আত্মন্বেষণের আয়না

আশিস গোস্বামী
কবিতা, প্রবন্ধ
Bengali
আত্মন্বেষণের আয়না

বেশ ছিলাম, পড়াশুনার পাশাপাশি মিউজিককে ধ্যান জ্ঞান করে এগিয়ে চলার মধ্যে। অন্যান্য কাজের ফাঁকে দিনে ঘণ্টা চারেক তবলা রেওয়াজ এই ছিল রোজনামচা। কিন্তু জীবন জুড়ে অন্ধকার আর কপাল ভরা ঘোড়ার ডিম থাকলে যা হয়। বাবার কোম্পানী নড়বড় করতে থাকল। ক্রমাগত অর্থের চাপে পুঁজি কাঁচকলা দেখাতে শুরু করল। সেই আমার চাকরির সন্ধান শুরু ও চাকরি এবং কাঙ্খিত ভালবাসার পথ ছেড়ে এতগুলো মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার লড়াই।

তবলা তখন অভিমানী নদী হয়ে পালা বদল করেছে। চাকুরিজীবী আমি, মনে এক তোরঙ্গ বিষাদ আর মুখে চার নটিক্যাল দন্তকৌমুদি সহযোগে বোঝাতে চাইছি আমার অতলান্ত খুশীর অবস্থান। অথচ প্রতিটি দিন আমার কানে বলে যাচ্ছে তুমি ভাল নেই, ভাল নেই। কি করি আমি। ভাবলাম তবলা বাজিয়ে নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাব যাতে চাকরি করতে না হয়। সেই চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না আমার। আবার ক্লান্তিও ত্রুটি রাখেনি আমাকে একঘণ্টা রেওয়াজের মধ্যেই বেঁধে রাখতে।

ক্রমেই বুঝতে পারছিলাম এ পথ আমার নয় অন্য কোনো পথ। শুধু বিষণ্ণ বদনে চাকুরি করে যাওয়া আমার ধাতে সইবে না। নিজেকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করানোর আর কোনো মাধ্যমই যে আমার জানা নেই। নিজের সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়া। আনন্দানুভুতির গভীর, আত্মন্বেষণের আয়না এই বিশেষণগুলি অবচেতনে পাক খেয়ে আবার অতলে তলিয়ে যেত। শুয়ে শুয়ে  চাঁদের চৌমাথায় অস্তমিত সূর্যের শব্দ শুনি। আর ভাবি এই কি জীবন। ঠিক এমন সময়ে তপনের সাথে আলাপ, (তপন বিশ্বাস – চিত্রকর)আলাপ থেকে বন্ধুত্ব।

আমার বই পড়ার অভ্যাস ছিল না। তপন  বন্ধুত্বের ভালবাসা ও অনাঘাত শাসনে আমাকে সেই অনুশীলনে দীক্ষিত করল।  ধীরে ধীরে নানান কবিতার আলোচনা ও তপনের অসাধারণ পাঠে আমার ভিতরদেশ কবিতার বৃষ্টি ও সোঁদা গন্ধে ভিজে উঠতে থাকল। ভাঙা টিকলির মতো আলো আঁধারি কথা, শরীর গঠনের আবদার নিয়ে আমার দরজায় ভাষা পেতে চাইল । আমি রাত ১২টা ১টা পর্যন্ত সাহিত্যর নানা বই গোগ্রাসে গিলতে থাকলাম। ভাবা যায় প্রায় ২৫ বছর বয়সে আমি সাহিত্য রসের স্বাদ নিতে শুরু করলাম। তারপর সেই ভোর পাঁচটায় উঠে আবার অফিস যাওয়া। এমন চলতে চলতেই একদিন আমার হাত থেকে বেরিয়ে এলো কবিতা। তখন আমার ২৯ বছর বয়স।  পাশাপাশি তপন আমায় পাঠ দিচ্ছে শিল্পকলার। রেমব্রান্ট, দালি, মিরো, ব্রাক, পিকাসো, টার্নার, কনস্টেবল, লিয়োনার্দো, মিকেলেঞ্জেলো। আমি অবাক হয়ে দেখি আর অনুভবের মাটিতে পা রাখার চেষ্টা করি। এই ভাবেই আমি পেয়ে গেলাম আমার আয়না। নিজের প্রকাশভূমির মগ্ন ছোঁয়া। নিজের সাথে কথা বলার চিলেকোঠা।আমার আড়াল কথা, রাখঢাক কথা, প্রতিসরিত কথা, আমার একাকিত্ব, আমার সত্য ও আমার আমিকে সঙ্গ দেওয়ার সাথি – কবিতা।

আর যাইহোক সে অর্থে আমি স্বভাব কবি নই। ঠ্যালায় পড়ে কবি।

এতো গেল কবিতা লেখার ব্যাপার এবার আসি কবিতা কেন পড়ি।

করোনার দরুন যেমন কোয়ারেন্টাইনে থাকার অর্থ এই সমাজ সংসার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা। তেমন সমস্ত আলো আসার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় কবিতা না পড়লে। কবিতা না পড়লে আমি কিভাবে জানব এর ইতিহাস, অগ্রগতি, ভাষা, ফর্ম, ভাবনা, অভিনবত্বের কথা। কবিতা পড়লে বোঝা যায় কোনটা হবে নিজের পথ।

নিজের অনুভূতি ও চেতনার জাগরণ হয়। ধরা দেয় গাছের প্রতিটি স্পন্দন থেকে পিরামিডের থুতনিতে অসামান্য তিলের অস্তিত্ব। কবিতার কোনো একটা শব্দ, একটা বাক্য, একটা মোচড় অন্য কবিকে উস্কে দিয়ে লিখিয়ে নিতে পারে একাধিক সম্পূর্ণ অন্যরকম কবিতা। কবিতা এক সুশ্রূষা। আলোর উদ্ভাস। কবিতা পড়লে কবিতার বিশ্ব নিজেকে মেলে ধরে। নিজেকে update করা যায়। আর কবিতার খনি থেকে বেরিয়ে আসে অজস্র কবিতা লেখার রসদ।

আশিস গোস্বামী। কবি। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কলকাতা। প্রকাশিত বই:

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ