আনুর জগৎ

মৃদুল শ্রীমানী
ছোটগল্প
Bengali
আনুর জগৎ

আনু বেশ বুঝতে পারে মা বাবার মধ্যে বেশ একটা সমস্যা আছে। মা বাবাকে আপনি করে বলে। বাবা কথা বলে ভাববাচ্যে। বাবার ছোটো মুদির দোকান। আগে দোকান বড় ছিল। মহাজনেরা বাকিতে অনেক মাল দিত। এখন দেয় না। বাবা মাল ঘাড়ে করে কিনে আনে। অল্প অল্প আনে। টানাটানির সংসার। মা বলে বাবা নাকি লটারির নেশায় ফতুর হয়ে গিয়েছেন। ফতুর কথাটা কোথাও কোনো বইতে দেখেনি আনু। কিন্তু মায়ের কথার ধাক্কায় বেশ বোঝা যায় ফতুর মানে নিঃস্ব। বাবার একদিন ভাল সময় ছিল। সে সময়ও বাবা লটারির টিকিট কিনত। তবে মেপেজুকে। তার পর লোকটার কি হয়ে গেল। একবার প্রাইজ পেল তিনহাজার টাকা। ব্যাস। মা বলে ঘাড়ে শনি চাপল। শনি খুব জ্যান্ত ঠাকুর। খুব পাপ দেয়। আচ্ছা শনি ঠাকুরটা এমন বেআক্কেলে কেন? মানুষের পিছনে লেগে কি সুখ পায় শনি, আনু বোঝে না।
আনুর নাম আনন্দ। আনন্দময় ঘোষ। বাবা ডাকে আনু। আনু জল আন। আনু গামছাটা এনে দে। আনু তোর মাকে বল চা করতে। আনু এটা কর, সেটা কর। মা বলে আনন্দ, পড়া ছেড়ে উঠবি না। জল আর গামছা আমি এগিয়ে দিচ্ছি। পড়া বন্ধ করবি না খবরদার।
ক্লাস এইটে পড়ে আনু। ক্লাসে মাস্টার তাকে ভ্যাঙায়, কোচিং এ না পড়লে লবডঙ্কা। এই বলে নাকের সামনে বুড়ো আঙুল নাড়াতে থাকেন। সবাই জানে আনুর বাবা গরিব। কোচিং ক্লাসের টাকা দিতে পারবে না। তবু স্যার কোচিং এ পড়তে বলে। কোচিং এ পড়ার সুবিধে আছে। একে তো মাস্টার উত্তর লিখিয়ে মুখস্থ করিয়ে দেয়। ভানু বলেছে স্যার চোখ বুজে পড়া বলে যেতে পারে। আনুর অবাক লাগায় মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল। মা বলে তোর বাবাও দোকানে কোন জিনিসের কি দর, কত ওজনে কি দাম হয়, মুখে মুখে বলে যায়। তা মা কিন্তু ঠিকই বলে। বাবা মুখে মুখে বড় বড় যোগ করে ফেলে। পাড়ায় কে কত টাকা বাকি রেখেছে তার হিসেব বাবার কণ্ঠস্থ। সেই টাকা কটা ব্যাঙ্কে থাকলে কত সুদ হত, সুদের সুদ কত হত, তাও বিড়বিড়িয়ে বলে বাবা। মা বলে অতোই যদি জানেন, বাকিতে মাল দেন কেন?
বাবা ধমকায়, আনু, তোর মাকে বল, বাকি না দিলে কারবার টেঁকে না।
মা বলে কারবার যে কেমন টিকিয়ে রেখেছেন বেশ দেখতে পাচ্ছি। আনন্দময় বড় হচ্ছে। অঙ্ক আর বিজ্ঞানের জন্যে টিউশন দিলে ভাল হয়। আর দুবেলা একটু দুধ।
ভানু আর একটা চমৎকার কথা বলেছে। কোচিং এ পড়লে পরীক্ষার প্রশ্ন আগেভাগেই জানা যায়। মৌখিক পরীক্ষায় ভালো নম্বর মেলে। ভানু চোখ টিপে বলে কোচিং এ পড়লে মৌখিক পরীক্ষায় সহজ করে প্রশ্ন ধরে। আনু মাকে বলেছিল। মা কোচিংয়ে পড়ব। কোচিংয়ে স্যারেরা সব বলে দেয়। নম্বর ভাল হয়। মা পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিল, না বাবা আমার, অমন করে নম্বর পেয়ে লাভ নেই। তুমি খেটে পড়ো। সব পরীক্ষায় তো স্কুলের স্যারের হাত নেই। মা বলে বটে। আনুর পুরো বিশ্বাস হয় না। কিন্তু মুখ ফুটে আর কিছু বলতে পারে না।
বাবা বলে পড়া ছাড়িয়ে দেবে। দোকানে খাটতে হবে। ভাতের চেষ্টা করতে হবে। মোটা ভাত মোটা কাপড় অভ্যাস করতে হবে। মা বলেন মোটা ভাত মোটা কাপড় ছাড়া আনন্দ আর কি পেয়েছে শুনি? একটা কোথাও বেড়াতে যায় নি, না চিড়িয়াখানা, না মিউজিয়ামে। বাড়িতে বসে বসে সব হয়?
বাবা রেগে গিয়ে বলে দোকানে বিক্কিরি নেই, তো চিড়িয়াখানায় ধেই ধেই করে নাচতে যাবি? আনুর ভাল লাগে না। কোনোক্রমে মাধ্যমিকটা পাশ করে নিয়ে ট্রেনে লজেন্স বিক্রি করবে। ঝাল টক মিষ্টি হরেক রকম লজেন্স।
মা বলে কেন বাবা, তোকে অনেক পড়তে হবে। অনেকটা। অমন অলুক্ষুণে কথা বলিস না। মায়ের চোখ দিয়ে টপ টপিয়ে জল পড়ে। মায়ের চোখের জল দেখে আনুর রাগ হয়। তোমরা রোজ ঝগড়া করো, আমার ভাল্লাগে না। আমি যেখানে খুসি চলে যাবো।
মা বলে আমি ঝগড়া করি? তোর বাবা বাড়িতে এসেই হম্বিতম্বি শুরু করে। পুরুষ সিংহ এসেছেন একটা। এদিকে দোকানে যারা বাকি রাখে, তাদের দুটো কথা বলার মুরোদ নেই। আনু ঘাড় শক্ত করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। খদ্দেরকে বাকি দিতেই হয়। নইলে যে বাকি দেবে, তার দোকানেই খদ্দের চলে যাবে। আজকাল সবার দিন খারাপ যাচ্ছে। পাড়ার মধ্যে দোকান। মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হবে না?
রান্না সেরে মা কাছে এসে বসে। বলে ভালো করে পড়। পড়ার সময় অন্য দিকে মন দিবি না।
আনু মুখ গোঁজ করে থাকে। বাবা দোকান থেকে ফিরলে বই ফেলে চট করে পা ধোবার জলের বালতি আর মগ নিয়ে বাবার কাছে যায়। আড় চোখে দ্যাখে মা হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছে। তাকে দেখে বাবা খ্যাক করে ওঠে। বলে পড়তে বসিস নি বাঁদর? আনু একটু কুঁকড়ে যায়। বাবা মা দুজনকেই সে সুখী দেখতে চায়। কিন্তু কোনো পথ পায় না।

মৃদুল শ্রীমানী। কবি। জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। প্রকাশিত বই: 'জমি জরিপ,  কি দেখে জমি বাড়ি কিনবেন,  ফ্ল্যাট ও বাড়ি,  তথ্য জানার অধিকার', 'মানুষের বাঁচার অধিকার সংক্রান্ত- মেয়েদের আইন', 'সে একটি পল্লবিত...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ