অমীমাংসিত

ইসরাত জাহান
ছোটগল্প
Bengali
অমীমাংসিত

রোজার মাস। খুব গরম পড়েছে। সেহরির সময় হয়েছে। রাজিব খান নিজেদের একতলা বাড়ির সামনের বারান্দায় বসে আছেন। পাশে মহাবিদ্যালয়ে পড়ুয়া ভাই রাতুল, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া বোন রেহানা ও ছয় বছর বয়সের মেয়ে নীরু বসে আছে। তার স্ত্রী রুবা ও মা সেহরির জন্য খাবার গোছাচ্ছেন টেবিলে। রাজিব খান এর বয়স ছত্রিশ। শিক্ষিত সম্মানি ব্যাক্তি। চালের ব্যবসা করেন। আছে নিজস্ব চাতাল। অল্প বয়সেই ব্যবসায় খুব উন্নতি করেছেন। হজ্জ্ব ব্রত পালন করে এসেছেন বলে সবাই হাজী সাহেব বলেই সম্বোধন করেন। দানশীলতা এবং পরোপকারে হাজী সাহেবের জুড়ি নেই। এই বাড়িটি নতুন। মফস্বল এলাকা। চারিদিকে ধান চালের আড়ত ও চাতাল। চাতালের মালিকেরা আশেপাশের জমি কিনে বাড়ি তৈরি করে বসতি স্থাপন করেছেন। হাজী সাহেবও করেছেন বছর খানেক হল। বাড়িটির সামনেই বড় রাস্তা। বড় রাস্তা ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই তার চালের মিল। অনেক বড়। অবশ্য তিন মাইল দূরেই তার পৈতৃক বাড়ি। রোজ সেহরির আগে তিনি বারান্দায় বসেন কিছুক্ষণ।
হঠাৎই পথ দিয়ে কেউ যাচ্ছেন। রাজিব খান ওরফে হাজী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
:কে যায়?
পথিক বললেন,
:আমি বশির। উত্তরপাড়ার বশির। হাজী সাহেব বললেন,
:এত রাতে এ পাড়ায় কেন?
বশির নামের লোকটি বললেন,
:লেবুর বাগানে পাহাড়া দিতে আইছিলাম, এখন বাড়িত যাই।
হাজী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন আবারও,
:এই গরমে গায়ে চাদর কেন?
বশির বললেন,
:ভাই আমার জ্বর তাই।
হাজী সাহেব অবাক হয়ে বললেন,
:জ্বর নিয়ে মাঝরাতে একা একা লেবুর বাগানে?
এরপর আর কথা এগুলো না।
পথিক বশির দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন।
টেবিলে খাবার গোছানো শেষ। হাজী সাহেবের স্ত্রী রুবা ডাকছেন সবাই কে।
সবাই বসা থেকে উঠেছেন মাত্র। হঠাৎই চিৎকার চেঁচামেচি। কে কোথায় আছ গো …মানুষ মরে গেল গো… খুন করে ফেলল গো…।
সবাই ভয় পেলো ভীষণ।
রাতুল বলল,
:ভাইজান হিন্দু পাড়ার ওদিক থেকেই চিৎকার আসছে।
খান বাড়ির পাশেই একটা পুকুর তার অপর পাশেই হিন্দুদের বাস। হাজী সাহেব পাশের বাড়ির বেলাল চাচা কে ডাকলেন। তিনি এলেন। তারপর হাজী সাহেব রাতুল ও পাশের বাড়ির চাচাকে সঙ্গে নিয়ে টর্চ ও লাঠি হাতে হিন্দুদের বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। হিন্দুদের বাড়ির সামনে জটলা বেঁধে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু যে দিক থেকে চিৎকার এসেছে সে দিকে ভয়ে কেউ যাচ্ছেন না। হাজী সাহেবকে দেখে তারা সাহস পেলেন। হাজী সাহেব সবাইকে নিয়ে হৈ হৈ করতে করতে পুকুরের দিকে গেলেন। অনেক টর্চের আলোয় চারিদিকে আলোকিত হয়ে উঠল। হাজী সাহেব দেখতে পেলেন পুকুরের পানি ঘেষে কেউ উপুর হয়ে পড়ে আছেন। হাজী সাহেব দ্রুত তার কাছে পৌঁছালেন। চিৎ করেই লাবলু বলে চিৎকার করলেন। ততক্ষণে বাকি সবাই এসে গেছে কাছে। সবাই মিলে ধরাধরি করে পুকুর পাড়ে তুলে আনলেন লাবলুকে।
তখন ও তিনি বেঁচে। পেট থেকে ভুড়ি বেরিয়ে এসেছে। রক্তে পুকুরের পানি লাল হয়ে গেছে। হাজী সাহেব নিজের গায়ের জামা খুলে লাবলুর পেট বেঁধে দিলেন। লাবলু ঠোঁট নেড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু সে শব্দ কারো কান পর্যন্ত পৌঁছালো না।
লাবলু মারা গেলেন।
ততক্ষণে চারিদিকে খবর চাউর হয়ে গেছে। হাজী সাহেবের স্ত্রী বাড়ির চারদিকের সব দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছেন। কারো আর সেহরি খাওয়া হলো না। ভোরের আলো ফুটতেই হাজী সাহেব বাড়ি এলেন। যা বললেন তা হলো,
পাশের গ্রামের লাবলু মিয়া চালের মোকামে যাবেন বলে টাকা নিয়ে চালের মিলের দিকে আসছিলেন। লাবলু মিয়া আরেক মিল মালিকের ম্যানেজার ছিলেন। টাকা নিয়ে তার ভোরের ট্রাকে দিনাজপুর চালের মোকামে যাওয়ার কথা ছিল। সাইকেল নিয়ে আসছিলেন বাড়ি থেকে। সাইকেলের সামনে টাকার ব্যাগ ঝোলানো ছিল। হিন্দুদের বাড়ির পেছনে আরেকটি পুকুর আছে পথের ধারে। সেখানে আসতেই কেউ উনার পেটে ছুরিকাঘাত করে টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছেন। যাওয়ার আগে উনাকে পুকুরের উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলেছেন। তখন লাবলু মিয়ার চিৎকার হিন্দুদের বাড়ির কেউ শুনেছেন। কিন্ত ভয়ে তারা কেউ বের হয়নি। পরে তারা নিজেরা সংঘটিত হয়ে চিৎকার করেছেন। যা হোক খবর দেয়া হয়েছে থানায় লোক পাঠিয়ে। হাজী সাহেব নামাজ আদায় করে আবার লাবলুর মৃতদেহের কাছে গেলেন। ঘটনাটা তাকে খুব ভাবাচ্ছে। কারণ মাঝরাতে টাকার ব্যাগ নিয়ে বেরোনো এই এলাকায় নতুন কিছু নয়। এই এলাকার বেশির ভাগ লোক জনেরই চালের ব্যবসা। দিনে রাতে পালাক্রমে চাতালে কাজ হয়। অনেক শ্রমিক কাজ করে এখানে।
লাখ লাখ টাকা ব্যবসায়ীদের কাছে সবসময়ই থাকে। এই ব্যাবসাটাই এমন। নগদ টাকা সাথে নিয়ে ধান কিনতে যেতে হয় দেশের বিভিন্ন জায়গায়। তারপর সেই ধান চালের মিলে ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয়।অনেক শ্রমিকের শ্রমে বিভিন্ন ধাপে চাল তৈরি হয়। সেই চাল আবার পাইকারি বিক্রি হত মিল থেকে। তাই নগদ টাকা হাতে থাকত ব্যবসায়ীদের সবসময়ই। কিন্তু এরকম ঘটনা এলাকায় এই প্রথম। ওদিকে পুলিশ এলো। লাবলু মিয়া তখনও পুকুর পাড়ে শোয়া। বিছানার চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। পেটের দিক রক্তে ভেজা। তাগড়া যোয়ান। দেড় মাস আগে বিয়ে করেছিলেন। উনার মাথার কাছে বসে সেই অল্প বয়সী বউয়ের কান্নার আওয়াজ যেন ঝড়ের চেয়েও জোড়ালো। হাজী সাহেব পুলিশ কে অনেক সহযোগিতা করলেন। কিভাবে, কোথা থেকে, লাবলু মিয়া কে তুলে আনলেন সেসব জানালেন।
পুলিশ ভ্যানে করে পাটিতে মুড়িয়ে লাবলু মিয়া কে নিয়ে গেলেন।
কিন্তু একটা ব্যাপার ভাবালো উপস্থিত সবাইকে। সাইকেলের ব্যাগ থেকে টাকার ব্যাগ খুলে নেয়া হয়নি। বরং টাকার ব্যাগ মাঝখান থেকে কেটে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ টাকার ব্যাগের উপরের অংশ সাইকেলের সাথেই আছে। আর সেই ব্যাগেও রক্ত লেগে আছে। মানে হল ব্যাগ কাটার সময় খুনিরও হাত কেটেছে।
তারপর এলাকার লোকজন দেখতে পেল রাস্তার এখানে সেখানে রক্তের দাগ। পুলিশকে বলতেই পুলিশ সেই রক্তের দাগ ধরে হাজী সাহেবের বাড়ি পর্যন্ত এসে থেমে গেলেন। কারণ রক্তের অনেকটা ছোপ এখানে পাওয়া গেল। তারপর আরও এগিয়েও দেখা গেল রক্তের ধারা। চিন্তিত হাজী সাহেবের মনে কিছু খেলে গেলো। গত কাল রাতে এখানে বশির বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। হাজী সাহেব অবশ্য মুখে কিছুই বললেন না। তিনিও পুলিশের সাথে সাথে এগোতে লাগলেন। দেখা গেল রক্তের ফোঁটা যেখানে শেষ হয়েছে সেটা একটা ইঁদারা। ইঁদারার আশ পাশ থেকে কিছুই পাওয়া গেলো না। আর এই ইঁদারার আসে পাশে বশিরের বাড়িও নয়। ইঁদারাটি একটি পরিত্যক্ত বাড়ির উঠোনে অবস্থিত। আগে এখানে বসতি ছিল। তবে বছর পাঁচেক হল বাড়ির মালিক শহরে বসবাস করার কারণে এখানকার বাড়িটি পরিত্যক্ত বলা চলে।
সেদিন ঐ পর্যন্তই।
দিন শেষে লাবলু মিয়া আবার পাটিতে জড়িয়ে ফেরত এলেন। রাতেই দাফন হল। সব ব্যবসায়ীদের চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। মামলা হল। মামলা করলেন লাবলু মিয়া যেই মিল মালিকের ম্যানেজার ছিলেন তিনি।
তারপর কয়েকদিন খুব ধরপাকড় হল। পুলিশের আনাগোনা বেড়ে গেল এলাকায়। সব ব্যবসায়ীরা এরপর টাকা নিয়ে আর একা বাড়ি কিংবা মিলে যাতায়াত করতেন না। কর্মচারীদের সাথে নিয়ে চলাফেরা করতেন রাতে। এদিকে হাজী সাহেব খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তার কেবলই মনে হচ্ছিল মাঝ রাতে মোটা চাদর গায়ে লেবু বাগান পাহাড়া দেয়াটা খুব অদ্ভুত। তার বাড়ির সামনে রক্তের ফোঁটার পরিমাণ বেশি। আবার এত ঘটনা ঘটল কিন্তু তারপর বশির কেও কোথাও তিনি দেখেননি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে পুলিশের কাছে সন্দেহের কথা বলতেও একটু ভয় পাচ্ছিলেন। এরকম পরিস্থিতিতে তো আগে কখনও পড়েননি। কিন্তু বিবেকবোধের কাছে লজ্জিত হচ্ছিলেন বারবার। এক সপ্তাহ পর এক সকালে হাজী সাহেব নিজের বিবেকের তাড়নায় পুলিশের কাছে যেতে উদ্যত হলেন। প্রথমে এলেন মিলে তারপর ম্যানেজার কে সাথে নিয়ে মোটর সাইকেল যোগে থানার দিকে রওনা দেবেন বলে মোটর সাইকেলে বসেছেন মাত্র। তখনই ছুটতে ছুটতে এক কর্মচারী এসে বললেন, এলাকায় আবার খুন হয়েছে। পাশের গ্রাম উত্তর পাড়ার ধান ক্ষেতে একটি লাশ পড়ে আছে।
লাশটি ঐ গ্রামেরই ছেলে বশিরের।
হাজী সাহেব খবর শুনে স্তম্ভিত হলেন। তিনি ম্যানেজারকে সাথে নিয়ে উত্তর পাড়ার দিকে গেলেন। গিয়েই দেখলেন পুলিশ এসেছেন। গলায় গামছা পেঁচানো বশির চিৎ হয়ে পড়ে আছে ধানক্ষেতে। শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে।
হাজী সাহেব খেয়াল করলেন বশিরের বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির অর্ধেক নেই। শুধু যে হাজী সাহেব খেয়াল করেছেন তা নয়। সবাই খেয়াল করেছেন। এবং বুঝতে বাকি রইল না কারো বশিরই খুন করেছিলেন লাবলু মিয়াকে? কিন্তু বশিরকে কে খুন করল?
চিন্তিত হাজী সাহেব বশিরের কাটা বৃদ্ধাঙ্গুলির দিকে চেয়ে ভাবতে লাগলেন লাবলুর খুনী জীবিত ধরা পড়ল না। লাবলুর খুনী খুন হলো। হয়তো অথবা নয়তো বশিরের খুনীও ধরা পড়বে না। তাহলে কি মীমাংসার পথ শেষ হচ্ছে? নাকি শেষ হয়ে গেছে? আমরা ধাবিত হচ্ছি ক্রমাগত অমীমাংসিত এক নতুন পথের দিকে?

ইসরাত জাহান। কবি। জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী। বর্তমান নিবাস ঢাকায়। তেরোবছর বয়স থেকে লেখালিখি শুরু। লেখা শুরু করেছিলেন দৈনিক বাংলার বাণীর মাধ্যমে। তারপর দৈনিক আজকের কাগজে নিয়মিত লেখালিখিতে ছিলেন। এরপর হঠাৎ করে বারোবছর লেখালিখি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন। প্রকাশিত বই: 'তোমার...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ