অযৌক্তিক তর্ক ও বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা

আজমত রানা
গল্প
অযৌক্তিক তর্ক ও বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা

দ্রুম!

কানে তালি লাগানো শব্দটা এতটাই প্রকট ছিল যে, সমবেত জনতা সমস্বরে যে আত্মচিৎকার করলো তার শব্দ কিছুক্ষণ আগে হওয়া শব্দের ঢেউয়ের কাছে হারিয়ে গেল। দলা দলা মাংসপিণ্ড,ছোপ ছোপ কালো রক্ত, এলোমেলো পথে কিছু সেন্ডেল জুতো বিক্ষিপ্তভাবে তখনও ক্যানভাসে শোভা পাচ্ছে।

আশ্চর্য!

চায়ের দোকানের কোণায় বসা ছেলেটা আশ্চর্য শব্দটা উচ্চারণ করে।

কবি না ছাই, যত না কবি তার চে বেশি ভাব ধরে। এমনটাই ছেলেটিকে নিয়ে সবাই ভাবে। এসব ভাবাভাবিতে ছেলেটির নিজের কোন ভাবান্তর নেই। তবে তিনি অন্য কিছু নিয়ে অবশ্যই ভাবেন। নইলে অকস্মাৎ  সবাই যখন রক্ত, মাংস, আর দ্রুম শব্দটি নিয়ে ক্যাচাল পাকিয়ে তুলছে তখন ছেলেটি কিছু একটা ভেবে ‘আশ্চর্য’ শব্দটি উচ্চারণ করে তিনি নিজেও যে একজন ভাবুক তা প্রমাণ করলেন। সবাই তার দিকে তাকালো, কিন্তু কেউ তাকে কিছু বলল না। তবে ক্যাচালওয়ালাদের মুরুব্বি গোছের একজন বলে উঠলেন

-কেন, আশ্চর্য কেন?

এবার ক্যাচাল জমে উঠবে ভেবে অনেকেই উৎসুক হয়ে উঠলেন। ছেলেটি এক মুহূর্ত ভেবে নিল এদের সাথে ক্যাচালে অংশ নেবে কি না। অবশেষে হ্যাঁ সূচকেই পাল্লা ভারি হলো।

– না মানে ওই যে আপনারা বললেন, কালো কালো রক্তের ছাপ।

-হ্যাঁ, ঠিকই তো বলেছি। আমি নিজে দেখেছি। সারা রাস্তাটা পুলিশ ঘিরে রেখেছিল। মাংসের টুকরাগুলোও কালো হয়ে গেছে, রক্তও কালো। একেবারে কুচকুচে কালো। একজন বেশ গলা বাড়িয়েই কথাগুলো বললেন।

তাকে সমর্থন করে আরো দু চারজন একইভাবে বললেন। আরো দু একজন অন্য জায়গার ঘটনাও বললেন। তাতে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল যে মানুষের রক্ত এবং মাংস কালো কুচকুচে হয়ে যায়।

-এতে আশ্চর্য হওয়ার কী দেখলে সেটাইতো মাথায় আসছেনা। রক্তের ধর্মই এটা। তরল রক্ত বাইরে বেরিয়ে এলেই জমে যায় তারপর শুকিয়ে কালো কুচকুচে হয়ে ওঠে। প্রথম যে ভদ্রলোক প্রশ্ন করেছিলেন তিনিই আবার প্রথম প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি  করলেন।

ছেলেটি তাদের সাথে তর্ক জুড়ে দিল। তিনি তথ্য উপাত্ত দিয়ে উল্টো তাদের কাছেই জানতে চাইল যেহেতু সকল মানুষ একবিন্দু সাদা পানি থেকেই সৃষ্টি তাই সবার মাংস সাদা হওয়াটাই ছিল যুক্তিযুক্ত। সবার রক্তগুলো সাদা হওয়াই ছিল যুক্তিযুক্ত। শুকিয়ে যাওয়ার পর রক্তগুলো সাদা হলে কীইবা এমন ক্ষতি হতো। দেহ থেকে বাইরে বের হয়ে যাওয়া রক্ত তো কারোই কাজে আসেনা। তখন এর সাদাই কী কালোই কী। তবে মাংস আর রক্তের  বিচ্ছিরি রকমের কালো রঙ ছেলেটির আপত্তির কারণ।

চা দোকানদার কাপে চিনি দিতে দিতে বলে ‘তুমি একটা মানুষ সৃষ্টি কইরে সাদা রক্ত দিয়ে দেহাও দিকিনি তহন বুঝবানে কত পার’।

ছেলেটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে একজন বলে

-কেন এত ফটর ফটর কর বাপু? সৃষ্টিকর্তা ভালো জানেন কেন রক্ত লাল হয় আর তা শুকিয়ে গেলে কালো হয়। তিনিই ভালো জানেন কেন মাংস শুকিয়ে গেলে কালো হয়। আর সাদা পানির কথা বলে পরিবেশটাই নষ্ট করলে, নাপাকিতে ছেয়ে দিয়ে। ওটা নিয়ে এমন প্রকাশ্যে কথা না বলাই ভালো।

ছেলেটি সবার কথা শোনে। তারপর একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে

আচ্ছা আমার শরীরে কার রক্ত?

-কার আবার; তোমার বাপের ছাড়া আর কার?

বুড়ো লোকটা ফোকলা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে

তোমার মা সতী বেটি ছাওয়াল হলি তোমার শরীরে তোমার বাবার রক্তই হবি।

ছেলেটি উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে যায়।

হ্যাঁ আমিও তো তাই বলছি। আমার বাবার না হয় অন্য কারো, একজনের রক্ত তো আমার শরীরে আছে, না – কি?

হুমমমমমম। সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।

ছেলেটি উত্তেজিত হয়েই বলে

তাহলে রক্ত না এসে কেন দু’ফোটা সাদা পানি এলো?

নাউজুবিল্লাহ…, এ ছাওয়াল দেখছি বাপের বীর্য নিয়ে গবেষণায় মেতে উঠেছে।

দু’একজন চায়ের দোকান ত্যাগ করে। দোকানদার তার ব্যবসার দিকে খেয়াল রেখে গলা ধাক্কা দেয়ার ভঙ্গিতে তেড়ে আসে

এই ছাওয়াল, বাইরাও বাইরাও এহান থে। এহানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ কতবার কব?

-ভাই এটাতো রাজনৈতিক আলাপ না, এটা একটা যুক্তি নিয়ে তর্ক হচ্ছে। যারটা সঠিক তারটা মেনে নেব।

কিডা বইললো এইডা রাজনৈতিক আলাপ না? দেহিছ আমার পাঁচটা কাস্টমার চইলে গেল। এহন যদি তারা আমার বিরুদ্ধে অবরোধ করে, তালি আমার অর্থনীতির কী অবস্থা হবি তা কি কতি পার? তুমি যাও যাও ভাই।

অর্থনীতি আর রাজনীতির এ জটিল ধারাটি ছেলেটির অজানা। সামান্য একটা বিষয়। কেউ সেটা নিয়ে যুক্তির ধার ধারেনা। সবাই রাজনীতিবিদ আর অর্থনীতিবিদ। আর সবাই মিলে ধার্মিক। ছেলেটি চায়ের দাম দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।

সপ্তাহ-মাস-অথবা বছর পরের ঘটনা।

এবার আর দ্রুম শব্দটা শোনা যায়না।

তবে আগের মত সেই রক্তের কালশিটে দাগ রাস্তার কাল পিচের সাথে মিশে গেলেও রক্তের দাগ আলাদা করে চেনা যায়। হাজার হলেও মানুষের রক্ত বলে কথা। রাস্তায় এবার আর দলা দলা মাংসের পিণ্ড ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই। আস্ত একটা মানুষই উপুড় হয়ে পড়ে আছে।এটাকে সবাই বলছে লাশ।

গতকালও যারা কোন যুক্তির ধারও ধারেনি তারাও অনেকেই উপুড় হয়ে পড়ে থাকা লাশটা নিয়ে নিজেদের দৃষ্টিতে একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে সচেষ্ট হয়েছে। লাশ হওয়ার আগে এটার যে একটা পরিচয় ছিল তা সবারই জানা। তারপরেও কেউ সেটা উচ্চারণ করার সাহস পাচ্ছেনা।

সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি আসে। এম্বুলেন্স আসে। লোকের ভিড় বাড়ে। নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে আহা উহু করার লোক বাড়ে। লাশ নিয়ে চলে যায় ময়নাতদন্তের জন্য। পুলিশ প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে চলে যায়। ভিড় কমে যায়। চায়ের দোকানে বিক্রি বাড়ে। মানুষের মৃত্যুর সাথে অর্থনীতির যোগসূত্র খোঁজার কাউকেই সেদিন পাওয়া যায়না।

কালো সড়কে লাল রক্তের কালো ছোপ ছোপ দাগ লেগেই আছে। ওটা পরিষ্কার করা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব না। আশে পাশের লোকজনেরও না। ডোম সুইপার কারোই না। দাগগুলো প্রকৃতিই ধুয়ে নিয়ে যাবে। তখনও রক্ত সাদা হয়ে যাবেনা। এক পশলা বৃষ্টির অনেক দরকার।

মাঝরাতে কেউ কেউ জানালা খুলে আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকায়। এক পশলা বৃষ্টি তাদের অনেক দরকার। রক্তটা মুছে দিতে বৃষ্টি তাদের অনেক দরকার…।

আজমত রানা। লেখক ও সাংবাদিক। নিম্নবিত্ত ঘরে জন্ম বলে জন্মের সঠিক দিন তারিখটা তাঁর জানা নেই। লেখাপড়াটাও এগোয়নি ইচ্ছের কমতি আর অভাবের কারণে। বাংলাদেশের মানচিত্রের একেবারে উত্তরের প্রান্ত শহর ঠাকুরগাঁওয়ে শ্রমিক বাবার ঘরে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। বয়স আঠার হতেই...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..