প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
মৃত্যুর রঙ কি কালো? সাদা, নাকি ধূসর! কে জানে! হয়তো কোনো রঙই নেই। সত্যি তো মৃত্যুর কোনো রঙ থাকে নাকি! যতসব বোকা বোকা ধারনা, তাছাড়া এই ঘটনার সঙ্গে মৃত্যুর তুলনা আসেই বা কি করে। কিন্তু খবরটা যখন কনফার্ম পজিটিভে রূপান্তরিত হল তখন রোমির চোখের সামনে কালো পর্দা নেমে এসেছিল। একটু কি টাল খেয়েছিল? নিশ্চয়ই খেয়েছিল। ব্ল্যাক আউটের সঙ্গে টাল খাওয়ার সম্পর্কটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জনসাধারণ অবশ্য এই নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে হীরের দ্যুতির ছোঁবল খুঁজে পেয়েছিল। এই ধাবমান সময়ে পাশাপাশি দুটো মানুষ সর্বক্ষণ একে অপরের সম্পর্কে সন্ধিহান। দুঃখের ভেতর সুখ খুঁজে পায়, সুখের ভেতর গভীর সন্দেহ, সন্দেহ থেকে ঈর্ষা, তারপর সামনাসামনি যুযুধান দুই পক্ষ, যাকে বলে সম্মুখ সমরে।
স্বপ্নে পাওয়া শব্দের মত, শব্দের শব আড়কাঠি হয়ে ক্রমশঃ ছোটো করে দিতে থাকে রোমির আয়ুরেখা। জটিল ভাষাতত্ত্বের কোনো কচকচানি না, সোজাসাপটা একটা বাংলা শব্দ আর তাকে ঘিরে একটা সাধারণ বাক্য রোমি, বুলু আর আদিত্যর জীবনটা একটা অন্ধকূপ হত্যার মত ছোটো ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে। জীবনটা যেন একটা মুহ্যমান হাহাকারে ঘিরে ধরে দাঁত, নখ বার করে উল্লাস করে যাচ্ছে। একটা কথাই মাথার ভেত পাক খেতে থাকে তা হল, ‘নগ্ন বাস্তব’।
গত কয়েকদিন আগেই বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলো সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন! শব্দটি বেশ মায়াময়। শুনলেই ভিজে যেতে ইচ্ছা করে। রোমি, আদিত্য এমনকি দুধের শিশুকন্যা বুলুকে নিয়ে তারা ভিজতোও। তখন তাদের ধারনা ছিল না এই বর্ষণে শিলাবৃষ্টি হয়, বাজও পড়ে। ঠিক এখনটা যেমনভাবে পড়ছে। ‘আগামী দেড় বছর’ মানে রোমির চোখের সামনে একটা ফ্ল্যাটলাইন। তবে সেদিনকার রোমির সঙ্গে আজকের রোমির বিস্তর ফারাক। অনেক চড়াই-উৎড়াই ভেঙে রোমি এখন শুধু একটা ভরভরন্ত নদী খোঁজে। একমাত্র নদীই পারে সব কিছু থেকে রক্ষা করতে। তবে নদীতেও প্লাবন হয়।
আদিত্য তখন উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে পোস্টিং ছিল। রোমিও তিন বছরের বুলুকে নিয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে কুলিকের পরিযায়ী পাখিদের মত উড়ে এসে জুড়ে বসলো কর্ণজোড়া সরকারি আবাসন চত্বরে। পুরো পাঁচটা বছর। আদিত্যর চাকরিটা মাঝারি গোছের অফিসারির। খানিকটা স্যান্ডউইচ ধরনের। ওপরে রাঘব-বোয়াল অফিসাদের চাপ আর নিচে পুঁটী অফিসারদের ঠোকরানি। কিন্তু এর মধ্যে কি করে যে অভিমন্যুর সপ্তরথিতে ঢোকার মত ইউনিয়ন নামে চক্রবুহ্যে ঢুকে পড়ে। অভিমন্যুর মতই ঢোকবার পথ জানা থাকলেও বের হওয়ার পথ জানা ছিল না।
রোমির সাধারণ কেরানীর চাকরি। একমাত্র প্রোমোশন ছাড়া মোটামুটি বদলা-বদলির গল্প নেই। সেই রোমিকে সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য করবার জন্য বারবার মাঝারি অফিসার স্বামীর সঙ্গে ফুসমন্তর হুশ করে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা উড়ে আসতে হয়। কিন্তু কোনো জায়গাতেই শেকড় গজায় না, মাটী আলগা থেকে যায়। কাজের জায়গায় কেউ তাকে আপন করে না। তারও মন পড়ে থাকে সারাক্ষণ ইছামতীর কোলঘেষা সেই মফস্বল শহরটাতে। সেখানে অফিস বাড়িটার তেতলার ছাদে দাঁড়ালে নদীটাকে দেখা যেত। শীতকালে রোমি, অনিন্দিতাদি, রঞ্জনা, সঞ্জয়দা, ভীমদা ছাদে যখন রোদ মাখতে যেত। উত্তুরে বাতাসকে বলতো —‘নদীর বাতাস’।
রায়গঞ্জ অফিসে এসে রোমির প্রথম ইউনিয়নে হাতেখড়ি হল। আগে কেবল চাঁদা দেওয়া, হরতাল হলে অকাল বোধোনের মত অকাল ছুটি উপভোগ করা, তোতা কাহিনীর মতো সব কিছুতেই হাত তুলে সমর্থন জানানো, – ‘ঠিক ঠিক’। আদিত্য মাঝারি গোছের অফিসার হলে কি হবে, এখানে এসে কি করে যে বড়ো নেতা হয়ে গেল কে জানে! আগুন খাওয়া বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতো। রোমির সংগঠনের আড়ালে রাজনৈতিক কুচুটেপানায় ঢোকার ব্যাপারটাকে পেখম তুলে সমর্থন জানালো। রোমির তখন মস্তিষ্কে বিপ্লব। মার্কস যেন তার কানে কানেই বলে গেছেন ‘হে নারী তুমি প্রলেতারিয়েত মেয়েদের ঠিকা নাও’। বিপ্লবের টাট্টু ঘোড়ায় সে তখন টগবগিয়ে ছুটছে। মুখে দিনরাত ‘বানর থেকে মানুষ হওয়ার বকবকম- বকবকম’। তখন শুধু জানতো না মানুষের মুখের আড়ালে কতরকম নরখাদক আছে। তারা কেউ ড্রাকুলা হয়ে রক্ত চোষে, কেউ আনাকোন্ডা হয়ে গিলে খায়। তারা রোমিকে মাকড়সা সঙ্গমের পাঠ দিতে লাগল। আদিত্যর মত সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ, সংগঠনের জন্য জান লড়িয়ে দেওয়া যুবককে রোজ কাঁচা বেলপাতা চিবিয়ে খাওয়ার অভিধান দেয়। রোমিকে রাতারাতি ফটাফট নেত্রী বানিয়ে দেয়। দাদ-হাজা-চুলকানির মলম বিক্রেতার গাড়িতে ‘ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না’ গানের মত সেও হাটে, মাঠে, ঘাটে একই বক্তৃতা থোর, বড়ি, খাড়া আর খাড়া বড়ি থোর করে যেতে লাগলো। পাবলিক করতালি দেয়, সেও দ্বিগুণ উৎসাহে গলার ভলুউম বাড়ায়। এখন এই বয়েসে এসে সে সিওর যে কোনো পাবলিকই তার বক্তৃতা শুনে হাততালি দিত না। দিত সেই সময়কার ডাঁটো চেহারার জন্য। ক্রমশঃ ওপর তলার নেতারা প্রচার করতে লাগলো ‘রোমির বক্তৃতার কাছে নাকি আদিত্য দাঁড়াতে পারে না’। একই খাটে পাশাপাশি শুয়ে তারা ক্রমশঃ কয়েক আলোকবর্ষ দূরত্ব তৈরি করে ফেলছিলো। তখন সে ভুলেও জানতো না ওপরতলার নেতাদের খতমের তালিকায় আদিত্য ছিল হিট লিস্টে। ঘাতক নির্বাচন করলো তাকেই।
আজ অনেক দিন বাদে টিভিতে একজন সিনিয়র সিটিজেনের কামোদ্দীপক ওষুধের বিজ্ঞাপন দেওয়ার ভাষা—–‘ দাঁড়াবে দাঁড়াবে’ শুনে তার অনেক দিন আগের রায়গঞ্জের সিনিয়র সিটিজেনকে মনে পড়ে যায়। আদিত্যর সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধ কর্মচারী মহলে তখন গরম খবর। প্রায় রোমিরই সমবয়েসি রোমিদের বাড়ির পরিচারিকা লালি একদিন কষে ধমক লাগায় তাকে, ‘কি করছেন দিদি? কি সব মীটিন-ফিটিন আর বক্তৃতা- ফক্তৃতা নিয়ে মেতে আছেন, বুলুর দিকে একটু খেয়াল করুন। অফিস থেকে ওসব সেরে রাত করে বাড়ি ফেরেন, দাদার চোখ মুখের অবস্থা দেখেছেন?’ যে আদিত্য রোমিকে বিপ্লবের হাতেখড়ি দিয়েছিল, যে তাকে ঘরের কোণ থেকে খোলা আকাশের নীচে দাঁড় করিয়ে বলেছিল, ‘জগৎটাকে দেখো রোমি’। সেই মানুষটা ঘরের কোণে বসে টিকটিকির পোকা ধরা দেখে। হঠাৎ একদিন সে আবিষ্কার করে, ‘আদিত্য আর কোনো জনসভায় যায় না’। বিষয়টা সেই সিনিয়র সিটিজেনকে একবুক যন্ত্রণা নিয়ে ভাঙচুর হতে হতে জানায়। উনি যেন হাতে ট্রামকার্ড পেলেন। বললেন, ‘অমিতাভ বচ্চন আর জয়া ভাদুরীর সিনেমাটা দেখেছো রোমি? ইগো। ইগো প্রবলেম। ছেলেটা তোমায় জেলাস করছে। মুভমেন্ট এমনই হয়’। লালির কাছে ফের একদিন বেদম ঝাড় খেল। ‘আপনি কি গো দিদি! প্রতিদিন রাতে মীটিন করে এ ওর মোটর সাইকেলে ঘরে ফিরছেন, লোকে কি বলে?’ লালিকে কাজ থেকে জবাব দিয়ে দিতে পারতো কিন্তু তার ক’দিন আগেই আবাসন চত্বরে মাম্পুর মা, রোমির বান্ধবী সুজাতাও একই কথা বলেছিল। তাই চুপ করে থাকে। অন্যান্য নেতাদের বাড়ি গিয়ে দেখে তাদের অনেকের বৌ চাকরি করলেও মাঠে, ঘাটে, রাতে মীটিং করে বেড়ায় না। সন্ধ্যাবেলায় শাঁখে ফুঁ দিয়ে, চপ-মুড়ি সহযোগে বসে বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখে। অনেকেই রোমির হাতে মুড়ি, চপের বাটি ধরিয়ে দিতে দিতে বাঁকা চোখে দেখে। একদিন এক নেতাকে শুধিয়েছিল, ‘বৌদি চাকরি করেন, তা ওনাকে লাইমলাইটে আনছেন না কেন?’ নেতা নাক ফুলিয়ে হেসে বলে, ‘মাথা খারাপ ও পুরোপুরি ঘরোয়া। ঐ চাকরিটুকুই করে। তাছাড়া সংসার নিয়ে মেতে থাকে সবসময়। রোমি হা করে তাকিয়ে থাকে। বুলু রোমির নর্মালে হয়েছিল। প্রসব যন্ত্রণা কাকে বলে জানে। মনে হল আর একবার সেই যন্ত্রণাটা তালগোল পাকিয়ে গলার কাছে আটকে গেল।
এরপর সেই সিনিয়ার সিটিজেন রোমির অফিসে আসা শুরু করলেন। স্বনামধন্য নেতা সিঁড়ির রেলিং ধরে দোতলায় উঠে রোমির সঙ্গে দেখা করতে আসেন এতে তার স্বম্ভ্রম বাড়তে লাগলো অফিসে। একদিন উনি বললেন, ‘একি রোমি তোমার চোখের নীচে কালি কেন?’ ম্লান হাসে রোমি। উনি আস্তিনের ভেতর থেকে সাপ বার করেন। রোমির দিকে সোজাসুজি তাকান। একবার আদিত্যর সঙ্গে হলে গিয়ে একটা ইংরাজী সিনেমা দেখেছিল রোমি। সেখানে একটা লোক অন্য একটা লোককে ঠিক এইরকমভাবে সম্মোহন বিদ্যা প্রয়োগ করছিল। ছানি কাটানো চোখদুটোর দিকে তাকাতে তার অস্বস্তি করে। উনি সাপটাকে রোমির টেবিলে রাখেন। তারপর হিশ হিশ করে ফিস ফিস করে ওঠেন, ‘আচ্ছা তোমাদের সেক্সচুয়াল সম্পর্ক ঠিক আছে তো?’ সেদিনও রোমিও যেন শুধু একটা কথাই শুনতে পায়, ‘দাঁড়াবে দাঁড়াবে’।
একটা ভয়ের শীতল স্রোত মেরুদন্ডের একেবারে ওপর থেকে নীচ বরাবর নেমে যায়। খুব আস্তে আস্তে। সুমিতদা এসে পড়ায় সিনিয়র সিটিজেন নেতা সাপটাকে আস্তিনের ভেতরে সঙ্গে সঙ্গে ঢুকিয়ে নেয়। সুমিতদার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলেন, ‘কি হে সুমিত খবরটবর কি? তুমি তো আর ইউনিয়ন মুখো হওনা হে’। সুমিতদা হাসে, ‘একদম সময় পাই না কাকু’। সুমিতদা এখানকার ভূমিপুত্র। সেই সুবাদে নেতাকে কাকু বলেন। অবশ্য এক সময় বাবা কাকা কারও সহপাঠিও থাকতে পারে এই নেতা। কিন্তু রোমি দাদাই বলে। বলতে হয়। সুমিতদার দিকে নেতা মরা মাছের মতো শীতল চোখে তাকায়। ‘মীটিং মিছিলগুলো এটেন্ড করো?’ চটজলদি জবাব দেয় সুমিতদা ‘করি তো?’ ‘মিথ্যে কথা। খবর আছে কোনো মীটিঙেই তুমি পুরোটা থাক না। মিছিল শুরু হলেই কেটে পড়ো’। সুমিত রোমির দিকে একবার তাকিয়ে মুখ নীচু করে থাকে। নেতা হাই তুলে বলে, ‘তোমাদের জেলা সেক্রেটারি বলছিল ছ’মাসের মধ্যে তোমার হেডক্লার্ক প্রোমোশন। পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড় কিংবা কোচবিহারের শীতলকুচি হলে তো তোমার খুবই অসুবিধা হবে তাই না?’ নেতা উঠে দাঁড়ায়। রোমির দিকে মিষ্টি করে হেসে বলেন, ‘আসি রোমি। আমাদের আজকের আলোচোনার বিষয়টা নিয়ে আমরা আর এক দিন বসবো কেমন’। বুলু যখন গর্ভে ছিল তখন ডাক্তারবাবু শেষের দিককার মাসে একটা রিমোটের মতো যন্ত্র তলপেটে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বুলুর হার্টবিট শোনাতো রোমিকে। রোমির মনে হয় যেন নিজের হার্টবিট নিজেই শুনতে পাচ্ছে। ‘ডিগ ডিগ। ডিগ ডিগ’।
সুমিতদা রোমির সামনে চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ে। টেবিলে দু’হাত মুঠো করে রেখে চাপা গলায় বলে, ‘এই লোকগুলোর সঙ্গে আপনি, আদিত্যদা কিভাবে জড়ালেন? লোকগুলো কি ভংকর জানেন না। বেড়িয়ে আসুন এখনই ওদের খপ্পর থেকে বেড়ীয়ে আসুন’। কোত্থেকে একটা টিকটিকি সায় দিয়ে ডেকে ওঠে। রোমির বশে না থাকা কান্নাটা আদুল গায়ে বেড়ীয়ে আসে হুড়মুড় করে। সুমিতদা বলে, ‘প্লীজ কাঁদবেন না। নেতা চলে যাওয়ার পর আপনি আমার সামনে কাঁদছিলেন এটা ছড়িয়ে গেলে আমাদের দু’জনেরই চরম সর্বনাশ হবে’।
এরপর দু’দিন বাদে সুমিতদা একদিন সন্ধ্যার পর ফোন করে। বলে, ‘রোমি দিদিমনি আপনি বাড়িতে একা আছেন?’ বলি, ‘একা মানে? আমি আর বুলু আছি’। সুমিত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাপা গলায় বলে, ‘পালান রোমি দিদিমনি। এখান থেকে যত তাড়াতাড়ী পারুন পালান। নতুবা আপনার সাধের সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে যাবে’। অসহিষ্ণু হয়ে বলে ওঠে রোমি, ‘আচ্ছা সুমিতদা সেদিন থেকে একই কথা বলে যাচ্ছেন কেন বলুন তো?’ সুমিতদা একটু ক্ষুন্ন হয়। বলে, ‘আপনার ভালোর জন্যই বলছি। আপনার প্রশংসা করতে করতে এরা বেলুনের মত ফুলিয়ে তুলবে। সুতো ছেড়ে দেবে, আপনি ভাববেন মুক্তির আকাশ। তারপর একসময় আপনার গ্যাস ফুরিয়ে যাবে। আপনি আছড়ে কোথায় যে পড়বেন কেউ আর খুঁজে পাবে না। এমনকি আদিত্যদাও না’। কথাগুলোর সত্যতা নিজেও টের পায় রোমি। তবু জিজ্ঞাসা করে, ‘আচ্ছা এসব করে ওদের লাভ কি?’
‘সিম্পিল। ডিভাইড এন্ড রুলস পলিসি। আদি অকৃত্রিম কাল থেকে চলছে’। আপনি আদিত্যদার থেকে যত বিচ্ছিন্ন হবেন তত একা হবেন। আর যত একা হবেন তত কমজোরি হবেন। বিভিন্ন কারণে ওদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হবেন’। কেঁদে ফেলে রোমি, ‘কি করবো তাহলে সুমিতদা?’ সুমিত বলে, ‘শুনেছি আপনার সঙ্গে আমাদের ইউনিয়নের জিএসের সম্পর্ক ভালো। ওনাকে বলুন পাঁচ বছর হয়ে গেছে এবার আপনি নিজের জেলায় ফিরতে চান। আর আদিত্যদার তো বদলির চাকরি। এ জেলায় পাঁচ বছর হয়ে গেছে ওনার বদলিটা তো ন্যায্য অধিকারের মধ্যেই পড়ে’।
এরপরের অধ্যায়টা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় রোমির। তার বদলীর আদেশ বেড়িয়ে গেলেও আদিত্যর আটকে যায়। আদিত্যর নামে অদ্ভুত সব অভিযোগ আসতে থাকে, ‘ঘুষ, তছরুপ, মিসবিহেভ এমনকি মাওবাদী যোগসাজোস তকমা পর্যন্ত। বুলুকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর পাক্কা দেড় বছর লাগে আদিত্যর ফিরে যেতে।
ঘূর্ণি ঝড়ের মতো পাক খেতে খেতে নাভির গোড়া থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে রোমির। ঝড়ের মতোই এলোপাথারি কান্নাটা লন্ডভন্ড করে দিতে থাকে তার ভেতর ও বাইরে। আবার সেই দেড় বছর। তবে সেদিনকার দেড় বছরের সঙ্গে আজকের দেড় বছরের বিস্তর ফারাক। সেদিন বুলু ছিল নেহাতই শিশু। বারো বছর বাদে আজ সে বয়ঃসন্ধির ফুটফুটে কিশোরী। রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে। মানুষ এক বুক আশা নিয়ে বেঁচে আছে এবার নতুন কিছু হবে। আদিত্য প্রোমোশন পেয়ে বীরভূম জেলায় ফের বদলি হয়েছে। রোমিও সংসারের স্বার্থে এই জেলাতে প্রোমোশোন নিয়েছে। কিন্তু বাস্তুতন্ত্রের মতো এখানে সব কিছুই চক্রাকারে ঘোরে, ‘চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানি চ দুখানি চ……’।
সময়ের গতির সঙ্গে সঙ্গে আদিত্য, রোমির শরীর, মনের ধার–ভার দুইই বেড়েছে। আদিত্য এখন অনেক বেশি সাবধানী। অফিসটুকু বাদ দিয়ে রোমি মন দিয়ে সংসার সামলায়। বুলু তাদের লক্ষীসোনা মেয়ে। মেয়েকে নিয়ে তাদের একটা চাপুর- চুপুর করা গর্ব আছে। বীরভূম জেলার সিউড়ি শহর থেকে বুলু নাইনটি ফাইভ পার্সেন্ট মার্কস নিয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে। আদিত্যই তাকে সায়েন্স গ্রুপটা পড়ায়। অঙ্কে বুলু খুব ভালো। সকলের খুব ইচ্ছা উচ্চ মাধ্যমিকের পর বুলু অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করে অনেক দূর যাক।আদিত্যও অঙ্ক বিষয়টাকে অসম্ভব ভালোবাসে। আর রোমির অঙ্ক নিয়ে অদ্ভুত ভীতি। তাই অঙ্ক যারা ভালোবাসে রোমি তাদের সমীহ করে, ভালোবাসে।
আদিত্য বলেছিল, বীরভূম তো কলকাতা, উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে দূরবর্তী জেলা তাই এখানে নিশ্চিন্তে বুলুর উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকতে পারবো। রোমিও নিশ্চিন্তে আছে। তারা তো এখন ইউনিয়ন, রাজনীতি থেকে শত হাত দূরে। পাঁচ বছর ধরে সিউড়ী শহরটাতে থাকতে থাকতে নিজের শহর ভাবতে না পারলেও বেশ ভালো লেগে গেছিল। বিশেষতঃ বুলুর। তার এখানে অনেক বন্ধু হয়ে গেছে।
বাম সমর্থিত সকল ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ডাকে ২রা সেপ্টেম্বর সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। বর্তমান শাসকদল ওরফে সরকার কড়া ভাবে ঘোষণা করে দিয়েছে, ‘যারা এই বন্ধের দিন কাজে যোগদান করবে না তাদের বেতনসহ চাকরি জীবনের একটা দিন কমে যাবে’। রোমিদের অফিসে বর্ধমানের আউশগ্রাম থেকে রাখী নামের একটা মেয়ে এস আই পোস্টে দু’মাস হল জয়েন করেছে। যাতায়াত করেই অফিস করে। ধর্মঘটের দিন কিভাবে অফিস করবো বলতে গিয়ে মেয়েটা কেঁদে ফেলে। ইউনিয়নের সেক্রেটারি এখানকার স্থানীয় দু’জন মহিলা কর্মচারীকে অনুরোধ করে রাখীকে একটা দিন থাকতে দিতে। কিন্তু কেউ রাজী হয় না। রোমি বলে ওঠে, ‘আমাদের ছোটো ভাড়া বাড়ী তবে একটা দিন ম্যানেজ করে নিতে পারবো’। রাখী চোখের জল মোছে। ঠোঁটের কোনে হাসি ফোটে।
সেই রাতেই আদিত্যকে ফোন করে ওর এক কলিগ খবরটা দেয়। আদিত্য কম্পিউটারের নেট খুলে দেখে খবরটা সত্যি। তার উত্তর চব্বিশ পরগনায় বদলীর আদেশ বেড়িয়েছে। কিন্তু কেন! সে তো অথরিটির কাছে প্রেয়ার দিয়েছিল, তার মেয়ে এখন ইলেভেনের ছাত্রী, সামনের বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। রেজিস্ট্রেশান হয়ে গেছে। এমত অবস্থায় অন্ততঃ আগামী দেড়টা বছর তাকে যেন কোথাও বদলী না করা হয়। কিন্তু তার এই আকুল প্রার্থনা কেউ শোনেনি।
রাখীকে রাতে বুলুর সঙ্গে শুতে দেয় রোমি। রোমির বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে আদিত্য। ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে রোমি, আমার আবার বদলী হয়ে গেছে। হঠাৎ করে রোমির মনে হয় তার যেন শ্বাস, প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে ভেন্টিলেশানে চলে গেছে। কিছুক্ষণ পরে দম নিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞাসা করে, ‘কেন? তুমি তো বলো তুমি এখন যে ইউনিয়নের মেম্বার তার কোনো রাজনৈতিক রঙ নেই। এপলিটিকাল। আর তাছাড়া তোমার তো এ জেলায় এখনও পাঁচ বছরের কোটা শেষ হয় নি। তাহলে?’ আদিত্য উঠে বসে অন্ধকারেই দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকায়, ‘না রোমি এ জেলায় আমার পাঁচ বছর দু’মাস এগারো দিন পূর্ণ হল আজ’। রোমি বিদ্রুপে হেসে ওঠে, ‘বাবা অথরিটি, ইউনিয়ন আর সব কাজে যদি এমন কর্তব্যপরায়ণ হয় তাহলে এ রাজ্যের তো চেহারাটাই পাল্টে যাবে!” দু হাঁটুতে মুখ গুঁজে আদিত্য বলে, ‘জান আমার আগে বেশ ক’জন এ জেলায় এসেছে তাদের অর্ডার হয় নি’। বন্যার জলের মতো ফুঁসে ওঠে রোমি, ‘তুমি তোমার এখনকার ইউনিয়নকে সে কথা বলো। অথরিটিকে নিজে বলো তোমার সমস্যার কথা। সব কিছু মামার বাড়ির আবদার নাকি!’ নিদ্রাহীন একটা রাত তারা বুক ভরা আশঙ্কা নিয়ে কাটায়।
পরদিন সকালটা আর অন্য দিনগুলোর থেকে আলাদা মনে হয় আদিত্য ও রোমির কাছে। রোমিকে সামনে বসিয়ে আদিত্য ফোনে সাউন্ড দিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলে। ওপাশ থেকে সেই ব্যাক্তি বলে, ‘আরে আদিত্যদা দরখাস্ত করে চুপ করে বসে থাকলে হয়? আমদের তো একটু বলতে টলতে হয় নাকি? তোমাদের মানে সিনিয়ারদের এত ইগো প্রবলেম, যাক শোনো আমাদের এপলিটিকাল ইউনিয়ান, অথরিটিকে ভজাতে পারলেই হল। হান্ডড্রেট পার্সেন্ট না হলেও নাইনটি পার্সেন্ট কথা দিচ্ছি প্রবলেম সল্ভ হয়ে যাবে’। রোমি আদিত্যর মুখের দিকে তাকায়। জানলা দিয়ে তেছড়া হয়ে পড়া সূর্যের আলোয় আদিত্যকে অনেক বেশি বয়স্ক মনে হয়। এক সময়কার দাপুটে নেতা কাকে যেন ফোন করে অনুরোধ করছে, ‘প্লীজ একটু চেষ্টা করো। আগামী দেড়টা বছর আমার পরিবারের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার মেয়েটার কথা ভেবে প্লীজ একটু চেষ্টা করো’। আদিত্যর কথাগুলো কান্নার মতো শোনায়।
ডাইরেক্টর তথা সুপ্রিম অথরিটির কাছে গিয়ে আদিত্য কি বলবে তা নিয়ে রোমির কাছে বেশ কিছুক্ষণ রিহার্সাল দিয়েছে। আজ পনের দিনের মধ্যে অর্ডার বাতিল না হওয়ায় আদিত্য নিজেই যাবে অথরিটির কাছে ঠিক করেছে।
স্লীপ দিয়ে অথরিটির সঙ্গে দেখাও করে। অথরিটি মাছি তাড়ানোর মতো করে আদিত্যর আবেদন নাকচ করে দেয়। চোখের জলে রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে আদিত্য। অথরিটি দরজা দেখিয়ে দেয়। আদিত্য কাঁদতে কাঁদতে অথরিটির কাছে জানতে চায়, ‘আমার আগে যারা ও জেলায় গিয়েছে তাদের ওর্ডার হল না কেন?’ অথরিটি নির্বাক হাসেন, ‘তারা আমার কাছের মানুষ’।
সিঁড়ি দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে নামে আদিত্য। আবার রোমি আর বুলুর কাছ থেকে টেনে ছিঁড়ে তাকে আলাদা করে দিল নিয়তি। বুলুকে কোনো অঙ্কের টিচার দেওয়া হয়নি। নিজের সবটুকু জ্ঞান উজার করে অঙ্ক শেখায় তাকে। কি হবে বুলুর এখন! রোমি আকুল গলায় ফোন করে জানতে চায়, ‘হ্যাঁগো অথরিটি কি বললেন?’ সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে আদিত্যর বাতাসে অক্সিজেন বড়ো কম মনে হয়। আদিত্যর কন্ঠস্বরটা হাহাকারের মতো শোনায়, ‘আমি অথরিটির কাছের মানুষ না রোমি’। রোমি চীৎকার করতে থাকে, ‘তুমি প্রতিবাদ করলে না কেন?’ শুকনো হাসে আদিত্য, ‘কি করবো? কেস?’ আবার হয়তো ঘুষ, তছরুপ, মাওবাদী তকমা পড়িয়ে দেবে। তোমাদের ফেলে চলে আসতে হবে আমাকে। আগামী দেড়টা বছর সব অন্ধকার রোমি’। রোমি কোনোরকমে বলে, ‘একটা অন্য শহরে টিনএজের একটা মেয়েকে নিয়ে আমি কি সব সামলাবো?’ আদিত্য অদ্ভুত গলায় বলে, ‘তোমাকে পারতেই হবে রোমি। জানবে জানোয়াররা সব পারে। শুধু অঙ্ক করতে পারে না। তাই বুলুকে আর আমার অঙ্ক শেখানো হবে না’। হা হা করে হাসতে থাকে আদিত্য। রোমি ভয় পেয়ে যায় , ‘আদিত্য তুমি হাসছো কেন?’ আদিত্য বলে, ‘আমরা কাঁদলে অথরিটির হাসি মনে হয়, তাই হাসছি যদি অথরিটির এটাকে কান্না মনে হয়’।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..