অমৃতের পুত্রী

মৃদুল শ্রীমানী
গল্প
Bengali
অমৃতের পুত্রী

শেখর কবিতা পড়তে পড়তে মেয়ের দিকে তাকালেন। হাসছে। কথা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু চোখ দুটো কথা বলে। কী যে অসুখ হল মেয়েটার। এই তো সাতাশ বছর বয়স মনোর্মির। ওর যখন বিয়ে হল ময়ূখ তখন হায়দরাবাদে ম্যানেজমেন্ট পড়ছে। কুড়ি বছরের ছেলে। মাথায় অনেকখানি লম্বা। মনোর্মির শ্বশুর বললেন, এই সামনের মাসেই বিয়ে দিতে হবে। তারিখটাও তিনি নিজেই পাঁজি দেখে ঠিক করেছেন। ব্রততী কাৎরে উঠে বললেন, ওই সময় আমার ছেলেটার পরীক্ষা। সে যে আসতে পারবে না। বিনোদবাবু বললেন, আপনার ছেলে মেধাবী। এখন ওর নানারকম পরীক্ষা, সেমিনার, ইন্টারভিউ থাকবেই। আবার একটা দেখেশুনে তারিখ ঠিক করলে সে সময় যে ওর পরীক্ষা বা প্রজেক্ট পড়বে না, তার কোনো গ্যারান্টি আছে?

শেখর বললেন, না বিনোদবাবু, আপনি যে তারিখ বলছেন, তাতেই আমি রাজি। বিয়েটা হয়েই যাক। ব্রততী যন্ত্রণাবিদ্ধ চোখে তাকালেন। শেখর কথাটা বলেই বুঝতে পেরেছেন তিনি ভুল করেছেন। বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হয়ে গিয়েছে। তাও বছরদুয়েক হয়ে গেছে। মনোর্মি পড়ার নাম করে বিয়েটা পিছিয়ে দিয়েছে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল সে। খড়্গপুরে তখন বিনোদবাবুর পোস্টিং। রিটায়ারমেন্টের আর কয়েকটা মাস বাকি বলে হোম পোস্টিং পেয়েছেন। খড়্গপুরের বাড়ি থেকে মেদিনীপুর কালেকটরেটে যাতায়াত করেন। দীপেনও কাছাকাছি ব্লকের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পোস্টিং পেয়েছে। শেখরই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সচিবকে ধরে করে ব্যাপারটা করে দিয়েছেন। কিন্তু কাউকে ঘুণাক্ষরেও সে কথা বলেন নি। মনোর্মি মাঝে মাঝেই গিয়ে দীপেনের বাড়িতে থাকত। শেখর ভাবতেন বিয়ের  রেজিস্ট্রেশনটা হয়ে গিয়েছে। তাই গিয়ে থাকতে অসুবিধা নেই। দুজনে বন্ধুর মতো মিলে মিশে থাকত। রাতে শুত আলাদা আলাদা।

বিনোদবাবু বললেন, আমাকে আপনার মিসেস খুব নিষ্ঠুর ঠাউরাচ্ছেন। কিন্তু আমি সত্যি সত্যি তা নই। এভাবে একসাথে থাকছে। লোকসমাজ বলেও তো একটা কথা আছে।

শেখর ভেবেছিলেন মেয়ে বড় হয়েছে। নিজের চোখে যাচাই করার বুদ্ধি হয়েছে।

মেয়ের দিকে তাকালেন। কিছুই বুঝতে পারিস নি, না মা? না কি, টের পেয়েও আমায় বলিস নি? মেয়ে শুধু চোখ চেয়ে হাসে । কিছু বলতে পারে না।

ডাক্তার বলে গেছেন, নার্ভ শুকিয়ে গেছে। মাথার কাছাকাছিগুলো এখনো যুঝে যাচ্ছে। ওটুকু গেলে আর আমায় আসতে হবে না। আয়া মলমূত্র ত্যাগ করায়। গায়ে মাসাজ করে। সুগন্ধি মাখিয়ে মাখিয়ে রাখে। রোজ দুবেলা বিছানার চাদর বদলে বদলে দেয়। ডাক্তার বলেছেন বেডসোর এসে গেলে মুশকিল। শুনে মনোর্মি হাসে। ব্রততী বলেন, হাসছিস কেন রে? এটা একটা হাসির কথা হল?

ডাক্তার শেখরের কানে কানে বলেছেন, ও হাসে না। নার্ভ শুকোচ্ছে। তাই অমন দেখায়।

শেখর ভাবেন, ওটাও একটা হাসি। মরণজয়ী হাসি। মোনালিসা হাসে। সে হাসি নিয়ে কতলোক কত গবেষণা করেছেন। তবু সে হাসির থই পাওয়া শক্ত। কেউ বলেছেন মোনালিসা গর্ভবতী। কেউ বলেছেন মোনালিসার দাঁতের অসুখ ছিল। কেউ আবার বলেছেন, মোনালিসা আসলে একটা ছেলের ছবি। কায়দা করে মেয়ে বানানো আছে। কেউ সন্দেহ করেন, ও শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি। কৌশল করে চাপা দিয়েছেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মেজো মেয়ে রাণীর জন্য ডাক্তার পাত্র খুঁজেছিলেন। ভেবেছিলেন স্বামী ডাক্তার হলে মেয়ের চিকিৎসার অভাব হবে না।

তখনকার দিনে যক্ষ্মার ভাল চিকিৎসা ছিল না। মেয়েকে আলমোড়ায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন কবি। খুব রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা। বাবা কোলে করে তুলছেন তাকে।  অত বড়ো মেয়ে বাবার কোলে শিশুর মতো চড়ে বলছে, বাবা ‘পিতা নোহসি’ বলো। মনোর্মি বলত, আমার কোনো কষ্ট নেই বাবা।

মেয়ে বার বার বলত, বাবা বক্সা বেড়াতে যাব। জেলখানায় রেখেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। আমি দেখব বাবা। তাঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জন্মদিন উপলক্ষে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়ে ছিলেন বন্দীদশা থেকে। উত্তরে “প্রত‍্যভিনন্দন” কবিতাটি লিখে পাঠান রবীন্দ্রনাথ। ‘অমৃতের পুত্র মোরা’-কাহারা শুনাল বিশ্বময়। আত্মবিসর্জন করি আত্মারে কে জানিল অক্ষয় । ভৈরবের আনন্দেরে দুঃখেতে জিনিল কে রে, বন্দীর শৃঙ্খলচ্ছন্দে মুক্তের কে দিল পরিচয় । আরথ্রাইটিসের  ব্যথা সামলে ব্রততী আর যেতে পারেন নি।

আলিপুরদুয়ারে নেমে গাড়িতে করে দমনপুরের রাস্তা ধরে গাড়ি পৌঁছে দিল সান্তালাবাড়িতে। পথের ধারে চায়ের দোকানে মেয়েকে বসিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন বক্সা দুর্গ কোথায়। লোকজন বলল, সে যে হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। অনেকটা রাস্তা। একটি লোক মজুরির বিনিময়ে বক্সা অবধি পৌঁছে দিতে রাজি হল। বাপের হাত ধরে ধরে মেয়ে চলছে। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে মেয়ে। বক্সা দুর্গ দেখব বাবা। ওখানে ফাঁসির সাজা পাওয়া আর যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া বিপ্লবীরা থাকত। তাদের দীর্ঘশ্বাস শুনে রেখেছে গাছেরা। আর পাথরের দেয়াল। হাতে পায়ে লোহার বেড়ি পরিয়ে পাথর ভাঙার কাজ। ‘বন্ধন নয়, বন্দন এই শিকল ঝঞ্ঝনা, এ যে মুক্তি পথের অগ্রদূতের চরণবন্দনা’। শরীর মনোর্মিকে সাথ দেয় না। সে চলে ধীরে ধীরে, থেমে থেমে। কত রকম গাছ আর কত রকম পাখি! শেষমেশ মেয়েকে কোলে তুলে পথ চলেন শেখর। মেয়ে বাপের কোলে চড়ে বার বার বলে চলেছে,  ‘অমৃতের পুত্র মোরা’-কাহারা শুনাল বিশ্বময়। আত্মবিসর্জন করি আত্মারে কে জানিল অক্ষয় । ভৈরবের আনন্দেরে দুঃখেতে জিনিল কে রে, বন্দীর শৃঙ্খলচ্ছন্দে মুক্তের কে দিল পরিচয় । বক্সায় গেস্ট হাউসে বাপ মেয়ে পৌঁছাল বেলা গড়িয়ে গেলে।

গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার এসে জানতে চাইল, কি খাবেন? মেয়ে হেসে বলল, তোমরা যা খাবে, তাই আমাদেরকে দিও। সে অবাক হয়ে শেখরের দিকে তাকায়। শেখর তার হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেন , আজ তোমার বাচ্চাদের যা খাওয়াতে মন চায়, তাই খাওয়াও। ওই আমাদের পূজা। আমরা বাপ বেটি পূজার প্রসাদ পাব। সে শেখরকে বাইরে ডেকে এনে বলে, আপনার মেয়ের যে খুব শরীর খারাপ! এখানে কিন্তু  কোনো ডাক্তার নেই। রাত বিরেতে কিছু হলে সেই দমনপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সান্তালাবাড়িতে অবশ্য একজন হোমিওপ্যাথ বসেন। শেখর আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন।

মেয়ে গান গেয়ে চলেছে, কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা, মনে মনে। ওই পদটাই বারে বারে গাইছে। ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে শেখরের। পরদিন সকালে উঠে মনোর্মিকে নিয়ে চললেন দুর্গ দেখাতে। এখানে ওখানে ভেঙে পড়েছে। দু চারটি মার্বেল ফলক আছে। কিন্তু ওর বেশি খুব একটা কিছু নেই। স্বাধীন দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবার সময় পায় না। দেশ জুড়ে কত ঐতিহাসিক সৌধ আর স্মারক আর মন্দির গাত্রের অলঙ্করণ হারিয়ে যাচ্ছে, কে তার খবর রাখে? নাগরিক সমাজও অসাড়। গোটা দেশকে বোবায় পেয়েছে।

মেয়ে বলে জানো বাবা, ইটালিতে ওরা যেখানে গ্যালিলিওকে আটকে রেখেছিল, সেখানে অবজারভেটরি বানিয়েছে। গ্যালিলিওর জীবন ছিল আকাশ দেখা। ইটালি তাঁর স্বপ্নের মর্যাদা দিয়েছে। আর দ্যাখো, এখানে না আছে একটা স্কুল, না বানিয়েছে হাসপাতাল। শেখর মেয়েকে বলেন, তুই সেরে উঠে দায়িত্ব নিস। মেয়ে বলে, এবারের মতো তো হল না বাবা। আবার জন্ম নেবো। তখন। মেয়ে গান ধরল, একবার বিদায় দাও মা, ঘুরে আসি।  .. . বক্সা দুর্গের মলিন পাথুরে দেয়ালে বালক বীরের গান কেঁদে কেঁদে বেড়াতে লাগল।

বিকেলে মেয়ে বায়না ধরল, বাবা, লেপচাখা যাব। কেয়ারটেকার অবাক হয়ে তাকাল।  সে যে আরো খানিকটা উঁচু! রাস্তা আরো কঠিন। আবদার করে মেয়ে বলে, বাবা যাবই।মেয়ে গান গায়, আমাদের খেপিয়ে বেড়ায় যে, কোথায় লুকিয়ে থাকে সে!

লেপচাখায় হোম স্টে আছে। এক বিধবা মহিলা আর তাঁর কয়েকটি কন্যা মিলে চালান। কন্যাগুলি ভারি সুশ্রী। তারা মনোর্মিকে খুব যত্ন করেছিল।

মনোর্মি চলে যাবার পর আবার বক্সা গিয়েছিলেন শেখর। আবার লেপচাখা। গাছের থেকে খসে পড়া ফুল কুড়িয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতিতে উৎসর্গ করেছিলেন। মনোর্মি গাছ থেকে ফুল তোলা অপছন্দ করত। বলত ফুটন্ত ফুল গাছ থেকে টেনে টেনে ছিঁড়লে গাছ ব্যথা পায় বাবা। গাছও যে বিশ্বমায়ের সন্তান। সন্তানকে ব্যথা দিয়ে মাকে খুশি করা যায় না বাবা।

লেপচাখায় তিনি একলা যেতে হোম স্টের পরিচালক বয়স্কা মহিলাটি শেখরের মুখ দেখেই সব বুঝে ফেলেছিলেন। মেয়েগুলি একটি ছোট মুদিখানা দোকান করেছে। নিজেরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বসে। একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কোথায় বিয়ে দিলে গো?

একজন পুলিশ বেড়াতে এসেছিল। সেই সাথে করে নিয়ে গেল। শেখরের মনে হয়, ডাক্তার পাত্র না খুঁজে একটা সাদামাটা ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে মেয়েটা হয়তো বেঁচে থাকত।

সন্ধ্যায় ঝোড়ো হাওয়া উঠল। শেষ বিকেলেই টের পেয়েছিলেন শেখর। গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা। পাহাড়ের উপর ঝড় বৃষ্টির দাপট খুব। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনোর্মির পছন্দের গানগুলো ঝড়কে শোনাচ্ছিলেন শেখর। পরদিন সকালে রোদ ঝলমল আকাশ। অনেক দূরে নিচে আলিপুরদুয়ারের প্রাণচঞ্চলতা দেখা যায়।

দিনের পর দিন যখন অসুস্থতা কাটেনা, তখন এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আশঙ্কা প্রকাশ করে ছিলেন, আপনার মেয়েকে গোপনে কেউ কিছু ইঞ্জেকশন দিয়েছে। রোগ ধরা যাবে না কেন? এটা কোনো সূক্ষ্ম হাতের কাজ। মেয়ে পরে বাবার কাছে অনুযোগ করেছিল। ওঁকে তুমি আসতে বারণ করে দিও বাবা। পৃথিবীর কারো ওপর আমার রাগ নেই। সবাইকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রিয়তমা কন্যা মাধুরীলতার বিয়ে দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে। শরৎ বিহারীলাল চক্রবর্তীর পুত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারি পছন্দের মানুষ। সেই শরৎ যে তাঁর কাছে পণের জন্য অত্যাচার করবেন, কবি ভাবতে পারেন নি। মানুষ যে কত নিষ্ঠুর পাষণ্ড হতে পারে, কবি দার্শনিকরা ভাবতেই পারেন না।

অথচ বিনোদবাবু ছিলেন ব্রততীর বাপের বাড়ির দিকের আত্মীয়। তায় পশ্চিম বঙ্গ সরকারের বড় থাকের অফিসার। তাঁর যে নারীশরীরের প্রতি জান্তব লালসা ছিল, সে তো আগে জানা যায় নি। হাসপাতালে যেসব দিন নাইট ডিউটি থাকত বরের, মনোর্মি রাতে আতঙ্কে ঘুমাতে পারত না। বাথরুমে যেতেও ভয় পেত।

বাবা নাম রেখেছিলেন চন্দ্রশেখর। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা দেবার আগে নিজের ইচ্ছায় নাম বদলে নিয়েছিলেন ছেলে। চন্দ্রটুকু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র শেখর? বাবা রাগ করেছিলেন। চন্দ্রশেখর মানে জানিস হতভাগা? শিবঠাকুরের নাম। মাথায় যাঁর চাঁদ, তিনি চন্দ্রশেখর। শেখর মানে চূড়া।  তারপর বললেন তিনি, স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থাণুর ললাটে, পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি?

মনোর্মিকে চিরবিদায় দেবার আগে মরণোত্তর চক্ষুদান করালেন শেখর। লাল বেনারসি আর চন্দনে মেয়েকে সাজিয়ে দিয়েছেন মনোর্মির মাসিরা। বিনোদবাবু ফোন করলেন, আমার বৌমার চোখদুটো দান করলেন যে, ও কি এরকম করতে বলে গিয়েছিল?

শেখর বললেন, সেভাবে স্পষ্ট করে কোনো কিছু বলে নি।

বিনোদবাবু বললেন, তাহলে? সে আমার বাড়ির বৌ। আমার পারমিশন নেওয়া উচিত ছিল আপনার।

পরে মনোর্মির চোখ দিয়ে দু দুজন মানুষ দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে শুনে, তিনি জানতে চেয়েছিলেন, কাকে কাকে দেওয়া হল?

শেখর শান্ত স্বরে বললেন, দুজন মানুষকে।

বিনোদ কটুভাবে বলেছিলেন, মানুষের চোখ দিয়ে মানুষকেই দেখতে হয় মশাই। গাধাকে তো মানুষের চোখ দেওয়া হয় না।

শেখর ধীর স্থিরভাবে বলেছিলেন, মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়, সে মানুষ। এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ তার জীবনে আর কিছু নেই।

সকালে, সন্ধ্যায় মনোর্মিকে রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ শোনান শেখর। টেবিলে ছবির ভিতর থেকে চোখ চেয়ে মেয়ে হাসে। ব্রততী কাছে এসে দাঁড়ান। বলে চলেন,

সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়— দ্বেষ।

সৃষ্টির মনের কথা: আমাদেরি আন্তরিকতাতে

আমাদেরি সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা

খুঁজে আনা। প্রকৃতির পাহাড়ে পাথরে সমুচ্ছল

ঝর্ণার জল দেখে তারপর হৃদয়ে তাকিয়ে

দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল

হ’য়ে আছে ব’লে বাঘ হরিণের পিছু আজো ধায়;

মানুষ মেরেছি আমি— তার রক্তে আমার শরীর

ভ’রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার

ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু

হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ ক’রে গেল, ….

রোজ শুনতে শুনতে মেয়ের মতোই মায়ের সে সব মুখস্থ হয়ে গিয়েছে।

একটা মেয়ে বারে বারে ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে চলেছে। মঞ্জরী। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেয় তাদের সুখযাপনের ছবি। বৌ মারা যাবার পরে ছমাস যেতে না যেতেই ডাক্তারবাবু আবার বিয়ে করেছেন। মঞ্জরীর ছেলে হয়েছে। ছেলের ফুটফুটে ছবি ফেসবুকে  পোষ্ট হচ্ছে সবসময়। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে শেখরের। মঞ্জরীকে বলতে পারেন না, ওগো, তোমার মতো খুশি জীবনের স্বপ্ন মনোর্মিও দেখেছিল। কিন্তু সে স্বপ্ন নিদারুণ ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট মুছে দেন শেখর। আবার আসে। আবার আসে। টেবিলে ছবি হয়ে মনোর্মি হাসে। শুধু হাসে।

মৃদুল শ্রীমানী। কবি। জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। প্রকাশিত বই: 'জমি জরিপ,  কি দেখে জমি বাড়ি কিনবেন,  ফ্ল্যাট ও বাড়ি,  তথ্য জানার অধিকার', 'মানুষের বাঁচার অধিকার সংক্রান্ত- মেয়েদের আইন', 'সে একটি পল্লবিত...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..