প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
অরিন্দম আজকাল আর সময় পায় না খুব একটা কৃপা’কে ফোন করার। কৃপাও অফিস নিয়ে ব্যস্ত, তাই খুব সমস্যা হচ্ছে না। এরপরেও আজ কৃপা’কে ফোন করে ম্যানেজ করে ফেলেছে অরিন্দম। শান্তিনগর থেকে ধানমন্ডি ১৯ এ আসতে খুব বেশি সময় লাগলো না অরিন্দমের, এখানে সাধারণত তারা দেখা করে কারণ কৃপার অফিস, বাসা এই জায়গা থেকে কাছে। সন্ধ্যা নামছে ঢাকায় আর এই সময় শহরটা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। সূর্যের আলো যেন লাল চায়ে ডোবানো পাউরুটির টুকরো। সকালের চায়ের গন্ধ পাচ্ছে অরিন্দম তাই, এই সন্ধ্যায়। বাজে সন্ধ্যা ৬’টা। অফিসের বাস থেকে নেমে একটা গলি’তে ঢুকে অরিন্দম চায়ের অর্ডার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ফেললো। এই ঘাম আর গরমের শহরে শেষ বিকেল মানে কাজ আর ট্র্যাফিক জ্যাম পেরিয়ে আরও একটা দিন শেষ করার স্বস্তি। তাকে সুদর্শন লাগছে অফিসের সাদা ফর্মাল সাদা শার্টে। হাজার হাজার চাকরিজীবীর মাঝে এই অরিন্দম, আলাদা কেউ নয়। অফিস শেষে ভালবাসার মানুষের কাছে এসেছে খানিকটা ভালবাসা খুঁজতে। অরিন্দম চা খেতে খেতে ভাবে, জীবনটা তার মন্দ না। ভালবাসার মানুষ সে খুঁজে পেয়েছে, যে সবকিছু দিয়েই তাকে ভালবাসে। পৃথিবীতে ক’টা মানুষ আজকাল ভালবাসা পায় ? অসম্ভব ভাল একটা মেয়ে তার জীবনে, এই কারণে এই শহরের ট্র্যাফিক জ্যাম, অফিসের চাপ সবকিছুকে ক্ষমা করে দেয়া যায়।
ফোন বেজে উঠে অরিন্দমের, কৃপা চলে এসেছে। ফোন ধরার আগেই সে কৃপা’কে দেখতে পায়, একটা হলুদ টিফিন ক্যারিয়ার ঝুলিয়ে হাসিমুখে খুঁজছে তাকে। কৃপা জানে অরিন্দমের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, তাই বাইরে খাবার আজকাল আর অরিন্দম’কে খেতে দেয় না, এই সিগারেট ছাড়াতেও সে তাগাদা দিচ্ছে। অরিন্দম কৃপা’কে নিয়ে রিক্সা নেয়, তারা রিক্সাতেই আজ ঘুরবে ধানমন্ডি এলাকায়। কৃপার আনা বাসার মোগলাই পরোটা খেতে খেতে অরিন্দম জিগ্যেস করে কেমন দিনকাল যাচ্ছে কৃপার। এদের দুইজনের কথায় উদ্বিগ্নতার ছাপ নেই, চিন্তা নেই। নিস্তরঙ্গ এক নদীর মত জীবন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শেষ বর্ষে প্রেম, চার বছরে কৃপার সাথে ভালবাসায় এতটুকু ছেদ পড়ে নি, দিনের পর দিন তারা নিজেদের’কে জেনেছে। দুইজন এখনও বিয়ে করে নি, তাতেও তাড়া নেই। খানিকটা টাকা জমিয়ে তারা বিয়ে করতে চায়। রিক্সাওয়ালা শেষ বিকেলের শান্ত হয়ে আসা শহরের ভবনগুলো পার হতে থাকে টুং টাং আওয়াজ করতে করতে। যেন এই দুইজনের শান্ত সমাহিত কথাবার্তা সঞ্চারিত হয়েছে রিক্সাওয়ালার মাঝেও, তারও আজ তাড়া নেই, জিগ্যেস করছে না কোথায় যাবে এরা আসলে। সে জানে, এরা ঘন্টাখানেক ঘুরবে, অন্য জগতে ডুবে থাকবে। পাশের গাড়ির হর্ন, শেষ বিকেলের জ্যাম কিছুই স্পর্শ করবে না। কৃপা অরিন্দমের বাহু ধরে ঘাড়ে মাথা দিয়ে রাখে। মানুষটা একান্তই তার, আর কারও না। সে অরিন্দমের শার্টের ঘ্রাণে নিমগ্ন হয়ে থাকে, অরিন্দম মোগলাই পরোটার টুকরো ছিঁড়ে মুখে দেয়। কৃপার নীল শাড়ি, অরিন্দমের সাদা শার্টের সাথে আজ বেশ মানিয়েও গেছে।
রিক্সায় যেতে যেতে অরিন্দমের সাথে দেখা হয় তার অফিসের বন্ধু মুজতবার সাথে। মুজতবা ভাল ফটোগ্রাফার, সে আগ্রহ নিয়ে অরিন্দমের রিক্সার দিকে তাকিয়ে রইলো, কাল অফিসের বস থেকে শুরু করে সবাই অরিন্দম’কে খোঁচা দিবে। তার আরেক নাম, ‘পাখি প্রেমিক’, মুজতবার দেয়া। এটার মানে কি অরিন্দম জানে না। সম্ভবত তাদের শান্ত, উত্তেজনাহীন সম্পর্কের কারণে এমন নাম ! অরিন্দম কৃপা’কে অফিসের কথা বলতে থাকে, নতুন জয়েন করা শান্তা নামের মেয়েটার ওভার মেক আপের গল্প, অফিসের বস বাশার ভাই, কেউই বাদ যায় না। এসব শুনতে শুনতে কৃপার একটা জগত হয়ে গেছে অরিন্দমের অফিস নিয়ে। এমনকি অফিসের সব থেকে কুটিল মহিলা খোরশেদা ম্যাডামের গোলাপী হিজাবের গল্পও বাদ যায় না। অরিন্দম একদিন তাকে বলেছিল যে খোরশেদা ম্যাম গরু রান্না করে অরিন্দম’কে খেতে দিয়েছিল, ঈদের পর। ভাবখানা এমন যে সে জানে না যে অরিন্দম হিন্দু। এদিকে অরিন্দমের ধর্মবিশ্বাস তেমন নেই, টিফিন বক্সের সবটুকু মাংস লাঞ্চ আওয়ারে খাবার পর যখন সে খোরশেদা ম্যাডাম’কে খালি টিফিন বক্স ফেরত দিতে যায়, ম্যাডামের চেহারা দেখার মত হয়েছিল ! এসব কিছুই কৃপার কাছে বলা যায় বাদ যায় না, এত ব্যস্ততার মাঝে, আজকাল এত কম দেখা হবার পরেও কোন গল্পই না বলা থাকে না। দুইজন দুইজনের জীবন’কে ভালবাসতো, আর তাই অরিন্দমও জানতো কৃপার সব অফিসের গল্প !
রিক্সা শঙ্করের দিকে এগোতে গিয়ে কৃপা তার বাবা’কে দেখতে পেলো। সে মাথা নামিয়ে ফেলে, রিক্সা পার হয়ে যায়। কোন সমস্যা নেই কারণ এদের পরিবারের কোন আপত্তি নেই, সবাই সবকিছুই জানে।
মোটামুটি এই পর্যন্ত, এই গল্প বলতে আমার সমস্যা হয় নি। সমস্যাটা শুরু হল রিক্সা শঙ্কর পেরোতেই। রাস্তা ক্রস করতে গিয়ে রিক্সাটাকে আড়াআড়িভাবে একটা কার ধাক্কা মারল, দুইজনই উড়ে একটু দূরে পড়ে গেল। রিক্সাওয়ালা রাস্তায় পড়ে গেল তার সিট থেকে। কৃপার মাথায় সামান্য চোট পেয়েছে কিন্ত পাশ থেকে আসা সিটি পরিবহণের বাসটা অরিন্দমের দেহের উপর দিয়ে চলে গেল। স্পট ডেড। এই গল্পে আমার ইচ্ছে ছিল আরেকটু এই দুইজনের জীবনকে দেখা, আরো একটু ভেতরে গিয়ে তাদের জীবনের দ্বন্দ্ব’কে দেখা কিন্ত সেই সুযোগ আমি আর পেলাম না। আমি দুঃখিত।
অরিন্দম মারা যাবার পরে কৃপা অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিল কিছুদিন। একটা শার্টের গল্প, অরিন্দমের শার্ট। এক্সিডেন্টের সময় যে শার্ট পড়েছিল অরিন্দম, সেই শার্ট কৃপা নিজের কাছে রেখে দেয়। মাঝে মাঝে সেই সাদা শার্ট বের করে গন্ধ শুঁকে দেখতো ও। সাদা শার্ট। অরিন্দমের ঘাম, মাথার চুল।
‘তোমার লেখা হল ?’
‘প্রায় শেষ, ছোট গল্প, কিন্ত এত ছোট হবে ভাবি নি…’
‘ সে ভাল, মানুষজন আজকাল এত পড়তে চায় না প্রেমের গল্প !’
‘ উহু, প্রেমের গল্প না। একটা গল্প, যা শুনেছিলাম বছরখানেক আগে, তোমার সাথে পরিচয়ের সময় !’
‘ যতসব গল্প বানাচ্ছো, আমার সাথে আর কেউ ছিল যে তোমাকে গল্প শুনাচ্ছিল ? আমি আর তুমি ছিলাম !’
‘ ঐ আর কি !’
‘এই আমি পানি দিয়ে আসি একটু মাংসে, পোড়া লাগবে।’
‘যাও…’
আমার সহধর্মিণী রান্নাঘরে চলে গেল। আমি চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে শোবার ঘরে যাই, আলমারি থেকে সাদা শার্ট’টা বের করি। গতকালও এই শার্ট’টা হাতে নিয়ে সে কাঁদছিল। লাইট’টা অফ ছিল। আমি জানালা দিয়ে দেখেও ওকে কিছু বলি নি। আমার খুব ইচ্ছে হয় অরিন্দম হতে, কিন্ত আমি অরিন্দম না।
আজ রাতে বৃষ্টি নামবে। একরাতের জন্যে কি আমি অরিন্দম হতে পারতাম না ? ঈশ্বর অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেন না, তাই আমি ব্যর্থ হয়ে বসার ঘরে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ি।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..