অবৈধ গল্প

ফারহানা রহমান
গল্প, পডকাস্ট
Bengali
অবৈধ গল্প

রাত ৮.৪৫ মিনিট । আর মাত্র সোয়া একঘণ্টা পর, অর্থাৎ ঠিক রাত দশটার সময়, এতদিন ধরে জমানো ঘুমের ওষুধগুলো পানিতে গুলে খেয়ে নেবো। অনেকদিন থেকে একটু একটু করে ওষুধগুলো জমিয়েছি। অনেকদিন তো বাঁচলাম, চুয়ান্ন বছর অনেক সময়। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে সেই তো কবেই। অথচ এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে প্রত্যেকটি স্মৃতি। যেন একটু আগেই ঘটে গেছে ঘটনাগুলো। এরই মধ্যে তিরিশ বছর কেটে গেছে। কিন্তু রিপনের প্রতি আমার ভালোবাসার তীব্রতা কী এক অজানা কারণে বহুগুণ বেড়েছে। পাগলের মতো প্রার্থনা করেও এতোগুলো বছরে একটিবার চোখের দেখাও দেখতে পারলাম না ওকে। আর এখন তো জেনেই গেছি ও গ্যাংগ্রিনে মারা গেছে অনেকদিন হয়েছে। মৃত্যুর সঠিক সময়টিও কেউ জানে না। শুনেছি কে বা কারা ওর দুইহাত আর দুইপা কেটে রাস্তায় ফেলে রেখে গিয়েছিল। কেউ না জানলেও আমি জানি এই জঘন্য কাজ শুধুমাত্র বদিউজ্জামানই করতে পারে।

মাঝেমাঝে নিজেই বিস্মিত হই নিজেকে দেখে। কী করে তিরিশ বছর ধরে একটি ঘরেই এভাবে বন্দি হয়ে রয়েছি। চোরের মতো মানুষের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখি। যখনই আত্মহত্যার কথা মনে হয়েছে মা’মনির মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠত আর মনে হতো রিপনের কথা। জানি এটা অসম্ভব তবুও মনের কোনে কোথাও যেন টিমটিম করে একটু আশার আলো জ্বলে ছিল। মনে হতো হয়তো কোন একদিন কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে যাবেই। আর বারবার কাছে পেতে চেতাম মা’মনিকে, বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে চাইতাম আমার ছোট্ট মেয়েটাকে! এখন তো সে নিজেই দু’সন্তানের মা। শুনেছি ঘর সংসারী হয়েছে মেয়েটা, আমেরিকার ফিলাডেলফিয়াতে স্বামী-সন্তান নিয়ে সে দিব্যি রয়েছে।

গল্পটির অডিও শুনুন এইখানে:

কোনকিছুর জন্যই আমার কোন অপরাধবোধ নেই। এখনো বিশ্বাস করি, যা করেছিলাম ঠিকই করেছিলাম। প্রেম আর যুদ্ধে তো সবই করা যায়। সবই বৈধ। অতীতের কাছে যখনই ফিরে যাই, প্রথমদিনটির কথাই মনে পড়ে; আর সেইসব উদ্দাম প্রেমময় দিনগুলোর কথা।

আজকের মত সেদিনও ঠিক এভাবেই মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছিল। ঢাকা চট্টগ্রামের ট্রাংক রোডের পাশেই আমার স্বামী বদিউজ্জামান (যে একজন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী এবং আমার চেয়ে ছাব্বিশ বছরের বড়)। অনেকদিন আগে ছোট একটি হোটেল দিয়েছিল। যদিও সেটি এখন আর মোটেও ছোট নেই। কে না জানে হোটেল জামালি এখন একটি ব্রান্ডের নাম! এদেশে অভিজাত হোটেল রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করতে ভালবাসে অথচ হোটেল জামালিকে চিনবেনা এমন হওয়া প্রায় অসম্ভব।

হোটেলের পাশেই বদিউজ্জামানের দাদা অর্থাৎ আমার দাদা শ্বশুর এই বাড়িটি বানিয়েছিল বহুবছর আগে। সেসময়ের সেই একতলা ভবনটি আজ আকাশছোঁয়া বহুতল ভবন। একশ শতক জায়গার ওপর পাঁচটি মাল্টিস্টোরেজ ভবন গড়ে উঠেছে। সেগুলোর একটি ভবনের ওপরের দিকে একটি ফ্ল্যাটে বহুবছর ধরে আমি বন্দি হয়ে আছি। দিনরাত গড়িয়ে কখন যে মাস বছর পেরোয় আমি জানিনা। আগে খাবারের সময় হলে বিশ্বস্ত কাজের বুয়া হোসনা খালা এসে তালা খুলে খাবার দিয়ে যেতো। বছরখানেক হলো হোসনা খালা মারা গেছে। এখন ওর বড় মেয়ে মরিয়ম এসে খাবার দিয়ে যায়। বহুবছর ধরে মানুষের সংস্পর্শ বলতে আমি আসলে এই দু’জনেরই পাই বা পেয়েছি বলা যায়। আমাকে খাবার দেওয়া, ওষুধপত্র দেওয়া, আমার নিত্য ব্যবহারের প্রায় সবকিছু এরাই আমাকে এনে দেয়। তবে মানুষের খাওয়াপড়া ছাড়াও জীবন কাটানোর জন্য আনুসাংগিক আরও অনেক কিছুই লাগে। মাঝেমঝে কমোডের ফ্ল্যাশ নষ্ট হয়ে যায় বা ভাল্ব জ্বলে যায়, এছাড়াও আছে নানান রকমের ইলেকট্রনিক জিনিশপত্র। এসবও তো বিকল হয়। আর তখন সিকিউরিটির ম্যানেজার সাথে করে নিয়ে আসে মেকানিক। এই ১৬৮০ স্কয়ারফিটের বাড়িতে আমি বছরেরপরবছর কীভাবে সময় কাটাই, যদি কেউ জানতে চায়, তাহলে বলি আমার কোন ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেট নাই। তবে ডিস লাইনসহ একটি আধুনিক টেলিভিশন, লিভিংরুমের দেয়ালে ঝুলে আছে। যা আমি শেষ কবে অন করেছি মনে নেই। তবে আমার হেদায়েতের জন্য বদিউজ্জামান অনেক অনেক হাদিস কোরানের বই দিয়ে বুকশেলফ ভরে দিয়ে গেছে। কিন্তু ধর্মেকর্মে যে আমার তেমন মন নেই, সে নিশ্চয়ই আপনারা এতক্ষণে বুঝে গেছেন। একাএকা থাকতে থাকতে যখন আমার বদ্ধপাগল হওয়ার উপক্রম তখনই প্রথমবারের মতো আমি বদিউজ্জামানকে ডেকে পাঠালাম। উনি কিছুতেই আমার মুখোমুখি হতে চান নি, তাই দরজার ওপাশ থেকেই জানতে চাইল, যে আমার কী দরকার। আমি বললাম কিছু বই, গল্প উপন্যাসের বই। একটি কথাও না বলে উনি চলে গেলেন। আমার বেঁচে থাকার শেষ ভরসাটুকুও বন্ধ হয়ে গেলো ভেবে আমি বহুদিন পর হাউমাউ করে চিৎকার করে সারাদিন শুধু কাঁদলাম।

আশ্চর্য ব্যাপার হলো, সন্ধ্যার পর দেখলাম চারটা বড় বড় ব্যাগ ভর্তি বই নিয়ে এসেছে দু’জন সিকিউরিটি গার্ড। বুয়া এসে বইগুলো সুন্দর করে বুকশেলফে গুছিয়ে দিয়ে গেল। এরপর ক্রমেই বইয়ে বইয়ে ভরে উঠলো আমার ঘর। আর আমি যেন একটি নতুন জীবন পেলাম। তবু ইদানীং নিজেকে আর বয়ে বেড়াতে পারছিলাম না। বড় ক্লান্ত লাগতো। চোখেও আগের মতো দেখতে পাইনা, তাই বই পড়া কমে গেছে। গতবছর হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলায় হোসনা খালা এসে আমার সাথে অনেকরাত পর্যন্ত বসে রইলো। আমাকে নিজ হাতে ভাত মাখিয়ে মায়েরমতো আদর করে মুখে তুলে ভাত খাওয়ালো। মাথায় তেল মালিশ করে চুল আঁচড়িয়ে দিল। অনেক অনেক কথা জানতে চাইল। হোস্না খালার এমন আচরণে আমার মনের ভিতর কেন যেন কু ডাক দিতে লাগলো। একসময় আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে খালা কাঁদতে লাগলো, জীবন কিছুইনা, মৃত্যুই যে সবচেয়ে বড় সত্যি। দুদিন আগে পরে সবাইকে যেতে হবে এসব কথার ফাঁকে জানালো যে রিপন আর বেঁচে নেই! কথাটা শোনার পর মুহূর্ত থেকেই এক অর্থহীন জীবনের বোঝা টেনে টেনে বিধ্বস্ত হয়ে গেছি আমি। মানুষের বেঁচে থাকার শেষ আশাটাও যখন নিভে যায় জীবন তখন বিষাক্ত সাপের মতো বারবার ছোবল দেয়। এরপর থেকে কী এক অসুস্থ-অস্থির সময় কাটিয়েছি বলে বোঝাতে পারবনা। আর আজকে সকালে যখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে নিজেকে মুক্তি দিয়ে দেবো, তখন থেকেই একধরনের স্বস্তি ফিরে এসেছে।

আজকের মতোই এভাবেই মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন। বিছানায় বসে বসে জানালার পাশের পর্দা উঠিয়ে রাস্তার উপর অঝরে বৃষ্টি পড়া দেখছিলাম। আমার সাত বছর বয়সি মেয়ে মলি (ওকে আমি মামুনি ডাকি) লুডু খেলার জন্য ভীষণ বিরক্ত করছিল বলে বৃষ্টি দেখার ফাঁকে ফাঁকে একটু একটু করে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম, আর সেইসাথে সাপলুডুতে দু’একটা চালও দিচ্ছিলাম। ঝমঝম বৃষ্টির মাঝে বড় রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে ছিল। দূর থেকে কে যেন হেঁটে আসছে দেখতে পেলাম।

কী ছিল সেই হাঁটার মাঝে? না চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য, না রঙয়ের জৌলুশ, না পাগল করা ব্যক্তিত্বের আভা। অথচ বিশ্বাস করুন আমি একবার দেখেই উন্মাদ হয়ে গেলাম! এমনই সে উন্মাদনা যার জন্য অনেকগুলো জীবনকে মাশুল গুনতে হলো।

দূর থেকে দেখলাম বেশ লম্বা একটি শ্যামলা ছেলে, শ্যামলা না বলে কালোই বলা ভালো। অথচ কী আকর্ষণ! কী আকর্ষণ ওই ঘন শ্যাম কৃষ্ণতে? ওই দূর থেকে হেঁটে আসার মধ্যে কী যেন একটা ছিল। সত্যি বলছি, আমি একেবারে গোপীহীন রাঁধা হয়ে গিয়েছিলাম। সেসময়টিতে জানালার পাশে বিছানায় বসে ছিলাম। রিপন (তখনো নাম জানিনা) বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আসছে। চিনিনা, জানিনা, কখনো দেখিনি অথচ কিছুতেই আর বসে থাকতে পারলাম না। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দরজার দিকে আসতে গিয়ে প্রথমেই বেখেয়ালে পায়ের কাছে রাখা চায়ের কাপটা ভেঙে ফেললাম। সেই থেকে শুরু এরপর আরও কতকিছুই না ভেঙেছি। কপাল, সংসার, সন্তান, সামাজিকতা, সব সব।

দরজাটা হাট করে খুলে বৃষ্টির মধ্যেই বেহুঁশের মতো বাইরে বেরিয়ে এলাম। কোথায় যাচ্ছে ছেলেটা দেখতে হবে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছেলেটা আমাদের হোটেলেই এসে ঢুকল। আমিও ওর পিছন পিছন হোটেলে ঢুকলাম। কাছে গিয়ে বললাম ‘বৃষ্টিতে একদম ভিজে গেছেন, বসুন চা খান। আমাদের হোটেলে খুব ভালো ডালপুরি বানানো হয়। চা আর ডালপুরি খান। আমি দেখি আপনার মাথা মোছার জন্য কিছু পাই কীনা!’

দৌড়াতে দৌড়াতে রান্না ঘরের দিকে গেলাম। ওখানে একটি তাকে কাস্টমারদের জন্য পরিস্কার তোয়ালে ভাঁজ করে রাখা হয়। ব্যবহার করা তোয়ালে বদলে বদলে এখান থেকেই নেওয়া হয়। ওখান থেকে বেছে অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার একটি তোয়ালে নিয়ে রিপনকে দিলাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওর মাথাটা টেনে এনে বুকের কাছে নিয়ে আসি, তারপর দু’হাত দিয়ে আদর করে করে মাথাটা মুছিয়ে দিই। যেভাবে গোসলের পর মামনির মাথা মোছাই। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে ওর হাতে তোয়ালে তুলে দিলাম। এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেদিন চিৎকার করতে করতে হোটেল বয়-বেয়ারাদের কান ঝালাপালা করে দিয়েছিলাম। ওদের ডেকে বলেছিলাম দু’কাপ চা আর ৪টি ডালপুরি নিয়ে আসতে। তারপর ওর সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লাম। এক অপরিচিত নারীর এমন আশ্চর্য ব্যবহারে রিপন যারপরনাই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল। বুঝলাম এরইমধ্যে হোটেলের বয়দের মধ্যেও ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে। যেই আমি কালেভদ্রেও এদিকে পা মাড়াতে চাইনা, সে কীনা আজকে একজন অচেনা কাস্টমারের জন্য কেমন উত্তাল সমুদ্র হয়ে ফুঁসছে। জানিনা ওরা সবাই আমাদের কী ভেবেছিল? হয়তো ভেবেছিল আমরা দু’জন পূর্ব পরিচিত।

রিপন তো আমার পূর্ব পরিচিতই বটে! ওকে আমি যুগ যুগ ধরে খুঁজেছি, যুগ যুগ ধরে চিনি।  এ চেনা এমনই চেনা, যার শুরু বা শেষ নেই। দেহ মন ছাড়িয়ে এ যেন আত্মার সাথে আত্মার পরিচয়। রিপনের সাথে সর্বসাকুল্যে আমার প্রেমের সময় ছিল মাত্র দু’বছর সাতমাস। তবে প্রেম যদি মজে যায় সেটা সাতদিন, সাত বা সত্তুর বছরই বা কী! আসল কথা হচ্ছে প্রেম। যা জমে ক্ষীর হতে হবে। এই সময়ের মধ্যেই আমার সবকিছু ওলটপালট গেল। অথচ আমি তো সাত জনম ধরে ওর হয়ে গেছি।

রিপন টাংগাইলের ছেলে। ঢাকা কলেজ থেকে ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করে চট্টগ্রামে এসে সোনালী ব্যাংকে জয়েন করেছিল। আমার সাথে যখন ওর পরিচয় হয় তখন ও একটি মেসে থাকতো। পরিচয়ের পরেরদিনই আমি ওর মেসে গিয়ে হাজির হই। তারপর ওর নিষেধ আর অন্য সবার নানা কাঁনাঘুষা আর গঞ্জনা উপেক্ষা করে প্রত্যেকদিন ওর ওখানে যেতে থাকি। আমার অতিব্যস্ত ব্যবসায়ী বিশ্বসন্ত্রাসী স্বামী, সবার প্রিয় বদিভাই (বদিউজ্জামান) সংসারের কোন ব্যাপারে কখনোই তার নজর দেওয়ার কোন সময় ছিলনা। তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞ্যান ব্যবসার পসার বাড়ানো আর কোন এলাকার পাশ দিয়ে কোন বড় রাস্তা যাবে বা কোথায় ব্রিজ হওয়ার প্ল্যান পাশ হয়েছে তার আশেপাশের সব জমি কিনে রাখা, আবার সুযোগ মতো সেগুলো বিক্রি করা। সেইসাথে ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা। এ বাড়ির ঘরে ঘরে আয়রন সেফ, আর তাতে কাড়ি কাড়ি টাকার স্তূপ করে রাখাই তার একমাত্র শখ। আমি ঘৃণা করি এসব। ঘৃণা করি এই বুড়ো হাবড়ার কথাবার্তা, আচরণ আর ওর সব চিন্তাভাবনা; সব কিছুকেই।

আমি আর রিপন যখন প্রেমের বাঁধভাঙা জোয়ারে ভেসে যেতে থাকলাম তখন আর রিপনের পক্ষে বেশীদিন মেসে থাকা সম্ভব হলনা। ওকে আমি দেখেশুনে চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকা খুলসিতে একটা নির্ঝঞ্ঝাট বাসা ভাড়া করে দিলাম। এরপর প্রতিদিন দুপুরে খাওয়ার পর ওর নতুন বাসায় যাতায়াত করতে লাগলাম। ঝটপট ঘর পরিষ্কার করা রান্না করা সব নিজ হাতে করে সন্ধ্যার আগেই সেজেগুজে ওর জন্য অপেক্ষা করতাম তারপর দুজনে নিভৃতে ২/৩ ঘণ্টা কাটিয়ে রাত নয়টা, সাড়ে নয়টার মধ্যে বাসায় ফিরে যেতে লাগলাম। এভাবে আসাযাওয়া করা ছাড়াও কক্সবাজার, টেকনাফ, বান্দরবান, সিলেটসহ কত শহরে যে গেছি, তার হিসেবে নেই। সেখানে দুয়েকদিন থেকে আবার ফিরে এসেছি। কী করে ঘরসংসার ফেলে, মামনিকে ফেলে সেই উদ্দাম বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াতাম, সেসব আরেক ইতিহাস।

কিন্তু যার জন্মের তিনদিনের মাথায় মা আর পাঁচবছর বয়সে বাবা মারা যায়। যাকে ফুপুর বাসায় লাথিঝাটা খেয়ে বড় হতে হয় আর মাত্র ষোল বছর বয়সে বিয়াল্লিশ বছরের লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, তার কপালে কী কারণে সুখ সইবে বলুন! তাই আমার প্রেমলীলাও এক সময় চাউর হয়ে গেলো আর আমিও যখন-তখন এদিক-সেদিক যাওয়ার স্বাধীনতা হারালাম। কিন্তু এতো সহজে হার স্বীকার করার মানুষ তো আমি নই। দিনরাত কেঁদে কেটে, না খেয়ে থেকে, চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়লাম।  আজকের মতো মোবাইল ফোনের যুগ তো আসেনি, তাই একটু সুস্থ হতেই অফিসে ফোন করে দেখা করতে বললাম।

রিপন আগেও আমার এই বাড়িতে এসেছে। বাড়ির কোথায় কী আছে সব সে জানে। এটি মূলত আমার দাদা শ্বশুরের তৈরি করা করা বাড়ি। আমার শ্বশুর তার একমাত্র ছেলে হওয়াতে বিয়ের পর এই বাড়িতেই দুইমেয়ে আর তিনছেলে নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। শুনেছি, আমার শ্বশুর-শাশুড়ি কখনো এক রুমে থাকতেননা। তাদের দুজনের দুই রুম, আমার দুই ননদের জন্য একটি রুম আর তিন ছেলের জন্য তিনটি রুম অর্থাৎ এবাড়িতে মোট পাঁচটি বেড রুম আছে। আমার বিয়ের বহুবছর আগেই শ্বশুর মারা গেছেন। দুই ননদের ছোটজনের ঢাকায় বিয়ে হয়েছে আর আরেক ননদ আর দুই দেবর বিয়েশাদি করে আমেরিকায় স্যাটেল করেছে। আমার বিয়ের পাঁচ-ছয় মাসের মাথায় ঘুমের মধ্যেই শাশুড়ি মারা গেলেন। সেদিন দাফন কাফন শেষে কবর দিয়ে এসে আমার স্বামী মার রুমে ঢোকার একটু পরেই বিকট চিৎকার দিয়ে রুম থেকে দৌড়ে এসেই বেহুঁশ হয়ে গেলেন। রাতে হুহু করে জ্বর এলো। সেই জ্বর তো আর সারে না। প্রায় দশ বারো দিন পর একটু সুস্থ হতেই তিনি ওই রুমে তালা ঝুলিয়ে আমাকে চাবির গোছা দিয়ে বললেন,‘তুমি কাউকে দিয়ে মাঝেমাঝে ঘরটা পরিষ্কার করিয়ে রেখো, আমি আর ওদিকে যাবনা।’ সত্যি সত্যি উনি আর কোনদিনই ওই ঘরমুখো হন নি। সেদিন ঠিক কী হয়েছিলো সেটা অবশ্য কখনই কাউকে বলেন নি।

শুনেছি আমার স্বামী নাকী পণ করেছিলেন চিরকুমার থাকার কিন্তু আমাকে দেখেই নাকি তার ধ্যান ভেঙে যায়। ঢাকার ধানমণ্ডিতে যে বাড়িতে আমি আমার ফুপা-ফুপির কাছে বড় হয়েছি তার ঠিক পাশের বাড়িটাই আমার ছোট ননদের শ্বশুর বাড়ি। তখন ক্লাস টেন এ পড়ি। স্কুল থেকে রিকশায় চড়ে মাত্র বাসার সামনে নেমেছি। হঠাৎ চোখ পড়লো পাশের বাসার বারান্দা থেকে একটি মাঝবয়সী লোক আমাকে খুব মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করছে। সেইদিনই সন্ধ্যায় দেখলাম পাশের বাড়ির মহিলা তার স্বামী ও শাশুড়িকে নিয়ে আমার ফুপুর বাড়িতে হাজির। আমার ফুপা-ফুপির সাথে তাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছিলো জানিনা, তবে দেখলাম আমাকে ডেকে মহিলার শাশুড়ি খুব আদর করে পাশে বসালো। ‘কাছে এসো মা, এখানে আমার পাশে বসো। আলহামদুল্লিলাহ, কী সুন্দর মেয়েটা। কী সুন্দর চুল, কী সুন্দর গায়ের রঙ! বাপ-মার দোয়া না থাকলে এতো ভালো মেয়ে পাওয়া যায়না। আমাদের বদিউজ্জামান অনেক পুণ্যের ফল, এমন বউ।’ এসব বলতে বলতে আমার হাতে দু’হাজার টাকা গুঁজে দিলেন। আমার ফুপি উনাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে বললেন, আমিও বিস্ময়ের ঘোরে সালাম করে চলে আসলাম। রাতে জানতে পারলাম তিনদিন পর আমার কাবিন হবে আর একমাস পর আমাকে তুলে নেওয়া হবে। দুপুরে দেখা সেই মাঝবয়সী লোকটার সাথে যে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে, সেটা তখনো জানিনা; তবে শুনলাম চট্টগ্রামের খুব ধনী পরিবারে আমার বিয়ে হচ্ছে।

আমার মা মারা যাওয়ার পর আব্বা তিনদিন বয়সী আমাকে নিয়ে নিরুপায় হয়ে মোহাম্মদপুরের বাসা ছেড়ে দিয়ে এখানে আমার বড় ফুপুর বাসায় এসে উঠেছিলো। সেই থেকে এটাই আমার বাসা। শুনেছি আম্মা মারা যাওয়ার পর থেকেই আব্বা চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে যখন-তখন একটা মোটরসাইকেল নিয়ে কয়েকদিনের জন্য উধাও হয়ে যেতো। কারো সাথে কোন যোগাযোগ করতো না। আবার নিজে থেকেই দশ পনেরোদিন পর এসে হাজির হতো। এভাবে উধাও হতে হতেই আমার পাঁচ বছর বয়সে আব্বা চিরদিনের জন্য উধাও হয়ে গেলো, আর কখনো ফিরে এলোনা। কেউ কেউ বলে খুন হয়েছে, কেউ বলে বিদেশে চলে গেছে , কেউ বলে মোটরসাইকেল এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমার আব্বার কী হয়েছিলো আর সেই মোটরসাইকেলটাই বা কোথায় উধাও হয়ে গেলো কেউই বলতে পারে না।

ছোটবেলা থেকেই ফুপা আমাকে সহ্য করতে পারতোনা। আব্বা গায়েব হওয়ার পর থেকে আমি যেন তাঁর চক্ষুশূল হয়ে গেলাম। কতোভাবে যে উনি আমাকে মানসিক অত্যাচার করতেন তার হিসেব নেই। এদিকে একটু বড় হওয়ার পর থেকেই শুরু হলো আরেক অত্যাচার। সুযোগ পেলেই স্তনে, উরুতে, হিপে চাপ দেওয়া, এসব দিনদিন বাড়তেই লাগলো। আমার ধারনা ফুপু এসব বুঝতে পারতো কিন্তু বাপ-মা মরা এতিম মেয়েকে নিয়ে কী যে করবে বুঝে উঠতে পারছিলোনা। তাই তো টাকাকড়ি আছে এমন একজন অবিবাহিত পুরুষ হোকনা বিয়াল্লিশ বছর, আমার জন্য স্বামী হিসেবে পেয়ে একেবারে ধন্য হয়ে গেলো। একবারের জন্যেও তার চেহারা দেখারও প্রয়োজন মনে করলো না। আমার মতামত চাওয়া, এ তো কল্পনা মাত্র! বিয়ে হবার পরে আমি চট্টগ্রামে চলে আসলাম। এক বছরের মাথায় মামনির জন্ম হলো ।

বদিউজ্জামান লোকটা বাইরের লোকের কাছে সন্ত্রাসী হলেও আমার সাথে খুব বেশী খারাপ ব্যবহার করতো না। কিন্তু লোকটার সাথে কোথায় যেন আমার ফুপার মিল আছে।  একেবারে অসহ্য। তার স্পর্শে আমার শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে। বিবাহিত জীবনের অসহনীয় আট বছরের মাথায় আমি রিপনকে পাই। সুখের ভেলায় ভাসতে ভাসতে দুই বছর সাত মাস চোখের পলকে কেটে গেলো। এরপর একদিন সব শেষ হওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু আমি তো আমার বেঁচে থাকার একমাত্র আনন্দকে এভাবে শেষ হতে দিতে পারিনা। আমি অসুস্থ বলে ও সন্ধ্যার পরপরই বাসার পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে আমার শাশুড়ির রুমে লুকিয়ে থাকল। রুমের তালা আগেই খুলে রেখেছিলাম। ও ঢোকার পর আবার বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে দিলাম। যেভাবেই হোক তাড়াতাড়ি মামনিকে ঘুম পাড়াতে হবে। সন্ধ্যারাতেই মেয়েকে জোড় করে একটু ভাত খাওয়ালাম। অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাচ্ছেনা দেখে ঘুমের ওষুধকে চারভাগ করে একভাগ দুধের সাথে খাইয়ে দিতেই দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলো। এদিকে রাত এগারোটার দিকে যথারীতি বদিউজ্জামান এলেন। রাতের খাবারের পর ঘুমাতে যাওয়ার আগে তিনি সবসময় এককাপ দুধ চা খান। চায়ের সাথে কয়েকটা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাকে খেতে দিলাম কিন্তু চায়ে একচুমুক দিয়েই তিনি বলতে লাগলেন ‘এতো তেঁতো কেন এই চা? আচ্ছা ফেলে দাও। আমি আর আজকে চা খাবনা’ আমি নানাভাবে বোঝালাম যাতে অন্য এককাপ চা তিনি খান যাতে আমি অন্তত একটা ওষুধ হলেও মেশাতে পারি। কিন্তু তিনি চা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন। কতরাত পর্যন্ত ঘাপটি মেরে বসে ছিলাম জানিনা। মামনি তো ঘুমিয়েই কাঁদা। একসময় ওর পাশ থেকে বদিউজ্জামানের গভীর নাকডাকার শব্দ আসার পরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তারপর নিঃশব্দে উঠে গিয়ে রিপনের রুমের তালা খুলে ভিতরে যেতেই ও আমার উপর ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো। এরপর আমরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে থাকলাম। কতক্ষণ কেদেছি জানিনা তবে ও একসময় উঠে লাইট জালিয়ে দিলো। বলল, ‘আমার সাথে তুমি এখনই যাবে। আমার পক্ষে তোমাকে ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয়’ ‘কী বলছো? কোথায় যাবো? আর আমরা যেখানেই পালিয়ে যাই উনি আমাদের ধরে আনবে। উনার কত ক্ষমতা তুমি জাননা।’ ‘আমি জানি, শোন আমি সব ভেবে এসেছি কি করতে হবে’

আমরা দুজনে মিলে পা টিপে টিপে শোয়ার ঘরে গেলাম। আমি বদিউজ্জামানের পায়ের কাছে আর রিপন মাথার কাছে গেলো। একই সাথে ও দুটো বালিশ নিয়ে ঘুমন্ত মানুষটার মাথা চেপে ধরল আর আমি শক্ত করে আরেকটা বালিশ নিয়ে উনার পায়ের উপর গিয়ে বসলাম আর শক্ত করে উনাকে চেপে ধরলাম যাতে বেশী নড়তে না পারে। বদিউজ্জামান তার শেষ শক্তি দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করে উঠে বসার চেষ্টা করাতেই মামুনির ঘুম ভেঙে গেলো। ডিমড লাইটের আলোয় ও পরিষ্কার দেখতে পেল আমরা দু’জন মিলে ওর আব্বুকে খুন করার চেষ্টা করছি আর ওর আব্বু প্রাণপণে যুদ্ধ করছে মুক্তি পাওয়ার। হঠাৎ মামনি দৌড়ে দরজার কাছে গেলো আর চিৎকার করে করে দরজা খোলার জন্য আঘাত দিতে লাগলো।

‘ইতারা আব্বুরে মারিফেলার, ইতারা আব্বুরে মারিফেলার, তোরা বাঁচাছোনা। অ্যাঁর আম্মু অ্যাঁর আব্বুরে মারিফেলার।’ এই বাড়ির গা ঘেঁসেই দাঁড়িয়ে আছে আমার চাচাতো চাচা শ্বশুরের বাড়ি, তার পরপরেই আরেক চাচা শ্বশুরের ও তার ছেলেদের বাড়ি। তখন রাত কয়টা বাজে? ভোর হয়ে গেছে কীনা জানিনা। তবে মনে হল শয়ে শয়ে হাতের ধূমধাম আঘাত পড়ছে দরজার ওপর। এরইমধ্যে কেউ একজন লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলেছে। রিপন কোথায় গিয়েছিলো? পরে কী হয়েছিলো ওর, আমি আর কিছুই জানিনা। এমনিতেই কয়েকদিন থেকে জ্বরে ভুগে ভুগে শরীর মন ভীষণ ক্লান্ত-দুর্বল, তার ওপর এতো কিছুর ধকল এই শীর্ণ-দুর্বল শরীর আর নিতে পরলো না। জ্ঞান হারানোর আগে শুধু শুনেছিলাম-

‘আইজো বদ্দার পরাণত রূহ আছে, আসপাতালত লইজন পরিবত, আসপাতালত লইজন পরিবত।’

তারপর? তারপর আর কিছুই নেই, তারপর আর কিছু থাকতে নেই।

ফারহানা রহমান। কবি ও গল্পকার। জন্ম ঢাকায়।  পিতা- মরহুম শেখ রহমত উল্লাহ ও মাতা- সালমা বেগম। লেখাপড়া করেছেন পল্লবী মডেল হাই স্কুল, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজ। ইংরেজি সাহিত্যে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট। কৈশোরে সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ থেকেই কবিতা লেখালেখির শুরু। সেই...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..