অমরত্ব ও তিনটি কবিতা

শ্বেতা সরকার
নারী, মুক্তগদ্য
Bengali
অমরত্ব ও তিনটি কবিতা

অমরত্ব

বাধ্য হয়েই মোবাইল এর স্ক্রীন থেকে চোখ সরালো তিয়াস।সারা দুপুর ধরে প্রায় দু়শো প্রোফাইল খুঁজতে খুঁজতে চোখ ব্যাথা করছে তার। একটানা এতক্ষণ মোবাইল সে কখনো দেখেনা। কিন্তু আজ তাকে নেশায় পেয়েছিলো। প্রায় বছর খানেক হলো স্মার্টফোন হাতে পেয়ে ফেসবুকে নাম লিখিয়েছে সে। সেই থেকেই খুঁজে চলেছে। ফেসবুকে নাকি সব্বার টিক্কি পাওয়া যায়। তাই সে খুঁজেই চলেছে। ফেলে আসা স্কুলের মুখ গুলোকে খুঁজেই চলেছে। যদিও চিনতে পারবে কিনা জানেনা। সে নিজেই কত বদলে গেছে এত বছরে। তবুও নাম ধরে সার্চ করে মাঝেমাঝেই। জানে একজনের টিক্কি পেলেই সবার টিক্কি পাওয়া যাবে। আজ সকাল থেকেই অদিতির কথা খুব মনে পড়ছে। ছটফটে হাসিখুসি শ্যামলা অদিতি।

পড়াশোনায় সাধারণ ছিলো বলে তিয়াসের বাবা মা খুব একটা পছন্দ করতেননা অদিতিকে। ক্লাসের টপ স্টুডেন্টদের সাথে তিয়াস বেশী মেলামেশা করবে এটাই কাম্য ছিলো বাবা মায়ের। তিয়াসের কিন্তু অদিতির সাথেই জমতো বেশী। একটু কম সিরিয়াস প্রানোচ্ছল অদিতির সাথেই বেশী বকবক করতো তিয়াস।কে জানে কোথায় আছে? কি করছে? দুপুরে তাই ফেবু খুলেই সার্চ করলো,”অদিতি হালদার “। সার্চ রিপোর্টে এলো প্রায় শ তিনেক প্রোফাইল। খানিকটা জেদের বশেই সব প্রোফাইল গুলো খুলে দেখতে শুরু করলো।

ঘন্টা চারেক ধরে প্রায় শ দুয়েক প্রোফাইল দেখে ক্লান্ত চোখে ক্লান্ত মনে ফোন অফ করলো তিয়াস। ব্যাটারি তখন লালবাতি দেখাচ্ছে। ভীষণ রকম একটা বিশ্রী খারাপ লাগা জমা হয়ে রইলো মনের কোণায়। মনের কোণায় খারাপ লাগাটা চাপা দিয়েই সে দিনের বাকি কাজ গুলো শেষ করলো। শেষ পর্যন্ত রাতের খাবার শেষে টেবিল মুছতে মুছতে ঠিক করলো, ধুত্তেরি আর খুঁজবইনা কাউকে। তারই যত বেশী বেশী আবেগ, যত বেশী বেশী কষ্ট। ওসব ফেলে আসা দিনের দিকে না তাকানোই ভালো। রাতে বিছানায় বসে নেট অন করতেই সৃজার ম্যাসেজ ঢুকলো,”গুড নাইট আন্টি “। ভারি মিষ্টি একটা পুঁচকে মেয়ে সৃজা। তিয়াসও গুড নাইট জানালো সৃজাকে। সৃজার পাঠানো চারটে ম্যাসেজ আনরিড রয়েছে। আজ আর সকাল থেকে কারোর ম্যাসেজ দেখা হয়নি। দুপুরে পাঠানো সৃজার ম্যাসেজটা পড়তে গিয়ে মনের কোণায় জমে থাকা খারাপ লাগাটা গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে গেলো।…. “ভারত বর্ষে যেসব মেয়েরা জন্মায় তারা সকলে মরে না।

ধরা যাক রিনা মজুমদার বলে কেউ জন্মালো। স্কুল, কলেজ, অফিস। তারপর সে বিয়ে করে রিনা বসাক হয়ে গেলো। বার্থ সার্টিফিকেট, স্কুল সার্টিফিকেট, সবের থেকে আলাদা একটা নামের ডেথ সার্টিফিকেট। আসলে যে জন্মালো, সে মরলো না। মরলো অন্য কেউ। ভারতবর্ষের ইতিহাসে কোটি কোটি মেয়েরা আসলে মরেনি। জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে তারা নিরুদ্দেশ। তার সেই নিরুদ্দেশ সম্পর্কে কোনো ঘোষণা শোনা যায়নি কোনোদিন”।

রোদ্দুর

রোদ্দুর,তুই নরম আদরে ঘাসফুল ছুঁয়ে দে রে,
সবুজ ঘাসেরা রোদ মেখে হেসে উঠুক।
জলের গায়ে আলোর নক্সা হ,
খুশি মেখে ঢেউ উঠুক গভীরে।

রোদ্দুর, তুই বুড়ো বটের ঝুরি বেয়ে দুলে,
লুটোপুটি খা প্রাজ্ঞতার কোলে।
শাখা প্রশাখায় কোটরে বাঁচুক প্রাণ,
সবুজ বাঁচুক আলো বেঁধে ক্লোরোফিলে।

রোদ্দুর, তুই বাষ্প ছুঁয়ে ডানা মেল আকাশে,
লুকোচুরি খেল মেঘের আঙিনায়।
তপ্ত ধরায় বৃষ্টির ছোঁয়া দিয়ে,
রামধনু আঁক স্নেহের পরশে।

রোদ্দুর, তোকে ছুঁয়ে মাখি শৈশবের আলো,
ছুঁয়ে যাই কত মায়াবী আলোর সুখ।
তুই আর আমি দিগন্ত পেরিয়ে যাই,
পড়ে থাক পিছে অলিগলি সাদাকালো।

রোদ্দুর, তুই চিলেকোঠার জানলায় উঁকি দিস,
জমানো কথারা কবিতায় লেখা হোক।
দিনের শেষে স্নিগ্ধ জ্যোস্না হোস,
কপালে আমার চাঁদের টিপ দিস।

রোদ্দুর, তোর সাথে খেলি কাটাকুটি আড়িভাব,
খেলতে খেলতে শৈশব ছেড়ে কৈশোর।
আর একটু তুই বড়ো হয়ে যা এবার,
জীবনে আসুক নীলখাম লাল গোলাপ।

রোদ্দুর, ইচ্ছেরা তোর ভিজুক গোলাপী সুখে,
আঙুলে জড়াক প্রতিশ্রুতির ওম।
বলবো সেদিন আমার রূপকথা,
এক রাজার কুমার আগলে রেখেছে বুকে।

হে নবীন

বেয়াল্লিশটি বসন্ত পার করে আসা আমি,
আজ তোমার সমুখে।
হে নবীন ছুঁয়ে দাও আমায়।
ছুঁয়ে দাও ঠোঁট কাঁধ,
জড়াও শিরদাঁড়ার বাঁক,
সে ছোঁয়া নামুক গভীর থেকে গহনে।
খসে যাক শুষ্ক পাতা।
খসে যাক জীর্ণ বাকল।
খসে যাক পুরাতন শালীন আগল।
জেগে উঠি শিরা উপশিরায় রক্তজালকে।
সেজে উঠি আজ বাসন্তী সাজে,
যে সাজ দেখো তুমি অপলক চোখে।

ভরসার ওমে জড়ানো আদরবাসি

বন্ধু তুমি ভীষণ রকম ব্যস্ত,
আদ্যপ্রান্ত সংসারী এক মানুষ,
ঘড়ির কাঁটায় ছকের জীবন যাপন,
সংসারী দায়ে পুড়ছে ইচ্ছে ফানুস।

এরই ফাঁকে আড্ডা বন্ধু দলে,
হয়তো কখনো বিনিদ্র রাতভোর,
বাবাই সোনার জ্বর এসেছে খুব,
ক্লান্ত শরীরে অফিস ছোটার ঘোর।

কখনো আবার গানের জলসায়,
ছুঁয়ে যাও তুমি স্বপ্ননদীর তীর,
শ্রোতাদের করতালি উল্লাসে
সঞ্চয় করো প্রাণবায়ু আগামীর।

তবুও আমি নতুন কিছু লিখলে,
সময় করে ঠিক দেখবে তুমি,
ভুলগুলো সব শুধরে দিয়ে বলবে,
“বাহ্ বাহ্ লেখার জন্য হামি “।

যখন তুমি লেখো নতুন গান,
সময় করে ঠিক শোনাও আমায়,
কাজের ভিড়ে সময় হারিয়ে গেলেও,
আমার জন্য ঠিকই থাকে সময়।

ক্লান্তি ভুলে ইচ্ছে গুলো যখন,
ভীষণ রকম বৃষ্টি ভিজতে চায়,
তখন তোমায় আমায় পড়ে মনে,
মন তোমার প্রেমিক হতে চায়।

আমার যখন ভীষণ মন খারাপ,
কান্না চাপি স্তব্ধ যন্ত্রণাতে,
দুষ্টুমি করো ফোন করে তুমি,
কান্না ভোলাও মিঠে খুনসুটিতে।

এই ভাবেই পাশে আছো তুমি,
ভরসার ওমে জড়ানো আদরবাসি,
এই ভাবেই বলতে চাও তুমি
“ডার্লিং তোমায় ভীষণ ভালোবাসি “

শ্বেতা সরকার। জন্ম ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি। স্থান, বাবার কর্মস্থল টিকিয়াপাড়া রেল কোয়াটার, হাওড়া,বাংলা, ভারত। পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে হাওড়া নরসিংহ কলেজ থেকে বায়ো-সায়েন্সে স্নাতক। ছোট বেলা থেকেই নাচ,গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফিতে ছিল শখ। বিবাহসূত্রে খড়্গপুরের বাসিন্দা। আঞ্চলিক...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ