ঝরা শিউলি
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
মেয়েটা ঠিক আমার মতো জামা পরে আছে, হুবহু এক রকম। মেয়েটাকে চিনি, রোজই কলেজে আসা যাওয়ার পথে দেখি। মন্দ না দেখতে, বরং বেশ ভালো বলা চলে। গড়পড়তা বাঙালি মেয়েরা যেমন হয় তারচাইতে বেশি লম্বা। পাঁচ ফিট তিনের কম না বরং বেতসলতার মতো ছিপছিপে মিষ্টি একহারা গড়ন বলে বেশ একটা ঋজু ভাব আসে। দেহবল্লরীর গড়ন অমন হালকার সঙ্গে তার বুকের গড়ন ভারী নয় বলে লম্বাটে গড়নই চোখে পড়ে বেশি করে। মাজা মাজা গায়ের রঙ, গমের মতো। ঐ যাকে আজকাল পার্লারের দিদিমণিরা হুইটিশ বলেন। বাঙালির কাছে ফর্সাই লাগে আরকি, কালো মানুষের দেশে যেমন হয়।
মেয়েটাকে চিনি বলছি বটে কিন্তু আসলে চিনি না। মানে চিনি আবার চিনিও না। পরিচয় নাই, কিন্তু পথ চলতে দেখি রোজই। হয় গলির মোড়ে, কিংবা মুদির দোকানের সামনে নাহয় গার্লস স্কুলের সামনে, তাকে দিনের যেকোন সময়, সপ্তাহের যেকোন দিন দেখা যাবেই। সবসময়ই সে বেশ পরিপাটি সাজগোছ করে, লম্বা চুলে বেণী দোলে। কিন্তু সে ঠিক কী করে, তা আমি জানি না। কেন রোজ রোজ তাকে দেখি!? নাকি সেই আমাকে দেখে!? জানি না!
আমি ছিট কাপড় বা প্রিন্টের জামা কি সালোয়ার কামিজ পরি না। বরাবরই আমার পছন্দ সলিড কালার, এক রঙের পোশাক। তাতে থাকে নানান রকম সূঁচের কাজ, এপ্লিক কি ক্রোশে বা নিদেন কেনা চাইনিজ লেস। কেউ আমার মতো পোশাক পরে এতে সমস্যা নাই কিন্তু ভালো লাগে না আরকি।সবার রঙে রঙ মিলিয়ে চলতে পারিনা, ভালো লাগেনা। আমার উচ্চতা ভালো, মেয়ে হিসাবে যথেষ্ট রকম ভালো বলে আমার একটু অহংকার আছে৷ রক্তের সাথে একটু দূর প্রাচ্যের রক্ত আছে বলে গায়ের রঙ আর উচ্চতা দু’টোই বেশ নজরে পড়বার মতো ভালো।
এদেশের অপুষ্টিতে ভোগা অধিকাংশ নারী পুরুষের কাছে পাঁচ সাত তো যথেষ্ট রকম ভালো উচ্চতাই বটে, তাই আমি কনট্রাস্ট কালার পছন্দ করি। রঙের বৈপরীত্য নিয়ে খেলা চলে পোশাকে। সালোয়ার কামিজ ওড়না সব এক রঙের পরিনা, ট্রাউজার্সের উল্টো রঙের জুতো আর শার্ট মেলাতেই হয়। পরিনা মানে পরতে পারিনা। সব লাল পরলে মামারা খ্যাপান। বলেন লাল কুলি সাইজেছিস নাকি বুড়ি!কিরাম উৎপটাং নাইগছে তোক। তো সব সবুজ সবুজ মিলাতে গেলে বাবা বলেন, হাসপাতালে চাকরি নিবি বাপ্পু! সবুজ সবুজ গাছ সেজেছিস যে বড়!
বড় যন্ত্রণা।
কিন্তু এইযে রঙের সাথে রঙ মিলিয়ে জামা কাপড়ের সেট বানানো, নিজে মতো থাকতে চাওয়া এও তো দেখি কপি পেস্ট করছে মেয়েটা।হুবহু আমার মতো হবার চেষ্টা করছে! আবার জামার ইয়োকে আমার জামার মতোই ক্রোশের লেস বসানোর চেষ্টা করেছে! হরিবোল! বেশ কয়েকবার দেখেছি মেয়েটা মোটামুটি আমার বেশ কয়েকটা পোশাক কপি করেছে! আমি যেদিন যে রঙ পরে বেরোই সেদিন সেও সেই রকম রঙেরই পোশাক পরে আর তার ছাঁটকাট আমারই মতোন! আমার মতো পোশাক পরে সে নিজেকেই দেখায়, আমাকেই! কেন আমারই মতো সেজে আমাকেই দেখাতে আসে রোজ রোজ,নিজেকে! আমি কী তার আয়না!? আমার চোখে সে কী দেখতে চায়!? প্রশংসা? কেন তা দেখতে চায়? জানিনা তো!
কেন তার চোখ জ্বলে!? কেন তার চোখে শ্বাপদের চাউনি থাকে!? কেন তার ভঙ্গিতে অমন কালোকেউটের মতো হিসহিসানো অস্পষ্ট শব্দ আসে ভেসে? আমার শরীর অসার হয়ে আসতে চায়, তাকে এড়াতে চায়। আমি তো তাকে চিনিনা। সেকি তাকে চেনাতে চায়? কী চায় সে মেয়ে! কিসের প্রতিযোগিতা তার সাথে আমার, কেনোইবা!
মেয়েটার নাম শাহীন, শাহনাজ পারভীন শাহীন! আমাদের ঠিক উলটো দিকের বাড়িটায় ভাড়া থাকে তারা। দু’টো মাত্র রুমে চার ভাই বোন আর তাদের বাবা মা। বাবা একটা ছোট চাকরি করতেন, এখন পেনশন পান৷ ভাইয়েরা টুকটাক ছোট কাজ কর্ম করেন। এই বাজারে তেমন ভালো কিছু জোটাতে পারেন নাই! শাহীন, বেশি দূর পড়ার সুযোগ পায়নাই। টেনেটুনে এসএসসি পাস করেছে গ্রামের স্কুল থেকে। শাহীনদের গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর ডোমারে। এক দূর সম্পর্কের মামা আছেন সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। তিনিই কিছু অর্থ সাহায্য করেন এই দুস্হ পরিবারটিকে। তাতেই কোনক্রমে খেয়ে পড়ে চলে যায় শাহীনদের, আটকায় না। কিন্তু মেয়েটা আমার উপরে এরকম নাহক নজরদারি করছে কেন!!
শাহীনের গালে কামড়, চড়ের দাগ। গালের চামড়া ভেদ করে পাঁচ আঙুলের দাগ কেটে আবছা চাপ চাপ রক্ত জমে আছে। সারা গায়ে ব্যথা, কালশিটে। একদার কুলীন ব্রাহ্মণের খাতায় লেখা কোন এক স্ত্রীর মতো, সক্কাল বেলা শাহীনের বারান্দায় মেলে দেয়া রঙীন গামছা দেখে বাস্তবতা বোঝা যায়। ভেজা চুলের চাইতে ততোধিক ভেজা লাল চোখ বলে দেয় রাতে তার পাড় মাতাল জুয়ারি স্বামী মিঠু এসছিলো। শাহীনকে বিয়ে করেছে সে পাকেচক্রে, তাই তা গোপন রাখে। পরিবার জানে কিন্তু সমাজ না, তাই বিবাহিতা নারীর স্বীকৃতি নাই, নাই সম্মান বা মর্যাদাও। শাহীন জানেনা আদৌ মিঠু তাকে কখনো কোনদিন স্ত্রীর মর্যাদায় ঘরে তুলে নেবে কীনা।
মিঠুর পছন্দ যাকে সেই মেয়েটা শাহীনদের উল্টোদিকের ধবধবে সাদা বাড়িটাতে থাকে। ডাকসাইটে সুন্দরী, পাড়ার সব ছেলেদের মনপ্রাণ কেড়ে নেয়া সেই মেয়েটার বড় দেমাগ। কলেজে যায় আসে, তার বন্ধুদের সঙ্গে দেদার ঘুরাঘুরি করে কিন্তু পাড়ার কারু সঙ্গে সে মেশেনা বড় একটা। মিঠু তাদের বাসায় যায়, ফাই ফরমাস খাটে। একেকদিন তাদের বাজার সদাই করে দেয়। শাহীন দেখেছে, মেয়েটা মিঠুর সাথে হেসেহেসে কথা বলে, রগড় করে। শাহীনের বড় অপছন্দ মেয়েটাকে, মনে মনে ছিনাল বলে হাজারবার।
কেনো সে মিঠুর সাথে হেসে কথা বলতে আসে! মিঠু তার কে!? মিঠু কেবলই শাহীনের, শাহীন তার স্ত্রী। কথা কইবার, হেসে কথা কইবার অধিকার কেবলই শাহীনের। মেয়েটা শাহীনের জীবনটা বিষাক্ত করে দিলো! কেনো দিলো! কেনো সে শাহীনকেনশান্তিতে থাকতে দিতে চায়না! কেনো সে মিশুর সামনে সেজে আসে! নতুন পোশাক সে কেন রোজ পরে!
গতরাতে মিঠুকে বলেওছে মেয়েটার সম্পর্কে! অক্ষম ক্রোধে বলা যতো অকথার পরে, সারাগায়ে ব্যথা রয়ে গেছে গতরাতের বেদম মারের চিহ্ন হয়ে! শাহীন এর তার কাছে নিন্দা করে মেয়েটার, পড়শী বলে কথা! যতো রকম করে পারে অসতি আখ্যা দেওয়া যায় তা দেয়! তবু
শাহীন ঠিক ঠিক মেয়েটার মতো জামা পরে। মেয়েটার মতো সাজে আর সেই মেয়েটা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বহু বহু বহু দূরে। অথচ শাহীনের ঠিক উল্টো দিকের ধবধবে সাদা বাড়িটায় সে থাকে যেনোবা নিঃশ্বাসের দূরত্বে!
অপালা, প্রচন্ড অস্হির অদম্য রাগ শান্ত করতে ক্রিম ছাড়া ব্লাক কফি নিয়ে বসে নিজের বারান্দায়। এই বারান্দায় কেবলই অর্কিডের রাজত্ব। ডেন আর নাইট কুইন তাদের প্রাচুর্য মেলে ধরেছে। একটু লক্ষ্য করলে ছাতিমের ঘ্রাণে মাতাল সমীরের হদিশ মিলবে বটে কিন্তু অপালার তাতে রুচি নেই। রুচি নেই আদতে কফিতেও, মন স্হির না থাকলে বাইরের কোন বস্তুর রূপ রস গন্ধ স্বাদ তিতকুটে পাচনের চাইতেও তেতো। লবণ ছাড়া তরকারির মতোই বিস্বাদ। আকাশে শারদ পূর্ণিমার স্বর্ণাভ চাঁদ, অপালার উচ্চণ্ড রাগ তাকেও ম্লান করে দিলো!
কফি মগ রেখে কোলে ম্যাকবুক নিয়ে বসে অপালা, অতি অবশ্যই ঢুঁ মারতে থাকে একটা বিশেষ মানুষের প্রফাইলে। অপালার ভাষায় ছিনাল, অপালার তাকে বড় অপছন্দ। চেনেনা, পরিচয় নাই, জানেনা তাকে তবুও বড় তীব্র ঘৃণা! তার ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, পেইজ মায় কোথায় কোন কোন পত্রিকায় বা ওয়েবজিন কি নিউজ পোর্টালের সাহিত্য পাতায় বেরিয়েছে তার লেখা তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেরে আর নিস্ফল আক্রোশে হিসহিসিয়ে উঠে একাকী। ফেসবুকের প্রতিটি পোস্ট পড়ে খুঁটিয়ে, কে কখন কি মন্তব্য করেছে দেখে। কি ছবি, কেমন পোশাক কেমন সাজ দেখে আর দেখে!
প্রফাইলের মানুষটা একটা মেয়ে, হালকা পলকা ভারী হাসিখুশি এক মেয়ে। মেয়েটার বয়স যে কতো তা জানেনা অপালা, জানেনা ব্যক্তিগত কোন কথাই। কেবল জানে অপালার বিশেষ বন্ধুটি সেই মেয়েটির গুণগ্রাহী!
অপালা, ঠিক ঠিক মেয়েটার মতো করে সাজে এখন৷ ঠিক ঠিক তার মতোই চুলের সাজ করতে চায়। সেই মতো সাজতে হেয়ার এক্সটেনশন কেনে, কেনে লম্বাআআআআ মতো পরচুলাও। রোজ রোজ সেই মেয়েটাকে গালি দিয়ে পোস্ট দেয় ফেবুতে, ইসারায় বোঝাতে না পেরে কাছের বন্ধুদের কাছে কুৎসা রটায়। প্রত্যেকটা দিন সারাদিনের অসংখ্য ক্ষণ ঘন্টা প্রহর ব্যাপী মেয়েটাকে পড়ে অপালা। দেখে তার ভক্ত, অনুরক্ত, স্তাবকদের স্তব বন্দনা স্তুতি! খুঁজে খুঁজে বের করে একেকজন ভক্তকে, বন্ধুকে আত্মীয়কে। তারপরে প্রত্যেকটা মানুষের সাথে কথা বলে, দোষ খুঁজে!
মেয়েটা কেন টিপ পরে, কেন সে হাসে! মেয়েটা কেন অমন করে প্রকৃতির সাথে মিলে গিয়ে একাত্ম হয়, কেন সে ছবি তোলে এমন স্বতস্ফুর্ত! মেয়েটা কি সত্যি ফর্সা!? মেয়েটা কেন সাজে, কেন মেকাপ করে! দমে না দমেনা অপালা, দমেনা তার প্রশ্ন!
অপালার প্রশ্ন আরো শানিত হয় আরো তীব্র চোখে দেখে সে মেয়েটাকে। মেয়েটা কি ধর্মের! সেকী একা না কি বিবাহিতা? তার স্বামী কে, কই থাকে?বাচ্চা আছে? আদৌ কি আছে!? কেন বাচ্চা নাই?
প্রশ্নের বাণ ছোড়ে অপালা, প্রশ্নে প্রশ্নে মেয়েটাকে জর্জরিত করতে একটা দল গড়ে। একা এক নিস্ফল সাপের হিসহিস ঘৃণার বিষ থেকে জন্ম নেয় শত সহস্র অজস্র অগুন্তি হিসহিসানো বিষধর চন্দ্রবোড়া! নারী পুরুষের মতো চেহারা নিয়ে চলেফিরে বেড়ায় একদল বিষাক্ত, বিষধর সরীসৃপ।
প্রফাইল স্টকিং চলে, ডিফেমিং, সাইবার বুলিয়িঙ নামের কুৎসিত সমস্ত রকম কাণ্ড চলে। রাত দিন উচ্চন্ডা রাগের বিষ নিয়ে সাপেদের পরিচালিত করে অপালা!
মেয়েটা তবুও ঠিক তেমনি হাসে, তেমনি সাজে তেমনি কথা কয়। মেয়েটা ঠিক তেমনি থাকে, নিজের মতোই… শতভাগ!
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..