকে। তিনি পেশায় কর্মকার। পাশাপাশি সাইকেল সারাইয়ের কাজও করেন। হাপর টানা থামিয়ে আমার সাইকেল নিয়ে বসলেন। জানতে চাইলাম, কাগজপত্রেও কি ভুট্টো নামটাই আছে? গামলার জলে টিউব ডুবিয়ে লিক পরীক্ষা করতে করতে বললেন, কাগজ বলতে ওই তো এক ভোটার লিস্ট বাবুসাহেব। জীবনে স্কুলের মুখ দেখিনি। বাপ মায়ের দেওয়া নাম সুনীল, সেটা আর নিজেরও মনে থাকে না। ওই যে বছর পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসি হলো, সেই বছরই নারায়ণ মাস্টার আমার এই নাম রাখলেন। দোষের মধ্যে কী, না আমি নাকি ছয় খান কোদাল আর দুখানা লাঙলের ফলা শান দেওয়ার বেশি মজুরি নিয়েছি তাই আমারও ফাঁসি হওয়া দরকার। সেই থেকে মুখে মুখে আমার ভুট্টো নামটা ছড়িয়ে গেল।

ভুট্টো শর্মা হাতের ইশারায় সামনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, আগে ওইখানে আমার ঘর ছিল সাহেব। দেখলাম, প্রায় একশো মিটার দূরে লতাগাছ আর জঙ্গলে ঢাকা একটা ভগ্নপ্রায় পাকা ঘরের কাঠামো দাঁড়িয়ে। জানলাম, আগে ওখানে ভালোই একটা বাসযোগ্য ঘরবাড়ি ছিল। কিন্তু আবাস যোজনার টাকায় ঠিকাদার এমন ঘর বানিয়ে দিল তাকে যে, এক বর্ষার জলেই দফারফা। ভয়ে আর সেখানে বাস করা হয়নি, যদি মাথায় ছাদ ভেঙে পড়ে!

পাহাড়ি রাস্তার দুপাশে শাল মহুয়ার জঙ্গল আর রুগ্ন এক ঝর্ণার পাশ কাটিয়ে মহুলপুর গ্রামের ভেতর ঢুকতেই দেখি রাস্তায় প্রায় পঞ্চাশ ষাট জন মানুষের জটলা। ভিড়ের মধ্যে থেকে মাঝবয়সী এক মহিলা এগিয়ে এসে মাইকেলের সাথে কথা বললেন। সাঁওতাল সমাজের রীতি অনুসারে তাদের মধ্যে অভিবাদন বিনিময় হলো। মহিলা এগিয়ে এসে আমার সাথেও পরিচিত হলেন। আমি একই রীতিতে তাকে অভিবাদন জানালাম ও তিনি তা গ্রহণ করলেন।

শূকর মাংসের বাসি তরকারি আর হাঁড়িয়া পরিবেশন করা হলো তেরেসা দিদির ঘরে। আমি শূকর খাইনা বলে পিতলের কলসিতে রাখা গুড় দিয়ে বানানো মহুয়া ফুলের নাড়ু নিয়ে এলেন। তার কাছে জানা গেল বাইরের জটলার নেপথ্য কাহিনি। মারাং সরেনের বউ প্রথম পোয়াতি। গ্রামের আর পাঁচটা পরিবারের মতো তাদের আর্থিক অবস্থাও অতি সাধারণ। গতকাল দুপুরে মারাং এর বউ মুরগির মাংস রান্না করে একবাটি মাংস নাকি লুকিয়ে রেখেছিল ধানের বস্তার ফাঁকে। “পোয়াতি মানুষের খিদে আর লোভ একটু বেশিই হয়”, তেরেসা দিদি হাতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলেন। মারাং এর মা কী ভাবে যেন বউ এর এই ‘চুরিবিদ্যা’ ধরে ফেলে আর সেই লুকিয়ে রাখা মাংসে ভয়ংকর কোনও বিষ মিশিয়ে দেয়। পুলিশ এসে বউয়ের মৃতদেহ আর মা বেটা কে তুলে নিয়ে গেছে একটু আগেই।

ঘটনাটা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। তেরেসা দিদির বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাইকেল জানতে চায় আমি সাইকেল চালানোর মতো অবস্থায় আছি কিনা। ওর সামনে একবার ট্রায়াল দিতে হয় আমাকে। বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে সে বলে, ওক্কে!

পশ্চিম দিকে রাজমহল হিলসের মাথায় সূর্য চলে এসেছে ততক্ষণে।

একটা ঢালু মতো পথরেখা বেয়ে আমরা নামছি। এখানে রাস্তা নেই। দুই তিন কিলোমিটার চলার পর রাজ্য সড়ক পাবো। যেসব প্রধান খাবারে আমরা অভ্যস্ত, তেমন কোনও মেইন মিল পাইনি আজ। কথাই ছিল, জল বা খাবার নিয়ে বেরোব না। মাইকেল হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘জল’ খাবই বা কেন!
হঠাৎ সামনে দুজন তরুণ। তাদের গায়ে দস্তুর মতো প্যান্ট শার্ট। একজনের হাতে তারের বাজনা ‘পেরেসাং’। অন্যজনের হাতে দিশি পিস্তল। আমাদের সমস্ত কিছু চেক করা হলো। বাজনা হাতে ছেলেটি আমাদের অবাক করে ইংরেজিতে জানতে চাইল, হোয়াট ডু ইউ ট্রাই টু কালেক্ট ফ্রম ইনোসেন্ট আদিবাসিজ? ডোন্ট ইউ লাভ টু লিভ এনি মোর? তারপর পিস্তল হাতে ধরা ছেলেটা হিন্দিতে যা বলে তার সারমর্ম হচ্ছে, গয়নার লোভ দেখিয়ে নির্বোধ মেয়ে চম্পাবহার পেট থেকে কথা বার করার মূল্য পুলিশকে দিতেই হবে। তোমাদের চেহারা বলে দিচ্ছে তোমরা পুলিশের লোক। …ভাগ্যিস আমরা পরিচয় পত্র সঙ্গে রাখি, তাই ওদের প্রকৃত সত্য বোঝানো অনেকটা সহজ হয়েছিল।

বাজনা আর পিস্তল থেকে দু তিনশো মিটার দূরে আসার পর হঠাৎ মনে পড়ে গেল কাছাকাছি একটা এনজিও আছে, ‘উদয়’। যেটা চালান এক প্রভাবশালী  নেতার  দূর সম্পর্কের আত্মীয় মরিয়ম এক্কা। আমার সাথে ভদ্রমহিলার চেনা জানা ছিল। মোটামুটি তিন কিলোমিটার মতো সাইকেল চালিয়ে মরিয়মের অফিসে গিয়ে দেখি সেখানে একটা কৃষক মিটিং চলছে। আমাকে দেখতে পেয়ে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললেন, ভালোই হয়েছে আপনি এসেছেন। অনেক টাকার একটা প্রজেক্ট পেয়েছি ‘জ্যট্রফা ক্যারকাস’ এর চাষ এই এলাকায় করার জন্য। আপনিও একটু কৃষকদের বোঝান। আমার ফ্যালফ্যালে মুখের দিকে চেয়ে বললেন, আরে ধুর কিচ্ছু না! প্লেন ভেরেন্ডা গাছ, ক্যাস্টর জানেন না? ক্যাস্টর অয়েল? খুব লাভজনক কৃষি। বলি, আমি তো সেরিকালচার বুঝি, তুতগাছ বুঝি। মরিয়ম বলেন, ওসব বাদ দিন তো। আপনি ভালো মোটিভেটর আমি জানি।

তারপর সভার মাঝে আমাদের বিশেষ মর্যাদায় বসানো হলো। কাঁসার পাত্রে জল এনে  পা ধুইয়ে আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেওয়া হলো। আমি লজ্জায় সঙ্কোচে মাটিতে মিশে যাচ্ছি। মরিয়ম বললেন আপত্তি করবেন না প্লিজ। আমার এত টাকার প্রজেক্ট, কৃষকরা না এগিয়ে এলে মাঠে মারা যাবে। এদের সামনে আপনার গুরুত্বটা বোঝাতে পারলে তবেই আপনার কথা মন দিয়ে শুনবে আর মানবে। আর হ্যাঁ, ভেরেন্ডা গাছ বলবেন না, ‘জ্যট্রফা’ বলবেন। যেন নতুন একটা ফাটাফাটি কিছু মনে হয়।

রাত্রে সেখানেই থাকা হলো। মিটিংয়ের পর কংগ্রেস টুডু নামে এক বৃদ্ধ অনেক রাত অব্দি আমাদের সাথে ছিলেন। যত দামি আর লাভজনক গাছ হোক না কেন ‘জ্যট্রফা’, তিনি ভুলেও তা নিজের জমিতে লাগাবেন না। নতুন চাষ তাঁর ধাতে সয় না। বছর পাঁচেক আগে বিডিও অফিসের এক বাবুর কথা শুনে ঘরের পাশের জমিতে নতুন জাতের বাঁশ লাগিয়েছিলেন। এক মাসের মধ্যে ফুটফুটে নাতনিটা মারা গেল। রোগ বালাই কিছুই ছিল না। আর ও পথে যাবেন না তিনি। সারাদিন পাহাড়ি পথে সাইকেল চালিয়ে আমার পায়ের তলায় কখন পাথরে সামান্য কেটে গেছে। তাই দেখে ওষুধ বলে দিলেন, রেল গাড়ির একটা টিকিট পুড়িয়ে সেই ছাই সর্ষে তেলে মিশিয়ে ক্ষতস্থানে লাগালেই ঠিক হয়ে যাবে। তিনি চলে যাবার আগে আমি তাঁর কানে কানে ‘জ্যট্রফার’ সাঁওতালি নামটা জানিয়ে দিই।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ