প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সুরমা তার বসার ঘরে এলেন। স্কুল থেকে প্রায় দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়েছেন। তাই রোজকার মত বাইরে যাবার কোন তাড়া নেই। তিনি ঘরের জানালাগুলো খুলে দিলেন। বাইরে থেকে স্নিগ্ধ হাওয়া আর ফুলের মিষ্টি ঘ্রান এসে ঘর ভরে গেল। সারাদিন বাড়ীতে থাকা হয়না বলে জানালাগুলোও তেমন খোলা হয়না। ঘরটা যেন গুমোট হয়ে ছিল।বাড়িটি পুরনো আমলের মত করে তৈরি হলেও জানালাগুলো বেশ বড় বড়। উত্তরমূখী বাড়ি। যদিও দক্ষীনমূখী বাড়িই সুরমা ও অচিন্ত দুজনেরই পছন্দের ছিল। কিন্তু বিকল্প ছিলনা। রাস্তাটি গিয়েছে বাড়ির উত্তর-পশ্চীম দিক দিয়ে। হয় পশ্চীম বা উত্তর যে কোন দিক বেছে নিত হোত। তাতে আরেকটি সুবিধা অবশ্য পাওয়া গেছে। বাড়ির দুই দিকে রাস্তা হওয়ায় বেশ একটু বারতি খোলামেলা ভাব রয়েছে। অন্তত পাশের বাড়িগুলো গায়ে গায়ে লেগে নেই। সুতরাং বাড়িটি উত্তরমুখো করে তৈরি করে উত্তর দিকেই বাড়ির গেট এবং সামনে একটু খোলামেলা জায়গা রেখে একটা বাগান করা হয়েছিল। অচিন্ত বাড়ির নাম দিয়েছিল”অন্তরা”। হাস্নাহেনা ,বেলী, রজনীগন্ধা আর গোলাপের সুবাস বাড়িটিকে যেন সারাক্ষন ঘিরে রাখে। এত বড় বাড়ি অথচ আজ থাকার কোন লোকজন নেই।
সুরমা পশ্চিমের দেয়াল ঘেঁষা কালো মেহগনি কাঠের বুককেসটার দিকে এগিয়ে গেলেন। অচিন্তর বই কালেকশন এর হবি ছিল। কত বই। সময়ের অভাবে আজকাল আর তেমন পড়াও হচ্ছেনা। সুরমা বইগুলোর উপর আলতো করে হাত বোলালেন কিছুক্ষন। শরৎচন্দ্র, রবীঠাকুর,নজরুল, বুদ্ধদেব, হুমায়ুন আজাদ, আলাউদ্দীন আল -আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক ,সুনীল , হুমায়ুন, ম্যাক্সিম গোর্কী,শেলী সবাই কত সহজেই জায়গা করে নিয়েছেন এই কাঠের বুককেসে। সুরমা বুদ্ধদেব বসুর ‘ তিথীডোর ‘ বইটা হাতে নিয়ে কয়েকটি পাতা উল্টালেন। গোটাগোটা অক্ষরে লেখা,” সুরমার জন্য ভালোবাসা” নীচে কিছুটা পেচানো অক্ষরে লেখা” অচিন্ত”। সুরমা চাপা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বইটি আবার যথাস্থানে রেখে দিলেন। তারপর বুককেসের উপরে রাখা কালফ্রেমে বাঁধানো ছবিটির দিকে অপলক চোখে অনেকক্ষন তাকিয়ে রইলেন। তার চোখ দুটি ধীরে ধীরে জলে ভরে উঠলো। এবং অজস্র ধারায় তা তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পরতে লাগলো। অজান্তেই বুক থেকে চাপা আরেকটি দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। আশ্চর্য! লোকটির বয়স নির্দিষ্ট একটি জায়গায় এসে যেন থেমে আছে। এখনও চুলগুলো কুচকুচে কালো। অথচ তার নিজের বয়স যেন হুঁ হুঁ করে বেড়ে যাচ্ছে। কানের দুপাশে,মাঝখানের সিঁথির দুইপাশ দিয়ে অজস্র সাদা চুল ঝলমল করছে।
বিনি সকাল থেকেই একটা ঝাডু হাতে নিয়ে বহুদিনের বন্ধ ঘরগুলোর দড়জা জানালা খুলে দিয়ে জমে থাকা ধূলোবালি ঝাড়পোচ শুরু করেছে। তার উৎসাহের কোন কমতি নেই মেহমান আসছে শুনে তার ভিতরে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। বিদেশী মেহমান বলে কথা। তারা সব আ্যামেরিকা, কানাডা, আর ইংল্যান্ড থেকে আসবে। সেই সাথে আসবে অনেক সুন্দর উপহারও।
মাসিমা, ও মাসিমা বেবীকে নিয়ে অপর্নাদি কোন ঘরে থাকবে? কিছু ভেবেছো? সেই ঘরটাতো একটু ভালো করে গুছাতে হবে। বেবীর জন্য বারতি জিনিষপত্র লাগবে….
কথা বলতে বলতে বিনি দরজা ঠেলে ভিতরে এলো। সুরমাকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে আবার ডাকলো,
মাসিমা…
সুরমার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরতে দেখে সে ভয় পেল।
মাসিমা , কী হয়েছে? কোন খারাপ খবর এসেছে?
প্রশ্ন করতে গিয়ে বিনির গলার স্বর কেঁপে গেল। কিছুটা ভয়ার্ত ভঙ্গিতে সে সুরমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সুরমা লজ্জিত হয়ে শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
কিছুই হয়নি বোকা মেয়ে। তোর মেশোর কথা হঠাৎ মনে হোল তাই…..
তারপর মৃদু হেসে, বসে যাওয়া গলাটা একটু পরিস্কার করে বললেন,
চল, আরতো বেশী সময় নেই, দুজনে মিলে সব গুছিয়ে ফেলি।
বিনি তার দশ বছর বয়সে এ বাড়িতে এসেছিল। তাও প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। সে কখনও সুরমাকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি। এখন সে পনের বছর বয়সের কিশোরী। তার মনে অদম্য কৌতুহল। মাসিমার পরনের রঙীন শাড়ি, সিঁথীর চওড়া সিঁদুর আর টিপ তাকে মাঝে মাঝে বিব্রত করে। মাসিমা কেন সিঁদুর আর শাঁখা পরেন? সে কী বিধবা না সধবা? মাছ মাংস সবই খান। মেসো কী তাহলে আজও বেঁচে আছেন? কোথায় আছেন? এসব নিয়ে এ বাড়িতে কেউ কখনো কোন কথা বলে না…..
বিনি তার দুই বেনী দুলিয়ে সুরমার পিছু পিছু শিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এলো। ছাদের দুটো ঘর আর নীচতলার তিনটে সবগুলো ঘর সারাদিন ঝাড়পোচ করার পর এতদিনের বন্ধ ঘরগুলো যেন ঝকঝকে তকতকে হয়ে উঠলো। জানালা দড়জা খুলে দেয়ায় বাইরের তাজা বাতাসে ঘর ভরে গেল। বিছানা বালিশে ধোঁয়া চাদর আর কভার লাগানো হোল। দরজা জানালায় পর্দা। বদ্ধ গুমোট গন্ধটা দূর করার জন্য সুরমা ল্যাভেন্ডার এয়ার ফ্রেসনার এনে স্প্রে করে দিলেন সবগুলো ঘরে। ফুলদানীতে রাখলেন বাগান থেকে তোলা কিছু তাজা ফুল। চারিদিকে তাকিয়ে তার মন ভালো হয়ে গেল। তার মনে হোল এইতো সেদিনও যেন ছেলেমেয়েগুলো এখানে ঘুরে বেড়াত। তাদের হাসি, উচ্চ স্বরে কথা বলা আর গানে বাড়িটি সব সময় মেতে থাকতো।
সুরমা চোখ বুঁজে যেন দেখতে পেলেন, অসীমা, অপর্না আর অনিমার মুখ। মেয়েদের নামগুলো অচিন্তর নামের সাথে মিলিয়ে রাখা। আর দুই ছেলের নাম তার নিজের নামের সাথে মিলিয়ে সুমিত আর সুকান্ত। অচিন্তর ব্যাংকের চাকরী আর তার নিজের স্কুলের চাকরীর টাকা জমিয়ে মিরপুরের এই পাঁচ কাঠা জায়গা কেনা হয়েছিল।
ছয়টি শোবার ঘর মিলিয়ে সাবেক আমলের মত এই দেড়তলা বাড়িটি কত জমজমাট ছিল একসময়ে। পাঁচ পাঁচটি ছেলেমেয়ে। তাই অচিন্ত সেভাবেই প্লান তৈরি করিয়েছিল। সবার জন্য যেন তার নিজস্ব একটি ঘর থাকে। ছাদের উপরে দুটো শোবার ঘর দুই ছেলের জন্য। বাকী খোলা ছাদটুকুতে বসার জায়গা আর বাগান। নীচতলায় চারটি শোবার ঘর। বসার ঘরের সাথে লাগোয়া বেশ বড় হলরুমের মত রান্না আর খাবার ঘর। নীচ তলায় তিনটি বাথরুম আর দোতালায় একটি। প্রতিটি ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দা। চারপাশে তার নিজের, অচিন্ত আর ছেলেমেয়েদের হাতে লাগান গাছপালা। অচিন্ত গাছের চারা কিনে এনে ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে আনন্দ করে গাছ লাগাতো। সুরমাকেও বাধ্য হয়ে যোগ দিতে হোত সেই” বৃক্ষ রোপন উৎসবে”।আম, জাম,কাঁঠাল, জলপাই আরো কত কত গাছ। গেটের দুই পাশে দুটি বিশাল কৃস্নচুরা। যখন ফুল ফোটে তখন বাড়ীটির রুপ যেন বদলে যায়। আগুন রংয়া লালের ছোঁয়া লাগে বাড়িটিতে। গাছপালাগুলো দিনে দিনে বড় হয়ে এখন পুরো বাড়ি যেন ছায়া দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। এই গাছগুলো মানুষটির বড় প্রিয় ছিল……
ম্যাসেন্জারের স্ক্রীন নোটিফিকেশনের লাল বিন্দুটি ফুটে উঠলো। সাথে টুংটাং মেসেজ টোন। অর্পনার মেসেজ। ওরা নিউ ইয়র্ক-ঢাকা গামী আমিরাতের ফ্লাইটে আসছে। কাল সকাল ১০ টায় ল্যান্ড করবে। ড্রাইভারকে ঘন্টা দুই আগেই এয়ারপোর্টে পাঠাতে হবে। রাস্তায় যা জ্যাম, তা না হলে সময়মত পৌঁছাতে পারবেনা। ওদিকে বড় মেয়ে অসীমা আসছে বরিশাল থেকে। তার ব্যাংকের চাকরী। তবুও প্রায় সপ্তাহখানেক ছুটি ম্যানেজ করেছে সে। অনীমা আসবে আজ রাতের ফ্লাইটে। কানাডার একটি স্কুলের বাচ্চাদের টিচার সে। এইতো একবছরও হয়নি ঘটা করে ছোট মেয়েটির বিয়ে দিলেন সুরমা। মেয়েরা ভালো আছে। অপর্নার কোল জুড়ে এসেছে ফুটফুটে মেয়ে অহনা। প্রায়ই স্কাইপে সে মেয়ে আর নাতনীর সাথে কথা বলেন। অহনা উঁ আঁ করে নানা রকম শব্দ করে। অপর্না তাই মাকে শোনানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। যেন পৃথিবীতে এর চেয়ে মধুর শব্দ সে আর কখনো শোনেনি। সুরমা মনে মনে মেয়ের কান্ডকারখানা দেখে হাসেন। শুধু ছেলেদুটিকেই এখনও সংসারী করা গেলনা। সুমিত তার পিএইচডি নিয়ে ব্যাস্ত। বিদেশের জীবন সে খুব মানিয়ে নিয়েছে। মাছের চেয়ে মাংসেই তার রুচী বেশী। প্রানখোলা স্বভাব। ফোনে আগেই সে বলে দিয়েছে তার ঘরে যেন গাঢ় সবুজ বা নীল পর্দা ঝোলানো হয়। ঝকঝকে আলো করা ঘর তার ভালো লাগেনা। ঘর হবে শান্ত, হাল্কা আলো-আঁধারী। ছেলেমেয়েদের সবার সব ধরনের মনোভাবের সাথেই তিনি মোটামুটি পরিচিত। কিন্তু সময় , বয়স এবং পরিবেশের কারনেও তাদের মাঝে প্রচুর পরিবর্তন এসেছে। সুকান্ত পন করেছে সে বিয়ে করবেনা। সে ধীরে ধীরে কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। মাছ , মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে এখন একেবারে পুরোপুরি নিরামিষভোজী সে। ফুড কুলিনারীর উপর পড়াশোনা শেষ করেছে। দুই বন্ধুতে মিলে লন্ডনে একটি অথেনটিক বাংলাদেশী খাবারের রেস্টুরেন্ট খুলেছে সে। তার সেই খাবার নাকি লন্ডনের দেশী আর বিদেশীদের মাঝে ব্যাপক সারা তুলেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস তার তৈরি খাবার আর রেষ্টুরেন্ট নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন ছেপেছে। উইকএন্ডে তার রেষ্টুরেন্টে ভোজন বিলাসি মানুষের লম্বা লাইন পড়ে যায়। সে এখন একজন সেলিব্রেটি সেফ। সেফপছন্দ রেসেপি ফুচকা আর মায়ের রেসেপিতে বানানো ডিমের ওমলেট নাকি তার কাস্টমারদের প্রথম পছন্দের খাবার। এসবই তার ছেলের মুখ থেকে ফোনে শোনা।
ছেলেমেয়েদের আসা উপলক্ষ্যে সুরমা একজন ছুটা আর একজন ফুলটাইম বুয়াও যোগার করেছেন। তা নইলে মনোর মা একা এত কাজ পেরে উঠবেনা। কাজের লোক পাওয়াও যেন এখন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এছাড়া সুরমা কাজের লোক রাখার তেমন পক্ষপাতী নন। তিনি নিজের প্রয়োজনীয় কাজগুলো নিজে করতেই বেশী ভালোবাসেন। নেহাতই স্কুলের ক্লাশ নেয়া, প্রশ্ন তৈরি, খাতা দেখা এসবে ব্যাস্ত থাকেন বলেই তিনি মনোর মাকে রেখেছেন। বিধবা মানুষ, ছেলেপুলেও কেউ কাছে নেই বুড়ো মা’টির খোঁজ নেয়ার জন্য। ভিক্ষা করতে এসেছিল। তাও সেই দশ বছর আগে। সেই থেকে সে রয়ে গেছে সুরমার কাছে।
সুরমা রান্নাঘরের দিকে গেলেন। মনোর মা আর নতুন বুয়ার কাজের তদারক করতে। ছেলেমেয়েরা এসে পৌঁছানোর আগেই ওদের পছন্দের কিছু খাবার তিনি তৈরি করে রাখতে চান। বাড়িতে পৌঁছেইতো সবাই খাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠবে। বিদেশের যত দামী আর মুখরোচক খাবারই তারা খাক না কেন মায়ের হাতের এবং দেশী খাবার এখনও তাদের কাছে সেরা। রান্নাঘরে পা দিয়েই সুরমা শুনতে পেলেন মনোর মার গলা। সে অধ্যবসায়ের সাথে নতুন বুয়াকে বিভিন্ন কাজের তালিম দিয়ে যাচ্ছে। কোনটা কিভাবে করতে হবে। ধোয়াধুয়ি ,পরিস্কার পরিচ্ছন্নভাবে কিভাবে সব কাজ করতে হবে। মনিবের পছন্দ অপছন্দ , মেজাজ সব কিছুই তার প্রশিক্ষনের মধ্যে আছে। সুরমা মনে মনে হাসলেন। এতদিন তিনি ভাবতেন, তিনিই মনোর মাকে আশ্রয়, খাবার, কাপড়চোপড় আর চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু আসলেই কী তাই? মনোর মাও কী তাকে দেখভাল করে, খাবার তৈরী করে ,বিশ্বস্থতা, নিরাপত্তা আর ভালোবাসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেনি?
অথচ আমরা কত অনায়াসেই তা মনেও রাখিনা। শুধু নিজের দান,অহংকার, আর ক্ষমতাকে কত বড় করে তুলে ধরি…
দিদি, তুমি আবার এই গরে ক্যান আইলা? তোমার বানাইন্না সাত দিনের খাওন দাওনের ফর্দ শুইন্না শুইন্না আমারতো মুখস্ত হই গ্যাছে…..
তুমি যাও দিহি…. ডেরাইবার বজলুরে এহনই যাওনের তাড়া দেও। নাইলে হে কিন্তু দেরী বাজাইবে। ছুডু মাইয়াডা আই এরফোডে বসি থাকবি….
মনোর মার কথার তোড়ে সুরমার চিন্তার জ্বাল ছিড়ে গেল। তিনি হাসতে হাসতে মনোর মার গলার স্বর আর কথার ভঙ্গী নকল করে বললেন,
আফনের ছুডু মাইয়াডা এয়ারফোডে আসি বসি থাকবি নানে। তারে সুময় মতই আনা হবিনে। সুরমা মনোর মার মাথায় একটি হাত রেখে সস্নেহে বললেন,
আমি জানি মনোর মা তুমি আমার বাচ্চাগুলোকে কত আদোর কর, তুমি ওদের মায়ের চেয়ে কোন অংশে কম নও।
সুরমার কথা শুনে মনোর মার চোখে পানি এসে যায়, সে মাথা নীচু করে চোখ মোছার চেষ্টা করে কান্নাজড়িত স্বরে বলতে থাকে,
দিদি, তোমাগর দয়ায়ইতো বাঁচি আছি , তোমরা কী আমারে কম বালোবাসা দিছ? পোলাপানগুলারে কত্তো ছুডু দেকছি। হেরাতো চোহের সামনেই ডাঙর অইলো।
সুরমা গভীর মমতায় মনোর মার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর হাড়িপাতিলের ঢাকনা তুলে তুলে , রান্নার সমস্ত আয়োজন নাড়াচাড়া করে দেখে বললেন,
রাতের খাবারের লিষ্ট মনে আছেতো? বড় চিংড়ি মাছের প্যাকেটটা ফ্রীজ থেকে নামাওনি? চিংড়িটা একটু ভেজে নিয়ে পেয়াজ কাচামরিচ দিয়ে ভূনা করতে হবে।
মনোর মা সুরমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,
দিদি তুমি এডা কী কতা কইলা কও দিহি? ছোডমা কী পছন করে খায় সিডা আমি জানিনে? আর সকাল থিকে একতা তুমি কতবার কইছো মনে কর দিখি?
কথা শেষ করে মনোর মা তার পান খাওয়া লালচে দাঁত বের করে হাসতে লাগলো। সুরমা স্বস্থির নি:শ্বাস ফেলে বললেন,
আহ্ হা,আমি জানিতো। তোমার ভুল হবার কোন উপায় নেই। বরং আমিই ভুল করবো। ভাবলাম আজ নিজের হাতে একটু রান্না করি। তুমিতো আমায় ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে ফেলছো। রান্নাবান্নাওতো প্রায় ভুলতে বসেছি।
কথা শেষ করে তিনি নতুন বুয়ার দিকে চাইলেন, এবং একটু প্রশ্রয়ের সুর গলায় এনে বললেন,
হ্যাগো, দেখো মনোর মার উপর যেন খুব চাপ না পরে, একটু হাত লাগিয়ে ওকে সাহায্য কর। ওরও বেশ বয়স হয়েছে। তুমিতো জওয়ান মেয়ে।
মনোর মা প্রায় জোড় করে ঠেলেঠুলো সুরমাকে পাঠিয়ে দিল। সুরমা ড্রাইভার বজলুকে তৈরি হয়ে গাড়ী বের করতে বললেন। একটু আগেভাগেই যাওয়া ভালো। বিনি বায়না ধরেছে সেও এয়ারপোর্ট যাবে। কিন্তু বজলুর সাথে রাতের বেলা তাকে একা দেয়া ঠিক হবে কিনা তাই নিয়ে সুরমা দ্বিধায় ভুগতে লাগলেন। পরে ভাবলেন, রান্নাবান্না যেহেতু মনোর মাই সামলাচ্ছে তাহলে বিনিকে নিয়ে তিনি নিজেও যেতে পারেন….
রাতের খাবারের পর সুরমা ছোট মেয়ের সাথে শুয়ে শুয়ে গল্প করতে লাগলেন। অধিকাংশই মেয়ের নিজের গল্প। তিনি আগ্রহ নিয়ে শোনেন। কানাডার জীবন-যাত্রা, বাচ্চাদের স্কুলের চাকরী, দেশের আর কানাডার শিক্ষা পদ্ধতীর পার্থক্য , বিয়ের পর মেয়ের নতুন জীবন, সংসার, স্বামী কত কত গল্প। সুরমা মেয়ের উজ্জল, সুখী মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অজস্র কথার ভীরে অনেক না বলা কথাও তিনি দেখতে পান মেয়ের উপচে পড়া হাসি মুখে। মনে মনে তিনি ঠাকুরকে ডাকেন…
“ভগবান তুমি ওদের সুখ আর আনন্দকে দীর্ঘস্থায়ী কর!”
তারপর হাই তুলতে তুলতে মেয়েকে বললেন,
অনি , মা, এখন ঘুমিয়ে পর। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে….এয়ারপোর্ট যেতে হবে অপর্নাদের পিক আপ করতে। সাথে ছোট বাচ্চা নিয়ে আসবে মেয়েটা….
তারপর থেমে থেমে টেনে টেনে বললেন, ভাগ্যিস… সমীরও সাথে আসছে….। তুইতো তোর নতুন জামাইটাকে সাথে আনতে পারলিনে….
সুরমা বড় বড় হাই তুলে কথা শেষ করলেন। অনিমা মায়ের কথা শুনে হেসে বললো,
মা বেচারীর এটা নতুন চাকরী। ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারলো না। আর, ওর আসলেই আসার খুব ইচ্ছে ছিল মা। আমারও খুব জেটলেগ হচ্ছে। আমি বরং ঘুমাই। তুমিও অনেক ক্লান্ত, আস তুমিও ঘুমাও।
সকালে ঘুম ভাঙতে আসলেই একটু দেরী করে ফেললেন সুরমা। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে তিনি রান্না ঘরে গেলেন নাস্তার যোগার দেখতে। রান্নাঘর থেকে সম্মিলিত হাসির আওয়াজ শুনে তিনি উৎসুক হয়ে ঘরে ঠুকলেন। অনিমা বেশ জাকিয়ে বসে গল্প করছে। আর তার চারপাশে সব গোল হয়ে বসে তার গল্প শুনছে। মনোর মা ,নতুন বুয়া, ড্রাইভার আর বিনি তার শ্রোতা। সুরমাকে দেখেই মনোর মা বলে উঠলো,
দেখ, এ্যাকেই বলে যার বিয়া তেনার খুঁজ নাই ,আর পাড়া পরশীর গুম নাই। আমগোর দিদিমনি এতোক্ষুনে গুম থাইক্যা উডলেন।
সুরমার দিকে তাকিয়ে মনোর মা তার বিখ্যাত পান খাওয়া লালচে দাঁতের হাসি হাসলো।
সুরমা একটু আল্হাদী হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
বাহ্ ! এখন আমাকে দুষছো কেন? তুমিইতো আমাকে আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছো। একটা কাজওতো ধরতে দাওনা। সবই তার নিজে করা চাই….
কথা শেষ হতেই তিনি সবার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকালেন,
কী ব্যাপার বলতো? তোমাদের সবার কী নাস্তাটাস্তা করা শেষ নাকি? মনোর মা….
অনিমা হাসিমুখে মার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
মা, তোমার রাতে ভাল ঘুম হয়েছে তো? আমরাতো সেই কখন খেয়েছি। সেই সূর্য ওঠার সময়….!
সারা রাত অঘোরে ঘুমিয়েছি। এত টায়ার্ড ছিলাম….ঘুম ভেঙে দেখি, বিনি বেচারী সেই সাত সকালে উঠে আমার অপেক্ষায় বসে আছে….তারপর দুজনে মিলে বাইরে বাগানে একটু হাঁটলাম। জানো মা, ছোটবেলার কথা খুব মনে হচ্ছিল…….!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনিমা আবার বলতে লাগলো, বাবার লাগানো গাছগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলাম।
শেষের দিকে অনিমার গলা একটু ধরে এলো। সে মার দিকে সজল চোখে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো।
সুরমার বুক থেকেও যেন চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। বললেন, তোদের হাতের লাগানো গাছগুলোওতো কী বিশাল হয়ে উঠেছে , দেখেছিস? সময় কত দ্রুত চলে যায়। বকুল গাছটাতো একেবারে ফুলে ফুলে ভরে যায়। আর তার সে কী পাগোল করা ঘ্রান…
অপর্না বলছিল সবাই মিলে আরো কিছু বন্ধুদের ডেকে বকুল তলায় পিকনিক করার কথা।
বিনি হাত তালি দিয়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলতে লাগলো,
পিকনিক !!! বাহ, খু-উ-ব মজা হবে ! অনেক দিন পিকনিক করা হয়না।
সুরমা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
অনি, বিনি ,মনোর মা,আর ড্রাইভারের জন্য তোর কোন গিফ্টটিফ্ট থাকলে এবেলা ওদের দিয়ে দে। ওরা তো অপেক্ষায় আছে। আর সবাই রেডীটেডী হয়ে যা, এয়ারপোর্ট যাবার সময় হয়ে এলো। তুই আর বিনি বরং যা,আমি ঘরেই থাকি। দুপুরের খাবার, রান্নাবান্নায় মনোর মার সাথে একটু না হয় হাত লাগাই…
অপর্না আসার সাথে সাথেই সারা বাড়ি যেন গম গম করতে লাগলো। তার মেয়েকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। পুতুলের মত সুন্দর মেয়ে। চারিদিকে নতুন লোকজন দেখে সে চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগলো। যেন সবার সাথে পরিচিত হতে চাইছে….
দুপুরের মধ্যেই অসীমারাও চলে এলো। তার এক ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েটির সাত আর ছেলের পাঁচ বছর বয়স। বড় জামাইটি হঠাৎ দরকারী কাজ পড়ায় শেষপর্যন্ত আসতে পারেনি। কথা দিয়েছে দুদিন বাদেই সে এসে যোগ দিবে। বাচ্চাদের হাসি আর কলকাকলীতে বাড়ি ভরে উঠলো। অপর্নার মেয়ে এই অল্প সময়ের মাঝেই অপরিচয়ের আরষ্ঠতা ভেঙে সবার কোলেই যাচ্ছে। অপর্নার স্বামী সমীর, সবাইকে বার বার বাচ্চার হাইজিনের ব্যাপারে সতর্ক করছে। যাতে বাচ্চার ঠোঁটে আদর করে কেউ চুমু না খায়, ময়লা হাত বেবীর মুখে না দেয়, কিন্তু কে শুনছে কার কথা….
সুরমা সবাইকে ডেকে সতর্ক করে দিলেন ,যাতে কল থেকে সরাসরি কেউ জল না খায়। ঢাকার জলেতে কী পরিমান ময়লা আর রোগ জীবানু আছে তা তিনি বার বার সবাইকে মনে করিয়ে দিতে লাগলেন। খাবার ঘরের দরজার কাছাকাছি এক কোনায় সুরমা মিনারেল ওয়াটারের বোতল এনে বড় স্তুপ করে রেখেছেন। এছাড়াও বড় বড় কয়েক হাড়ি জল ফুঁটিয়ে ফিল্টার করে রাখা হয়েছে। তিনি যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেছেন যাতে বেড়াতে এসে কেউ অসুস্থ না হয়ে পড়ে….
আজ রাতের ফ্লাইটে আসবে দুই ছেলে। তারা দুইভাই একই দিনে আসছে। আবার চলেও যাবে একই সাথে। স্বভাব চরিত্রে যদিও দুই ভাই পুরোটাই বিপরীত চরিত্রের, কিন্ত তাদের মাঝে ভাতৃত্বের বন্ধনটা বেশ দৃঢ়। কথাগুলো ভেবে মনে মনে সুরমা খুব তৃপ্তি পেলেন। বাবার অভাবে ছেলেমেয়ে গুলো বখে যায়নি, বা ছন্নছাড়া হয়ে বেড়ে ওঠেনি। বরং একটা দৃঢ় ও বলিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধন তাদের মাঝে তৈরি হয়েছে। দুহাত দিয়ে তিনি বাচ্চাগুলোকে সব রকম ঝড়-ঝাপটা থেকে আগলে রেখেছেন। হয়তো তাও ঠিক নয়। সুরমা একটু ক্ষন আনমনা হয়ে ভাবলেন। ওরাও কী তাকে আগলে রাখেনি? মায়ের প্রতি ওদের যে ভালোবাসা, বিশ্বাস, কর্তব্যবোধ সেটাও তো কোন অংশেই কম নয়। ওদের অনুপ্রেরনাও তাকে যেন বেঁচে থাকার, আর লড়াই করার শক্তি যুগিয়েছে। সে কারনে তারও ছেলেমেয়ের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা প্রয়োজন বৈকী। হয়তো এই শক্ত মায়ার বন্ধনই পুরো পরিবারটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করেছে, বাঁচিয়ে রেখেছে।
অনিমা আর বিনি এয়ারপোর্ট থেকে দুই ভাইকে আনতে যাবে। অসীমা দুপুরের খাবার খেয়েই ঘুমুতে গেছে। বললে,
মা ,এই দস্যিদুটোকে এবার তুমি একটু সামলাও। ভাই দুটো আসার আগে আমি একটু প্রান ভরে ঘুমিয়ে নেই। কতকাল যে মনের মত ঘুমাই না…..ওরা এলেই আমায় ডেকে তুলবে, তখন আড্ডা হবে…
সুরমা বাচ্চাদের নিয়ে তার নিজের ঘরে বসে গল্প করতে লাগলেন। নিজের ছোটবেলার, তাদের নানার, রাঙামাটি থেকে অচিন্তর আনা কালো ময়নাটির গল্প। কিন্তু অপর্না অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, এ বয়সী বাচ্চাদের কাছে গল্পের বিষয়বস্তু অনেকখানিই যেন বদলে গেছে। ছোট্ট মৌ আর অপুর ভূবনে সিনড্রেলা, স্নোহোয়াইট স্পাইডার ম্যান, আয়রন ম্যানরাই অনেক বেশী আবেদনময় আর জীবন্ত। অপর্না ছোট বাচ্চাকে খাইয়ে ঘুম পারাতে গেল। সুরমা বাচ্চাদের আগেই তৈরি করে রাখা মুড়ির মোয়া ,নারকেলের নারু খেতে দিলেন। তাদের খাওয়ার আনন্দ তাকে মুগ্ধ আর তৃপ্ত করলো। যতই ক্যাডমিয়াম আর মিল্কচকলেটে বাজার ভরে যাকনা কেন, মুড়ির মোয়া আর নারকেলের নাড়ুর আবেদন এখনও ফুরোয়নি।
ছেলেরা বাড়িতে পা রাখা মাত্রই পুরো বাড়িটি যেন আধো ঘুম থেকে জেগে উঠলো। তাদের উচ্চস্বরে ডাকাডাকি হাঁকডাকে বাড়িঘর গমগম করতে লাগলো। ছেলেদের লম্বা শক্তিশালী হাগ সুরমাকে অভিভূত করে তুললো। কিছুক্ষন পর পরই ছেলেরা এসে জড়িয়ে ধরে জানতে চাইছে,
মা তুমি কেমন আছ? এত বড় বাড়িতে একা একা কিভাবে আছ বলতো? তোমার দম বন্ধ হয়ে আসেনা?
সুমিত বরাবরই এমন, একই প্রশ্ন, একই চিন্তা তার মাথায়। এত বড় বাড়ি ,কিভাবে সুরমা একা আছেন, এইদিনে তা কতটুকু নিরাপদ তার জন্য। কেন এখনও মা বিকল্প কিছু ভাবছে না। ফোনে বা স্কাইপে এসব নিয়েই সে বেশীর ভাগ সময় কথা বলে। সুপ্রিয় নিজেও মায়ের ব্যাপারে খুব চিন্তিত। কিন্তু বড় ভাইয়ের মত বাড়ির বন্দোবস্ত নিয়ে তার তেমন মাথাব্যাথা নেই। অথবা সে বিকল্প কিছু মেনে নেয়ার জন্য এখনো মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয়। মেয়েরা মায়ের একাকীত্ব বোঝে, কিন্তু বাড়িটির প্রতি তাদের টান অন্যরকম। এই বাড়ি তাদের কাছে বাবার প্রতিচ্ছবি। এখানে এলে তারা যেন তাদের বাবার সান্নিধ্য পায়। বাড়ির প্রতিটি আনাচে কানাচে যেন অচিন্তর স্মৃতি ছড়িয়ে আছে …
সুকান্ত এসে মার গলা জড়িয়ে ধরে বললে , মা,তুমি বরং কিছুদিন লন্ডনে এসে থাক। তোমারও একটু চেন্জ হবে। আমিও তোমার হাতের রান্না খেতে পারবো।
সুরমার চোখ ছলছল করতে লাগলো। ছোট মেয়ে অভিযোগ তুললো,
মা ,এসব কী? ছেলেদের পেয়ে তুমি খুশিতে কাঁদছো? কই আমরা আসার পরতো তোমায় কাঁদতে দেখলাম না? বুঝতে পেরেছি তুমি ওদেরই বেশী ভালোবাস, তাইনা?
সুরমা আঁচলে চোখ মুছে প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন। বললেন,
তোমাদের বিয়ে হয়ে গেছে, যার যার নিজস্ব সংসার হয়েছে। কিন্তু ওদেরতো এখনও কেউ নেই, একটু দেখেশুনো, খাওয়ানোর ,খোঁজ খবর করার। তাই ওদের জন্য একটু বেশীই টেনশন হয়।
সুরমা টেবিলে রাতের খাবার সাজাতে শুরু করলেন। আজ অনেক দিন পর তার সবগুলো ছেলেমেয়ে একত্র হয়েছে। সবাই মিলে একসাথে ডিনার। সবার পছন্দের খাবারগুলোই মেনুতে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। অনিমার পছন্দের গলদা চিংড়ির দোঁপেয়াজি। অসীমার সর্ষে ইলিশ , অপর্নার পছন্দ কৈ মাছ আর টমেটোর ঝোল। সুমিতের মুরগীর সাথে আলুর ঝাল তরকারী। সুকান্ত নিরামিষ ভোজী। সুতরাং তার পছন্দের সোনামুগের ডাল ঘিয়ে পেঁয়াজ বেরেসতা করে বাগার দেয়া। বড় বেগুন সোনালী করে ভাঁজা। আর শেষ পাতে থাকবে ঘরে বানানো দই।
বড় একটি হলরুমের মতই তাদের ডাইনিং প্যাসেজটি। সেই কবে ঘরের একেবারে মাঝ বরাবর পাতা হয়েছিল ডাইনিং টেবিলটি। এখনও সেভাবেই আছে। সেই উনিশ কুড়ি বছর আগে বাড়িতে মিস্ত্রী এনে বানানো। আজো ঘূনে ধরেনি বা নষ্ট হয়নি। দশ জন বসে একসাথে খেতে পারে। নাড়াচাড়া বা সেটিংয়ের সুবিধার জন্য সমান দুই পার্ট করে বানানো হয়েছিল। কিন্তু প্রথমবারে অচিন্ত আর মিস্ত্রী মিলে যেভাবে সেট করেছিল আজো সেভাবেই আছে।
সুরমা সবাইকে খেতে ডাকলেন। বিনি মনোর মাকে নিয়ে দশ জন। সুরমা সবাইকে নিয়েই আজ একসাথে বসার আয়োজন করেছেন। খাবার টেবিলেই তিনি আজ তার কিছু ভবিষৎ পরিকল্পনা সবার সাথে আলোচনা করবেন, এবং তার মতামত সবাইকে জানাবেন। অনেকদিন ধরেই তিনি ধীরে ধীরে এইদিনটির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। নিজের মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছেন। এই কঠিন সিদ্ধান্তগুলো তার নেয়ার প্রয়োজন ছিল। আর এড়ানোরও কোন উপায় ছিলনা….
খাবার শেষে সবাইকে দই দেয়া হোল। সুরমা ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
তোমাদের সাথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আমি এখনই সেরে ফেলতে চাইছি। তোমরাও নিশ্চয়ই জান, তোমাদের সাথে আগেও ফোনে এসব নিয়ে আমার কথা হয়েছে…..
সুরমা একটু থেমে তার গলা পরিস্কার করে নিলেন। ১৯৭৮ সালে তোমাদের বাবার সাথে আমার বিয়ে হয়। আমার বয়স তখন আঠারো কি উনিশ হবে। ইন্টরমিডিয়েট পাশ করেছি। বিয়ের পর আমরা পশ্চিম মনিপুরে একটি বাসা ভাড়া করে থাকা শুরু করলাম। অসীমার জন্ম হোল। আমি বিএ পাশ করলাম। মনিপুর হাই স্কুলে চাকরী পেলাম। তোমার বাবার উৎসাহে এবং চাকরীর প্রয়োজনে এম, এ পাশ করলাম। তারপর ১৯৮৫ সালের দিকে তোমার বাবা আর আমি দুজনে মিলে এই জমিটি কিনে ছিলাম। দোতালার ভীতের উপর এই বাড়িটি তৈরি করে আমরা এখানে উঠে এলাম। প্রায় ত্রিশ বছর হয়ে গেল বাড়ির বয়স। একে একে তোমাদের পাঁচ ভাইবোনের জন্ম হোল। তোমরা সবাই পিঠাপিঠি ভাইবোন। কথার মাঝখানে সুরমা একটি বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর আবার শুরু করলেন,
২০০৪ সালের ডিসেম্বরের এমনি এক দিনে, সেদিনটি ছিল শুক্রবারের সকাল। ছুটির দিন। উনি সকালে উঠে নাস্তা খেয়ে বেড়িয়ে গেলেন। আমায় বললেন, চুল কাটার জন্য সেলুনে যাবেন। তারপর ফেরার পথে কিছু তাজা শাকসবজি আর মাছ কিনে বাড়ি ফিরবেন। ছুটির দিন তাই ফ্রেশ কিছু খাওয়া যাবে। মানুষটি সকালে বেড়িয়ে গেলেন আর সারা দিন কোন খোঁজ নেই। চারিদিকে খোঁজাখুঁজি করা হোল। আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবকে ফোন করা হোল। কারো বাসায় বা কোথাও কারো সাথেই দেখা করতে যাননি। কারো সাথে তার দেখাও হয়নি। যেই ছেলেটির কাছে সে সেলুনে সচরাচর চুল কাটে তার কাছে খবর নিয়ে জানা গিয়েছিল , তোমাদের বাবা সকালে দশটার দিকে সেখানে চুল কাটতে যান। তারপর সে কোথায় গিয়েছেন তা তারা যানে না।
সারাটা দিন খোঁজাখুঁজি চললো ,অনেক কষ্টে ,আতংক নিয়ে বিভৎস একটি রাত পার করলাম। পরের দিন মিরপুর থানায় গিয়ে একজন নিঁখোজ মানুষ হিসেবে রিপোর্ট ফাইল করা হোল। পুরো এলাকা জুড়ে একটানা সাত দিন মাইকিং করা হোল। নিঁখোজ ব্যাক্তির বর্ননা দিয়ে ,ছবি ছাপিয়ে,লিফলেট বিলি করে পাড়ায় পাড়ায় প্রতিটি লাইটপোষ্টে , দেয়ালে , দেয়ালে নিখোঁজ সংবাদ দিয়ে পোষ্টার লাগান হোল। পেপারে , টিভি , রেডিওতে নিঁখোজ সংবাদ প্রচার করা হোল!
কিন্তু মানুষটি সেই যে গেল, আর কখনও ফিরে এলোনা!
এই সময় অপর্নার স্বামী সমীর হাত তুলে বললো,
মা , আমার কিন্তু এখনও মনে পরে আমি সেদিন রাতেই বাবাকে পরিস্কার দেখে ছিলাম। ঠিক এই বাড়ির গেটের সামনেই সে দাঁড়িয়ে আছেন। রাত তখন এপারটা হবে , আমি আমাদের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম। যেহেতু অপর্নার সাথে আমার সম্পর্কটা উনি জানতেন, তাই তাঁকে দেখে আমি বরং একটু আড়ালে গেলাম। যাতে আমার হাতের সিগারেট তাঁর চোখে না পড়ে। আর সারাদিন আমি বাসায় ছিলাম না , তাই ওনার নিঁখোজের ব্যাপারটা কিছুই জানতাম না। পরে ঘুমুতে যাবার সময় মা বললেন , সমী , জানিস , সকাল থেকে পাশের বাড়ির অপির বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন আমি হেসে মাকে অভয় দিয়ে বলেছিলাম, মা , আমি এইমাত্র কাকাবাবুকে তাদের গেটের সামনে দেখে এলাম। মা বললেন, কী বলিস? সারাদিন খোঁজা হল, কত কান্নাকাটি। তারপর মা আপনাকে ফোন করে ব্যাপারটা কর্নফার্ম হতে গেলেন। এবং যখন শুনলাম সে আদৌ বাসায় ফেরেনি, তখন আমার খুব খটকা লাগলো। আমি দৌড়ে গেটের কাছে গেলাম। তারপর সবাই মিলে আরো কত খোঁজাখুঁজি হলো। মনে হোল দশ মিনিট আগে দেখা মানুষটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
সুরমা একটু বিষন্ন হেসে বললেন, বাবা, সে রাতে তুমি কী দেখেছিলে জানিনা। কিন্তু মানুষটাতো সত্যিই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। হাসপাতাল, পাগলাগারদ, কমলাপুর ষ্টেশন, সদরঘাট, আমাদের দুজনের গ্রামের বাড়ি, এমন কী কোলকাতায় দু একজন চেনা জানা যারা ছিলেন সেখানেও খোঁজ নেয়া হয়েছিল। তারপর কত ভুয়া খবর এলো তোমাদের বাবার মত কাউকে ঢাকা মেডিকেলে দেখা গেছে। বরিশালের এক বন্ধু ফোন করে খবর দিল মাসুদ খান নামক লন্চে তাকে কম্বল গায়ে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। পরে জানা গেল ঐ লোকগুলো দেখতে অচিন্তর সাথে চেহারার কিছু মিল ছিল।
এভাবে অনেক ছুটোছুটি করেছি। তারপর মেনে নিয়েছি। সে হারিয়ে গেছে। সারা জীবনের মত। অমিমাংসিত প্রশ্ন, আজো অমিমাংসিত রয়ে গেল। অপেক্ষা আজো শেষ হোলনা।
সুরমা গলার স্বর একটু উঁচু করে বলতে শুরু করলেন, আজ বারো বছর আমরা তার অপেক্ষায় আছি। আমি তোমাদের সবার মতামত আগেই নিয়েছি। আর সেভাবেই আমি সব বন্দোবস্ত করে রেখেছি। আজ বুধবার। শুক্রবার ছুটির দিন। পুরুতমশাই সকাল দশটা নাগাদ আসবেন। তোমরা ছেলেরা তাঁর সাথে শ্বশানঘাটে যাবে। তোমাদের বাবার কিছু প্রিয় জিনিষপত্র দিয়েই আমরা তাঁর দাহ করবো। তারপর শাস্ত্রমত তের দিন শোক পালন এবং যা কিছু করনীয় সব কিছু করে তার শেষকৃত করবো। ঐদিন থেকেই আমি তাঁর হারিয়ে যাওয়াকে তাঁর মৃত্যু হিসেবে মেনে নেব।
সুরমা কাঁদলেন না। শুকনো চোখে পরিস্কার গলায় কথা বলতে লাগলেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা অবাক চোখে মার দিকে তাকিয়ে রইলো। মায়ের এত কঠিন, শক্ত রুপ তারা আগে কখনো দেখেনি।
সুরমা এবার একটু সহজ স্বরে গলার স্বর আরেকটু নীচু করে কথা শুরু করলেন,
বাড়ির ব্যাপারেও আমি একটি সিদ্ধান্তে এসেছি। আমি জানি এ বাড়িটি তোমাদের সবারই অনেক প্রিয়। এই বাড়ির সাথে রয়েছে তোমাদের বাবার স্মৃতি, তোমাদের ছোটবেলার স্মৃতি। কিন্তু আমার সত্যিই আর কিছু করার নেই। এখানে আমি বড় অসহায়। এত বড় বাড়িতে এভাবে একা থাকা তেমন নিরাপদও নয়। বাড়ি খালি রেখেও কোথাও যাওয়া সম্ভব না। সামনের খালি জায়গাটুকু, বাগানটা বা পেছনের গাছপালার ফাঁকা জায়গাটুকু অনেক কষ্টে বজলু পাহাড়া দিয়ে রাখে। সেখানে প্রায় রাতেই পাড়ার ছেলে ছোকরারা ড্রাগ এনে খায়। আগেতো প্রায়ই ফেনসিডিলের ভাঙা বোতল পরে থাকতো। এখন ইন্জেকসনের সিরিঞ্জ, পোড়া কাগজ কত কী পড়ে থাকে। বজলু নিজেও এখন ওদের কিছু বলতে ভয় পায়।
ভাড়া দেয়াও মুসকিল। এখন এত বড় বাড়ি ভাড়া নেয়ার তেমন লোকও নেই। তাছাড়া , পানির লাইন , গ্যাসের লাইন সব পুরনো হয়ে গেছে। সুয়ারেজ লাইনও ভেঙেচূরে গেছে। কদিন পর পরই এসব মেরামত করতে হয়। এসব বড্ড ঝামেলা। আমার আর এই বয়সে এসব ঝামেলা ভালো লাগছে না। এছাড়াও মিরপুরে এখন গ্যাস আর পানির বড় অভাব। নতুন করে এসব লাইন না বসালে এখানে বসবাস বেশ কষ্টকর। আর দিন দিন এখানকার পরিবেশও বেশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিছুই আর আগের মত নেই!
আমি ডেভলপারদের সাথে কথা বলেছি। একটা কোম্পানীর সাথে মোটামুটি কথা সব ঠিক করা হয়ে গেছে। ওরা কাল সকালেই আসবে। সকালে আমাদের পরিচিত উকীল রহমান সাহেবকেও আসতে বলেছি। উনি তোমাদের বাবার ভালো বন্ধু ছিলেন। কাগজপত্র মোটামুটি তৈরি করাই আছে। আর তোমাদের হাতেওতো তেমন সময় নেই। সবাই ব্যাস্ত। ডেভলপাররা বাড়িটি ভেঙে আটতলা করবে। আমাদেরকে সাতটা ফ্লাট দেবে। বাড়ি ভাঙা বাবদ কিছু ক্যাশ টাকাও দেবে। আমি ঠিক করেছি তোমরা পাঁচ ভাই বোন পাঁচটা ফ্লাট পাবে। আমার নামের ফ্লাটটা আমি বিনিকে দিয়ে যাব। আমার মৃত্যুর পর এটা বিনি পাবে। আর একটা ফ্লাট বিক্রি করে ক্যাশ টাকাটা আমি আমার যাবতীয় খরচপত্র, বিনির লেখাপড়া ও বিয়ের জন্য রাখবো। আপাতত আমার স্কুলের বেতন আর রিটায়ারমেন্ট থেকে যা পাব তাতে ছোট্ট একটা টু বেডরুম এপার্টমেন্ট ভাড়া করে আমাদের তিন জনের চলে যাবে। গাড়ীটি ভাবছি আর রাখবো না। তাহলে বজলুর বেতন আর গাড়ীর খরচটাও কমে যাবে।আজকাল ঢাকায় উবারের খুব ভাল সার্ভিসই পাওয়া যাচ্ছে।
সুরমা একটু দম নিয়ে, মনোর মার দিকে তাকিয়ে স্বস্নেহে বললেন, আমি যতদিন বেঁচে আছি মনোর মা আমার সাথেই থাকবে। সে তোমাদের মায়ের মতই। আমার হঠাৎ কোন কিছু হলে তার দায়িত্বও তোমরা নেবে আসা করি। মনোর মার নামে সোনালী ব্যাংকে আমি একটি ব্যাংক একাউন্ট করেছিলাম। তাতে বেশ কিছু টাকা আছে। প্রতি মাসে ওখানে কিছু জমা রাখতাম। মনোর মাও তা জানে। তোমরাতো কেউ আর দেশে থাকো না, বিনি, অসীমা এবং তোমাদের সবার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, তোমরা, সে যত দিন বেঁচে থাকবে তার খোঁজ খবর রাখবে। এবং তার টাকা দিয়েই তাকে একটি ভালো বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যাবস্থা করে দেবে। অথবা বিনি চাইলে, মনোর মা তার কাছেও থাকতে পারবে।
তোমাদের কারো কোন মতামত থাকলেও আমাকে জানাতে পার। আজ রাতটা ভাব। কাল সকালে মতামত জানাবে। আর অমত না থাকলে কাল সকালেই সবাই মিলে সাইন করে সব ফাইনাল করা হবে। তোমাদের সবার নামে যে ফ্লাট তোমরা পাবে, ইচ্ছে করলে তা যতদিন খুশি রাখতে পার, ভাড়া দিতে পার, চাইলে বিক্রি করেও দিতে পারবে। সেটা তোমাদের ইচ্ছে। আমার কোন জবরদস্তি থাকবেনা।
পরদিন সকালে উকীল সাহেব আর ডেভলপার কোম্পানীর লোক এলে ছেলেমেয়েরা সবাই খুশিমনেই সব কাগজপত্র সাইন করে দিল। এরচেয়ে ভালো বন্দোবস্ত আর কিইবা হবে? ওরাতো এটাই চাইছিল। মার পক্ষে এখন এসব সামলানো সত্যিই কঠিন। আর তাঁরওতো এখন একটু বিশ্রাম আর চিন্তামুক্ত থাকা দরকার। বাড়িটি এখন সুরমার জন্য আসলেই একটি বোঝা হয়ে যাচ্ছিল।
সকাল এগারটা বাজতে না বাজতেই পিকনিকের লোকজন আসা শুরু করে দিল। ছেলেমেয়েরাও অনেকদিন পর যার যার বন্ধুবান্ধবকে পেয়ে খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠলো। বিনির ছুটোছুটির অন্ত নেই। সে সবার কাছেই ছুটে ছুটে যাচ্ছে। নানা রকম নাস্তা পানির যোগার সেই সামলাচ্ছে। অসীমার বাচ্চা দুটিও মনের আনন্দে বড় আম গাছটির সাথে বেঁধে দেয়া কাঠের দোলনায় দুলছে। বাগানের পাশের খোলা জায়গাটুকুতে বাস্কেট বল খেলছে সুমিত আর ওর বন্ধু কুশল। এ দুটি সেই স্কুল জীবন থেকেই বন্ধু। বাস্কেট বল আর নেটটা গত বছর সুমিত যখন সামারের ছুটিতে দেশে এসেছিল তখন নিয়ে এসেছিল। বাড়ির পশ্চীম কোনের দেয়ালে শরাফত রাজমিস্ত্রীকে ডেকে নেটটি পোক্ত করে লাগিয়ে নিয়েছিল। সেবারও কুশল এসে মহা উৎসাহে বন্ধুর সাথে প্রতিদিন খেলতো। মেয়েরা সবজী কাটছে। তাদের পাশে কডলেস স্পীকারে বাজছে মৌসুমি ভৌমিকের একটি জনপ্রিয় গান,” আমি কখনো যাইনি জলে কখনো ভাসিনি নীলে”। মনোর মা, নতুন বুয়া আর বজলুও লেগে গেছে মাটির চূলা আর লাকড়ীর বন্দোবস্ত করতে। চালডাল, নুন, তেল, মসলাপাতি , সবজী ,মাংস সব কিছু বকুলতলার চাতালে জড় করা হয়েছে। সুরমা মাঝে মাঝে বাইরে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে আসেন। তার মনটা আজ অনেক হাল্কা আর ভারমুক্ত মনে হচ্ছে। আহা, ছেলেমেয়েগুলো মন খুলে একটু আনন্দ করুক। এটাই তো এই বাড়িতে তাদের শেষ জড় হওয়া। তাদের আনন্দবাড়ির শেষ আনন্দ অনুষ্ঠান।
শুক্রবার। নভেম্বরের মাসের শীতের সকাল। আজ খুব সকাল সকাল সুরমার ঘুম ভাঙলো। আগে শীতের শুরুর এই সময়টাতেই সকালটা কেমন হাল্কা কুয়াশামাখা আর শীত শীত ভাব থাকতো। এখন শীতকালটা ছোট হতে হতে যেন নাই হয়ে যাচ্ছে। সুরমা উঠে রান্না ঘরে গেলেন। মনোর মা এখনো ঘুমাচ্ছে। বেচারীর কদিন ধরে বেশ খাটুনি যাচ্ছে। তিনি নিজেই বড় কেতলীতে করে চায়ের জল আর পাতা ফুটতে দিলেন। তারপর হাতমুখ ধুতে বাথরুমে ঢুকলেন। পরিস্কার হয়ে, শোবার ঘরে এসে বড় আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে দেখলেন। হঠাৎ কী মনে করে ডান হাতের অনামিকায় একটু বেশী করে সিদূর নিয়ে কপালের সিদূরের টিপটা একটু বড় করে আঁকলেন। বাকী সিদূরটুকু মাঝখানের সিঁথীতে লেপ্টে দিলেন। দ্রুতহাতে চুল আঁচড়ে উঁচু করে একটি হাতখোঁপা করে নিয়ে রান্নাঘরে ফিরে এলেন।
ততক্ষনে মনোর মা আর নতুন বুয়াও উঠে গেছে। সুরমা কাল রাতে তৈরি করে রাখা লুচীর ডো থেকে লিচি কেটে দিতে লাগলেন। মনোর মাকে লুচি বেলতে দিয়ে নতুন বুয়াকে গাছ থেকে পেড়ে আনা কাঁচা পেঁপে, তার সাথে আলু, মিষ্টি কুমড়া আর গাজর কাটতে দিলেন। পাঁচফোড়ন দিয়ে সবজী হবে। গরম গরম লুচীর সাথে খেতে খুব মজাদার এই সবজী। নাস্তা তৈরি হতে হতেই একে একে ছেলেমেয়েরাও সবাই এসে টেবিলে জড় হোল। সমীর মেয়েকে কোলে নিয়ে খাবার টেবিলে এসে বসলো। অসীমার বাচ্চা দুটো এখনও ঘুমাচ্ছে। কালকের পিকনিকে লাফালাফি আর দৌড়ঝাঁপ করে তারা ক্লান্ত।
সদ্য স্নান করে তৈরি হয়ে আসা ছেলেদের আর সমীরকে আগে নাস্তা খেতে দিলেন সুরমা। বললেন, বাবা, তোমরা আগে খেতে শুরু কর। পুরুত ঠাকুর রওনা হয়ে গেছেন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চলে আসবেন। লুচি ভাজা শেষ হলে আমরা সব মেয়েরা একসাথেই বসে যাব।
আমি রাতেই সব বন্দোবস্ত করে রেখেছি। উনি এলেই সব আচার অনুষ্ঠান করবেন। আমি কোন অসম্পূর্ণতাই রাখতে চাইনা।
বিনি ভাইয়াদের কাছ থেকে তার নতুন পাওয়া ল্যাপটপ নিয়ে মহাব্যস্ত আর উত্তেজিত। সে টেবিলে বসে পা দোলাচ্ছে আর বিভিন্ন এ্যাপ্স ডাউনলোড করছে। খুশিতে তার সারা মুখ যেন ঝলমল করছে। সুরমা তাকে ছেলেদের চা এনে দিতে বলতে গিয়েও আর বললেন না। তিনি হেসে হেসে ছেলেকে বললেন,
দেখ, আমাদের বিনিকে, সেতো এই জগতেই নেই!
বিনি লজ্জা পেয়ে মাথা তুলে বললো,
মাসিমা , কিছু করতে হবে?
কিছুই করতে হবেনা , পাগলী। বরং দাদারা থাকতে থাকতে এটার ব্যাবহার সব শিখে রাখিস।
সুকান্ত, তুই এটা এনে অনেক ভাল করেছিস বাবা। বিনির একটা ল্যাপটপের সখ ছিল অনেকদিন ধরেই।
সুরমা ড্রাইভার বজলুকে ডাকলেন নাস্তা খেতে। তাকে ছেলেদের নিয়ে শ্বশানঘাটে যেতে হবে। বজলু গরম গরম ধোঁয়া ওঠা লুচি আর সবজী খেতে খেতে বললো ,
দিদি, আজগের সবজীলুচী খুবই মজা হইছে। দাদা আর দিদিদের পেয়ে মনোর মার মেজাজ মর্জী খুপ বালা। হের জন্যি রান্নার সোয়াদও বাইড়া গ্যাছে।
মনোর মা এক থালা লুচি নিয়ে এসে টেবিলে রেখে বললো,
মামনিরা, তোমরাও খাতি বসি যাও দেহি….লুচি ঠান্ডা হলি কোন মজা থাকবিনানে।
তারপর বজলুর দিকে তাকিয়ে, তার স্বভাব সুলভ লালচে হাসি হাসলো। বললো, কিরে বজলু, সুমিত বাবা যে তোরে একখান ফোন দিছে, তা দিদিরে দেখাইছিস?
বজলু খুব লজ্জা পেল। খাওয়া বন্ধ করে নিজের গালে নিজেই দুটো চড় বসালো। তারপর পকেট থেকে একটি ‘আই-ফোন ফোর’ বের করে সবাইকে দেখালো। সে কথা বলে কম। কিন্তু কৃতজ্ঞতা আর খুশিতে তার মুখখানী উজ্জল হয়ে উঠেছে।
পুরুত মশাই চলে আসায় সবাই ব্যাস্ত হয়ে উঠে পড়লো। সুরমা একখানা খোলা বেতের ঝুড়ি এনে সবার সামনে রাখলেন। তাতে অচিন্তর একখানা পুরনো বাঁধানো ছবি। ছোট ছোট কাঁচের বোতলে দুধ, দই, মধু, ঘী, পবিত্র গঙাজল। বিয়ের সময় সুরমার বাবার দেয়া সিল্কের ধুতি পান্জাবী, তাঁর চশমা, মানিব্যাগ, সুরমার সিদূরের সৌখিন কৌটাটি, হাতের পলা, নোয়া আর শাঁখা জোড়া। আর এক প্রস্ত নতুন সাদা কাপড়। পিন্ডদানের জন্য আগের তৈরি করা কিছু খাবার। বজলু গাড়ী বের করতেই তারা সবাই হরি, হরি, হরি বল….জপতে জপতে বেড়িয়ে পড়ল।
সমস্ত কাজ শেষ হলে সুমিত ফোন করে মাকে খবর দিল। তারা ফিরে আসছে ! সুরমা মেয়েদের সবাইকে স্নান সেরে সাদা পোশাক পরে বসার ঘরে আসতে বললেন। তিনি নিজেও স্নান সেরে ধীর পায়ে বসার ঘরে এলেন। পরম যত্নে অচিন্তর কালো ফ্রেমে বাঁধা ছবিটিতে একটি তাঁজা ফুলের মালা পরালেন। ছবির দুই পাশে ধূপধূনো, আগরবাতি জ্বালালেন। মেয়েরা একে একে এসে মায়ের সাথে যোগ দিল। সুরমাকে সাদা শাড়ি, খরখরে সাদা সিঁথী, সিদূরের লালটিপ ছাড়া স্থির মূর্তির মত বসে থাকতে দেখে বিনির গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠলো।
ছেলেরা আর মেজ জামাই সমীর ফিরে এসে বসার ঘরে মায়ের সামনে এসে দাঁড়াল। মুন্ডিত মস্তক ছেলেদের দিকে তাকিয়ে সুরমা ডুকরে কেঁদে উঠলেন,
বাবা, এটার দরকার ছিলনা। কেন করলে? কান্নাজড়িত স্বরে সুরমা ছেলেদের বলতে লাগলেন, আমিতো তোমাদের বলতে সাহস পাইনি। তোমরা নিজের থেকেই….কথা শেষ করার আগেই সুরমা কান্নায় ভেঙে পরলেন।
ছেলেরা এসে মার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। সুমিত কাঁদতে কাঁদতে বললো , মা তুমিতো পেরেছো, আমরা কেন পারবো না? পিন্ডদান আর মুখাগ্নী করে আমরা যে আজ আমাদের বাবাকে দাহ করে এলাম।
বাবোটি বছর পর, আজ আবার বাড়িটিতে মৃত্যুশোকের কান্না শুরু হোল। মাকে ঘিরে তাঁর ছেলেমেয়েরা বাবার মৃত্যুর শোকে আজ মন খুলে অঝোরে কাঁদতে লাগলো!
Ami
Sent from my iPhone
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..