প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
আমরা
এখন গরমকাল। পাখি ডাকতে না ডাকতেই আকাশে সূর্যটা দপ করে জ্বলে ওঠে। তারপর সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারে। সারাক্ষণ যেন আকাশে সূর্যটা গনগনে তাওয়ার মতো ফুটে আছে। আমার বয়েস পনের। সামনের বছর মাধ্যমিক দেব। বোনের দশ। বোনের দুবছর বয়েসে বাবা সাইকেল নিয়ে লড়ির সঙ্গে এক্সিডেন্টে মারা যায়। আমাদের ঘরে কোনও সিলিং ফ্যান নেই। সেই আদ্যিকালের একটা টেবিল ফ্যান আছে। তা প্রায় কারও গায়েই হাওয়া লাগে না। মা বলেছে সামনের মাসে একটা সিলিং ফ্যান কিনবে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা সেবা নার্সিংহোমে আয়ার কাজ করে। মাঝে মাঝে মাকে তাই নাইট ডিউটি করতে হয়। সে সময় বোন আর আমি বাড়িতে থাকি। আমাদের খুব ভয় করে, কিন্তু মাকে বলি উল্টোটা। আমরা ভয় লাগলে দুই বোন তারস্বরে চেঁচিয়ে পড়তে থাকি। কখনও কখনও গানও গাই – জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে, ভারত ভাগ্যবিধাতা ……………………।
আমার বোন শোকেসে রাখা পুতুলের মতো সুন্দর। বরং আমিই একটু ঢ্যাঙা প্যাকাটি ধরনের। গায়ের রঙও শ্যামলা। তবে আমার কোমর পর্যন্ত এক ঢাল চুল আছে। আর সকলে বলে আমার চোখদুটোও নাকি অদ্ভুত সুন্দর। ভাসাভাসা। মায়াময়। সবসময় যেন জল টলটল করে। ক্লাস নাইন থেকে আমাদের স্কুলে শাড়ি পড়তে হয়। লালপেড়ে সাদা খোলে। আমার এখনও পর্যন্ত কোনও নতুন শাড়ি কেনা হয় নি। নাইনে ওঠার পর দিদা দিদার দুটো পুরনো শাড়ি পাঠিয়েছিল। সেই দুটো শাড়িতেই চলে যাচ্ছে। কেসজুতো এক জোড়া। আমারই। তোলা আছে। খেলা পরীক্ষার দিন বার হয়। চক দিয়ে সাদা করে পরি। বোনের খেলা পরীক্ষার দিন মা ন্যাকড়া গুঁজে জুতোর ভেতরটা ছোট করে দেয়।
আমরা দু’বোনই এক থেকে দশ জনের ভিতরে থাকি। আমরা দুবোনই পাশ করলে পুরনো বই কিনি। হাফ দামে। কিছু কিছু নতুন বই দিদিমণিরাও দেন। স্কুলে এখন আমরা রোজই আইসক্রিম দিয়ে টিফিন করি। বুটওয়ালা দাদু স্কুলের মেইন দরজার ওপারে আইসক্রিমের হলুদ বাক্স আর তেলি গুড়ের চাকির মতো চীট নিয়ে বসে। কাঠিওয়ালা লাল, কমলা আইসক্রিম। দশ পয়সা থেকে দু’টাকা পর্যন্ত। দু’টাকারটা শুধুই মালাই। নরম। তুলতুলে। মা’র মনটার মতো। বুটওয়ালা ছেনি হাতুড়ি দিয়ে চীট ভাঙে। দারুণ খেতে। নুন নুন মিষ্টি মিষ্টি। বোনের আগে ছুটি হয়। ও চলে আসে। আমি একটু পরে বাড়ি ফিরলেও বোন খায় না। আমার জন্য অপেক্ষা করে। আমি ফিরলে দুই বোন এক সাথে গোগ্রাসে ভাত খাই। ভাতে জল দেওয়া থাকে। মা বলে ভাত আমানি হলে তা খেলে শরীর ঠাণ্ডা থাকে।
মা বিকেলবেলা যেদিন নাইট ডিউটি থাকে আমাদের দুবোনকেই ফিতে দিয়ে চুল বেঁধে দেয়। আমার আবার ফিতে ফ্যাসিনেশান আছে। লাল, কালো, সাদা, গোলাপি। বিকালে দুবোনই পুকুরে গা ধুতে যাই। বড়ো দিদি হওয়ার সুবাদে এইবার বোনকে আমি একটু শাসন করি। ওর জন্য বরাদ্দ বালতিতে জল তুলে মগে করে গায়ে ঢালা। আর আমি পুকুরের এপার ওপার দাপিয়ে সাঁতার কেটে বেড়াই। বোন নাকে কাঁদে – দাঁড়া মাঁ আঁসলে বঁলে দেঁব। কিন্তু বলে না। সমস্যা হয় সাঁতার দিতে দিতে মাঝে মাঝে মাথাটা টুপ করে ডুবে যায়। গোঁড়াকষা বাঁধা চুল ভিজে সপসপে। মার কাছে তখন বকুনি, মাঝে মাঝে চপেটাঘাতও জোটে।
ওরা
ওরাও দুবোন। বড়ো জন আমার সাথেই পড়ে। ছোট জন বোনের সাথে। ওদের প্রত্যেক ঘরে সিলিংফ্যান তো আছেই। একটা ঘরে এসি লাগানো আছে। এমন কি ওদের রান্নাঘর, বাথরুমেও এক্সজস্ট ফ্যান লাগানো আছে। এই গ্রীষ্মের দাবদাহও তাই ওদেরকে শীতল করে রাখে। ওদের বাবা, মা দু’জনই আছে। ওরা দু’বোনই খুব রোগা – রোগা। ওদের মা বলে, খাওয়া নিয়ে ওদের নাকি খুব ঝামেলা। ওদের দেখলেই মনে হয় অপুষ্টিতে ভুগছে। ওদের মা বলে খাওয়া নিয়ে এতটাই ঝামেলা যে ওদের নাকি ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতে হয়।
ওদের ছোট বোনটা একেবারেই ভালো না। ও স্কুলের ফাংশানে কোনোদিন মেইন পার্ট পায় না। তবে ওদের মা দুই বোনকে বিউটি পার্লার থেকে হাল ফ্যাশানের চুল কাটিয়ে আনে। দামী দামী বিদেশী সাবান ব্যবহার করে। ওরা স্কুলে যায় বাঁধা রিক্সা করে। আমরা যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘাম মুছতে মুছতে যাই, ওরা আমাদের পাশ দিয়ে হুশ করে বেড়িয়ে যায়। ওরা টিপটাপ স্কুল ড্রেস পরে স্কুল যায়।
ওরা দুজনেই কোনরকমে পাশ করে নতুন নতুন ক্লাসে ওঠে। বড় বোনটা তো গতবারে প্রমোটেড অন কনসিডারেশনে নতুন ক্লাসে উঠেছে। তবু প্রতি বছর, ঝকঝকে নতুন বই কেনে। ওরা রোজ দুটো টিফিন বাক্স ভর্তী করে রকমারি খাবার আনে। বন্ধুদের দিয়ে ফেলে ছড়িয়ে খায়। বুটওয়ালার আইসক্রিম নাকি ড্রেনের জলে তৈরি, তাই ওরা খায় না। যেহেতু ওদের বাঁধা রিক্সা তাই ছোট বোনটা ছুটির পরে দিদির জন্য অপেক্ষা করে। একসঙ্গে ঘরে ফেরে। বাড়ি এসে রোজ ওরা গ্লুকোজের জল খায়। তারপর লুচি, পরোটা, ডিম টোস্ট। ওদের মা বাড়িতে থাকে। তাই ওদের কোনোদিন একলা থাকতে হয় না। নির্ভয়ে ঘুমায় ওরা। ওরাও এসে রোজ গা ধোয়। বাথরুমে সাওয়ার ছেড়ে দিয়ে। মাথার চুল ভিজে গেলেও ওদের কোনও সমস্যা হয় না। কারণ ওদের চুল শোকানোর মেশিন আছে। তাই ওরা ওদের মায়ের কাছে বকুনি, মার কোনটাই খায় না।
আমরা
এখন বর্ষা। কোন কোনদিন লাগাতার ধর্মঘটের মতো বৃষ্টি। হোক না, তাতে আমাদের কোন দাবীদাওয়া নেই। বরং স্ফূর্তিতে টইটম্বুর আমরা দুই বোন। কারণ আমাদের স্কুলে যেতে হয় না। বাড়িতে থেকে বাঁদরামি। আর মা ডিউটিতে চলে গেলে আমাদের পাখনা গজায়। এ সময় পুকুরের উপরের সিঁড়িতেও জল উঠে আসে। গামছা আর খালি সুলেখা কালির দোয়াত নিয়ে তে’চোখা মাছ ধরার অভিযান। বোন দোয়াত হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। আর আমি জেলেদের জাল পাতার মতো করে গামছা ছড়িয়ে দেই জলে। মাছ উঠলে সেটাকে চালান করে দেয় বোন দোয়াতের ভেতরে। মাছটা এক-দুদিন মতো বাঁচে। ঘরে এসে দোয়াতের ভেতর আমরা দু’চারটে ভাত ফেলে দিই। আমাদের একোয়ারিয়াম।
সর্দি, কাশি, জ্বর এসব আমাদের প্রায় হয়। নার্সিংহোমের ডাক্তার বাবুদের বলে মা ওষুধের ফ্রি স্যাম্পেল নিয়ে আসে। তবে লাগাতার বাড়ি থাকলে অনেকক্ষণ পড়াশোনা করতে হয়। এটাই সবথেকে অশান্তি। আমাদের একটা ঢাউস ছাতা আছে। সেটা নিয়ে মাঝে মাঝে আমরা দুবোনে গুঁতোগুঁতি করতে করতে যাই। আধাআধি ভিজে যাই। বোনের ছুটি হয়ে গেলেও আমার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, কারণ ছাতা একটা।
মা প্রায় বর্ষাকালে চালে-ডালে বসায়। বোনের তো খিচুড়ি খাওয়ার ব্যাপারে লা-জবাব। আমার বরং একটু প্যাকনা আছে। খিচুড়ির সাথে ডিম ভাজা, একটু চাটনি না হলে খেতে পারি না। ইলিশ মাছ হলে তো সেদিন আমাদের মহাভোজ। বর্ষায় প্রায় লোডশেডিং হয়। আমরা হ্যারিকেন নিয়ে পড়তে বসি। কিছুক্ষণের মধ্যে হ্যারিকেনে শিস উঠে একদিক কালো হয়ে যায়। তখন আমি আর বোন সেই আলোর ভাগ নিয়ে হ্যারিকেনটা টানাটানি করি। মা বাড়ি থাকলে কাঁচ মুছে দিয়ে ফের জ্বালিয়ে দেয়।
রাতে টিনের চালে বৃষ্টির আওয়াজে কান পাতি। মেঘ ডাকলে বোন ভয় পায়, চুপ করে থাকে। আমার আকাশে বিদ্যুতের আলোর ঝলকানি দেখতে খুব ভালো লাগে। মা আমাদের দুই বোনের গায়ে হাত রাখে। আসতে আসতে বলে, জানিস ঐ আলোটাকে বলে – অতিভী। আমি জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে অতিভীকে দেখি। বোন রেগে যায়। বলে – তোর সব ব্যাপারে বেশী বেশী সাহস তাই না? বোন জানলার ফাঁকফোকরে ন্যাকড়া গুঁজে দেয়।
ওরা
বৃষ্টির জল ওদের কখনও স্পর্শ করে না। কখনও বা দু’য়েক ফোঁটা গায়ে পড়লেও ওদের মাখমের মতো শরীরে তা পিছলে যায়। নাগাড় বৃষ্টিতেও ওরা স্কুলে যায়। ফুলতোলা জলরঙের রেইনকোর্ট পরে। তাছাড়াও ওদের দুবোনের হাতে দুটো রঙ্গিন ফোল্ডিং ছাতা থাকে। রিক্সায় বসে সামনে ওরা প্লাস্টিক টেনে দেয়। বৃষ্টি ওদের ছুঁতেই পারে না। রেইনি ডে মাথায় করে বাড়ি ফেরে। তবু ওরা ঘোর বর্ষাতেও রোজ স্কুলে যায়।
ওরা কখনও পুকুরে গিয়ে স্নান করে না। ওদের বাড়ির ডাইনিং-এ ইয়া বড় পেল্লাই সাইজের সত্যিকারের একোয়ারিয়াম আছে। তাতে চোখধাঁধানো বিস্ময়। দেখলে মনে হয় গোটা সমুদ্রটাই বুঝি তুলে আনা। টলটলে নীল জলের তলায় কি সুন্দর সব নুড়ি পাথর। আর মাছগুলো – উফ কি সুন্দর যে সব দেখতে লাল, নীল, হলুদ, কালো। তাদের আবার হরেকরকম নামও আছে। ওদের বাবা মাছের খাবার কিনে আনে।
ওদের নাকি সারাবছরই ঠাণ্ডা লাগার ধাত। তাই ওরা বার মাস চবনপ্রাশ খায়। সর্দিকাশি কিছু হলে ওদের হাউজ ফিজিসিয়ান এসে ওষুধ দিয়ে যায়। ওদের ইনভার্টার, চার্জার লাইট সবকিছু আছে। তাই লোডশেডিং হলেও ওরা টেরই পায় না। যেমনকার সবকিছু চলে তেমনভাবেই চলে। আলো ছাড়া ওরা এক মুহূর্ত থাকতে পারে না।
বর্ষাকালে ওরা মাঝেমধ্যে খিচুড়ি খায়, তবে ভুনা খিচুড়ি। গোবিন্দভোগ চাল আর সোনামুগ দিয়ে তৈরি। অনেকটা ঘি দিতে হয় শুনেছি। ইলিশ মাছ ওরা তো প্রায় খায়। সন্ধ্যাবেলা প্রায়দিন ওরা কিচেন কিং দোকানের তেলে ভাজা খায়। ওদের ছাদের ঘরে বৃষ্টির শব্দ শোনা যায় না। ওদের জানলায় ফাঁকফোকর না থাকায় কোনও বিদ্যুতের আলো দেখতে হয় না। ওদের ছোটবোনটা নিশ্চিন্তে ঘুমায়। ভয় ওকে স্পর্শ করে না। বড়ো বোনটা ছাদের ঘরের ওমে শরীরের ওম নেভাতে জাল বোনে। কতশত সুখস্বপ্নের জাল।
আমরা
শরৎ আর হেমন্ত এই দু’টো ঋতু এমনই যেন একে অপরের শরিক। বিনি সুতোয় গাঁথা গোড়ের মালা। শিউলি ঝরার টুপটাপ কান্না। মন কেমন করা রোদ নাতিদীর্ঘ বেলা মনে করিয়ে দেয় মা দুর্গা আসতে আর খুব বেশী দেরী নেই। সবার মনে আনন্দের চমক, খুশীর বার্তা। মা যে নার্সিংহোমটায় কাজ করে বোনাস দেয় না। হয়তো ভাবে আয়ার কাজ করতে আসা এই সব দুঃস্থ মহিলারা বোনাসের আওতায় পড়ে না। কিন্তু আমরা সে সব বুঝি না। আমাদের নতুন পোশাক লাগবেই। সাথে হার, চুড়ি, নেলপালিশ, টিপের পাতা হরেক কিসিমের জিনিস। আমাদের মায়ের ছোটবোন মানে আমাদের ছোট মাসী মহালয়ার দিন একটা দুধসাদা স্করপিও নিয়ে আসে। সঙ্গে আমাদের জামা বানানোর ছিটকাপড়। এক বাক্স হলদিরামের লাড্ডু। একটা মাঝারি সাইজের হটপটে চিলি চিকেন। মা’র জন্য একটা হলুদ রঙের সিনথেটিক শাড়ি। মাকে ছোট মাসী বলে – সিনথেটিক শাড়ি আনলাম। তোর ডিউটিতে যেতে সুবিধা হবে তাই। আমাদের ছোট মেসো দু’দুটো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক। মা নিচু গলায় বলে – আমার শাড়ির দরকার ছিল না। মেয়েটা টেনে উঠে গেল, এখনও পর্যন্ত একটা লালপাড় শাড়ি পেল না। ওর একটা নতুন শাড়ি হলে ভালো হত। ছোট মাসী মাকে বোঝায় – একটু কষ্ট করে পড়াশোনা করলে আখেরে ফল ভালো হয়। কেন জানিনা চিলি চিকেনের স্বাদই পেলাম না। হয়তো আমাদের দু’বোনের স্বাদকোরক নিতে পারে নি।
আমার খুব শখ ওদের বড় বোনটার মতো একটা আনারকলি চুড়িদার বানাবো। মা শ্রীকৃষ্ণ বস্ত্রালয় থেকে লাল রঙের সুতির ভয়েলের ছিট কিনে আমাদের দু’বোনকে দুটো ফ্রক বানিয়ে দেয়। লাল রঙের কুচি দেওয়া ফ্রকে আমার বোনকে পুরো শোকেসের পুতুলের মতো দেখায়। বোন আমার আনারকলি চুড়িদার প্রীতির কথা অনেক আগে থেকেই জানে। তাই বলে – দিদি ছোট মাসী যে ছিটকাপড় দিয়ে গেল তা দিয়ে আমি একটা টেপ বানাই, তাহলে তোর চুড়িদার হয়ে যাবে। বোন টেপ বানালেও বাকি ছিটকাপড়টায় চুড়িদার হয় না। স্কার্টব্লাউজ হয়ে যায়। বোন তারপর একবার ছোট মাসীর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দেখে ওদের বাথরুমের জানলার পর্দা আর টেপ জামার কাপড়ের ছিটটা হুবহু এক।
ওরা
ওদের মহালয়া থেকেই উৎসবের শুরু হয়ে যায়। ওখানকার সবথেকে বড়ো দোকান মহামায়া বস্ত্রালয়ে কতবার যে যাচ্ছে তার ঠিক নেই। একই পোশাক যে কতবার বদলাচ্ছে তারও ঠিক নেই। রং ডিজাইন নিয়ে খুঁতখুঁতানি যায়ই না। প্রতিবছরই হালফ্যাসানের যা ওঠে তাই ওদের চাইই চাই। ওদের বাবার পেট্রলপাম্প আছে। প্রচুর আয়। শুনলাম বড়ো মেয়েটার তিনটে চুড়িদার, দুটো স্কার্ট হয়েছে। ওদের মেক-আপ বক্স আছে। এ বছর শুনলাম চন্দ্রাণী পার্লস থেকে সেট কিনবে। মামা, মাসী, পিসি, কাকারাও ওদের নতুন পোশাক দেয় পুজোতে। পুজোর সময় ওদের বাড়িতে অনেকে আসে। রোজই ওরা রেস্টুরেন্টের খাবার খায়।
ওদের মা শুনলাম এবার বেশী কিছু নেয় নি পুজোয়। দুটো তাঁত, একটা সিনথেটিক আর একটা কাঞ্জিভরম। কারণ ওদের মা এবার পুজোয় তিন ভরীর চূর বানিয়েছে। পুজোর পর ওরা কাশ্মীর বেড়াতে যাবে।
আমরা
শীত। এই সময়টা আমাদের সবথেকে খারাপ কাটে। যদিও ভূগোল অনুযায়ী উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্মপ্রধান দেশে শীত মানে রামধনু অথবা মাছরাঙ্গার ঠোঁটে ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়া কোনও মাছের অসাবধান মুহূর্ত। তবে আমাদের ভালো লাগে না। কারণ আমাদের মা এই সময় হাঁপানির টানে অসম্ভব কষ্ট পায়। সারারাত ঘুমাতে পারে না মা। যেদিন নাইট ডিউটি থাকে হাঁপাতে হাঁপাতে ডিউটি করে। যেদিন বাড়ি থাকে আমি গরম জল করে এনে খাওয়াই মাকে। তেল গরম করে এসে বুকে মালিশ করে দিই। বোন ওর ছোটো ছোটো হাত দুটো দিয়ে চুলে বিলি কেটে দেয়। এগুলোর সাথে হাঁপানি রোগের হয়তো কোনও সম্পর্কই নেই। মার আরাম হয় কিনা বুঝতেও পারি না। কিন্তু মুখে বলে – অনেকটা ভালো লাগছে। এবার তোরা শুয়ে পড়। কাল আবার স্কুলে যেতে হবে। বোন কাঁদে। ও খুব ভয় পায়। ও বরাবর একটু ভীতু স্বভাবের। একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়লেও বোন কিন্তু ঘুমায় না। মর্নিং ডিউটি থাকলে মা কনকনে ঠাণ্ডাতেও কাকভোরে উঠে পড়ে। আমাদের খাবার বানিয়ে ডাক দেয় – পড়তে বোস।
আমাদের মা উলকাঁটা দিয়ে ডিজাইন করে সোয়েটার বানিয়ে দেয়। বড়ো হওয়ার সুবাদে নতুন সোয়েটার সবসময় আমারই হয়। আমারটা ছোট হয়ে গেলে বোন পরে। অবশ্য এ নিয়ে ওর কোনও অভিযোগ নেই। বরং নতুন গুড়ের পাটালী, পুলি পিঠে, কাস্তেপোড়া, পাটিসাপটার দিকে ওর ঝোঁক। খেজুরের রসের পায়েস হলে তো লা জবাব। আমাদের মায়ের বড়ো শখ সাদা রঙের একটা কাশ্মীরি সালের।
ওরা
শীত ওদের কাছে বাহারি ফুল। ওদের সামনের খোলা জমিতে লোক লাগিয়ে এক পাশে মরশুমি ফুলের বাগান বানায় প্রতি বছর। আর একপাশে ব্যাডমিন্টনের কোর্ট বানায়। রাতে লাইট জ্বালিয়ে হইহল্লা করে ওরা খেলা করে। ওদের মাও কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে মাঝে মাঝে খেলতে নেমে পড়ে। রাতে ওরা রুম-হিটার জ্বালায়। নরম কম্বলের ওমে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে। পড়বার সময় ওদের মা ফ্লাক্সে কফি বানিয়ে টেবিলে রেখে যায়।
ওরা কেনা সোয়েটার পরে। উইঞ্চিটার, ব্যাগিস, জ্যাকেট কতরকম নাম। ওদের ছোটবোনটা পিঠেপায়েস ছুঁয়েও দেখে না। শীতভর ওরা কেক খায়। ওদের মা সকালে ইমার্সান হিটারে জল গরম করে ওদের ডাকে। শীত ওদের ছুঁতেই পারে না। ওদের মা কাশ্মীরি শাল বিক্রেতার কাছ থেকে ফি বছর নতুন শাল কেনে।
আমরা
If winter comes can spring be far behind – সত্যি তাই। শীতের পিছুপিছু নাছোড় বসন্তও আসে। আমরা ভাঙা, আস্ত টব, মগ, ভাঁড় যেখানে যা পাই তাতে দু’বোন মাটি ভরে সাদাফুলের গাছ লাগাই। আমাদের মাথানিচু টিনের বারান্দাটা হলুদে হলুদ হয়ে থাকে। মা বলে, ফুল সে যে ফুলই হোক সবসময় সুন্দর। আমরাও খুব খুশীখুশী থাকি। দু’বোনই আমরা চাপুরচুপুর হয়ে হোলি খেলি। বোন বারান্দায় দাঁড়িয়ে পিচকারী দিয়ে রং ছোড়ে আর আমি সারা পাড়া টইটই করে ঘুরে রং খেলি। দেবাঞ্জনদা আমাদের দু’বোনের গালে আবির লাগিয়ে দেয়। আমি সারা পাড়া ঘুরতে ঘুরতে দেবাঞ্জনদার বাড়ি গিয়ে হাজির হই। দেবাঞ্জনদার দিদি আমায় রং মাখিয়ে ভূত করে দেয়। দেবাঞ্জনদা ম্যাথস অনার্স নিয়ে যাদবপুরে পড়ে। ওদের গোয়ালঘরের পেছনে আমায় নিয়ে গিয়ে হাত ধরে বলে – তুই আমায় কথা দে মাধ্যমিকে স্টার পাবিই পাবি। কিছু না বুঝেই বলি – বেশ কথা দিলাম। দেবাঞ্জনদার দিদি ডাক দেয় – দেবু বাবা বাজার এনেছে। দেবাঞ্জনদা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে দৌড় লাগায়। আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে কাঁপতে থাকি। দেবাঞ্জনদার মা চীৎকার করে – ধিঙ্গি মেয়ে পড়াশোনার নাম নেই, মার হাতে হাতে দুটো কাজ করে দেওয়ার নাম নেই, সারাদিন টং টং করে বেড়াচ্ছে। মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট না করলে কান টেনে ছিঁড়ে দেব। আজ আমাদের বাড়িতে খিচুড়ি, ঝুরো আলুভাজা, বেগুনি, ডিমের অমলেট, চাটনি, পাঁপরভাজা, মহাভোজ।
আমাদের মা সাদা থানের আড়ালে পাড়ার বউদের রঙের খেলা দেখে।
ওরা
ওরা রং খেলে না। রঙে নাকি ওদের অ্যালার্জি বের হয়। ওরা সারাদিন সিডি চালিয়ে হোলির সিনেমা, গান দেখে। ওদের বাবার বন্ধু এখানকার যমুনা হলের মালিকের ছেলে বুমবুম। বুমবুম আসে রং মাখাতে। বুমবুম এখানকার কলেজের পাশ কোর্সে পড়ে। ওরা মাখে কিনা জানি না। বুমবুমের বাবা-মাও আসে। প্রচুর খাওয়া দাওয়া চলে। বুমবুমের মা ওদের বড়ো বোনটাকে বলে – ইস পড়ে পড়ে চোখের নীচে কালি পড়ে গেছে। আইজেল লাগা। ভালো করে ঘুমা।
ওদের মা লালপেড়ে হলুদ খোলে শাড়ি পরে সবার সাথে রং খেলে। তবে শুধু দেবাঞ্জনদাকে আমাদের বাড়িতে দেখে মনে মনে বলে – ইস অমন একটা ছেলেকে যদি …………।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..