প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
রান্নাঘর থেকে যে কথাগুলো এতদূরেও ভেসে – না না ভেসে ঠিক নয়, উড়ে উড়ে আসছিল, সেগুলোকে আর যাই হোক স্বামী-স্ত্রীর প্রেমালাপ বলা চলে না কিছুতেই। আজকাল এই এক ব্যারাম হয়েছে সন্দীপনের। রাত্রে যত তাড়াতাড়িই শুতে যান না কেন ভোরবেলা বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারেন না। ওর স্থির বিশ্বাস একটু কম চীৎকার করলে বরুণাও শুনতে পাবেন – ওর শরীরের ভেতর থেকে কট কট,মট মট – নানা শব্দ জানান দিচ্ছে শরীরটা আর আগের মত বশে নেই। যদিও ঠিক বিছানা ছাড়ার আগে কেউ যদি গা – হাত – পা একটু ম্যাসাজ করে দিত তাহলে আর মটকা মেরে বিছানায় পড়ে থেকে থেকে কাতরাতে হত না। কিন্তু বরুণাকে বলতে গেলেই – আঃ মরণ! আদিখ্যেতা দেখ। বলি, কাল সারারাত আমি যখন বাতের টনটনানিতে চোখের জল ফেলছিলাম – তখন কেমন ঘাপটি মেরে শুয়ে ছিলে – কই তখন তো একবারের জন্যেও মনে হয়নি,আহা নিজের সাত পাকে ঘোরা বউটা কষ্ট পাচ্ছে, একটু কোমরটা ঘসে দি। তা কেন ভাববে? এর চেয়ে ছেলের বউ যদি কিছু বলত,একটু উঃ আঃ করত,তখনই তো লেউ লেউ করে ছুটে যেতে – কিছু বুঝিনা ভেবেছো? – সব আস্ত বজ্জাত এক একটা। বাবা বেঁচে থাকলে বলতাম – তোমরা দেখে যাও, কেমন লোকের গলায় আমাকে বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছো। এর চেয়ে একটা কলসি আর একটু দড়ি কেন কিনে দিলে না বাবা? আমি নয় খিড়কির পুকুরে এমনি গলায় বেঁধে ডুবে মরতাম! — তাহলে তো কবে আমি বেঁচে যেতাম। ইচ্ছে না থাকলেও কেমন করে যেন কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে গেল সন্দীপনের। গরম তেলের কড়াইতে ভেজা খুন্তির মত চড়াৎ ফেটে পড়ল বরুণা। তুমি আমার বাবাকে নিয়ে ঠাট্টা করছো! গুরুজনকে নিয়ে ঠাট্টা! দেখো, তোমার মহা পাপ হবে।
আজকাল মাঝেমাঝে এত বিরক্ত লাগে,একটা কথারও যদি সোজা সাপটা মানে করত বরুণা। মাথায় খুন চেপে যায় সন্দীপনের। মনে হয় হঠাৎ যদি পা পিছলে ওর কোমরটা ভাঙে,কিংবা বেশ একটু মচকে দ মত হয়ে যায় তবে অন্ততঃ কিছুদিনের জন্য রেহাই পান সন্দীপন। – না ঠিক এতটা ক্ষতি চান না বোধহয়। কিন্তু কিছু একটা না হলে আর পেরে ওঠা যাচ্ছে না। কদিন আগেই ভোরবেলা মর্ণিং ওয়াক সেরে ফিরছিলেন। পাশের বাড়ীর অল্পবয়েসী কাজের বৌটার সঙ্গে পথ চলতি হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ায় পরস্পর কুশল বিনিময়ে দুটো কথা হল।
– কাকু,ভাল আছো?
– হ্যাঁ তা একরকম আছি বাপু। তুমি ভাল আছ?
– হ্যাঁ, কাকু ভাল আছি।
– আজকে মেয়েকে আনোনি সঙ্গে?
– না কাকু,ওর ইস্কুলে আজ পরীক্ষা দিয়েছে। তাই আসার আগে মুড়ি চা খাইয়ে ইস্কুলে পাঠালাম।
– খুব ভাল করেছো। ভাল করে পড়াশোনা করলে পরে একদিন ঠিক নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। তবেই তো তোমাদের এই খাটাখাটনি সার্থক হবে।
–সবই ঠাকুর আর তোমাদের দয়া কাকু।
রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বরুণা সবই দেখলেন কিন্তু দুরত্বের কারণে ওদের কথাবার্তা প্রায় কিছুই শুনতে পেলেন না। এর কিছু পরে রোজকার মত বাজারে বেরোচ্ছিলেন সন্দীপন। ডালে ফোড়ন দিয়ে কাশির দমক সামলে রান্নাঘরের ভেতর থেকে গজগজ করতে করতে বরুণা বললেন – একেই বলে ভিমরতি,তাই বলি এত গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর কীসের। এরপর কোনদিন দেখব বাজারে গিয়ে বৈদ্যনাথ ভিটা – এক্স নিয়ে আসবে। সন্দীপন কিছু শুনলেন,কিছু আন্দাজ করলেন, মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে বাজারের পথ ধরলেন। আলু,পিঁয়াজ,আদা,কাঁচা লঙ্কা,ছোট মাছ,তরি তরকারি,নকুলদানা – এসবের পর একটু ওষুধের দোকান ঘুরে ফিরলেন। মুখে একটুকরো তাচ্ছিল্যের হাসি ধরে রেখে বরুণাকে বললেন – একটু ভাল করে চা বসাও তো। বাজারের ব্যাগটা রাখলাম,সময় মত দেখে যেখানকার যা সেখানে গুছিয়ে রেখো। তোমার তো আবার মাঝে সাজে ভুলে যাওয়া বাতিক। কাজ করতে করতে ঝটিতি মুখ তুলে তাকালেন বরুণা কিন্তু ততক্ষণে সন্দীপন ড্রয়িং রুমের পর্দার ওপারে।
বাইরের ঘরে সবে একটু খবরের কাগজটা মেলে ধরেছেন,বরুণা সবেগে ঢুকে এলেন। হাতে চায়ের কাপের বদলে একটা নীল সাদা বি – টেক্সের ডিবে।
– এটা কী? কার পাছায় ঘষবে বলে এনেছো?
– কেন তোমার লাগবে বলেই তো —
– চোপ,আমার ওসব নোংরা জিনিস লাগে না।
শিল্পী: রিয়া দাস
১.
– কেন,সকালে যখন বাজারে বেরোচ্ছিলাম তুমিই তো চীৎকার করে বললে – বাজার থেকে বৈদ্যনাথ,বি – টেক্স নিয়ে আসবে।
ভাবলাম চ্যবনপ্রাশটা ফুরিয়েছে আমার মনে ছিল না। তার সঙ্গে আবার পায়ে হাজা হয়েছে বোধহয়,কষ্ট পাচ্ছ। জল হাজা খুব খারাপ জিনিস,রোজ রাত্রে পা – টা শুকনো করে মুছে ঠিক শোওয়ার আগে আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে মাত্র তিন দিন লাগালেই সেরে যাবে।
– গুস্টির পিন্ডি শুনেছো। হবে না,তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে তবু বাড়ীর কাজের লোকেদের সঙ্গে যখন তখন গুজ গুজ ফুস ফুস। বলি কাজের লোকেদের সঙ্গে এত পীড়িৎ কীসের তোমার?
– এই,বাজে কথা বলো না। সাতসকালে বাজার সেরে এলাম,কোথায় একটু ভাল করে চা করে খাওয়াবে তা না আজে বাজে ঝগড়া করছো।
– ঝগড়া করছি কি সাধে,অনেক কিছু চোখে পড়ছে যে। এই রইল তোমার বি – টেক্স,নিজের যেখানে খুশি মেখে বসে থাক গে।
কথায় কথায় বুঝলেন সন্দীপন কোথাও একটা দারুণ গন্ডগোল হয়ে গেছে। অগত্যা মলমের ডিবেটা ড্রয়ারের ভেতরে রেখে আবার কাগজটা মেলে ধরলেন। বেশ জানেন একটু পরে হলেও ঠাকাস করে চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর নামিয়ে বরুণা বলবেন – নাও, গেলো। গিলে আমায় উদ্ধার করো। এই জন্যেই বরুণা ছাড়া অচল মানুষ সন্দীপন।
আজকাল খেতে বসেও মাঝেমধ্যে সন্দীপনের ঈষৎ নোয়াপাতি মার্কা ভুঁড়িটাকে খোঁটা দিতে ছাড়েন না বরুণা। সমস্যাটা নিয়ে মর্ণিং ওয়াকের পার্টনার দিব্যেন্দুর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন সন্দীপন। শেষমেশ ওরই পরামর্শে গিয়েছিলেন এক নাম করা নিউট্রিশানিস্ট কাম ডায়েটিশিয়ানের কাছে। ডাঃ পি খাস্তগির। বেশ ভিড় ওনার চেম্বারে। অল্প বয়েসী ঝকঝকে চেহারার এক লেডি রিশেপসনিষ্ট বাইরের ঘরে এক এক করে নাম ডাকছিল। কিছুক্ষণ পরে যখন ওনার পালা এল,যাকে বলে একেবারে দুরু দুরু বক্ষে চেম্বারের ভেতরে ঢুকলেন। মহিলা ডাক্তার। আগে নাম দেখে বা শুনে বোঝা যায় নি। প্রায় ৪৮ – ৪২ – ৫২ ফিগারের মহিলা ডাক্তারকে দেখেই সন্দীপন মোটামুটি হাঁফাতে লাগলেন। ডাক্তার লম্বা একটা মেজারিং টেপ নিয়ে সন্দীপনকে প্রায় লোফালুফি করতে করতে ওর শরীরের বিভিন্ন অংশের মাপ নিতে লাগলেন। চেস্ট – ৩৬, টাম্মি – ৪৬, বাটক – ৩৬। মুখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলেন – হাউ স্ট্রেঞ্জ,অ্যাট দিস এজ ইয়ু স্যুড বি কশাস্। দিস বালজ্ হ্যাজ টু বি রিমুভড্। ততক্ষণে মহিলার বিশালকায় চেহারার খাঁজে সন্দীপনের প্রায় খাবি খাওয়ার অবস্থা। একবার ভাবলেন কার্টুন নেটওয়ার্কে দেখা টম অ্যান্ড জেরির মত মহিলার যুগল ফাঁদ থেকে পিছলে পালান। কিন্তু পাছে আটকে গেলে হুলুস্থুল হয়ে যায় তাই সংযত হলেন। এরপর পাশের একটা বেডে শুইয়ে সন্দীপনকে মহিলা প্রায় দলামোচা করে বিভিন্ন ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ শেখাতে লাগলেন,সঙ্গে রানিং কমেন্ট্রি চলতে লাগল – কীভাবে নিয়ম করে প্রেশক্রিপশন মেনে বিভিন্ন ওষুধগুলো খেতে হবে তার নিদান। সন্দীপনের মনে হচ্ছিল–এখান থেকে একবার মুক্তি পেলে – বাবা, এই নাক কান মুলছি বেলতলার ধার আর মাড়াবো না। কী কুক্ষণেই যে দিব্যেন্দুকে বলতে গিয়েছিল কথাটা। তবে ওর থেকেও বেশি দোষ বরুণার,সন্দীপনের এই নোয়াপাতি মার্কা ভুঁড়ির জন্য ও – ই – তো খোঁটা দেয় সব চেয়ে বেশী। অবশ্য লোকের পেছনে টিকটিক করাটা বরুণার একরকম স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে বলা যায়। কারণ বরুণা শুধু যে ওর পেছনে টিকটিক করেন তাতো নয়,ঘরের ঠিকে কাজের মেয়েটাও জবাব দিল বলে। সারাদিন এটা ঠিক করে মাজা হয় নি,ওটা ভাল করে রাখা হয়নি থেকে শুরু করে আজ দেরি দেখে ভাবলাম আর বোধহয় তোর টিকিটি দেখতে পাব না ইত্যাদি। আজকালকার খুঁটে খাওয়া মেয়ে,জবাব তো ঠোঁটের ডগায় তৈরী করে ঘুরছে।
– তা দিদা বাসনগুলো সব জড়ো করে রেখে দিয়েছো যে,টিকি না দেখেই বুঝে গেলে, আমি আসছি? বাবা,তুমি এত ভাল হাত
গুণতে শিখলে কোথায় গো?
– থাম, ঢঙ করিস না। বেশি বকবক না করে কাজ শুরু কর এখনই।
– আহা,অত বকা ঝকার কী আছে? এই তো সবে এল,একটু গুছিয়ে নিতে দাও।
– অ্যাই,অ্যাই একদম মাথা গলাবে না বলে দিচ্ছি। ও যখন কাজে আসে না,তখন আমার কোন সতীন এসে বাসন – কোসনগুলো
মেজে দিয়ে যায় বল তো?
– ও তো না বলে কামাই খুব একটা করে না।
– আ,মলো যা,এ যে দেখছি মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি হয়ে গেল গো! বেছে বেছে সব কাজের মেয়েদের প্রতি বাড়তি যত্ন,এতো
ভাল লক্ষণ নয়।
– আঃ,কী যা তা বলছ?
– খুব খারাপ কিছু বলছি কি? আজকাল প্রায়ই ধান শুনতে কান শুনছো যে।
২.
প্রতিবাদের রাস্তায় গেলে এসব ঝগড়া থামবে তো না – ই উপরন্তু ক্রমশঃ বাড়বে মনে করে আপাতত চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের পরিচয় বলে ভাবলেন সন্দীপন। বরুণার গলাকে ভয় পায় না এ পাড়ায় সেরকম কেউ আছে বলে ওঁর অন্তত জানা নেই। তাছাড়া মাত্র তিন কামরার ছোট বাসা বাড়ী,একটু গলা তুললেই পাশাপাশি ঘর থেকে সব কিছু শোনা যাবে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সন্দীপন নিজের মনেই কোথায় যেন হারিয়ে যান।
ঘর মুছবার সময় কাজের মেয়ে শ্যামলীর সালোয়ারের ফাঁকা জমির আল বেয়ে ইচ্ছে পোকাটা গুটি গুটি পায়ে এগোতে থাকে। সন্দীপনের দুচোখ মেয়েটার বুকের বাম দিকে গভীর তিল ছুঁয়ে স্বপ্ন দেখে। একবার ধরা পড়ে যেতে শ্যামলী ফিসফিসে গলায় মৃদু ধমক দেয় – দাদু দুষ্টুমি করে না। দিদাকে বলে দেব কিন্তু।
– কই,কিছু না তো। এই বলনা,ওটা কি ট্যাটু করিয়েছিস?
– টাট্টু – সেটা আবার কী?
– দূর ছাই,বলনা সত্যি করে – ট্যাটু না তিল?
– তিল গো – তিল, জন্ম থেকেই আছে। কেন বিশ্বাস যাচ্ছে না?
– আমায় একবারটি একটু ভাল করে দেখতে দিবি?
– ধ্যাৎ, তুমি না একটা কী। আচ্ছা মানুষ বটে তুমি,এত বয়েস হল তবু দুষ্টুমিটা কমল নাগো!
– বিশ্বাস কর,আমি কিছু করব না,শুধু দেখব। আমাদের স্কুলে পড়ার সময় শোলে বইতে হেলেনের বুকের ওপরের চেয়েও বড় তিল
আমি জীবনে দেখিনি তাই একবারটি দেখতে চাইছি। তোর বুকের তিলটা বেশ বড় মনে হল — একবার দেখব শুধু, গড প্রমিস
বলছি,তোর গায়ে হাত দেব না,দেখে নিস।
– আর কাউকে বলে দেবে না বল?
– মা কালীর দিব্যি,কাউকে কোনদিন বলব না।
হঠাৎ কী মনে করে শ্যামলী সন্দীপনের খাটের কাছাকাছি চলে এসে মাথা নীচু করে একমনে খাটের নীচটা মুছতে থাকে। সন্দীপন চমকে উঠে বলেন – উফ, কী রিয়ালিস্টিক দেখতে রে! আমি ভেবেছি তুই বোধহয় ট্যাটু করিয়েছিস। ওখানে ছুঁচ ফোটালে খুব ব্যথা লাগে তো তাই ভাবলাম কী করে সহ্য করলি।
– তোমার মাথা,বললাম না,এটা আমার জন্ম তিল,ব্যথা কেন লাগবে?
হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে সন্দীপনের। নানা, এ পাপ হচ্ছে। শ্যামলী মেয়েটা আমার ছোট মেয়ের চেয়েও ছোট। ও যদি ভুল বোঝে দাদু বলে ডাকা মানুষটাকে? বরুণা জানতে পারলে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। জানালা দিয়ে তেরছা রোদের দিকে তাকিয়ে সন্দীপন আবার ডুব দেন পুরোনো দিনের ঘটনায়।
সন্দীপন পড়াশোনা করেছেন তখনকার দিনে জয়েন্টে সব চেয়ে কম নম্বর পাওয়া ছাত্র ভর্তি করা, এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। বাড়ী থেকে বহু দূরে সিনিয়ারদের তত্ত্বাবধানে প্রায় মাসাধিক কাল র্যাগিং সহ্য করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠার অঙ্গীকার নিয়ে বেড়ে ওঠা এক অর্থে চমপ্রদ বইকি। খচরামিতে তখনকার দিনে পি এইচ ডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত সেইসব সিনিয়ারদের সাহচর্যে সে এক অভাবনীয় সময়। সেসময় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরটার সঙ্গে বাঘের গুহার খুব একটা পার্থক্য ছিল বললে কেউ বিশ্বাস করবে না,উল্টে পাগলও ভাবতে পারে। মনে পড়ে যায় কলেজ হোস্টেলের দিনগুলোতে এক চুড়ান্ত উৎপটাং কাজ কারবার। একবার বিশ্বকর্মা পুজোর চাঁদা তুলতে বেরিয়ে ধুম গন্ডোগোল। আসলে তখন চূড়ান্ত বোহেমিয়ান জীবন। সকাল বিকেল সারাদিনই হস্টেলের কোন না কোন ঘরে ধুনকি চলছে।‘দম মারো দম’ থেকে শুরু করে ‘মহুয়াতে হয় না নেশা’ – র পাশাপাশি ‘ধরো হুইস্কি সোডা আর মুরগি মটন’ — সবই চলছে। সব কিছুতে নিজেদের দাপট দেখানোটাই দস্তুর। দাবীমতো চাঁদা না দিলে নানা রকম ব্যবস্থা করে মানুষকে জ্বালাতন করার মধ্যে একটা হিরো – ইজম কাজ করত। সেবার সামান্য কী একটা কারণে এই চাঁদা চাইতে গিয়ে এক বয়স্ক ডাক্তারের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল ওদের ব্যাচের। ব্যাস দাওয়াই বেরিয়ে এল কার একজনের মাথা থেকে। সেই রাত্রেই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ডাক্তারের বাড়ীতে গঁদের আঠা ভরা কন্ডোম ছুঁড়ে ভদ্রলোককে যথাযোগ্য শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন ওরা সবাই। সঙ্গে হুমকি চিরকুট ছিল ‘আজ রাত্রে আবার আসব কিন্তু’। শেষমেশ সেই ডাক্তার ভদ্রলোক একশ টাকা চাঁদা দিয়ে মামলার রফাসূত্র বার করেছিলেন।
নিজের মনেই একবার খুক খুক করে হেসে নেন সন্দীপন। মনে পড়ে যায় চাকরী জীবনের প্রথম দিকের কথাও। তখন ট্রেনিং পিরিয়ড চলছে। প্ল্যান্টে ঠিক সময়ে ঢুকে একবার ‘ইন – পাঞ্চ’ করে ফেলতে পারলে বেরোনোর সময় ‘আউট – পাঞ্চ’ করার জন্য অন্য কারও সাহায্য নেওয়া যায়। তো সে রকমই এক বি শিফটের ডিউটিতে হঠাৎ দুতিন জনের সঙ্গে ফিট হয়ে গেলেন
৩.
সন্দীপন – কী একটা দক্ষিণি বই দেখতেই হবে,ব্ল্যাকে টিকিট ‘চার কা ছে’- তে বুক করা হয়ে গেছে। মানিকদা,সিনিয়ার ফোরম্যান, হঠাৎ জেদ করে ওদেরকে দিলেন আটকে। একটা ব্রেক ডাউনের পুরো কাজ তুলে দিয়ে তার পর ছুটি পাওয়া যাবে। অর্থাৎ কেস পুরো কিচাইন। ‘মানিকদা সব করে দিয়ে যাচ্ছি,ট্রায়ালের আগে ফাইনালটা একটু চেকিং করে নেবেন’ — বলে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ তুলে দিয়ে সন্দীপনরা প্ল্যান্ট থেকে বেরিয়ে যান। এদিকে কিছু সময় পরে মানিকদা গুটি গুটি পায়ে শপ ফ্লোরে হাজির হলেন। খুঁত খুঁতে মানুষ,সব কিছু ভাল ভাবে চেক করতে গিয়ে হাতে এবং জামা কাপড়ের বিভিন্ন জায়গায় বেশ খানিক তেল – কালি – গ্রিস মাখলেন। কারণ যে টুল বক্সের থেকে যন্ত্রপাতি বার করলেন তার হ্যাণ্ডেলে ছিল এক খাবলা গ্রীস। ফলে হাতময় গ্রিস লাগল। শপের দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে গায়ের জামায় লেগে গেল হাওয়া ঠেসে লেগে থাকা গ্রীস। হাত ধোওয়ার সাবানে গ্রীস, মুখ মোছার টাওয়েলের উল্টোদিকে গ্রীস – মানিকদাকে তখন পুরো মেছো ভূতের মত লাগছে। সাহায্যের জন্য কাউকে যে ডাকবেন তাও পারছেন না। সন্দীপনদের কীর্তি কলাপ সব বুঝতে পারলেও কেউ তো আর কাছে বসে নেই যে দু – চার কথা বলে গায়ের ঝাল মেটাবেন। মনে মনে যত দূর সম্ভব ওদের মুন্ডুপাত করে ঐভাবেই আড়ালে আড়ালে মুখ লুকিয়ে বাড়ী ফিরলেন।
তো এ হেন ডাক সাইটে ঘোল খাওয়ানো মানুষ সন্দীপন,এখন খাবি খাচ্ছেন নিজের স্ত্রীর কাছে – একথা ভাবলেও লজ্জা করে। অগত্যা গুণ গুণ করে আপন মনেই গান গাইতে থাকেন সন্দীপন – এ ব্যথা, কী যে ব্যথা, বোঝে কি আনজনে,সজনী আমি বুঝি মরেছি মনে মনে…
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে,বাড়ীর ভেতর থেকে এখন আর কোন আওয়াজ নেই। অন্যান্য দিন এ সময় এক কাপ চা, সঙ্গে মুড়ি – বাদাম কিংবা এক পিস রয়াল সাইজের পেঁয়াজি অথবা মুসুর ডালের বড়া – কিছু না কিছু ঠিক হাজির হয়ে যায়। আজ সেরকম কোন খবর না পেয়ে খবরের কাগজটা পাশে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন সন্দীপন। ড্রয়িং রুম থেকে ডাইনিংয়ে ঢোকার পর্দা সরিয়ে এগোতেই প্রায় ধাক্কা খাচ্ছিলেন সন্দীপন। প্লেটে করে চারটি ডালের বড়া আর গরম চা নিয়ে এঘরে আসছিলেন বরুণা। সন্দীপন পাশ কাটিয়ে সামান্য এগিয়ে পেছন থেকে গলা বাড়িয়ে বরুণার বয়স্ক গালে চকাস্ করে একটা রয়াল সাইজের চুমু দিয়ে বললেন – তোমায় সামনে পেয়েও খুঁজে বেড়াই মনের চোরাগলি। – আঃ মরণ, ঢঙ দেখে বাঁচি না। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে,বুড়োর রস দেখ। তখনই জানতাম, পাড়ার যত কা – একটা গরম বড়া প্লেট থেকে তুলে বরুণার মুখে ঢুকিয়ে দিলেন সন্দীপন। বরুণা মাঝপথেই চুপ করে যান। এক অবাক চোখে পুরোনো হলেও নতুন মানুষটিকে দেখতে থাকেন বরুণা।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..