অশ্বডিম্ব

মোহাম্মদ হোসেন
গল্প
Bengali
অশ্বডিম্ব

পশু-পাখি বৃক্ষরাজি মানব-দানব অধ্যুষিত অশান্ত এই ধরাধামে যারা শান্তি প্রত্যাশী, শান্তির পক্ষে কাজ করছেন এবং মানুষের মুখে এক ফোটা হাসি দেখার জন্য দিন রাত এক করে ফেলছেন, নোবেল পাওয়ার উপযোগী অবদান রাখছেন, অথচ ফেটে যাওয়া কাচের মত ভঙ্গুর নৈতিকতার অধিকারী, তাঁদের জন্য ওঁত পেতে আছে অতি সাধারণ এক দুঃসংবাদ। (অবশ্য ভয়ংকর মন্দ খবর তাঁদের জন্য যারা নোবেল পদকের চটক মেখে সারা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে অলিতে-গলিতে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চান এবং চটকদার বিজ্ঞাপনের মত ভড়ং দেখিয়ে আড়ং বসাতে চান।) শান্তিতে নোবেল পদক প্রার্থীদের জন্য প্রবর্তিত হয়েছে এক অভিনব বিধান। সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভূক্ত থাকবে যাদের নাম তাঁরা, আমরা বিশ্বাস করি এবং সকলেই তা করে, প্রকট মানবিক বোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। হরেক রকম পারিপার্শ্বিক চাপ উপেক্ষা করে, ষড়রিপুর তাড়নাকে যাতনা দিয়ে এবং নীতির প্রশ্নে ভীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তাঁরা প্রীতি লাভ করেন। এখন কথা হচ্ছে, আমাদের বিশ্বাস কি শুধুই বিশ্বাস, মানে তাঁদের নৈতিক সততা ও দৃঢ়তার শেকড় অশ্বত্থ বৃক্ষের ন্যায় অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত ও প্রোথিত, নাকি তার উল্টোটি, এলেবেলে টাইপের অর্থাৎ এক কথায় ইংরেজীতে যাকে বলে ইন্টেগ্রিটি তার একটা আপাত পরিমাপ করা হবে বিশ্বশান্তিতে তাঁরা কে কী অবদান রেখেছেন তা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি। ইন্টেগ্রিটি মানবচরিত্রের সবচেয়ে সমীহ জাগানিয়া বৈশিষ্ট্য এবং আর সব গুণাবলীকে দৌড়ে পেছনে ফেলে একাই যেতে পারে অনেক দূর ও উঁচু অব্দি- এই বোধ ও উপলব্ধি নতুন নিয়ম, যাকে ইতিমধ্যেই অনেকে বলেছেন কিম্ভূত, বিস্ময়কর ও চমৎকার, প্রচলনে তাঁদেরকে তাড়িত করেছে বলে জানিয়েছে নোবেল কমিটি এবং সর্বসম্মতিক্রমে এর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিশ নম্বর। একদল সুইডিশ বিজ্ঞানী অনেক বছর কঠোর সাধনা ও অধ্যবসায় করে আবিষ্কার করেছেন এমন একটি খুবই প্রয়োজনীয় যন্ত্র যার নামকরণ করা হয়েছে ইন্টেগ্রিটি রিডিং মেশিন, সংক্ষেপে আইআরএম। নোবেল কমিটি চড়া দামে ক্রয় করে নিয়েছে এর স্বত্ব ও পেটেন্টের মালিকানা। সকল সদস্য সমস্বরে রায় দিয়েছেন, একে বাজারী পণ্যে পরিণত করার পক্ষপাতী তাঁরা আদৌ নন। তার মানে, একমাত্র নোবেল কমিটিই এই যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা ও অধিকারপ্রাপ্ত। অন্য কোন লোক, গোষ্ঠী ও সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান পাবে না বা দাবী করতে পারবে না আইআরএম ব্যবহারের মর্যাদা। এ ধরণেরই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে আবিষ্কারক বিজ্ঞানী ও নোবেল কমিটির মধ্যে এবং তাঁদের সাথে যুক্ত হয়েছে সরকার বাহাদুর। চুক্তির কোন ধারার বা কোন অংশের যাতে কোনও ধরণের ব্যত্যয় না ঘটে এ ব্যাপারে কঠোর তদারকি করবে সরকার।

এ বছর এশিয়া থেকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের একমাত্র দাবিদার বার্মার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী লি হিউয়েন অং। বর্তমানে তিনি অন্তরীণ। খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে শ্রান্তি ভাব দূর করে বুক ভরে নি:শ্বাস নিতে পারছেন না, প্রিয় দেশবাসীর পাশে অবস্থান নিয়ে দেশমাতৃকার প্রশ্বস্তিসূচক জাতীয় সংগীত গাইতে পারছেন না আজ কতদিন! সামরিক জান্তা গৃহবন্দী করে রেখেছে তাঁকে। এই যখন যা খুশি করতে না পারার এবং যেথায় খুশি যেতে না পারার অবস্থা মনে হয় চলবে আরো অনেকদিন। কিন্তু তাঁর দম এত কম নয়, নি:শক্তও নয়, সবল ও প্রবল। যত জেলজুলুমই আসুক তিনি হারবেন না, পরাজয়ের তিলক কপালে ধারণ করবেন না। অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাবেন সমানতালে যতক্ষণ না সাঁজোয়া যানসমূহ চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে ফিরে যায় ব্যারাকে, সামরিক দমবন্ধ অবস্থার অবসান হয়, ব্যাটনের জায়গা নেয় রজনীগন্ধার স্টিকার। এতিম দেশবাসী যে বড়ো আশা নিয়ে চেয়ে আছে তাঁর পানে। আর তিনিও বেশ ঘটা করে কথা দিয়েছেন, গণতন্ত্র এনে তাদের মুখে হাসি ফোটাবেন, হাসির দরিয়া যাতে সাগরের মোহনায় গিয়ে মিলিত হতে পারে সেই মত কার্য সম্পাদন করবেন, স্বাধীনভাবে শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ করে দেবেন। সবচেয়ে বড় কথা, এসব যদি তিনি করতে না পারেন, সময় ও সুযোগ না হয় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তিনি করজোড়ে ক্ষমা চাইবেন দেশবাসীর কাছে। কোন দ্বিধা করবেন না, প্রতিশ্রুতির কথা অস্বীকার করে হাস্যস্পদ হবেন না।

এদিকে নোবেল কমিটি জান্তা সরকারের কাছে বিনীত আবেদন করেছে যাতে তাদের তিন সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলকে লি হিউয়েন অং-এর সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু সামরিক জান্তা তো ভয়ংকর ক্ষুব্ধ। তস্করদের নেত্রী লোক-লস্কর নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে নেমেছে সর্বাত্মক আন্দোলনে, চেয়ার উল্টে দেয়ার আকাংখা নিয়ে দেশজুড়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি করছে, পাপেট হয়ে বিদেশী প্রভূদের ইশারায় দেশের শান্তি ও ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, যার দলের দস্যুরা আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপর বিনা উস্কানিতে যখন-তখন হামলা করে আহত নিহত করছে শান্তিতে নোবেল পদকের জন্য তার নামও কিনা গোণায় ধরা হচ্ছে! এ তো তাদের গালে বিরাট চপেটাঘাত! এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের সাথে বেধড়ক উপহাসের শামিল! আবেদন গ্রাহ্য করার তো প্রশ্নই উঠে না। তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনড়। তবে শেষ পর্যন্ত ঘাড় সোজা করেছে তারা। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আসিয়ান ও আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, বৃটেনসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর সম্মিলিত কার্যকর চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে জান্তা সরকার। গাধা জল খেয়েছে আধা ঘোলা করে।

অং তো বেজায় খুশি। এটা তাঁর পরম গরব যে, সারা বিশ্ব সরব হয়েছে তাঁর পক্ষে। নোবেল পদকটাও বুঝি এবার বলছে তাঁর কথাই, তাঁর গলায় ঝুলে ধন্য হওয়ার প্রহর গুণছে। যদি তাই হয় তবে আন্দোলন আরো গতি পাবে, বেগবান হবে। সেদিন হয়ত খুব দূরে নয় যখন একটা দফারফা হবে। সামরিক জান্তা হয় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবে, নয়তো তাঁর সাথে একটা সমঝোতায় আসবে। বয়স তো হয়েছে। আর কত! এখন ক্ষমতার স্বাদ নিতে চান তিনি। তবে নিজের জন্য নয়, দেশ ও দশের একনিষ্ঠ সেবা করার জন্য। কারণ ক্ষমতা ছাড়া প্রত্যাশিত সেবা ও উন্নয়ন করা দুটোই থেকে যায় অধরা। আর এই দেশ ও দেশের মানুষ যে বড় অভাগা। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির এত বছর পর এসেও উন্নয়ন সহযোগী দেশসমূহের দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিতে হয় কাঁধে ঝুলি নিয়ে। সত্তর বছর আগে যে তিমিরে ছিল দেশ এখনও আছে সেই তিমিরেই। অবস্থা তথৈবচ। যথা পূর্বং তথা পরং। এখন তাঁর ক্ষমতায় আরোহনের মানে হবে মুক্ত বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত হওয়া এবং বাজার অর্থনীতি ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অবগাহন করে অগ্রগতির অচল চাকা সচল হওয়া।

আহ, সার্থক জনম তাঁর! ভাবতেই রোমাঞ্চ অনুভূত হচ্ছে, গা শিরশির করে উঠছে, নোবেল ও ক্ষমতা- দুই চুনি পান্নার মালকিন হবেন তিনি। এমনটি ঘটে ক’জনার ভাগ্যে! তিনি সেই সৌভাগ্যবান মুষ্টিমেয় ব্যক্তিদের একজন দেশের ইতিহাসে যার নাম থাকবে স্বর্ণখচিত কলমের সোনার কালি দিয়ে লেখা। দেশ-বিদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে তাঁকে স্মরণ করবে পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে। মানুষের গায়ের লোম খাড়া হয় ভয় ও আতংকে। আর তাঁর হচ্ছে ভয়ানক আনন্দে, পাখা মেলে নীল আকাশে উড়তে পারার উচ্ছ্বাসে!

দুই

একটা গোল্ডেন বুদ্ধমূর্তির সম্মুখে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন অং। সারা গা থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে ভক্তি ও শ্রদ্ধার লালিত্য। চোখ বুজে বিড়বিড় করে পড়ছেন তিনি,‘ বুদ্ধাং শারাণাং গেইছামে, ধাম্মাং শারাণাং গেইছামে, সাংগ্রাং শারাণাং গেইছামে। জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।’ তাঁর খোপায় শোভা পাচ্ছে একগুচ্ছ তাজা বেলি ফুলের মালা। তাঁকে মানিয়েছেও বেশ। বয়স কিছুটা কমে এসেছে মনে হচ্ছে। প্রথম দৃষ্টিতে কোন প্রেমিক হয়তো কবির ভাষায় বলে উঠবে প্রেমাকুল হয়ে, ভৈরবী তুই সুন্দরী তুই কান্তিমতী রাজরাণী। প্রতিদিন তাঁর জন্য মালা বানিয়ে আনা হয়। কারণ তিনি ফুল ভালবাসেন। আর ফুল ভালবাসে যে সে পারে না কারোর গায়ে হুল ফুটাতে। হিংসায় তার গরজ নেই। তিনিও অহিংসার বাণী লালন করেন মন ও মননে গৌতম বুদ্ধের মত। হিংসা দ্বেষ লোভ হানাহানি খুন-খারাবিতে তাঁর প্রচন্ড অনীহা, জাগে বিবমিষা। তিনি আশা করেন এবং বিশ্বাস করেন মনে-প্রাণে, তাঁর যত সমর্থক আছে সকলেই তাঁর পথের পথিক ও মতের অনুসারী।

তিন

লি হিউয়েন অং ফুলেল হাসি দিয়ে করজোড়ে স্বাগত জানান সুইডেন থেকে ডানা ঝাপটে উড়ে আসা নোবেল কমিটির তিন প্রতিনিধি মার্টিন, যোসেফ ও করনার্ডকে। তিনি উল্লসিত এবং তিন সুইডিশও দারুণ উচ্ছ্বসিত কিংবদন্তী নেত্রীর দেখা পেয়ে। কোন অফিসিয়াল আলোচনা নয়, একেবারে ঘরোয়া আলাপ জুড়ে দিলেন তাঁরা। তার আগে একটা আইআরএম অন করে দিলেন মিস্টার মার্টিন ম্যাডাম থেকে অনুমতি নিয়ে। এটা আসলে হতবাক করে দেয়ার মত কোন যন্ত্র নয়। বলা যায়, একটা রেকর্ড প্লেয়ারের চাইতে এক ধাপ বেশি কিছু মাত্র। রেকর্ড প্লেয়ারের উন্নত সংস্করণের সাথে যুক্ত হয়েছে আলাদা দুই একটি বৈশিষ্ট্য। অং-এর সব কথাই রেকর্ড হবে। তাঁর কথা ও আচরণ দুই ভাগে বিভক্ত হবে এবং সে অনুযায়ী জ্বলবে সবুজ বাতি ও লাল বাতি। যত সবুজ বাতি তত প্লাস পয়েন্ট এবং যত লাল বাতি তত মাইনাস পয়েন্ট। তো নানান বিষয়ে তাঁরা কথা শুরু করে দিলেন। রাজনীতি সমাজনীতি অর্থনীতি ধর্মনীতি এমনকি প্রেমনীতিও জায়গা করে নিল তাঁদের আলাপচারিতায়। দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, বিদেশনীতি, কারেন বিদ্রোহী গোষ্ঠী, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রসঙ্গ পেল বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা। আলাপের ফাঁকে ফাঁকে চলল হালকা নাস্তার পর্ব। অতিথি তিনজন কোন কোন নাজুক বিষয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্যও দিলেন। বুদ্ধিমতী অং চোরাবালিতে পা না দিয়ে বুঝে-শুনে হাসিমুখে ঠান্ডা মাথায় বলে গেলেন কথার পিঠে কথা। কারো প্রতি ক্রোধ ক্ষোভ বিদ্বেষ প্রকাশ না করে সন্তদের মত সতত ভালবাসা ও কল্যাণ কামনা করে গেলেন সবার জন্য। এমনকি ব্যক্তিগত অপবাদ ও খোঁচারও তিনি জবাব দিলেন সহজ ও সাচ্চা। ক্রোধ দেখিয়ে শোধ নেয়ার কথা ভাবেননি। এই যেমনঃ

‘ ম্যাডাম, কেউ কেউ বলে, আপনার নাকি একজন গোপন প্রেমিক আছে এবং মং, আপনার একমাত্র পুত্রসন্তান, হচ্ছে আপনাদের ভালবাসার ফসল, তাই কি?,’ কফিতে চুমুক দিয়ে জানতে চান মিস্টার করনার্ড।

অং হেসে জবাব দিলেন,‘ওদের জন্য আমার আশীর্বাদ রইল ওরা যেন মহামতী বুদ্ধের পথ অনুসরণ করে এবং তাঁর উপদেশাবলী মেনে চলে।’

‘ পশ্চিমে বিশেষত ইউরোপে এটা চাউড় হয়ে গেছে যে, আপনার বৃটিশ স্বামী আপনাকে পরিত্যাগ করছেন এটা জানার পর।’

‘ রটনা রটনাই, ঘটনা নয়।’ অং-এর নিশ্চিন্ত জবাব।

‘ বিবিসি রেডিওর ভাষ্য মতে, জান্তা সরকারের সাথে সমঝোতায় আপনি খুবই আগ্রহী। আপনার খুবই বিশ্বস্ত একজন দলীয় নেতা নাকি এ ব্যাপারে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। জানতে চাই এই খবরের সত্যতা কতটুকু।’ বললেন মিস্টার যোসেফ।

‘ এরকম ভিত্তিহীন কোন খবর বিবিসি প্রচার করেছে বলে আমার জানা নেই। আর করবে না বলেও আমার বিশ্বাস। আমার পূর্ণ আস্থা আছে সারা বিশ্বের কোটি কোটি শ্রোতার ভালবাসায় ধন্য এই সংস্থাটির উপর।’

এরকম ঘন্টা দুই একের অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার পর বিদায় নেন যোসেফ, মার্টিন ও করনার্ড। তাঁদের মনোদেশ অবশ হয়ে আছে মুগ্ধতা ও চমৎকৃতির ব্যাপকতায় ।

চার

লি হিউয়েন অং-ই শেষতক বিজয়ী। খোঁপায় বেলী ফুলের মালার সাথে এখন যোগ হয়েছে গলায় শান্তির পদক। তাঁর খুশি দেখে কে! নিদ্রার ঘাটতি আছে তাঁর। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে জম্পেশ একটা ঘুম হবে দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর। দেশে-বিদেশে তাঁর অসংখ্য সমর্থকও আনন্দে আত্মহারা। জমিয়ে নেচে-গেয়ে তারা উদযাপন করছে মাদার অব হিউম্যানিটির (প্রিয় নেত্রীকে তারা ডাকে এই নামেই) সর্বোচ্চ পদকপ্রাপ্তি। পাশাপাশি বার্মার সাধারণ মানুষও বেজায় খুশি। আর খুশি আরাকানের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তারাও স্বপ্ন দেখছে জান্তার বিদায়, অং ক্ষমতায়। তাদের প্রত্যাশা যে, ক্ষমতায় গিয়ে মানবতার জননী জান্তার সজনী হবেন না, দজ্জাল প্রসব করবেন না। ধরণীকে কলংকিত করবেন না। নমরূদের বংশধর সামরিক সরকার তাদের ন্যুনতম নাগরিক অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে। তাদের পশুর মর্যাদা দিতেও প্রবল আপত্তি জান্তার। এখন হাওয়া লেগেছে তাদের আশার পালে, মানুষ হয়ে ইজ্জত-সম্মান নিয়ে তারা আবার বসবাস করতে পারবে এবং ফিরে পাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের নাগরিক অধিকার। খুশি সবাই। একমাত্র ব্যতিক্রম জান্তা ও তার মোসাহেবের দল। তারা হয়েছে বেজার। সরকার সদম্ভে ঘোষণা করেছে, নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে তারা অনুমতি দেবে না তাদের দুশমনকে। সুদূর স্টকহোম গিয়ে মুক্ত নিঃশ্বাস নেয়া তো দূরের কথা, ঘরের দেউড়ি পার হয়ে ঢং করে যাত্রার সঙও সাজতে পারবেন না অং। এই তাদের দৃঢ় পণ।

পাঁচ

আন্দোলনেও দৃশ্যত জয়ী অং। সামরিক সরকার বেরিয়ে এসেছে কঠোর অবস্থানের জঠর থেকে। ঘোষণা করেছে গণতন্ত্রের মানসকন্যাকে মুক্তি দেয়ার, নির্বাচন আয়োজনের ও সংবিধান সংশোধনের। জান্তা তিন নম্বর কাজটি করেছে মূলতঃ দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। তাদের মূল লক্ষ্য ক্ষমতা ভাগাভাগি। নির্বাচনে অং-এর দল পেয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সরকার গঠন করেছে তারা। স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষাসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সামরিক বাহিনী রেখে দিয়েছে নিজেদের ঝুলিতে। প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হয়েছে তাদেরই একান্ত অনুগত একজন। আর অং হয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্টেট কাউন্সেলর। বলতে কী, তাঁকে এখন মনে হচ্ছে সেই বাচ্চার মত যে কচি দুটো হাত দিয়ে ঝুলে আছে বাবার গলা ধরে এবং পলকে খসে পড়বে একটু ঝাপট খেলেই।

ছয়

মোহভঙ্গ হয়েছে এককালের স্বাধীন রাষ্ট্র বর্তমানে রাখাইন রাজ্য নামে পরিচিত আরাকানে হাজার বছর ধরে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর। অং তাদের সাথে প্রতারণা করেছেন। তাদের বিশ্বাসের নিঃশ্বাস করেছেন হরণ। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তাদের জন্য কিছুই করছেন না তিনি। তাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য গ্রহণ করছেন না কোন উদ্যোগ। বরং বৈধতা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের প্রতি কৃত সেনাদের অন্যায়, অমানবিক ও অবৌদ্ধিক আচরণের। এই ক্ষোভ থেকে তারা উদ্যোগী হয়েছে আন্দোলন করার। কিন্তু অদ্ভূতুড়ে সরকার (অংশত গণতান্ত্রিক, অংশত সামরিক) তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জবাব দিয়েছে অস্ত্রের ভাষায়। দানবীয় শক্তি নিয়ে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করতে চেয়েছে রোহিঙ্গাদের উচ্চকিত কন্ঠ। তাদের দোষ দেয়া হয়েছে পুলিশ চৌকিতে সশস্ত্র হামলা করে কয়েকজনকে হত্যা করার। এই অভিযোগে তাদের উপর চালানো হয়েছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। পুলিশ ও সৈন্যদের সাথে যোগ দিয়েছে চরমপন্থী বৌদ্ধ যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত কিছু সন্ত্রাসী ও জঙ্গী গ্রুপ। তারা আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গা মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামের পর গ্রাম। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে করেছে পাশবিক শিশ্নবিলাস, তারপর করেছে হত্যা আগুনে পুড়িয়ে বা অঙ্গহানি করে। যুবকদের তো দেখামাত্রই খতম। শিশুদের বেলায়ও পশুত্ব বলি দেয়নি তারা যারা বলে অহিংসা পরম ধর্ম, জীব হত্যা মহাপাপ, জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক। গুরুতর যুদ্ধাপরাধ করছে দখলদার বাহিনী। শুরু করেছে জাতিগত নিধন, রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান, এথনিক ক্লিনজিং। এহেন নারকীয় অবস্থা থেকে বাঁচতে লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু হিজরত করেছে পাশের দেশে। রাতের অন্ধকারে পাহাড় নদী পেরিয়ে কোনরকমে জান নিয়ে হাজির হয়েছে নতুন দেশে ভিন্ন পরিবেশে। অনাহারে অর্ধাহারে কাদামাটিতে মাখামাখি হয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে করছে মানবেতর জীবনযাপন। সঙ্গী হয়েছে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা, নোনা অশ্রুজল আর অনিশ্চয়তার বুদ্বুদপূর্ণ ভবিষ্যৎ। ‘কেউই ঘর ছেড়ে যায় না, যদি না ঘর হয় হাঙ্গরের মুখ।’ এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও চমৎকার নির্বিকার শান্তিতে নোবেল বিজয়ী কথিত মানবতার জননী লি হিউয়েন অং। তিনি বিচলিত নন মনুষ্যত্বের বিপর্যয়ে, শোকগ্রস্ত নন অপঘাতে মানবতার সমাধি হচ্ছে দেখেও। রা করছেন না আগুনে ফাগুন পুড়ে নাশ হয়ে যাওয়ার পরও। নিন্দা করছেন না বুদ্ধের অনুসারী কর্তৃক হায়েনার মত ধ্বংসযজ্ঞের, তাদের উচ্ছৃংখল তান্ডবলীলার। পাশে দাঁড়াচ্ছেন না মজলুমের। শান্তির পদক পেয়েও যারা শান্তির পথে হাঁটেননি এবং মন ও মননে বামন রয়ে গেছেন নোবেলের অমর্যাদাকারী সেই মন্দ লোকদের কাতারে তিনি শামিল হচ্ছেন। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি। জোরালো দাবী উঠেছে তাঁর নোবেল পদক কেড়ে নেয়ার।

অবশেষে অরিন্দম কহিল বিষাদে….। তিনি মুখ খুলিলেন এবং ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি…….জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক’ উচ্চারণ করিয়া বড়ো স্মার্ট ভঙ্গিতে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলাইয়া ছাড়িলেন মধুর বাণী, হিজরত করা ভালো। তারপর বয়ান করিলেন জরাগ্রস্তের মত,‘আমি তো জানিই না কী কারণে রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। তাদেরকেই জিজ্ঞেস করুন না আপনারা।’ স্তম্ভিত বিবেক! অবাক তাকিয়ে রয় পৃথিবী!এলতলা বেলতলা শেষকালে শেওড়াতলা! এ কেমন সৃষ্টিছাড়া পরিহাস! ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় বয়ে যায় পৃথিবী নামক গ্রহের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। রামদাসের মা কথার ফাঁদ জানো, কাজের ছাঁদ জানো না। তবে এটা ঠিক, নিজেকে যদি নগ্ন করেই না দেখালো তবে লোকে কী করে চিনবে উর্বশীকে? কিন্তু এই দুর্দিনেও নির্বান্ধব থাকেননি অং। দুই একজন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রকর্তা যারা মূলতঃ সাম্প্রদায়িক ও রক্তপায়ী, শরাবের গ্লাসে করে রক্তপানে অভ্যস্ত তারা এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর একান্ত পাশে। আশ্বাস দিয়েছে সর্বতো সহযোগিতার, প্রয়োজনে মারণাস্ত্র বিক্রির। তবুও বিশ্ববিবেক এখনো আশাবাদী যে অং আর ভং ধরে থাকবেন না। জ্বিনের আছরের মতো তাঁর উপর ভর করা অসুরকে তাড়াতে তাকে ঝাড়ু–পেটা করবেন, বলহীন ও পুষ্টিহীন করবেন। তাঁর অস্ত যাওয়া বোধের উদয় হবে শীগগিরই। বনসাঁই মানসিকতা ত্যাগ করে উদারতা নামক বটবৃক্ষের শীর্ষে আরোহণ করবেন, সম্বরণ করবেন ক্ষমতার লোভ। ভয়কে জয় করে কঠিন বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়েও গীত রচনা করবেন মানবতার পক্ষে, সুরারোপ করবেন, তারপর দরাজ গলায় গাইবেন গান স্বজাতির শত-সহস্র রক্তচক্ষু ও ভ্রুকুটি সত্ত্বেও।

মোহাম্মদ হোসেন। গল্পকার। জন্ম ও নিবাস বাংলাদেশ।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..