অলৌকিক ট্রেন

বদরুদ্দোজা শেখু
কবিতা
Bengali
অলৌকিক ট্রেন

অলৌকিক ট্রেন

একটা ট্রেন আসছে ।

আমার বিশ্বাসের বিশীর্ণ তট , প্রতীক্ষার ছারখার
চাঁদমারি, আর অস্তিত্ত্বের বিপন্ন বিস্ময় নামক উপত্যকা ধ’রে
একটা ট্রেন আসছে ।

আমার শ্রমিক সত্ত্বার ঘামের অমোঘ নদী , সোনালি
আকাঙ্ক্ষার উজানীর মাঠ , আর সাতপুরুষের
ঘুমানো নৈঃশব্দ্যের আরণ্যক প্রান্তর অতিক্রম ক’রে
একটা ট্রেন আসছে ।

আমার বুকের বিধ্বস্ত নীলিমার নিসর্গ-প্রচ্ছদ ,আড়ষ্ট
অনুভূতির অব্যক্ত ঊর্ণাজাল ,উন্মাতাল
ভালবাসার বিহ্বল বিবর্ণতা , আর
ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা শিল্পঘ্ন সমাজ ভেদ ক’রে
একটা ট্রেন আসছে ।

আমার চিন্তার নির্দল নিজস্ববোধ , চেতনার
মর্চে-পড়া ঝোপঝাড় , আদর্শের
বলি হওয়া বিশ্বাসের রক্তাক্ত সোপান , আর মানুষ নামক এক
অবিভাজ্য পার্থিব জীবের সাথে আত্মীয়তার আঙিনা উচ্চকিত ক’রে
একটা ট্রেন আসছে ।

তোমরা বানাও ধাতব শহর , বৃক্ষদের
বংশে হানো নির্মম কুঠার , স্তূপীকৃত করো
চৈতন্যের কবরখানায় তেজস্ক্রিয় আবর্জনা ,কফিন বানাও
আমার কণ্ঠের যৌবনের নির্ভীক মলোইসকে ,
তবু আমার সত্ত্বার—

দ্বিখণ্ডিত বঙ্গদেশ
বর্ণবৈষম্যবাদ-বিরোধী বাঙ্ময় আফ্রিকা
বিপর্যস্ত বাউল সঙ্গীত
স্পন্দন-মুখর সবুজ পাতার প্রেম
প্রজন্মের পরাস্ত প্রয়োজনের দৈনন্দিন দিকচক্রবাল
তোলপাড় ক’রে তীব্র হুহু শব্দে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় ক’রে
ছুটে আসছে আমার একান্ত অনুভূতির শব্দশ্রেণীর শৃঙ্খলাবদ্ধ ট্রেন ।

সাদা পৃষ্ঠার প্ল্যাটফর্ম দিয়ে
ওকে পাশ করিয়ে দিই গন্তব্যের দিগন্তের উদ্দেশে ,
তারপর প’ড়ে থাকি
ধূসর প্রান্তরে যেমন শূন্য রেললাইন কংক্রীটের কঙ্কাল ;
কখনো-বা ,একটা ট্রেন যেতে না যেতেই
ঘন ঘন তাগাদার বাঁশি দ্যায়
পায়রার মতো নেচে-নেচে-ওঠা বক্ষলগ্ন রাজেন্দ্র শব্দের
অলৌকিক আরেকটা ট্রেন ।।

পাশাপাশি

গ্রামগঞ্জ পঞ্চায়েত মফঃস্বল অফিস কাছারি
ফ্যা ফ্যা ক’রে ঘুরতে ঘুরতে একদিন চৌরাস্তার
হতচ্ছাড়া ভাগ্যের ছ্যাকড়া গাড়ি
সরকারী টিপিক্যাল কেরাণীর কপি হওয়া সস্তার অসার
সৌভাগ্যের সিংহদ্বারে পৌঁছে গেল মাঝ রাস্তায় হঠাৎ , সেই
সুবাদেই প্রত্যহ রাজবাড়ির আনাচে-কানাচে কেউ-কেটা সাজি ,স্তূপ
নথিপত্রে বকলম মুসাবিদা-লেখা মুরুব্বির
জো-হুজুর তল্পি-বওয়া মুন্সীয়ানার খোঁচায়
নিজস্ব শিক্ষাক্রমের মুখ-থুবড়ে’ প’ড়ে থাকা বাতিল মৃগের
মুণ্ডুপাত করি অকপট রোজ , একদা সম্ভাব্য
পদোন্নতির প্রশস্ত সড়কে পৌঁছানোর মোহে । তবু
দপ্তর-কর্তার অসন্তুষ্ট ইঙ্গিতের অর্ধচন্দ্র
বস্তুতঃ শিয়রে ঝুলে আঁকসির অদৃশ্য ফণায় ।
অফিসের কর্মব্যস্ততায় উড়ে শব্দের বুদ্বুদ ,
মিটিং মিছিলে ঘুরে আলোচনা প্রচারণা দাবি-দাওয়া চাঁদা
আন্দোলন ,সংঘের ধূর্তামি ।আর দীর্ঘ চেঁচামেচির মলম
বকেয়া কিস্তির কিছুমিছু মহার্ঘ ভাতার গন্ধে
ব্যবসাদাররা মহানন্দে রাজপথে বগল বাজায় ,দেখি
ভদ্রতার বাহ্যিক চাকচিক্যের চৌকস মোরামে
আদর্শের চোরাবালি ,এবং আমার
অসহায় অস্তিত্বের নেপথ্যে কৌতুকে হাসে ভূশণ্ডীর কাক ।

দৃশ্যান্তরে, কে এক মানুষ যায় অলৌকিক ধবধবে সফেদ ঘোড়ায়
চ’ড়ে অলিগলি আস্তাকুঁড় ডাকবাক্স এভিনিউ পার্ক বিমানবন্দর ইত্যাদির
দৃশ্যাবলী দু’চোখের আয়নায় আঁকতে আঁকতে অবিরাম
চ’লে যায় দূর দিগন্তের সানুদেশে বিস্তীর্ণ বনভূমির সবুজ উপত্যকায় ,
পাহাড়ী ঝর্ণার স্নিগ্ধতায় রাখে মুখ ।
বস্তুতঃ স্বভাব-দোষে কেবলি সে সারাক্ষণ
মরালের মগ্নতায় সাহিত্যের জলকেলি করে ,
রোদ বৃষ্টি ঝড়ে ভাঙাচুরা নীলিমার ইন্দ্রপ্রস্থে
সাজায় রামধনুর প্রসন্ন বিস্তার , দৃষ্টির দিব্যতা দিয়ে
পাতি পাতি খোঁজে শুধু স্বতঃস্ফূর্ত
পাখির গান ও ফুল শহরের বিনষ্ট বাগানে ।বিমুগ্ধ নিষ্ঠায়
শিল্পের মৃগয়াভূমে আকৈশোর মৌন বিচরণ তার,
চোখে তার আলম্বিত
অস্তিত্বের অধম ভাটপাড়ার সাদামাটা মানুষ এবং
সুকৃতি ।

সে এক আজব লোক , আমার সত্ত্বার
অশরীরী সহচর , অধম আত্মার
অন্তঃপুর প্রতীতির সমঝদার প্রাণপুরুষ , আমার
চিন্ময়
বিশ্বাসের একনিষ্ঠ পথ-প্রদর্শক ।
যখন আমার হন্তদন্ত চৌরঙ্গীর চারিপাশে
নিত্য পরাস্ত প্রয়োজনের আঁধারে ঘুরে বেড়ায়
নৈরাশ্যের কালকুট ,চৈতন্যের চামচিকে ,আকাঙ্ক্শার শব ,

পাশাপাশি নিবিষ্ট আস্থায় সে কেবলি ক’রে যায়
মানবিক দায়াবদ্ধ চিত্রকল্পে অমৃতের স্তব ।।

বাঙ্ময় মুখ

(কবি বেঞ্জামিন মোলইস স্মরণে )

নয়কো যাবজ্জীবন জেল কিংবা নয় দ্বীপান্তর
ছেলেটাকে হলো ফাঁসি,খুব ভোরে,যখন শহর
সুমসাম, পথঘাট অন্ধকার, এবং ডাকেনি কাক,
প্রকৃতির আর্তনাদ অন্তরীক্ষে হয়েছে বে-বাক;
ওরা চেয়েছিল কবির কণ্ঠ করতে সমূলে বিনাশ,
কবি ব’লে কেটে বসে আমারও গলায় সেই ফাঁস।

কিন্তু পারলো না কেড়ে নিতে ওকে, রাতের আঁধারে
এখনো ছেলেটা এসে প্রতিদিন জোর কড়া নাড়ে
প্রতিটি ঘরের দুয়ারে দুয়ারে,করে উচ্চারণ
আলোর বন্দনা, চেতনার প্রতিধ্বনিময় মাঠে
আকাশ বাতাস ব্যর্থতা বিদীর্ণ ক’রে পাখসাটে
ঘুরে ঘুরে তুলে যায় প্রত্যাশার তীব্র অনুরণ,
আন্দোলিত করে বুকের অনুভূতির সবুজ পত্রালি,
আদিম একাত্মতার নতুন শপথ, এবং সোনালি
ভবিষ্যতের কোনো সমৃদ্ধ উদ্ভাসন; রক্ত-লাল
মুক্তির কেতন ওড়ায় অন্ধ-প্রায় অক্ষি-গোলকে ,
শঙ্কাহীন ছড়ায় সে জীবনের নতুন সকাল
নিয়ে আসার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি মৃত্যুর সড়কে,
কর্তব্যের রাত শেষে ঘরে -ফেরা শিস্ দিয়ে যায়,
সে কেবল একটি জীবন নয় , সংগ্রামের জীবন্ত অধ্যায় ।
বক্তব্যে প্রত্যয়-পূর্ণ, কর্তব্যে কঠিন ,
অঙ্গীকারে একনিষ্ঠ ,অন্যায়ের প্রতিবাদে ক্ষমাহীন
কবির কণ্ঠে বাঙ্ময় কৃষ্ণকায় আফ্রিকার মুখ
যেমন ভাষায় সত্য খাঁচাবদ্ধ যতো পাখি ,কাক ও ডাহুক ।।

হয়তো হবে না

আমি নিজেই নিজেকে কেমন-যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা এখনো ।

আমার হৃদয়ে একটা দেবতা আছে
যে সামান্য সাহায্যের অর্ঘ্য চেয়ে আমার কাছে
ব্যর্থ হয়েছে কতোদিন, আমার মনের মধ্যে আছে একটা অতীন্দ্রিয় মন্দির
যার বাইরে স্বার্থপর প্রবৃত্তিগুলো ইতস্ততঃ ভিড়
ক’রে থাকে কিন্তু ঢুকতে পারে না ,নীলিমার মতো
একটা বিস্তীর্ণ দেশ উদ্ভাসিত আমার আড়ালে , এবং অনবরত
গান গাইতে চায় আমার আত্মার অভয়ারণ্যের একটা পাখি ;
কিছুই দেখি না , অথচ দোহাই দিয়ে যাই সমাজ-কালের অবক্ষয়ের ফাঁকির ।
তবু একবার অন্ততঃ নিজেই অন্তরের প্রতিধ্বনি কান পেতে শোনো ।

আমি চাই রাস্তার উদ্বাস্তু মানুষগুলোর জন্য
একটা বিশাল রাজপ্রাসাদ বানাতে , মতিচ্ছন্ন
আদর্শের কাঁধটা ঝাঁকিয়ে একনিষ্ঠ বিশ্বাসের ঋজু রাস্তায় দাঁড়াতে , ইচ্ছে হয় —
জীবিকার ধূসর প্রান্তর থেকে মুছে দিই দুর্ভিক্ষের কালো বিপর্যয় ,
আমার মনের মৃত্যুমুখি ময়ূরকে প্রাণ খুলে গাইতে দিই গান
বিবেকের বিধ্বস্ত অরণ্যে , ভেঙে ফেলি দাসত্ত্বের পিঞ্জর পাষাণ ।

—সে আর হবে না হয়তো জীবদ্দশায় ,
কেননা দেখছি —
স্বদেশে বিদেশে স্কন্ধদেশে খড়্গ তোলে প্রতিহিংসা-পরায়ণ কাব্যের কসাই ।।

বদরুদ্দোজা শেখু। কবি। জন্ম ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘিতে। অভাব অনটনের মধ্যে তাঁর বেড়ে উঠা। প্রথাগত শিক্ষায় স্নাতকোত্তর। পেশায় অবসরপ্রাপ্ত রাজ্য সরকারি কর্মচারী, নেশায় কবিতা লেখালিখি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: অলৌকিক আত্মঘাত, দুঃস্বপ্নের নগরে নিভৃত নগ্ন, শব্দ ভেঙে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..