অপেক্ষা

বিতস্তা ঘোষাল
গল্প
Bengali
অপেক্ষা

মাটি ছেড়ে আকাশে ওড়ার মজাটাই আলাদা । মেঘেদের রাজ্য পেরিয়ে যখন লাল ডানাওয়ালা বিশাল পাখিটা ওড়ে, তখন মনের মধ্যে অদ্ভুত এক আলোড়ন চলে। খানিক আগেও মাটির মধ্যে বিচরণ করতে করতে হঠাৎ জোরে দৌড়তে শুরু করে প্লেন, তারপর ওপর থেকে ক্রমশ ওপরে। ছোটো হতে হতে মিলিয়ে যায় নিচের বাড়ি ঘর, রাস্তা, নদী। সম্পূর্ণ এক অন্য জগতে ভেসে চলা। যেন এভাবে চলাটাই একমাত্র সত্য, একটু আগেও যেগুলো ছিল, সব মিথ্যে ।

গুনে গুনে ২০ দিন বাদে দেখা হবে শালুকের সঙ্গে । দেখা হলে কী হবে সেটা জানা। একসাথে থাকা মানেই নানা অশান্তি,  মতবিরোধ, ঝগড়া । গত ২৫ বছরের দাম্পত্য জীবনে এর বাইরে কিছু ঘটেনি। তবু এখনো বিয়ের আগের দিনগুলোয় দেখা হবার মতই পেটের ভিতরটা গুড়গুড় করে ওঠে। ইচ্ছে করে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে। যদিও ইচ্ছেগুলো বুকের মধ্যেই ঘুরতে থাকে,তারপর শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যায়। একবারে কুম্ভকর্ণর মত। ছ’মাস না হলেও ছ ‘সপ্তাহ তো বটেই। ততদিনে আবার নতুন ইচ্ছে জেগে ওঠে ।

পালকি বলে, মা তোমার বাবার প্রতি এই প্রেম, এই ন্যাকামি জাস্ট নেওয়া যায় না। যে লোকটা দিনরাত তোমার শ্রাদ্ধ করে , তোমাকে ছেড়ে দূরে থাকতেই ভালবাসে তার প্রতি কী করে যে এত প্রেম তোমার আসে!

পালকি ভুলভাল বলা বন্ধ করো। মানুষটা তোমার বাবা।একটু রেগেই যায় আরশি।

বাবা! জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না মা। কিছু দায়িত্বও নিতে হয়।

দায়িত্ব! ভেবেই চুপ করে যায় আরশি। পালকি বলেই চলে , মা এই লোকটা তোমাকে ভালবাসে না।ভান দেখায়। মনে নেই তোমার, বেড়াতে গিয়ে নিজের ইনবক্স থেকে একজনকে কী লিখেছিল! তোমার ন্যাকা বৌদিটাও সঙ্গে এসেছে সোনা। তুমি রাগ কোরো না , ব্লা ব্লা ব্লা . . তুমি এখনো কেন যে এই লোকটাকে. .

আরশি মনে মনে বলে , সব জানি, কিন্তু আমি নিজে যা বলতে পারি, অন্য কেউ শালিকের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললেই ভেতরে ভেতরে রাগ হয়ে যায়। ইচ্ছে করে সেখান থেকে উঠে চলে যাই। মন যে কেন এখনো … দিদা বলতেন, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক সাত জন্মের। ভগবানের ইচ্ছেয় তারা এক হয়। তাই তার সামনে শপথ নিয়েই পথ চলা শুরু করে সবাই। চট করে মাথা গরম করে সম্পর্ক ভাঙলে পরে খুব কষ্ট হয়।

দিদার কথাটাই বোধহয় ঠিক। আরশি নিজের মনেই বিড়বিড় করে। তাই এতবার এত কিছুর পরেও ভাঙতে মন চায় না।

***

অপেক্ষা। অপেক্ষা।

এতগুলো বছর ধরেই তো নানা অপেক্ষা । মাধ্যমিক দেবার পর কলেজে ভরতির জন্য, ছেলে মেয়ে একসঙ্গে পড়ার জন্য কী আকুতি, কী অপেক্ষা ! কলেজ মানেই যেন হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়া , একা একা পথে নামার ছাড়পত্র। সেখানেও বাবার চোখ রাঙানি। মেয়েদের কলেজেই পড়তে হবে। অগত্যা ! মা চললেন ভরতি করতে সারদা মিশন।এক মিশনের স্কুল  ছেড়ে আরেক মিশন স্কুল। তেপান্তরের মাঠ ভেঙে সেই স্কুলে পৌঁছে মা বললেন, অসম্ভব এখানে পড়ানো। বৃষ্টি হলেই মাঠ ভেসে যাবে জলে। মেয়ে শাড়ি পরে এতদূর জল ঠেঙিয়ে যেতে- আসতেই সাপের কামড়ে শেষ।

আবার অন্য কলেজের তল্লাশ। বাড়ির কাছের কলেজ। প্রিন্সিপ্যাল বাবার পরিচিত। রেজাল্ট দেখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মার মুখের দিকে।

বৌদি, আপনার হ্যাজব্যান্ড জানি খুব ব্যস্ত  মানুষ। মেয়েদের দিকে নজর দেবার সময় পান না। কিন্তু আপনি নিজেও তো স্কুলে পড়ান। আপনার মাথায় যে ছিট আছে জানতাম নাতো!

মা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললে, কেন! ভরতি করা যাবে না বুঝি! মেয়ের রেজাল্ট তো ভালোই। উনিও বললেন, আপনি আছেন, চিন্তা না করতে।

 আপনার মেয়ের রেজাল্ট শুধু ভালো নয়।খুব ভাল। আমাদের কলেজে সেকেন্ড, থার্ড ডিভিশন ছাড়া ভরতি হয় না। আপনার মেয়ে হাই ফার্স্ট ডিভিশন উইথ লেটার। এখানে কেন পড়াবেন! কত ভালো ভালো কলেজ আছে , সেখানে ভরতি করুন।

অগত্যা আবার খোঁজ শুরু।ততদিনে ভালো কলেজে ভরতির ফর্ম দেওয়া প্রায় শেষ।সব শুনে জ্যেঠুর ছেলে বলল, কোনো চিন্তা নেই, হয়ে যাবে। শুধু রাতে গিয়ে লাইন দিতে হবে।

মানে?

মানে ভোর ছটা থেকে ফর্ম দেওয়া শুরু হবে। কিন্তু লাইন পরে রাত থেকেই। তাতে চিন্তার কিছু নেই। নটা’ নাগাদ গিয়ে ইঁট পেতে,  লোক বলে এলেই হবে।

সেটা যে আমার ইঁট কি করে বুঝবে সকালে?

আরে টাকাটা কী এমনি নেবে নাকি!

অবশেষে প্রতীক্ষা , অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভালো কলেজেই ভরতি।

 এক অপেক্ষা শেষ হয়ে তখন আবার অন্য অপেক্ষা ।

কবে শালুক আসবে দেখা করতে! লুকিয়ে-চুরিয়ে মিনিট দশেক কথা।একটু ছোঁয়া। আর নিঃশ্বাসের গতি হঠাৎ বেড়ে যাওয়া।

তারও পরে আরো অপেক্ষা। কবে দুজন সব বাঁধা কাটিয়ে,পরিবারের শাসন উপেক্ষা করে এক হব!

সে অপেক্ষারও অবসান হল নির্দিষ্ট সময়েই।

সময়টা কী নির্দিষ্ট ছিল, নাকি ভাগ্য ! কে জানে!

একা একা কত দিন রাত অপেক্ষার প্রহর গোনা। কখন শালুক বাড়ি ফিরবে কাজ শেষ করে, তার প্রতীক্ষায় চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।একটা একটা করে বাস, অটো, ট্যাক্সি যে যার মত চলে যায় গন্তব্যে। ঘরের মানুষ ঘরে ফেরে।রাতের প্রহরী ল্যাম্প পোস্টে লাঠি মেরে বাঁশি ফুঁকে জানিয়ে দেয়, রাত হয়েছে , ঘুমোও এবার ।

আরশির ঘুম আসে না। ঘরের মানুষ এখনো রাস্তায়। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নিশাচর কত মানুষের সঙ্গে ভাব জমে ওঠে।

 আকন্ঠ মদ খেয়ে ঘর খুঁজে না পাওয়া ছেলেটিকে পরম যত্নে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে আরশি জেনে যায়, ইঞ্জিনিয়ার ছেলের বাপ পালিয়েছে তার মাকে ছেড়ে অন্য কোনো মেয়ের সাথে। পেলে খুন করে দেব. . আমার মা দু’বার মরতে গেছিল ওই শা… … দুঃখে। আমি বুঝি তোর কেউ নই! বুঝলে দিদি পৃথিবীটা হচ্ছে একটা বা… !

আরশি ঘর অবধি পৌঁছে দেয়। শান্ত ভাবে বলে, সময় সব ভুলিয়ে দেয়, দেবে। এত মদ খাস না। তুই মরে গেলে তোর মার কী হবে!

পরদিন অফিসে যাবার সময় সেই ছেলে আরশিকে দেখে চোখ নামিয়ে দ্রুত রাস্তা পেরোয়।

আরশি ভাবে রাতের অন্ধকারেই এভাবেই ঢাকা থাকে বুঝি সব বিষাদ ।

***

দেবী অর সঞ্জন, কৃপয়া ধ্যান দিজিয়ে আচনক রাঁচিমে ভারী বর্ষন হোনে কে কারণ উড়ান কলকাতা লট যা রাহা হ্যায় ।

মা , শুনলে? ও মা, ঘুমিয়ে গেলে নাকি! পালকির ডাকে চমক ভাঙে আরশির।

মা, প্লেন আবার কলকাতায় ফিরে যাচ্ছে। ব্যাড ওয়েদারের জন্য।

ও। কী আর করা যাবে, বলে আরশি জানলার বাইরে তাকালো। সে যেন চাইছিলই দ্রুত না পৌঁছতে।

ঘন কালো মেঘ ঘিরে আকাশটা। মনে হচ্ছে সাতটা সমু্দ্র একসঙ্গে। কালো কালো অজস্র  ঢেউ সাপের মত ছোবল মারতে ছুটে আসছে পাড়ের দিকে। অন্যদিকে নানা মুখের সারি। একটা মুখ মিলিয়ে যেতে না যেতেই আরেক মুখ। তারপর আরেকটা।

ছোটোবেলায় যখন বাবা এয়ারপোর্ট যেত ফ্লাইট ধরবে বলে, আরশি অপেক্ষা করত কবে কখন বাবা ফিরবে ওই আকাশের বুক চিরে মাটির পৃথিবীতে ।

বাবা। বাবা। সেই অপেক্ষায় কত যে ভালবাসা লুকিয়ে থাকতো! বাবা ছাড়া কেই বা বুঝতো তাকে!তার যাবতীয়  মান অভিমান চাওয়া পাওয়ার একটাই তো ঠিকানা ছিল।

বাবার যেদিন ফেরার কথা থাকত সেদিন যত রাতই হোক না কেন, ঘুম আসত না আরশির। জানলার ধারে বসে কত কিছু যে দেখত। নেপালি নাইটগার্ড- জাগতে রহো বলে,  চিৎকার করতে করতে পাড়া চক্কর দিত। তার সঙ্গে কতগুলো কুকুরও হঠাৎ করে চেঁচিয়ে উঠত একযোগে। মা বলত, চোরেরা সজাগ হয়ে যায়, বুঝে যায় পাড়া জেগে আছে।

জানলায় বসেই সে দেখত, লালু কাকু জোরে জোরে গান গাইতে গাইতে আসছে। তার পাশে পাশে কুকুরগুলোও গান জুড়ত। যেন সমবেত সঙ্গীতের মহড়া চলছে।

খানিকক্ষণ এসব দেখে সে আকাশের দিকে তাকাত। ওই বুঝি বাবার প্লেন উড়ে আসছে। বাড়ির ছাদে নামলে ভারী মজা হত। বাবাকে কষ্ট করে গাড়ি ধরে আসতে হত না। কালিচরণ কাকুরও ভালো হত।এত রাত অবধি বাবার জন্য অপেক্ষা করতে হত না এয়ারপোর্টে। এসব ভাবতে ভাবতেই সাইরেন বাজার শব্দ শুনতে পেত। দূর থেকে কখনো নীল কখনো লাল আলো ঘুরতে ঘুরতে  বাড়ির কাছাকাছি আসা মাত্র সে ছুট্টে গিয়ে দরজা খুলত, তারপর বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পরত।

কী রে এখনো জেগে আছিস! বলে বাবা আদর করত।তারপর পকেট থেকে বের করে আনত মুঠো মুঠো  চকলেট।

বহুদিন অবধি আরশির ধারণা ছিল, চকলেটগুলো প্লেনে উঠলেই পাওয়া যায় ।

নিজে প্রথম ফ্লাই করার সময় সেই ভুল ভেঙে ছিল। একটা চকলেট, তাও সব প্লেনে নয়। তবু কী ভীষণ বিশ্বাস ছিল, তার বাবা বিখ্যাত ছিলেন বলে এত চকলেট পেতেন।

শালুক বলেছিল, তোমার বাবা দেশের সেরা মানুষ। তিনি যেটা পেতেন, আমরা সাধারণ মানুষ কী তা পেতে পারি!

সেই বাবাও চলে গেল। শেষসময় তাকে ঘর থেকে জোর করে বের করে দিয়েছিল কেউ।এতটুকুই মনে পরে।বাকিটা অনেক চেষ্টা করেও … কেবল অন্ধকার নেমে আসে দুচোখের পাতায়।মাথা ভারী হয়ে যায়।

একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল সে।

বাবা! কোথায় তুমি! এই মেঘেদের মধ্যে ভাসমান নৌকায় তুমি বসে আছ?  দেখতে পাচ্ছ আমায়? আমিও তো আকাশে মেঘের মাঝে। তুমি কী এই সীমানা ছাড়িয়ে আরো উচুঁতে? নিজের মনেই প্রশ্ন করল আরশি।

আর তখনি মনে পরল ক্লাস এইটে পড়ার সময় প্রথম ঘড়ি বাবা এনেছিলেন গৌহাটি থেকে। বেশ ক’দিন বাবার ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকার পর এক রাতে। জামা ছাড়ার আগের সেই সোনালী ঘড়ি আরশির হাতে।

ঘড়ি হাতে পরে আরেক অপেক্ষার শুরু। প্রতিটা মুহূর্ত দেখার অপেক্ষা। কেমন করে হাতের মধ্যে বাঁধা সোনালী চাকতির কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে , অনাগত ভবিষ্যতের দিকে, এগিয়ে যাচ্ছে জীবনের পথ বদলের সাক্ষী হতে।

***

লেডিস এ্যান্ড জেন্টলম্যান এ্যাটেনসন প্লিজ. . . 

মা, আবার কলকাতা। কতক্ষণ কাটাতে হবে কে জানে! পালকির কথা শুনে আরশি হাসল।

 কী হল হাসছ কেন?

কিছু না, এমনি, বলে আরশি কলকাতার আকাশের দিকে তাকালো। চারদিকে সাদা তুলোর মতো পেঁজা মেঘ। কত রকম তাদের অঙ্গ ভঙ্গি। দেখতে দেখতে হঠাৎ আকাশ ছেয়ে গেল কালো মেঘে। বৃষ্টি নামল। সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে আরশি মোবাইল পকেট থেকে বের করে  ফ্লাইট  মোড থেকে নর্মালে এনে শালুককে ফোন করল।

ফোন ধরেই শালুক বলল, রাঁচি পৌঁছলে?

না। রাঁচি থেকে আবার কলকাতায় ফিরে এসেছি।

কেন? কী হল?

সেখানে ঝড় বৃষ্টির জন্য ফ্লাইট নামতে পারে নি।

এয়্যার ক্রুদের কাছে জানতে চাও কত দেরি হবে।পালকিকে দাও ফোনটা।

বাবা কথা বলবে পালকি।বলে আরশি পালকির হাতে ফোন দিল।

হ্যালো বাবা, এরা নিজেরাও এখনো জানে না। বলছে রাঁচিতে বৃষ্টি কমলে এখান থেকে ছাড়বে আবার। আর ফুয়েলও নিতে হবে।ততক্ষণ কিছুই করার নেই।

বাইরে বেরিয়েছ?

বাইরে মানে? ফ্লাইটের মধ্যেই বসে সবাই।ছাড়লে জানাচ্ছি তোমায়। আচ্ছা বাবা বাই।

পালকি আরশির হাতে ফোন ফেরত দিয়ে হেডফোন কানে গুঁজে গান শুনতে শুরু করল।

মেয়েটার কান মাথা সব নষ্ট হয়ে যাবে দিন রাত হেডফোন কানে লাগিয়ে। বিরক্তিকর। চোখটা বন্ধ করে নিল আরশি। সেই ভেড়াটার মত, যে ভেবেছিল, চোখ বন্ধ থাকলে বাঘ তাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু. .

হঠাৎ মনে হল, এখন ছেলে মেয়েরা সারাদিন কানে এই যন্ত্রটা লাগিয়ে রাখছে। যাকেই জিঞ্জেস করা হয় ,  সেই বলে গান, বা কিছু শুনছে বা দেখছে। সত্যি এরা একটা গানও পুরো জানে?

বাবু নামে যে ছেলেটি গাড়ি চালায়, কানে তার সবসময় হেড ফোন গোঁজা। মাঝে মাঝে দু’একটা গানের কলি কানে আসে। বাবু বলে, ম্যাডাম টেপটা লাগান গাড়িতে। অ়থচ তার মুখ থেকে কোনোদিন এক কলি গানও এতগুলো বছরে শুনতে পায় নি।

টেপ রেকর্ডার।  টেপ… টেপ।

প্রথম টেপ বাড়িতে এসেছিল ১৬ বছরের জন্মদিনে। তারসঙ্গে বাছাই করা কিছু রবীন্দ্র সংগীত, নজরুলগীতির ক্যাসেট। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমে গোটা কয়েক ক্যাসেট ক্রমাগত বেজে চলেছে ।  আরো পরে একে একে ঢুকে পরল গণসঙ্গীত, লোক সঙ্গীত আর গীতা দত্ত কিশোর মান্না । ঘুম থেকে উঠেই ঝুম সেগুলো চালু করে দিত। পড়া আর গান, গান আর পড়া। সবকটা গান শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেল কবে নিজেরাই টের পায় নি। ঝুম প্রতিটি পরীক্ষার খাতায় নিচে একটা করে গানের লাইন আর নিজের নামের সিগনেচার লিখে আসত।

কত অনুষ্ঠানে এসব গান সে করে বেরিয়েছে।

তখন গান শোনার জন্য এই যন্ত্র আবিষ্কার হয় নি। ভাগ্যিস হয় নি। তাই স্রষ্টা বিভিন্ন শব্দ শুনে সুর লয় বাঁধতেন। মিউজিক কম্পোস হত প্রকৃতির সুরের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে ।

এরা সারাদিন কান বন্ধ রাখলে বাইরের এত শব্দ উচ্ছ্বাস শোনে কী করে, ভেবেই মনে হল, এরা তাহলে সব রকম শব্দ, বাহ্যিক অনুভূতি, মানে ভিজুয়্যাল এফেক্ট থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে একক নির্জনতায় বিশ্বাসী। কিন্তু বাইরের শব্দ না শুনলে, বিভিন্ন মানুষের মুখের নানা ভঙ্গি না দেখলে কীভাবে নিজেকে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে?

সেই জন্যেই, এবার সে নিশ্চিত, বাইরের জগতের সাথে তাল দিতে না পারার জন্যই, হেডফোন আর মোবাইল সরে গেলেই এই ছেলেমেয়েরা এত উত্তেজিত হয়ে পরে, চিৎকার করে কথা বলে, কারোর কোনো কথা শোনে না। আরো কত কী! আসলে একটা যান্ত্রিক মাধ্যমের কথা শুনতে শুনতে এই মানুষের দল যান্ত্রিক হয়ে গেছে ।

সে পালকির দিকে তাকালো। একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে ফ্লাইটের গেটের সামনে গেল। সেখানে কো পাইলট, আর ক্রুজ মেম্বাররা কানে লাগানো যন্ত্রে কারোর নির্দেশ নিচ্ছে।

তারপরেই নিচে দাঁড়িয়ে থাকে এয়্যারক্রাপ্ট কর্মীকে বুড়ো আঙুল তুলে হাত দেখালো।

কেবিন ক্রু মেয়েটি , বুকের উপর অপরূপা লেখা , ভূবনমোহিনী হাসি হেসে বলল, ম্যাডাম সিটে যান প্লিজ।

সিটে ফিরে এসে বসা মাত্র বেজে উঠলো ,

দিল্লিগামী ভায়া রাঁচি ৩০৮ উড়ান আকাশে ওড়ার জন্য প্রস্তুত. . . যাত্রীদের সিটবেল্ট বেঁধে নিতে অনুরোধ করা হচ্ছে . . .

আরশি মোবাইল থেকে ডায়েল করল, প্লেন ছাড়ছে, রাঁচি পৌঁছে কল করব। সব ঠিক থাকলে দেখা হচ্ছে ।

ওদিক থেকে উত্তর এলো, চলে এসো, আমি এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেছি।

আরশি অবাক হল। এত বছরে এই প্রথম শালুক এয়ারপোর্টে নিতে আসছে, তাও তারা পৌঁছবার আগেই পৌঁছে গেছে !

দিদা বলতেন, সবুরে মেওয়া ফলে, অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়. . .

তবে কী! আরশি নিজের মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা নানা রঙের বৃষ্টিগুলোকে জানলার দিকে মুখ বাড়িয়ে মুক্তি দিল।

আকাশ এখন রোদে ঝলমল । একটু আগের তীব্র বৃষ্টি ভেজা এয়্যারগ্রাউন্ড ছুঁয়ে কেবল অল্প জলের উপর রোদের  চিকচিক রেখা।

বিতস্তা ঘোষাল। কবি, গল্পকার ও অনুবাদক। জন্ম ৫ই জানুয়ারি, ভারতের কলকাতায়। ইতিহাসে এম এ, কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’র সম্পাদক। ‘বাংলা আকাডেমি’, ‘একান্তর কথা সাহিত্যিক', 'চলন্তিকা' পুরস্কারপ্রাপ্ত। বিতস্তার প্রকাশিত বই ২২টি। তাঁর কবিতা হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজিতে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..