প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
আজ মায়ের বাৎসরিক। দেশের বাড়িতে সেভাবে এখন আর আসা হয় না, বহুদিন বাইরে বাইরে থাকে অপ্রতিম। সেই গ্র্যাজুয়েশনের সময় থেকেই। আত্মীয়স্বজনের সাথে অ্যাটাচমেন্টটাও স্বাভাবিকভাবেই অনেকটা শিথিল।মা ও যে খুব সামাজিক ছিল তা কিন্তু নয়, কিন্তু মায়ের একটা নিজস্ব বৃত্ত ছিল সারাজীবন সেখানে মা ভারি স্বচ্ছন্দ উজ্জ্বল,চিরকালই। একরকম ফ্যান্টাসি নিয়ে কাটিয়ে দিল সারাজীবন। কম্পারেটিভলি বাবা অনেক বেশি কনসিডারেট ছিলেন। অথচ লোকে মা’র কথাই বেশি জিজ্ঞেস করে,সবসময়। অদ্ভুত এক রহস্য নিয়ে বেঁচে থাকতে ভালোবাসতো মা।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসব কথাই ভাবছিল অপ্রতিম,অপ্রতিম চৌধুরি, কেন্দ্রীয় সরকারের বেশ ভারি অফিসার। সন্ধ্যে নেমেছে অনেকক্ষন।দেশের বাড়ি বলতে বর্ধমান শহর, তার শৈশব, কৈশোরের বেড়ে ওঠা, নিজস্ব পাড়া, ফুটবল ক্রিকেট।এখন স্কাইলাইন বদলে গেছে অনেক, পুকুর বুজিয়ে আবাসন তৈরী হয়েছে, উড়ালপুল, স্টেশনের কাছটাতো চেনাই যায় না অথচ এখানেই আজন্ম বেড়ে ওঠা। গুঞ্জা খুব বিরক্ত বোধ করে
“ওসব রাখো তো, তোমাদের বর্ধমানের বাড়িতে আশেপাশের আত্মীয়ের ভীড় লেগেই আছে, কাছে তোমার মামারবাড়ি, কাজিনের অভাব নেই, ও বাড়িতে গিয়ে আমি দিনের পর দিন থাকতে পারব না, তাছাড়া তোমাদের বাড়ির রকমসকম আমার সাথে মেলে না। ইম্পসিবল”।
অথচ মা তো গুঞ্জাকে কোনদিনই কিছু বারণ করেনি বরং অঢেল স্বাধীনতা দিয়েছিল, মা নিজেও অত্যন্ত সংস্কারমুক্ত মানুষ ছিল, ভীষণরকম আধুনিক ছিল মন মানসিকতায়। গুঞ্জা কোনদিনই মা কে…
অপ্রতিম নিজেও কি কোনদিন মা কে সেভাবে ভালোবাসতে পারলো, মায়ের সাথে কেমন জানি একটা ঠান্ডা প্রতিযোগিতা রয়ে গেল সারাজীবন ধরেই।
অথচ শৈশবটা মায়ের সাথে খুনসুটিতেই ভরা। বয়েসের ফারাক কম ছিল বলেই কি এমন হল? মা’র অধিকারবোধ ছিল সাংঘাতিক অথচ আচরণে ভীষণ শান্ত, নিমগ্ন মানুষ। এখন গুঞ্জাও কত স্বাভাবিক, কোন অনুযোগ নেই, বাবা’র ছোটখাটো দেখাশোনা, আত্মীয়স্বজন, কাজের বাড়ি সব একা হাতে সামলাচ্ছে। পিসিমনি আছে যদিও তবুও…
মা গুঞ্জার প্রতিপক্ষ ছিল?
খুব হলদেটে স্মৃতি মনে পড়ে, বিয়ের পরপরই তখন অপ্রতিম মুম্বাইয়ে পোস্টেড, পুজোয় বর্ধমান আসবে, গোছানো কমপ্লিট বিকালে ট্রেন, গুঞ্জার চোখমুখ টসটস করছে
” বিয়ের পর প্রথম পুজো, আমি মা’র কাছে যাব না? আমার বন্ধুরা?
“আমার মা নেই বুঝি “? মজা করে অপ্রতিম।
ফোঁস করে ওঠে গুঞ্জা ” বিয়ে করলে কেন তবে? মা’র কাছে থাকলেই পারতে! “
“যাহ বাবা! ” গুঞ্জাকে কাছে টানে সে
“দু’দিন তো সোনা, চলো, তারপর তোমার বাড়ি তো যাবই “।
” অসহ্য লাগে আমার তোমাদের বাড়িতে,তোমার আঁতেল মা যাচ্ছেতাইরকম স্নব, সারাক্ষণ ব্যাঁকা কথা। তুমি কি করে বুঝবে মেয়েদের কমপ্লেক্সটা? কোথায় লাগে! একটু ঘুরবো ফিরবো তোমার সাথে, নিজে তো কোথাও যাবেই না উপরন্তু আমাদের যাওয়াটাও সহ্য হয় না “।
” মা তোমায় কোথাও যেতে না করে “?
” তা করবেন কেন? এমন হাসেন যেন খুব অন্যায় করে ফেলেছি,শোন আমি ওই অত ওবলিগেশনের মধ্যে নেই। ব্যস! “
খুব সামলেছিল সে যাত্রা। খারাপ ও লাগতো মাঝে মাঝে, গুঞ্জা মিথ্যা তো বলেনি, যেকোন বিষয়ে মা’র ইনভলভমেন্ট ছিল খুব কম। কোনদিনই পারিবারিক কোন অনুষ্ঠানে মা’কে সক্রিয় দ্যাখেনি। মায়ের বিয়ের সময় তখনো মা’র পড়াশোনা শেষ হয়নি, ঠাকুমা পিসির সংসারে মা কোনদিনই প্রায়োরিটি পায়নি সেভাবে, একটা ঠান্ডা যুদ্ধের আবহ মা’কে ঘিরে থাকত সারাক্ষণ। স্বভাবগত কারণে চরিত্রে সো-কলড মেয়েলিপনাও কমই ছিল মা’র। উল বুনতে, আচার করতে, কাঁথা সেলাইয়ে অক্ষম মায়ের জন্য ঠাকুমার হাহাকার কিছু কম ছিল না। আত্মীয়স্বজনদের কাছে বলে বেড়াতেন
“সধবা মেয়েমানুষ কান, গলা খালি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, একটা ছেলে পেটের, ষষ্ঠী উপোষ কিছু করে না। হেই মা কথা, এ আবার কি, অলুক্ষনে মেয়েছেলে, আমার বাবুর কপালটাই খারাপ”।
সেই মা, তার ছোটোবেলায় জ্বর এলে মাথায় জলপটি দেবার বদলে স্নান করিয়ে দিত, প্যারাসিটামল খাইয়ে বলত ” রেস্ট নাও, সেরে যাবে “।তুকতাকে বিশ্বাস ছিল না, তাবিজ-কবচ কিছুই পরায়নি কোনদিন, আত্মীয়রা আড়ালে নিন্দে করতো। সারজীবন নিজের স্কুল আর লেখালিখি নিয়ে কাটিয়ে গেল। ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল তবে পুজো-আচ্চা করতে বিশেষ দেখা যায়নি কোনদিন। বাবা উল্টো, সাত্ত্বিক প্রকৃতির মানুষ, গুরুনাম, জপ-তপ সবই করতেন। ধর্মভীরু মানুষ মায়ের মত বোহেমিয়ান নন। মা নেই আজ একবছর, বাব কি মা’র কথা ভাবে? যে মা’কে তারা সবাই একদিন ‘ও ঠিক আছে’র দলে ফেলে দিয়েছিল!
ঠাকুমা,ঠাকুরদা, বাবা, পিসিমনি সবার কাছে শুনে শুনে কখন যেন অপ্রতিম নিজেও বিশ্বাস করেছিল ‘মা স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক”।গুঞ্জা তার শ্বশুরমশায়কে যতটা গুরুত্ব দিত,মা’কে বিরক্ত হত ঠিক ততটাই, মা’র জন্য কারোর কোন দরদ ছিল না, পথের ভিখারি বা প্রান্তিক মানুষজন ছাড়া। বইপত্র লেখালিখি,কবিতা, নাটক-পাগল মা’কে এ বাড়ি একরকম নির্বাসন দিয়েছিল। তার ছোটবেলাতেও কখনো সে দ্যাখেনি মা রান্নাঘরে, রান্নার লোককে কিছুমাত্র বলছে, এটা-ওটা, নাহ! ঠাকুমা পিসি এরাই সব ছিলেন। আমিষ-নিরামিষ না মানা,শাঁখা-পলা না পরা, পুজো-আচ্চা না করা মা অথচ সাংঘাতিক দৃপ্ত ঋজু এক নারী যে পনেরই অগাস্টের রক্তদান শিবিরে, তেইশে জানুয়ারির পতাকা উত্তোলনে, ছাব্বিশে জানুয়ারির রোডর্যালিতে ভীষণ স্বচ্ছন্দ। সেই মা। অপ্রতিমের আত্মকেন্দ্রিক, উদাসীন মা।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বাড়িটা ঘুরে দেখছিল অপ্রতিম, তার শৈশবের গন্ধমাখা এই বাড়ি। কত স্মৃতি যে জড়িয়ে-মড়িয়ে আছে এর প্রতিটি কোনে কোনে। প্রথম হামা দেওয়া, সাইকেল চড়া, বাড়ির পিছনের বাগানে হারিয়ে যাওয়া ডিউজ বল খুঁজে বের করা,পাড়ার বন্ধুদের সাথে ঘুড়িমেলায় ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো। হঠাৎ একঝলক আবার মা’র কথা মনে এলো,বিকেলবেলার ছাদ বড় প্রিয় ছিল মা’র। মা আর অপু, মানে অপ্রতিম মিলে হুটোপুটি করে ছাদে খেলতো, তখন কতই বা বয়েস হবে ওই চার কি পাঁচ, একটা অদ্ভুত আলো দেখতে পেত অপু মায়ের মুখে, মায়ের এই টমবয় গোছের মেজাজটি ভারি ভালোলাগতো তার। সংসারে বুঝি এমনই হয় তাই বড় হয়ে যাবার পর, ম্যাচিওরড অপুর, মা’কেই কেমন যেন প্রতিপক্ষ মনে হত। বাবাকে নিয়ে সমস্যার জায়গাই ছিল না, আদ্যোপান্ত ভালোমানুষ, সাতে-পাঁচে না থাকা বাবা, আজও বাড়ির সব্বাই বাবা’র কথা মেনে চলে,কাকামনি অত বড় ডাক্তার তিনিও বাবাকে না জানিয়ে কোন সিদ্ধান্ত আজ অবধি নেন না, অথচ মা’র বেলাতেই…
করুণা করা যেত না বলেই কি মা কোনদিন নিজের হতে পারলো না? কারোরই?
সারাবাড়িতে তার জিনিষপত্র এখনো, এখানে ওখানে ছড়ানো। মা’র বইখাতা,লেখার টেবিল,আলমারিতে অজস্র জামাকাপড়, ছাদের টবে তার নিজের হাতে লাগানো গাছগুলো, অযত্নে শুকিয়ে গেছে। মা’র অনেক সফ্টটয় ছিল, এ নিয়ে গুঞ্জাও আড়ালে তাকে বলতো
“সত্যি, তোমার মা এখনো ওসব নিয়ে খেলা করে? পাগল নাকি “!
মেলায় গিয়ে অপুকে বলতেন ” নরম পুতুল কিনবি অপু “? নিজেই কিনে নিত, সেকি আনন্দ মা’র, একুশ বছর বয়েসে মা হওয়া মায়ের জন্য বুকটা আজ হঠাৎ চিনচিন করে ওঠে অপুর। বেঁচে থাকতে আরও একটু সহানুভূতি…
সহানুভূতি সইতে পারতো না মা। ঝগড়াঝাঁটি হলে প্রায়ই বলতো ” আমি কারোর বোঝা হতে চাই না”।সত্যিই বোঝা হওয়া আর হলো না। দুদিনের জ্বরে…
অমন ভাইরাল ফিভার তো কতই হয়, খবরটা প্রথম বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি, বাব যখন ফোন করেছিল তখনও অপু বিছানায়। ভোররাত, আগেরদিন ডিপার্টমেন্টের সিক্রেট মিটিং, ফিরতে রাত হয়েছিল, গুঞ্জা আর ডেকে তোলেনি, অথচ সেই ডাকতেই হয়েছিল। কাকামনি গম্ভীর গলায় বলছিল, যত তাড়াতাড়ি পারো চলে এসো, তুমি ছাড়া মুখাগ্নি হবে না। তাতান তখনও খুব ছোট বছর দুয়েক। অত ভোরে তখনও মানুষজন ঠিকমতো ওঠেনি, বাবা’র দোকানের কর্মচারীরা ঘরে থেকে উঠিয়ে বাইরের বারান্দায় শুইয়েছিল। অথচ তার আগেরদিনও তাতানের সাথে কত কথা, কত গল্প, রোজ সন্ধ্যেবেলা মা ফোন করে তাতানকে চাইতো, এ নিয়েও গুঞ্জার আপত্তি ছিল।
” আচ্ছা তুমি বলো, ছোটছেলেকে এতক্ষণ মোবাইল দেওয়াটা কি ঠিক? তোমার মা পারেও আদিখ্যেতা করতে! আমার মায়েরও তো নাতি, করে আমার মা এরকম ?”
গুঞ্জাকে অপ্রতিম কি করে বোঝাবে তাতানের মধ্যে মা তার ছোট্ট অপুকে খুঁজতো। তার বড় আদরের অপু, তার আত্মজ, মেয়েবেলার একান্ত সাধ।
শোবার ঘরের ভিতর একটা কাঠের আলমারিতে মা’র বইপত্তর, ম্যাগাজিন,চিঠি,ছোটোবড় কতরকম মেমেন্টো, মা’র সারাজীবনের সঞ্চয়, সব সব সাজানো থাকতো। কোন কোন শান্ত নির্জন ঘুঘুডাকা দুপুরে যখন রাস্তায় ফেরিওয়ালা ছাড়া আর কোনও লোকজনের সাড়া পাওয়া যেত না, মফস্বল শহরের দুপুরে গেরস্তের খিলআঁটা ঘুমে মগ্ন সময়ে, পা টিপেটিপে ওপরের ঘরে উঠে কতদিন অপু দেখেছে, আলমারি খুলে তন্ময় হয়ে মা তাকিয়ে আছে,কিম্বা হাতে ধরে আছে কোন হলদেটে শারদসংখ্যার কবিতার পাতা, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে সেসব। এমন কত্বদিন হয়েছে। অপু চুপিচুপি পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলে মা বলেছে ” এই আমার রাজ্যপাট অপু,তুমি পড়বে বড় হয়ে? “ছোট্ট অপু অতসব বুঝতো না, মা তড়িঘড়ি বন্ধ করে দিত তার প্যান্ডোরার বাক্সখানি। সেই আশ্চর্য আলমারি।
আজ পায়ে পায়ে ওই আলমারিটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে সব,গা-চাবি ঝুলছে, ঝুল ধুলো পরে আছে, এতবড় বাড়ি ঝাড়পোছ করার লোক কই, ময়লা জমছে। বাবা যতদিন আছে তারপর তো বিক্রির ব্যবস্থা করতেই হয়। মুখোমুখি দুখানা বাড়ি করেছিলেন বাবা, যাতে হাত পা ছড়িয়ে থাকতে অকুলান না হয়। কেউ কি রইলো? অপু বরাবর বাইরে বাইরে, গুঞ্জা তার চাকরি, ফ্লাওয়ার-বুটিক,লেডিজ ক্লাব নিয়ে মজে আছে। তাতান ওখানের টডলারে এবছর এডমিশন নিয়েছে। এবার এদিকের সব ব্যবস্থা আসতে আসতে করাই ভালো। পাল্লাটা টানতেই ক্যাঁচ আওয়াজটা বড় তীক্ষ্ণ লাগলো কানে, কতদিন খোলা হয়নি কে জানে! কোনদিন এই অচেনা অন্দরমহলে উঁকি দেয়নি, আজ কেন জানিনা…
থরে থরে কাগজ, ম্যাগাজিন, মায়ের প্রকাশিত অপ্রকাশিত লেখা সব সাজানো। কত ডায়েরি, পাতায় পাতায় না জানি কত কি লেখা আছে, কবে লিখলো মা এসব? আরে এগুলো কি? ছোট্ট ছোট্ট ফ্লানেলের জামা, হাতভাঙা পুতুল,মোটরগাড়ি, রাবারের বল। এগুলো তো তার ছোটবেলার সব,মা রেখে দিয়েছিল এতকাল? ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা রঙিন, ছোট একটা সোয়েটার, দুটো নকশা করা কাঁথা। ওর বড় হয়ে যাবার পরও মা বড় হলোনা? ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতো অপুর শৈশবকে? একটা মিষ্টি গোলাপি রঙ বেনারসি, এটা অপুর দিদিমার বিয়ের শাড়ি মা’কে দিয়েছিল তার মা,এতবছর ধরে এসবকিছু তোমার বুকে বয়ে বেড়িয়েছ, মা? একা একা? একটা পুরনো কাগজের কভারফাইলে কত সার্টিফিকেট, পুরনো হলদেটে হয়ে গেছে।লেখাপড়ায় বরাবর ভালো ছিল মা, আবৃত্তি নাটক কবিতা এই নিয়ে ছিল মায়ের জগত, দাদু ছিলেন যাত্রা-নাটক পাগল লোক, সেই রক্তই মা’কে সারাজীবন ধরে বিচ্ছিন্ন করে রাখলো সমাজের গতানুগতিক স্রোত থেকে। এত ক্রিয়েটিভ ছিল বলেই কি অমন ছেঁড়াখোঁড়া জীবন কাটাতো মা? ওভার সেন্সেটিভ মায়ের দুঃখটাকে যদি আর ক’বছর আগে ছুঁতে পারতো অপু,মা এমন করে চলে যেত না হয়তো। আর একটু সমানুভূতি মা’কে বোধহয় দেওয়া যেত,সবাই তো আর একছাঁচে ঢালা হয় না।
এখন আর এসব ভেবে লাভই বা কি! কোনদিন ডাক্তার ওষুধপত্রের ধার দিয়ে যেত না মা, অথচ বেশ ঘনঘন অসুস্থ হত,লেগেই থাকতো টুকটাক। তবে একেবারেই বিছানায় পরে থাকতে কেউ কখনো দেখেনি মা’কে। খুব সহ্যশক্তি ছিল, একটা নির্লিপ্তিঘেরা উদাসীনতায় নিজেকে সবসময় মুড়ে রাখতো মা,পুরনো লোমওঠা বালাপোষের মত।
“আচ্ছা, তোমার মা তো পুজো-আচ্চাতেও একটু গয়নাগাটি পরতে পারে, আমার মামা-বাড়ি, এত লোকজন,আত্মীয়রা, সবাইকার সামনে এত লজ্জা করছিল আমার! “
“মা? কোথায়? কি হয়েছে? “
আরে আমার ছোটমাসি সল্টলেকে ফ্ল্যাট নিল না! সেবার ওই গৃহপ্রবেশে, তোমার কনফারেন্স ছিল তো! “
“তো? মা, কি করতো “?
” কি আবার করতো? করার কথা হচ্ছে না। একটা ম্যাড়মেড়ে সাদা শাড়ি আর সেই ঝোলা ব্যাগ, মা গো! যত্তসব। স্কুলটিচার যে আর কেউ হয়না! নাকি কবিতা উনি ছাড়া আর কেউ লেখেন না! ভীষণ আঁতেলটাইপ একটা, লজ্জায় মাথা কাটা গেল আমার “।” “আরে মা চিরকাল সাদা শাড়ি পরতেই ভালোবাসে, আমি ছোটথেকে এমনই দেখছি মা’কে, সাদা খুব প্রিয় মায়ের। সেই সাদা শাড়ি দিয়ে মোড়া একটা কাঠের বাক্স! মা’র ডায়েরি, হলুদ চামড়া দিয়ে বাঁধানো। মা ছোটবেলায় বলতো ” কারোর ডায়েরিতে হাত দিতে নেই অপু, অন্যের ডায়েরি পড়া অসভ্যতা “।একটু ইতস্তত বোধ করে, মা’র একটা ছবি লেখার টেবলের ওপর, তেইশ বছরের মা অপুকে কোলে নিয়ে হাসছে। মা কি তাকে দেখছে? একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে…
জানলা দিয়ে দিনশেষের শেষ আলো এসে পড়েছে মেঝেতে, চারিদিক ঝাপসা হয়ে আসছে, ক্ষয়ে এসেছে বিকেলটুকু, শীতের সন্ধ্যে, চারপাশ আবছা, কুয়াশাময় শীত শীত। বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে অব্যক্ত ব্যথা শীতের সাথে সাথে তাকে ধীরে ধীরে একটানা ঝিঁঝিঁ’র ডাকের ভিতর নিয়ে যায়, কোথা, দূরে,কোন জন্মান্তরে।
” অপু এই দ্যাখ, আয় আয় এই তো আমি ছাদে “
“সবক’টা অঙ্ক করেছিলি অপু “?
” আজ টিফিনে ম্যাগি নিবি? বানিয়ে দেব “?
” অপু আজ মামাবাড়ি যাবি “?
” আমি যখন থাকব না, কাকে বলবি এসব? অপু? “
মায়ের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কথা দুকান ভরে আসছে, ক্রমশ বাড়ছে আওয়াজ,অপু…অপু…অ…পু…
চোখ খুলতেই হাঁ হাঁ করে ওঠে গুঞ্জা “উঠো না, শুয়ে থাকো “। কি হয়েছে অপ্রতিমের? আত্মীয়রা ঘিরে আছে, বাবা মাথার কাছে উদ্বিগ্ন। পিসিমনি বললো ” মহাগুরু নিপাত হয়েছে…”
পাশ থেকে মামীমা ” সে তো একবছর হয়ে গেল গো! “
“এতগুলো বছর তো এবাড়িতেই” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন বাবা। কাকামনি পালস ধরে বললো ” তোর কি খুব উইক লাগছে “?
” না, সেরকম তো কিছু… “
“হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে গেছিলি, এমন হতেই পারে যে কারো, ডোন্ট ওরি, রেস্ট নে, ক’দিন যা ধকল গেল। উপোস-টুপোস করেছিস তার ওপর ।
জানলা দিয়ে যতদূর দেখা যায় সবুজমাঠ, রেললাইন, ছোট ছোট ঘরবাড়ি দূরে দূরে। তারও ওপারে আকাশ। হু হু হাওয়ায় হঠাৎ মনে হল মা’র শাড়ির আঁচল, চমকে উঠেছে অপ্রতিম!
গুঞ্জা একটা সাদা শাড়ি পরেছে আজ, অবিকল মা যেমন পরতো।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..