অলিখিত সম্পর্ক

রাবেয়া রাহীম
গল্প
Bengali
অলিখিত সম্পর্ক

নিউ ইয়র্ক থেকে বিমানে ৬ ঘন্টার ট্রাভেল ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো শহর। এখানের সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর সুন্দর সৈকত গুলোর মধ্যে একটি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে পড়ন্ত সূর্যের মায়াবী আলোয় মন ভরিয়ে আমাদের প্লেনটি বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে।

এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি কল করে হোটেল রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নেই।

আমি গরমের ছুটি কাটাতে স্বামীর সাথে এসেছি ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোতে। এই শহরটি আমেরিকার সুন্দর শহরগুলির একটি।

এখানে কখনো চরম আবহাওয়া দেখা যায় না। উত্তর আমেরিকা যখন তুষারে আবৃত থাকে তখন এই শহরে বসন্তের আমেজ।

জুলাই আগস্ট মাসে যখন সমস্ত আমেরিকাতে গরমে সবাই অস্থির তখন এই শহরে মৃদু মন্দ বাতাস বয়ে যায়। আবহাাওয়াজনিত এমন কারনে এখানে পর্যটকদের ভীড় সারাবছর লক্ষ্যকরার মতন।

আমেরিকায় রিসিশনের পর ডেমস্টিক ফ্লাইটে কোন এয়ার লাইনস আর খাবার সরবরাহ করে না। অবশ্য খাবার থাকে কিন্তু ডলার খরচ করে কিনে খেতে হয়।

প্লেনের টুনা ফিশ স্যানডউইচ রসনা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়, আমাদের মত ভেতো বাংগালীদের জন্য। তাই হোটেল রুমে ঢুকেই বাংগালী ফুড কোথায় পাওয়া যায় তার খোঁজে গুগল করি।

গুগল সার্চ করে জেনে নেই বেস্ট ইনডিয়ান ফুড কোথায় আছে। হোটেলের বেশ কাছেই একটি ইনডিয়ান খাবার হোটেলর সন্ধানে আমরা ছুটে যাই।

রেস্টুয়ারেন্টির নাম “ইনডিয়ান শেফ”। ভেতরে ঢুকে মনোরম ডেকোরেশন দেখে মন জুড়িয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম খাবারের মান যেন ঠিক এমনই হয়।

এই রেস্টুরেন্টেটিতে বুফে আর অর্ডার দুভাবেই খাওয়া যায়। বুফের খাবারে চোখ বুলিয়ে পছন্দ না হওয়াতে আমরা খাবার অর্ডার করতেই মনস্থির করি। খাবার অর্ডার করে বসে আছি তখনই চোখ পড়লো আমাদের টেবিলের সামনের টেবিলে বাংগালী এক মেয়ের দিকে।

মেয়েটির বয়স বড়জোর বত্রিশ । সাথে প্রায় তিন বছরের ফুটফুটে একটি বাচ্চা মেয়ে। খাড়া নাক, বড় বড় চোখের হাল্কা পাতলা মায়াবী চেহারার মেয়েটিকে প্রথম দেখাতেই বেশ আপন মনে হলো।

এমনিতেই বিদেশ বিভূঁইয়ে সব বাংগালীকেই খুব আপনার আপন মনে হয় । চোখাচোখি হতেই মুচকি হাসি দিয়ে “হ্যালো” বলাটা এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।

বললাম “হ্যালো”

মেয়েটি নিজের আসন ছেড়ে উঠে এলো । হেসে দিয়ে বলল

“সত্যি নিজের দেশের লোক দেখে খুব আনন্দ লাগছে। এদিকটায় বাংগালী তেমন আসেনা, আপনারা কোথায় থাকেন”?

বললাম “আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি, থাকি নিউইয়র্ক”।

“নিউইয়র্ক” আপন মনেই বিড়বিড় করলো কিছুটা উদাসীন হয়ে।

“কতদিন থাকবেন এখানে” আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো

“আজ একদিন চলেই গেলো, আরও চার দিন আছি”।

“আমি এখানেই থাকি একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করছি। আজ আমার মেয়ের জন্মদিন তাই এখানে এসেছি ডিনার করতে, আপনার ফোন নাম্বার টা দেওয়া যাবে”?

“অবশ্যই”।

সে আমার ফোন নাম্বার তাঁর সেল ফোনে এন্ট্রি করে নেয়।

ডিনার শেস করে আমরা স্বামী স্ত্রী হোটেলে ফিরে যাই।

মেয়েটির নাম অদিতি রহমান।

গতকাল সন্ধ্যায় অদিতির সাথে আমার পরিচয় । আজ সকালের নাস্তা শেষ করে বোর্ডওয়াক ধরে হাটতে থাকি। বোর্ড ওয়াকের দুই পাশে সারি সারি দোকান বাহারী জিনিষ দিয়ে সাজানো । গাংচিলের উড়াউড়ি দেখতে দেখতে আপন মনেই হেটে চলি । আজ শনিবার হওয়াতে সকাল বেলাতেই পর্যটকদের বেশ ভিড় লক্ষ্য করলাম।

হঠাত মুঠো ফোন বেজে—“অদিতি” নামটি ভেসে উঠে।

সালাম দিয়ে জানতে চাইলো “কি করো “।

“এই তো হাটছি, সমুদ্র দেখছি”।

“যদি তোমার কোন সমস্যা না হয় আমি আসতে পারি কি”?

“আরে না, সমস্যা আবার কি, তুমি আসলে ভালোই হবে, জমিয়ে গল্প করা যাবে”।

“আচ্ছা”। ছোট নিঃশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দেয় অদিতি।

মেয়েটির কোথায় যেন খুব দুঃখের ছোঁয়া আমাকে উদাসী করে তোলে। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশে বাস করে সম্মানজনক জীবন জীবিকা থেকেও কেন মেয়েটির ভেতর এত বেশি হাহাকার খুব জানতে ইচ্ছে করে।

হয়ত আমাকে বললে তার মনের ভার কিছুটা লাঘব হবে। আর্থিক সামজিক কোন সাহায্যর তার প্রয়োজন নেই কিন্তু মানসিক ভাবে কিছুটা শান্তি তো আমি তাকে দিতে পারি, এটাই বা কম কি!! এমন ভাবনায় পেয়ে বসে মন।

প্রায় আধা ঘন্টা পর অদিতিকে দেখতে পেলাম তার মেয়েটিকে সাথে নিয়ে বালির উপর দিয়ে হেঁটে আসছে। কি যে সুন্দর লাগছে মা মেয়ে দুইজনকেই।

পরনে নীল রঙের জিন্সের সাথে হাফ হাতা সাদা টিশার্টে বেশ মানিয়েছে তাঁকে। দুর থেকে হেসে হাত নাড়লো সে। বাচ্চা মেয়েটি কাঁধ পর্যন্ত চুল ঝাঁকিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে আসছে। কাছে এলে গাল টিপে দিয়ে বললাম– কি নাম তোমার? ছোট মুখটিতে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল—-অরু।

হাটতে হাঁটতে তিনজনে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেলাম। অনেক কথার ফাঁকে মেয়েটির চোখে আর নিঃশ্বাসে খুব শূন্যতা বুঝতে পারলাম।

খুব জানতে ইচ্ছে করছে চমৎকার প্রাণ খোলা হাসিতেও এতো বিষণ্ণতা কেন লুকিয়ে আছে।

সূর্য মাথার উপর উঠে গেছে। ভাবছি হোটেলে ফেরৎ যাব । ঠিক তখন অদিতি আবদারের সাথে বলে উঠলো “দিদি আজ আমার বাড়ী লাঞ্চ করবে চল”।

কিন্তু আগে থেকেই লাঞ্চের জন্য রেস্তুরাতে সিট রিজার্ভ করা আছে তাই যেতে অক্ষমতা জানালাম।

আগামী পরশু চলে যাব, ভাবলাম মেয়েটিকে কিছুটা সময় দেই হয়ত এই বিদেশ বিভূঁইয়ে আপনজন তেমন কেউ নেই।

হেসে বললাম—- “আগামী কাল রাতে তোমার বাড়ী খাবো, কি বলো”?

আনন্দে মেয়েটির চোখের কোনে চিক চিক করে উঠলো। সাথে সাথে জানতে চাইলো ” তোমার পছন্দের খাবারের নাম বলো আমি সব রেঁধে রাখবো” ।

শুধু বললাম—“পাগলী আমি সব খাই। তোমার পছন্দ মত রেঁধে রেখো”।

সান ডিয়েগো এসেছি আজ তিনদিন। আজকের সকালটা ভারি মিষ্টি লাগছে। জানালার ভারি পর্দা সরিয়ে দিতেই ঝক ঝকে রোদ দেখে মন ভরে গেল। সেই সাথে বিচ ভিউ রুম হওয়াতে সৈকতের পুরোটাই হোটেল রুম থেকে দেখা যায়। সূর্য উঠে গেছে । বিচে এখনো মানুষ তেমন আসেনি। সী গালের উড়াউড়ি বেশ লাগছিল দেখতে। জানালার পাশে বসে সমুদ্র সৈকতের দিকে চেয়ে আছি আর মনের ভেতর “অদিতি” খচ খচ করতেই লাগলো।

সারাদিন আশে পাশে ঘুরেই সময় কেটে গেলো। দুপুরে ম্যাডেটেরিয়ান রেস্তোরাঁ থেকে ভুড়িভোজ সেরে হোটেল রুমে এসে ভাত ঘুম দিলাম।

বিকেল পাঁচটায় তৈরি হয়ে ঠিকানা ধরে অদিতির বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলাম। বিকেলের মিষ্টি রোদের আভায় চারদিক ঝকঝক করছে ।

আলিশান বলা যায় না তবে বেশ পরিপাটি রুচিশীল তিন তলা একটা বাড়ীর সামনে এসে ভাড়া করা ট্যাক্সি থামল। স্প্যানিয় ড্রাইভার জানালো এটাই সেই ঠিকানার বাড়ী।

অদিতি আমার অপেক্ষাতে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর পাশে অরু।

আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রাখেনি মেয়েটি। বাঙালী যে অতিথিপরায়ণ অদিতি আরেকবার প্রমান করে দিল।

প্রায় সব ধরনের খাবারে টেবিল ভর্তি করে রেখেছে। একা হাতে এত কিছু কেমন করে করলো কিছুটা অবাক হয়েছি।

মৃদু আপত্তি করি এত আয়োজনের জন্য। ডিনার করে বসে আছি তার গোছানো ড্রয়িং রুমে। কথায় কথায় জানতে চাইলাম এ দেশে কেমন করে এলো, এখানে কে কে আছে।

অদিতি যেন মূখিয়ে ছিল নিজেকে প্রকাশ করতে। একাকীত্বের শহরে মনের কথা শোনার মানুষ কই?

কিশোরীর চপলতায় যেন উচ্ছল হয়ে ওঠে অদিতি- বলতে থাকে—-” জানো দিদি আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি চার বছর আগে ডাইভারসিটি লটারি পেয়ে। এসেই নিউ ইয়র্ক উঠি আমার এক পরিচিত আত্মীয়ের বাসায়”।

আমেরিকা আসার পর থেকে ডিভি লটারি বিজয়ী কারোর সাথে এই পর্যন্ত আমার পরিচয় হয়নি তাই অদিতির কথায় বেশ আনন্দ পেলাম।

আমার শোনার আগ্রহ দেখে অদিতি আরও বলতে থাকে —-

“বাংলাদেশে আমি কম্পিউটার সাইন্সে গ্রাজুয়েশন করে একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতাম। একদিন অনেকটা শখের বশে বা ঝোঁকেও বলা যায় ডিভি লটারি এপ্লাই করি।

সেদিন ঘুণাক্ষরেও মনে আসেনি আমার এপ্লিকেশন এপরুভ হবে। ডিভি লটারি জয়ী অনেক বিজয়ীর মত আমিও আমেরিকার মাটিতে পা রাখি। আমেরিকার অনেক সুযোগ সুবিধার মধ্যে আমিও একটা সুযোগ পেয়ে যাই।

বাংলাদেশের লেখা পড়া এখানে আমি কাজে লাগাতে পারি। ভালো একটা কোম্পানিতে আমার চাকরি হয়ে যায়”।

অর্নবের সাথে সেখানেই আমার পরিচয়। প্রথম দেখায় খুব সাদামাটা ধরনের মনে হয় তাকে । নজর কাড়া ব্যাক্তিত্ব বা চেহারা কোনটাই তাঁর ছিল না। কাপড়ে চোপড়ে খুব সাধারন ছিলো। অফিসের প্রথম দিনেই তার সাথে আলাপ।

এক দেশের হওয়াতে ভালোই লাগলো। সেটা ছিলো শুধুই নিজের দেশের মানুষ হিসেবে। তাঁর কথাবার্তায় নারীর প্রতি সমীহ ভাব খুব ভাল লেগেছিল।

একদিন নিউ ইয়র্ক সিটির পাতাল ট্রেনের জন্য রেল স্টেশনে একা দাঁড়িয়ে আছি। সকাল অফিস টাইমে সবারই খুব তাড়া। তারপরেও প্রচন্ড ভদ্রতার পরিচয় দেয় সকলেই।

হঠাত নিজের নাম শুনে পেছন ফিরে চেয়ে দেখি –অর্ণব। সেও একই ট্রেন ধরবে। অপরিচিত একটি পরিবেশে তাকে পেয়ে ভীষণ ভাল লেগেছিল সেই মুহূর্তে।

সেদিন প্রথম খেয়াল করলাম কি নিষ্পাপ হাসি তাঁর। শিশুর হাসি একেই বলে যেন!

আমার জীবনে অর্ণব অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে লাগলো। অফিসের অনেক জটিল কাজে সে আমাকে বন্ধুর মত সাহায্য করতে লাগলো।

কাজ শেষে বাড়ি যাওয়ার তাড়া থাকতো না কারোরই, তাই চলে যেতাম কফি শপে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করতাম । কেন যেন তাঁর সামান্য কথাতেও হেসে উঠতাম।

সব চেয়ে ভাল লাগা ছিল দুজনার পছন্দ গুলো ছিল এক রকম। দুজনেই কবিতা লিখতাম, রাত জেগে পড়তাম। শহর থেকে দূরে কোলাহল মুক্ত পরিবেশ দুজনেরই ভীষণ পছন্দের ছিল।

দূর থেকে তাকে দেখলেই ভাললাগা ছড়িয়ে পড়ত আমার ভেতর। সাধারন মানুষটিকে আমার কাছে অসাধারন লাগতে থাকে। অর্ণবের মিটি মিটি হাসি চোখে লেগে থাকতো। স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর ছিলো সেই দিন গুলো।

সোম থেকে শুক্রবার কাজ শেষ করে আমেরিকার মানুষ শনি রবিবারের জন্য অধির অপেক্ষায় থাকে। শুক্রবার আসলেই সবাই খুব উত্তেজনা অনুভব করে। শনিবার রবিবার কাটানোর প্ল্যান শুক্রবারেই শুরু হয়ে যায়। অনেকে আবার শুক্রবার রাত থেকেই উৎসবের রাত ধরে থাকে।

নভেম্বরের শুরু , সুয়েটার ছাড়া বাইরে যাওয়া সম্ভব হয়না । গাছের সব পাতা লাল হয়ে যাচ্ছে, প্রকৃতির এমন পরিবর্তন মনে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগায়।

প্রকৃতির এমন ভিন্ন রুপে মুগ্ধ হই দুজনেই। নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে দেড়-দুই ঘন্টার ড্রাইভে কান্ট্রি সাইড।

শুক্রবার লাঞ্চের পর আমি কাজে ব্যস্ত এমন সময় এলিনা আমার কলিগ তাঁর টেক্সট আসে— “এই উইকেন্ডে চলো নিউ ইয়র্কের বাইরে বেড়াতে যাই, যাবে?”

–“আচ্ছা”, উত্তর করেই অর্ণব এর কথা মনে হয়। অর্ণবের খুব ইচ্ছে কান্ট্রি সাইডে বেড়াতে যাওয়ার।
অর্ণব কে টেক্সট করি —- “অফিসের পর হলওয়েতে অপেক্ষা করো”।

সাথে সাথে রিপ্লাই আসে—“আচ্ছা”।

সেদিন অফিস ফেরার পথে ঝুম বৃষ্টি, শীতের সন্ধ্যা ঝুপ করে নেমে আসে। আমি আর অর্ণব দুজনেই সিটি বাসে উঠে বসলাম। আমি তন্ময় হয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। বৃষ্টি হলেই বাংলাদেশের কথা মনে আসে।

অর্ণব আমার মনের কথা বুঝতে পেয়ে আমার হাতের উপর তার হাতটি আলতো করে রেখে হাল্কা চাপ দিয়ে বলে—
“আমারও বাংলাদেশের কথা মনে পড়ছে”।

আমি অর্ণবের কাঁধে মাথা রাখি নির্ভরতায়। আরও খানিকটা কাছে সরে এসে অর্ণব জানতে চায়—

“ঘরে কিছু রান্না করেছিলে, কি খাবে যেয়ে” ?

“খেয়ে নেবো কিছু একটা”।

“তুমি খাওয়ার ব্যাপারে খুব উদাসীন, এটা ঠিক না, দুপুরে তেমন কিছু খাও না, সারা দিনে অন্তত একবার ভালভাবে খাওয়া উচিত।এমন করলে শরীর খারাপ করবে। তারপর কে দেখবে”?

আমি হেসে ফেলি তার কথার সরলতায়,
বলি —-“কেন তুমি আছো তো”।

“বাংলাদেশী গ্রসারী স্টোর থেকে বড় ইলিশ মাছ কিনেছিলাম, গতকাল রান্না করেছি, চল আমার বাসায়, পেট ভরে ভাত খাবে “।

ইলিশ মাছ আর ভাতের কথা শুনে সত্যি ভীষণ ভাত খেতে ইচ্ছে করলো। রাজী হয়ে গেলাম।

অর্ণব এর ফ্ল্যাটটি স্টুডিও রুম। তাঁর বাড়ি এই প্রথম আসা। ঘরে ঢুকেই ভাল লাগলো, বললাম—-

“তুমি দেখছি বেশ গোছানো”।

সে আমার কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলল

“বাথরুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো । তুমি ক্লান্ত “

অর্ণবের এই কেয়ারিং স্বভাব আমাকে আরও বেশী আকর্ষণ করলো।

মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বের হয়ে এসেছি । অর্ণব কাছে এগিয়ে এসে আমার মুখ তার দুই হাত দিয়ে আরও কাছে নিয়ে বলল

“তুমি সুন্দর তুমি পাগল পারা আদুরে সুন্দর”।

বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার। জানালা গলে চাঁদের আলো আমার মুখে এসে পড়ছে। ঘরময় ফুলের গন্ধ অনুভব করলাম। অর্ণবের চোখে আমার চোখ।

নিজের ভেতরে কোথায় যেন একটু নড়াচড়া অনুভব করলাম। আমার বাঙালি নারী স্বত্বা বলে এটা ঠিক না। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।

বললাম— “চলো বিয়ে করি, এভাবে না”।

অর্ণব হেসে আমার কপালে ছোট্ট চুমু দিয়ে বলল —– “ভাত খাবে চলো”।

কেমন এক অজানা আনন্দে শিহরিত হলাম। চোখে পানি চলে এলো । শুধু বললাম—“তুমি কেন এত ভালো”?

ভাত খেতে খেতে আমরা প্ল্যান করি আগামীকাল শনিবার বেশ কিছু ঘরের কাজ সারতে হবে। এই উইকেন্ডে সব গুছিয়ে পরের শনিবার এলিনার সাথে কান্ট্রি সাইডে যাওয়া যাবে।

বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিতে অর্ণব আমার সাথে আসে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বাস আসছে। হঠাত যেন তাঁর কি হয় সে আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে—

“পাগলী তুমি ঠিক বলেছ, চল বিয়ে করি। দিন তারিখ তুমি ঠিক করো ওটা তোমার দায়িত্ব”।

আমিও তাঁকে আঁকড়ে ধরি। এই মুহূর্তে তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্বাস যোগ্য আর আপনজন বলে মনে হচ্ছে ।

দুই.

কোন সম্পর্ক শুধু মাত্র ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে টিকে থাকে না, সম্পর্ক টিকে থাকে দুটি মানুষের পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস সম্মান আর ভাল লাগার উপর । এই কথাটি আজ অফিস থেকে ফেরার পথে বার বার মনে পড়ে আমি যেন অন্যরকম ভাল লাগার ঘোরের ভেতরে ঢুকে যাই।

এই প্রথম অর্নব এতোটা কাছে এলো। শুধুই শারীরিক আকর্ষণ? না তা নয় । আমি তাকে বিশ্বাস করি সম্মান করি , সেও আমাকে এতোটাই করে আমার মনে হচ্ছে। নইলে বিয়ের কথা কেন বলবে ! তাঁর পারফিউমের ঝাঁঝালো ঘ্রান এখনো আমার নাকে লেগে আছে।

“বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করার দায়িত্ব” অর্ণবের বলা এই একটি কথা ভীষণ আনন্দিত করে আমাকে। বিয়ের জন্য সিটি ম্যারেজ রেজিস্ট্রার অফিসে এপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। এই মাসে কি পাওয়া যাবে! এ ব্যাপারে এলিনার সাহায্য দরকার।

এ ভাবনাতে এলিনা কে ফোন করি । তার কাছে জানতে চাইলাম ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসের নিয়ম কানুন।

আমার কথায় এলিনা প্রায় লাফিয়ে উঠলো

” ওহ মাই গড– বিয়ে ?

কে করবে ?

তুমি?

অর্ণব কে”?

তাঁর কথায় সারা শরীরে শিহরন ছড়িয়ে পড়লো। অন্যের মুখে নিজের বিয়ের কথা শুনতে অদ্ভুত ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো। শুধু বললাম

“হুম” এতটুকু বলতেই পানির পিপাসা পেয়ে গেলো।

সে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বললো “করে ফেলো, করে ফেলো। অর্নব ভীষণ ভালো ছেলে। তোমরা সুখী হবে। তুমি কিছু ভেবোনা আমি সব খবর জেনে রাখবো। তা আগামী কাল যাচ্ছিতো সাউন্ড বে তে”?

–আগামীকাল না চলো পরের সপ্তাহে,

–আচ্ছা তোমার ইচ্ছে।

এলিনার সাথে কথা বলছি সে সময় স্ক্রীনে অর্নবের নাম ভেসে উঠে । অর্নব ফোন করছে । এলিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অর্নবের কল রিসিভ করি। এই মুহূর্তে এক অজানা ভালো লাগায় তার সাথে কথা বলতে বুকের ভেতর ধুকপুক করতে লাগলো।

“হ্যালো বউ” — “বউ” কথা শুনে কেঁপে উঠলাম শিহরন আর আনন্দে। আবেশের রেশ যেন কেটে না যায় তাই শুধু হাসলাম। সে আরও বেশী আদর মাখা গলায় বলল —

“কি ব্যাপার কথা বলবেনা ?

নাকি একদম বিয়ের দিন বলবে”?

আমি আবারও কেঁপে উঠি তার কথায়।

হাল্কা অনুযোগের সুরে বলি—“বিয়ে এখনো হয়নি তবে বউ ডাকা কেনো”?

“আচ্ছা ডাকলাম না তবে বিয়ের পর কিন্তু আমি নাম ধরে ডাকবো না, বউ ডাকবো”।

আমি আবারও কেঁপে উঠি। অর্নব বুঝতে পারে। ছোট্ট আদর দিয়ে বলে— ঠিক আছে আর জ্বালাবোনা এখন ঘুমাও ।

শনিবার অনেক বেলা করে ঘুমানো অভ্যাস। মাথায়, মনে “বিয়ে” কথাটা গেঁথে আছে যেনো। বিয়েতে শাড়ী না লেহেঙ্গা, কেমন রঙ। এ ব্যাপারে অর্ণবের সাথে কথা বলতে হবে। অর্নব কি পরবে। আমার সাথে ম্যাচ করে শেরওয়ানী? কত শত রকমের ভাবনারা আমাকে অস্থির করে রেখেছে। বিছানায় শুয়ে থাকতে্ও ইচ্ছে করছেনা।

সারা সপ্তাহের বাজার শনিবারে করে রাখি কিন্তু আজ ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করছেনা। বিয়ের পর দুজনার এক সাথের জীবন—আচ্ছা তখন কি অর্নব আমর সাথে ঝগড়া করবে? কি ভাবছি এসব? ঝগড়া কেনো করবো! সুন্দর গোছানো পরিপাটি একটি গৃহকোণ হবে আমাদের।

ছুটির দুই দিন কেমন করে যেন কেটে যায়। অফিসের কাজে ব্যাস্ত আছি এলিনার টেক্সট আসে ” নভেম্বর ১২ তারিখ ম্যারেজ রেজিস্টার কাছে বিয়ের এপয়েনটমেন্ট”। তারিখ মেলাই আজ নভেম্বর দুই আরও ১০ দিন বাকি। এলিনার টেক্সটের স্ক্রীন শট অর্নবকে পাঠিয়ে দেই।

অর্নব উত্তর করে –“আমার ঘরে স্বাগতম বউ”।

আনন্দ আর আনন্দ! চাপা আনন্দ আর উত্তেজনায় চোখে পানি চলে আসে। এই মুহূর্তে চিৎকার করে সবাইকে বিয়ের কথা জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।

এই পর্যন্ত বলে অদিতি থামে। তার চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেই। টিস্যু দেই চোখ মুছতে।

ভাবনাতে পরে যাই এতো আনন্দের ভেতরে কেনো কষ্ট লুকিয়ে থাকে! আমরা বুঝতে পারিনা জীবন কোন সময় আমাদের কি রং দেখায়। ভবিষ্যতের জন্য আমরা শুধু স্বপ্ন বুনে যাই। জীবনের স্বর্নালী দিনগুলোর হিসেব মেলাতে গিয়ে, গড়মিল আর অপ্রাপ্তির তালিকা দীর্ঘ হলেও ভেঙ্গে পড়ার উপায় থাকেনা এগিয়ে যেতে হয় নতুন জীবনের আশায়। ঘুমন্ত অরুর দিকে চোখ পড়ে। কি নিষ্পাপ! এই মেয়েটি বাবা মায়ের আদর এক সাথে কেন পাবেনা! জীবন কেন এতোটা নিষ্ঠুর হয়!

অদিতি নিজেকে সামলাতে সময় নেয় আর আমি জানতে আগ্রহী হই এমন কি ঘটনা ঘটে গেল যে বাচচাটিকে নিয়ে আজ অদিতি এত বেশী একা। আর্থিক স্বাছন্দ্য কি আর মানসিক শান্তি আনতে পারে!

“তারপর— বিয়েটা হয়েছিলো ১২ তারিখে “? খুব নরম সুরে জানতে চাইলাম।

টিসু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে উপর নীচ মাথা নেড়ে বলে “হ্যাঁ বিয়ে হয়েছিল মনের সাথে মনের বিয়ে । আত্মার সাথে আত্মার বিয়ে। আমার সারাজীবনের স্বামী হিসেবে তাকে গ্রহন করেছিলাম সেদিন”।

আমি অস্ফুটে বোকার মত বলে ঊঠি– “তার মানে সামাজিক ভাবে বিয়ে হয়নি? কেন ? এপয়েন্টমেন্ট তো নেওয়াই ছিল”।

অদিতি আবার চোখ মুছে বলে— “সেদিন ছিলো শুক্রবার। অফিসের কাজ সারতে অর্নবের দেরী হয়ে যায় । আমরা যখন সেখানে যেয়ে পৌঁছাই ম্যারেজ রেজিস্টার অফিস বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নেই কান্ট্রি সাইডে যাওয়ার। এলিনার সাথে তার বয় ফ্রেন্ড আর আমরা দুইজন এক গাড়িতেই চলে যাই।

আমেরিকার গ্রাম যে এতো সুন্দর হয় কল্পনাও ছিলো না। বিশাল আপেল বাগান পার হয়ে আংগুর বাগান। তার মাঝখানে পিচের রাস্তা । তাছাড়া ফল সিজনে গাছের রং লাল – হলুদ হয়ে অপুর্ব পরিবেশ। নভেম্বরে বিকেল চারটের পর সুর্য ডুবে যায়। সুর্য ডোবার পর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনে খুব অবাক হয়ে যাই। চাঁদের আলোয় ভেসছিল চারদিক।

অর্ণব পাশে এসে দাঁড়ায়। আমার কাঁধে হাত রেখে জানতে চায়– “আজ বিয়ে হয়নি বলে মন কি বেশী খারাপ”?

—“খারাপ লাগছে তোমার” ? আমিও জানতে চাই ।

অর্ণব আমাকে তাঁর দুই হাত দিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে চুলে মুখ ডুবিয়ে বলে—“লক্ষী আমার বিয়ে কি বাইরের না মনের.”।

আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে আমার শুধু বলতে পারি— “আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহন করলাম”।

স্বপ্নের রাত শেষে মিষ্টি ভোরে এক মায়াবী আবেশে, মধুর আর কিছু নতুন অনুভূতিতে নিজেকে আবিষ্কার করি অর্নব এর উষ্ণ আলিঙ্গনে।

খুব হিসেব করতে ইচ্ছে করে মানুষের জীবনের আনন্দ আর সুখের সময়ের ব্যাপ্তি কতক্ষণ ? কেউ কি জানে কতক্ষণ ? মহাকালের গহ্বরে এই সময়টুকু খুব অল্প। যেন চোখের পলকে চলে যায়। তাতেই আমরা পরিপূর্ণ হয়ে যাই। মনে হয় সব পাওয়া হয়ে গেলো।

তাই বোধহয় জীবনকে আরও গভীরে ভালবাসি। এক অলিক আবেশে শনি/রবি দুটি দিন কেটে যায়। রবিবার সন্ধেতে তৈরি হতে থাকি নিউ ইয়র্ক ফিরে যাওয়ার।

যদিও সন্ধ্যার পর রাতের খাবার খেয়ে বের হয়ে যাই কিন্তু হাইওয়েতে খুব ট্র্যাফিক থাকায় রাত দশটা বেজে যায় নিউ ইয়র্ক ফিরে আসতে । আমরা দুজনেই খুব ক্লান্ত ছিলাম । রাতে অর্নব নিজের বাড়ি যাওয়ার তেমন আগ্রহ দেখাল না আমারও তাকে ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল না।

সোমবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই দুজনে যে যার মতই অফিসে চলে যাই। অফিসে দুপুরের খাবারের সময় অর্ণব কে টেক্সট করি । উত্তর আসে —-“ভীষণ ব্যস্ত পরে কথা হবে”।

অফিস ছুটির পর অর্ণব কে খুঁজতে তাঁর ডিপার্টমেন্টে যাই। যেয়ে শুনি অর্ণব ফ্লোরিডা অফিসে দুই সপ্তাহের জন্য আজ দুপুরের ফ্লাইটে চলে গিয়েছে।

কিছুটা অবাক হই এই ভেবে আমাকে একটা টেক্সট না করেই চলে গেল! বিকেলে বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরে আসি। তাকে ভীষণ মনে পড়ছে। গত দুই দিন এক সাথে কাটানোর সময় গুলো মনে ভীড় করছিল।

এমন সময় অর্ণবের টেক্সট আসে–“খুব বেশী ব্যস্ত ছিলাম তাই বলে আসতে পারিনি। আমি এখনও অফিসে আছি বের হতে দেরি হবে।তুমি ভাল থেক, ভাল রেখ সবাইকে, আমার নিউ ইয়র্ক ফিরতে দেরি হবে”।

সেদিন রাত দশটায় ঘুমানোর আগ পর্যন্ত তাকে প্রায় চল্লিশটা টেক্সট করি । কিন্তু কোন উত্তর আসেনা। এভাবেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে অফিসে যেয়ে অর্ণব এর জন্য অস্থির লাগতে থাকে। ২৫ তলা অফিস বিল্ডিঙয়ের অসংখ্য মানুষের ভেতর নিজেকে খুব একা আর নিঃসঙ্গ মনে হতে লাগলো। দিন গুনে গুনে ৬ দিন পার হয়ে যায় । আমি অস্থির হয়ে উঠি জানার জন্য সে কোথায়।

ফ্লোরিডা অফিসে হিউম্যান রিসোরসে ফোন করে জানতে পারি অর্নব অফিসের কাজে আটলান্টা অফিসে ট্র্যান্সফার হয়েছে। খুব অবাক হলাম আমাকে জানালো না কেনো? আটলান্টা অফিসের ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন করি। সে ফোন রিসিভ করেনা ।

এভাবে ২০ দিন কেটে যায় । মনের মাঝে অজানা শঙ্কা কাজ করে। মনে হয় সে ইচ্ছে করেই এমন করছে। মেইলের পর মেইল করি কোন উত্তর নেই।

এভাবেই প্রায় একমাস পার হয়ে যায়। গত একমাসে অর্ণব সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গাধাদের একজন বলে মনে হচ্ছে।

আটলান্টায় অর্ণবের বউ আর দুটি বাচ্চা নিয়ে সংসার আছে। দিনের শেষে সে তাঁর স্ত্রী আর সন্তানের কাছেই ফিরে গেছে। আসলে দোষ আমারও ছিল ।

আমি কখনো জানতে চাইনি সে বিবাহিত কিনা! আসলে আমার প্রতি তাঁর আকর্রষণ এতোটাই তীব্র অনুভব করেছিলাম যে গত দুই মাসের পরিচয়ে আমার মনে একবারের জন্য এই প্রশ্ন আসেনি।

এই জীবনে অনেক কিছুই শেষ হয়েও, নিঃশেষ হয় না! কোথাও না কোথাও আরও বেশী অনেক গভীরে থেকে যায়।

এক মাস পর হঠাত বমির দমকে ঘুম ভেঙ্গে যায় । বিছানা ছেড়ে উঠতে যেয়ে মাথটা চক্কর দিয়ে উঠে। কিছুক্ষণ যেন নিঃশ্বাস আটকে থাকে, জোরে শ্বাস নেই। কি ঘটছে নিজের শরীরে বুঝতে পারছিনা কিছুই। ঘড়িতে সময় দেখি ভোর ছটা। সকাল আটটায় ছুটতে হয় অফিসের উদ্দেশ্যে। আজ শরীর চলছে না।

বিছানা থেকে উঠতে যেয়ে মাথা চক্কর দিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম, খাটের কোনা ধরে ঠিক থাকি। হঠাত বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। এই সময়ে যদি অর্ণব আমার পাশে থাকত! যদি পরম নির্ভরতায় আমার হাতটা ধরে পাশে থাকত ! ভীষণ মনে পড়ে তাকে।

সেই রাতে এক সাথে কাটানোর সময়, উষ্ণতা, অনুভূতি আজ দুচোখ ভিজিয়ে দিয়ে যায় । ভীষণ একা লাগতে লাগলো।

বিকালে ডাক্তারের কাছে যেয়ে জানতে পারি আমি সন্তান সম্ভবা । অর্ণবের সন্তান আমর গর্ভে । কি আনন্দ !! কিন্তু কোথায় অর্নব!!

ভীষণ অভিমানে বুক ভারি হয়ে উঠলো। প্রতিজ্ঞা করি একাই আমি এই সন্তান জন্ম দিবো। এই সন্তানের কথা কখনোই তাঁকে জানাবো না।

তাই আমি নিউ ইয়র্ক ছেড়ে চলে আসি সান ডিয়েগোতে। অরুর জন্ম এই শহরেই হয়। আমরা মা মেয়ে ভাল আছি।

ছল ছল চোখে আমি অদিতির দিকে তাকিয়ে থাকি। মেয়েটির গাল বেয়ে অভিমানের জল গড়িয়ে তার জামা ভিজে যাচ্ছে। সত্যিইতো মুখের বিয়ে আর ধর্মীয় ও আইনগত বিয়ের পার্থক্য অনেক।

মুখের বিয়েতে কোন প্রমাণ থাকেনা তাই ছেড়ে যাওয়া বা অস্বীকার করা সহজ হয়। কিন্তু প্রশ্ন জাগে মনে –প্রেম , ভালবাসা কি দলিল পত্রে হয়ে থাকে? মনের টান, এক জনের জন্য আরেক জনের ব্যাকুলতা এসবের জন্য কি দলিল পত্র লাগে?

জীবন সত্যিই অদ্ভুত!!

শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নেই অদিতির কাছ থেকে। সে তাঁর ইচ্ছে মতন বাচুক। তাঁর জন্য অনেক শুভ কামনা।

রাবেয়া রাহীম। কবি। জন্ম ২০ মার্চ, ময়মনসিংহ; বাংলাদেশ। বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। বর্তমান নিবাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। জীবনকে খুব সহজভাবে দেখতে ভালবাসেন। যা কিছু মন ছুঁয়ে যায় তাই নিয়ে তাঁর ভাবনা প্রকাশিত হয় গল্প, কবিতায়। কৈশোর থেকেই কবিতার সাথে তাঁর বন্ধুত্ব।...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..