আইয়ুব বাচ্চু ও তরুণ প্রজন্মের চাওয়া পাওয়া

জিয়া হাসান
প্রবন্ধ, সঙ্গীত
Bengali
আইয়ুব বাচ্চু ও তরুণ প্রজন্মের চাওয়া পাওয়া

আইয়ুব বাচ্চু আমাদের আশির বাংলাদেশের পটেনশিয়াল, নব্বইয়ের বিকাশ এবং একবিংশ শতকের পতনের মূর্তমান প্রতিচ্ছবি। একজন মিডিওকারের কঠোর পরিশ্রম এবং ক্রমাগত নিজেকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে সুপেরিয়র শুধু নয় একজন লিজেন্ড হয়ে উঠার বাংলাদেশের সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ আইয়ুব বাচ্চু।

আইয়ুব বাচ্চু লিড গিটারিস্ট ছিলেন। সব ব্যান্ডেই লিড গিটারিস্টরা একটা দুইটা গান করতে চায়। কিন্ত সোলসের মত ব্যান্ডে যেই সব বাঘা বাঘা সিঙ্গার ছিল, সেখানে লিড গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চুকে অভিমান যেন না করে এই জন্যে হয়তো কনসার্টে, একটা দুইটা গান করতে দেয়া হতো।

আইয়ুব বাচ্চুর টোন সুন্দর ছিল না। বিশ্রী ছিল। রেঞ্জ ভালো ছিলনা। ভাইব্রাটো, ধরে রাখতে পারতেন না। কোন কিছুতেই আইয়ুব বাচ্চু ভালো সিঙ্গার ছিলেন না। চট্টগ্রামে ব্যান্ড গানের কনসার্টে যারা নিয়মিত যেত তাদের একটা হাস্য রসের আলাপ ছিল,

‘বাচ্চুইয়া আজিয়াও গান গাইতে উইঠ্যে‘।

কিন্ত সেই আইয়ুব বাচ্চু বাংলাদেশের বাংলা ব্যান্ডের সবচেয়ে এক্সপ্রেসিভ গানগুলোর মধ্যে কিছু গেয়েছেন। তার রেঞ্জ ছিল ঈর্ষণীয়। টোনের ইউনিকনেসটাই তাকে বরং আলাদা করে তুলেছে পরে। এর একমাত্র কারণ, সাধনা এবং অধ্যবসায়।

আইয়ুব বাচ্চুর ক্যারিয়ার দেখে একটা জিনিশই বুঝি যে, তিনি কন্সটান্টলি নিজের বাউন্ডারি পুশ করেছেন এবং এমন কিছু ট্রাই করেছেন যেমন সাহস তার আগে বাংলা গানে তেমন কেউ করেন নি।

বাংলাদেশের প্রথম ডাবল অ্যালবাম আইয়ুব বাচ্চুর। সেটাও একটা রক অ্যালবাম।

আমি একজন সংরাইটার এবং একটা ফেইল্ড সলো অ্যালবামের সিঙ্গার হিসেবে বলতে পারি, কীভাবে একটা অ্যালবাম ডবল অ্যালবাম হয়।

একজন ব্যান্ড লিডার দেখতে পাচ্ছেন, তার ব্যান্ড ৩০টার ওপরে ভালো গান অ্যারেঞ্জ করে ফেলেছে, একটার থেকে একটা গান ভালো হয়েছে। কীভাবে এখন ৩০ টা গান থেকে, বেছে ১২ টা গান হবে?

তাহলে ডবল অ্যালবাম হোক।

আমি নিশ্চিত, রেকর্ড কোম্পানির ম্যানেজার নিশ্চয়ই বলেছিল ডবল অ্যালবাম? আপনি পাগল!

সে আমলে সিন্থ বেজড গান বেশী হতো।

আইয়ুব বাচ্চুই বোধ হয়, প্রথম আর্টিস্ট যিনি সিন্থের জায়গায় গিটার বেজড অ্যালবাম করেছিলেন। এবং কী সেই অ্যালবাম ছিল, এলআরবির সেই ডবল ডেবু অ্যালবাম।

কিছু ব্যালাড একটা রক একটা একটা রেগে একটা ফোক সবকিছু নিয়েই তখন একটা বারোইয়ারি অ্যালবাম হতো।  কিন্ত আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম সেলফ টাইটেল অ্যালবাম ছিল, মূলত রক অ্যালবাম -গিটার বেজড রক অ্যালবাম। কিন্ত তার মধ্যে ফ্যান্টাস্টিক মেলডি ছিল।

আমাদের জেনারেশান রবীন্দ্রনাথ নজরুল শুনে বড় হয় নি। আমাদের জেনারেশানের আঁতেল টাইপের পাঞ্জাবি পরা ছেলেরা শুনতো, রবি, নজরুল। আমাদের পোলাপানের গান ছিল, বাচ্চু-জেমসের।

রবীন্দ্রনাথের নাকী সকল অনুভূতির গান আছে। হায় হায় রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যাইতে হবে?

আইয়ুব বাচ্চুর সব অনুভূতির গান আছে।

ছ্যাঁকা খাইছেন। আছে ‘সেই তুমি‘।

https://www.youtube.com/watch?v=9US5QeBtw6w

একটু সাইকোডেলিক ভাব নিতে চান। ‘গতকাল রাতে‘।

https://www.youtube.com/watch?v=9akkYPkMKec

জীবনমুখি গান। ‘হকার‘, ‘মাধবী‘।

https://www.youtube.com/watch?v=50BLcP1sGjc

প্রেমে পরেছেন? ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি“।

https://www.youtube.com/watch?v=5OGwbe7tFMU

কত গান নীল বেদনা, মাকে বলিস, এই সব। রবীন্দ্রনাথের কোন গানে কি মাকে বলিসের অনুভূতি আছে? যেখানে ছেলে বাড়িতে যাওয়া বন্ধুকে বলতে বলেছে, শহুরের যন্ত্রণায় সে ভালো নেই, কিন্ত মাকে বলিস আমি ভালো আছি?

আমার হিসেবে আইয়ুব বাচ্চুর বেস্ট গানের মধ্যে তাঁর হার্ড রক হাল্কা সাইকোডেলিক গানগুলো।

কিন্ত আমরা যারা গিটার বাজাই, বিশেষত যারা হার্ড রক জেনারেল তাদের যে কারো সাথে কথা বলবেন, তাদের কাছে আইয়ুব বাচ্চুর প্রিয় গানগুলো করেছেন, মিল্টন খোন্দকারের ড্রামস্-এর সাথে, এর মধ্যে রয়েছে ‘পাগল‘, ‘চাঁদ মামা‘সহ আরো কিছু গান। খুব সম্ভবত ক্যাপসুল অ্যালবামের গানগুলো। মনে নেই। বুড়ো হয়ে গেছি!

https://www.youtube.com/watch?v=a_cHo4wSCyw

বুড়ো আইয়ুব বাচ্চু টানে নি।

আইয়ুব বাচ্চুর বাংলা সিনেমায় গান গাওয়া আমাদের জন্যে বড় প্রতারণা ছিল। বিষয়টা কালচারাল। এখানে সাবল্টারর্ন বিষয় আছে। কিন্ত সেগুলো ওইসময়ে বোঝার কথা ছিল না।

আইয়ুব বাচ্চু যখন শওকাতের সুরে গেয়েছে ‘উড়াল দেবো আকাশে‘ বা ‘অভিমানি আমি‘,  সেই আইয়ুব বাচ্চু আমাদের রক কিশোরকে প্রতারণা করেছে। যে কিশোরের মনন তিনি গড়েছেন, সেই কিশোর হতাশ হয়েছে তারুণ্যে আইয়ুব বাচ্চুর পতন দেখে। তারপরে আইয়ুব বাচ্চু আর টানে নি।

একটা বিষয় পরে খারাপ লেগেছিল। এই বিষয়ে আগে লিখেছিলাম। খুব কম মিউজিশিয়ান গ্রেসফুলি বুড়ো হয়। ডিলান পেরেছেন, কোহেন পেরেছেন- কারণ তাঁরা মূলত কবি ছিলেন। রিচি ব্ল্যাক-মুর পেরেছেন তাঁর গুণবতী স্ত্রীর কারণে।

কিন্ত এইটটিজের হেয়ারের রকারের মধ্যে তেমন কেউই পারে নি। ইউরোপ, ইউটু বা ফিল কলিন্স কেউই সঠিকভাবে বুড়ো হতে পারেন নি। তাঁদেরকে পঞ্চাশ বছর বয়সে এসেও কুড়ি বছরের ছ্যাঁকা খাওয়া তরুণের জন্যে গান গাইতে হয়েছে। তাই আইয়ুব বাচ্চু, হৃদয় খানের সাথে কম্পিট করতে গিয়ে পারেন নি। কিন্ত, সেই কম্পিটিশনে তাঁর নামাই উচিত হয় নি।

তবুও, আমি সেইটা জাজ করার কে!

হুমায়ুন আহমেদের লাস্ট বই পড়েছিলাম, তিথির নীল তোয়ালে। তারপরে আর পড়ি নি। আইয়ুব বাচ্চুও ঠিক একটা পয়েন্টে আমাদের সাথে ডিসকানেক্ট হয়ে গিয়েছিলেন।

কিন্ত আমি যা, আমাদের জেনারেশান যা হয়েছে, আমাদের প্রেমে পরা, স্বপ্ন দেখা, ক্ষোভ, ক্রোধ দ্রোহ, আঁতলামি, ছ্যাঁক খাওয়া, চাকরি পাওয়া, শহুরে জীবনের সাথে ডিসকানেক্ট, বাসের হ্যান্ডেল ঝুলে ঝুলে যাতায়াত, বাবা মায়ের সাথে জেনারেশান গ্যাপ সবকিছুকে আইয়ুব বাচ্চু ধারণ করেছেন- তাঁর গানে।

আশির দশকে বিশ্ব সংস্কৃতি থেকে শুরু করে কলকাতার রাবিন্দ্রীক ইনফ্লুয়েন্স উপেক্ষা করে, আমাদের নিজেদের মাটি, নিজেদের আলো নিজেদের ঘামে সম্পূর্ণ আমাদের যে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে উঠেছে; যার মধ্যে আমরা নিজেদের চিনতে পারি, নিজেদের মত করে, স্বতন্ত্রভাবে, সেই স্বাতন্ত্র্যতা গড়ে তুলে এই গর্বিত আত্মপরিচয় দিয়েছে যে অল্প কয়েকজন- আইয়ুব বাচ্চু তাঁদের প্রথম পাঁচ জনের একজন।

আজকের তরুণরা শুনে অবাক হবেন, আশি এবং নব্বুই দশকে বাংলা ব্যান্ডের মান এশিয়ার প্রথমদিকে ছিল এবং বর্তমান বলিউড থেকে তা অনেক এগিয়ে ছিল। সেই স্লাঘা আমাদের ফেক ছিলনা।

তিনি আমাদের কৈশোর এবং তারুণ্যের পার্ট শুধু নয়- তিনি আমাদের অস্তিত্বের অস্তিত্ব, আত্মার আত্মা।

তিনি না থাকলে আমরা, আমরা হয়ে উঠতাম না।

এডিয়স। বস।

একবার জ্যামিং এর শখ ছিল আপনার সাথে । পুরা না করেই চলে গেলেন। খুব খারাপ করেছেন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..