আমাদের প্রায়োরিটি

মাসকাওয়াথ আহসান
প্রবন্ধ
Bengali
আমাদের প্রায়োরিটি
বাংলাদেশের দেবশিশুরা ডেঙ্গিতে মরে গেলে আমাদের কী!
ঠিক যেরকম দুই ইঞ্চি চিন্তার মাপে সহমত ভাই সার্টিফিকেট দেয়, আপনি বিএনপির মতো কথা বলতেছেন, রহমত ভাই চুকচুক করে বলে, শেষ পর্যন্ত আপনি আওয়ামী লীগ, শিবব্রত দাদা ঘাড় গুঁজ করে বলে, আপনার প্রগতিশীলতার পৈতে বাতিল হয়ে গেলো; শরিয়ত ঠিক সেইরকম দাডি ঝাঁকিয়ে বলে, আপনি নাস্তিক।
আসলে ফেসবুকের এক্সরে মেশিনে লেখা দিয়ে এই চারটি প্রাণীর এক্সরে রিপোর্ট জমা করতে থাকি। মধুমতীর খালে ইঁচা মাছ ধরে পুঁটিমারা স্কুল ও মাদ্রাসা থেকে দুটি সার্টিফিকেট জোগাড় করে, জিনস টিশার্ট পান্জাবি কপালে তিলক আর চোখে সুরমা দিয়ে, পেটে পার্টির দুটো সেদ্ধ ভাত পডলেই; এদের আত্মবিশ্বাস চাগান দেয়।
পট কইরা রাইগা মুখে যা আইলো কইলো আর কী! পেছনে প্রত্নযুগের রাজা বাদশার ঔপনিবেশিক বৃটিশ পাকিস্তানের চাবুকের দাগ! রাগ দেখাতে আসে লেখকের ওপর।
দাক্ষিণাত্যের ক্ষরায় না খেতে পেয়ে সমৃদ্ধ বাংলায় ঢুকে পড়েছিলো যে ঠগীরা, তারাই সংঘবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপি শিবসেনা ও শিবির হয়ে; বিরাট তালেবর একেকজন।
বৃটিশেরা রেললাইন বানালে তার ধারে বসে ঠগী দাদুরা আজ কোথায় হাট বসবে, কোথায় সম্পন্ন কৃষকেরা ফসল বেচে ফিরবে, তাঁতীরা বস্ত্র বিক্রি করে ফিরবে, কারিগরেরা কোন পথ দিয়ে মালামাল হাটে নিয়ে যাবে এসব নক্সা কষতো প্রাত:ক্রিয়ার ব্রান্ম মুহূর্তে। সেই ঠগীর জীন সহমত রহমত শিবব্রত শরিয়ত ফেসবুকের মন্তব্যের লাইনের ধারে দাদু বিলাস করে।
কোথায় কোন সম্পন্ন মানুষকে রুমালের ফাঁস পরালে পার্টির সাইবার গ্যাং এ নামডাক হবে , কোনখানে গালাগালির বিনিময়ে খাদ্য,বালিশ প্রকল্পের বখরা, কোথায় চাঁদাবাজি, কোথায় কোন ভাইয়ের সংগে সেলফি তুললে একটু জাতে ওঠা যাবে, একটু চেতনা কিংবা জাতীয়তাবাদের শীৎকার দিলে দেশের মালিক সাজা যাবে কোথায় ধর্মের স্বপ্রণোদিত ম্যানেজার সাজলে আত্মপরিচয়ের সংকট কেটে যাবে!
তাই কী হয়! কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের যে আত্মপরিচয় তা তো পরিশ্রমের ফসল। একজন শিক্ষক লেখক বিজ্ঞানী দার্শনিকের আত্মপরিচয় তার কাজের মধ্যেই মিশে থাকে।
শুধু নাম পরিচয়হীন এই দলান্ধ ও ধর্মান্ধ বখাটে ঠগীগুলো। এদের কেউ কেউ লুন্ঠনের টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট নেয় অশিক্ষিত করে তোলার শিক্ষা কার্যক্রমে।
বাংলাদেশের প্রত্যন্তের স্বশিক্ষিত মানুষের সংগে অনেক গল্প করে দেখেছি তাদের চিন্তার আলো পরিশ্রমের পবিত্রতা হৃদয়ের ঔদার্য্য, শিষ্টাচারের স্নিগ্ধতা।
এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি আমাদের বিদ্যালয় ও মাদ্রাসাগুলো আসলে জীবনের স্কুলে শিক্ষিত শিশুদের অশিক্ষিত বানায়। নানারকম অশুভ ধান্দা শেখায়। অশালীন ও অমার্জিত করে। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাই পৃথিবীর দ্রুততম দুর্নীতিবাজ ঠক প্রতারক বিদূষক তৈরি করেছে। কাজে ঠন ঠন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে পটু ইঁদুর জন্ম দিয়েছে।
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলো আসলে দেশপ্রেমহীন মানবতাহীন কোলাবরেটর বা মিডলম্যান তৈরির আস্তানা। সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলা আর নির্লজ্জ তেলান্জলি দেবার পিঁপড়াবিদ্যা শেখায় সেখানে।
“প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছি” অনুষ্ঠানে ডেঙ্গি নয়, ডিম, আওয়ামী লীগ আমলের সর্বব্যাপী লুন্ঠন নয়, ইউনুসের ট্যাক্স ফাঁকি নিয়ে সেকী বিদগ্ধ আলাপ প্লট সাংবাদিকদের। দশবছর আগে মুখ শুকনা করে যারা ঘুরতো; তাদের সেকি চেকনাই মুখমন্ডলে।
বাপ দাদা টমটম গরুর গাড়ি নিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতো, নিজে মুড়ির টিন বাসের হাতল ধরে ঝুলতো তেল চিটচিটে ঘামের গন্ধে আর মুখে ক্ষুধার গন্ধে উন্মাতাল হয়ে, এখন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গাড়ি লাগে শীতাতপ লাগে লোকের মুখে স্যার ডাক শোনা লাগে। ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে যারা বিশ্ববীক্ষা না খুঁজে যারা বিসিএস গাইড মুখস্থ করতো।
মেয়েদের হলে রুম থেকে আলু ভর্তার বল বানিয়ে জাগলিং করতে করতে যারা ডাইনিং হলের ডালপানিতে সাঁতার কেটে গাপশিলাইতো, সে ধমক দিয়ে বলে, স্যার বলবেন, কে আপনার আপা!
দুটি সার্টিফিকেট একটি চেয়ার একটি হলুদ রঙের তোয়ালে এতোই অহংকার শিক্ষা দেয় যে দেশের মানুষকে প্রজার মতো ভেবে নিয়ে প্রভু সাজে এরা। একজন বয়েসী মানুষকে ধমক দেবার সময় একবারও নিজের বাপের চেহারা মনে পড়ে না!
বৃটিশ পাকিস্তানের পুলিশ এতো নিষ্ঠুর নরভোজি কী ছিলো! ওরা হয়তো ভাতের হোটেল খোলেনি কিন্তু কথায় কথায় অস্ত্র উদ্ধারে যায়নি অসহায় প্রজাদের নিয়ে।
পৃথিবীর কোন দেশের ডাক্তার উপায়হীন রোগীর সংগে এতো দুর্ব্যবহার করে, কোথায় ইন্জিনিয়ার এরকম কমিশন খায়, কোথায় কেরানি ফাইল এভাবে আটকে চাঁদাবাজি করে!
এতো নির্লজ্জতা শিক্ষা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেয়, যে ভোটবিহীন নির্বাচনের এমপি বুক ফুলিয়ে ঘুরে। মন্ত্রী পতাকা উড়িয়ে শাসিয়ে বেড়ায় দিনমান।
পৃথিবীর কোন দেশের আইন মন্ত্রীকে অস্ত্রের ভয় দেখাতে দেখেছেন কখনো!
পৃথিবীর কোন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শুনেছেন, কোথায় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কে বলেছে সিন্ডিকেট আছে!
ফ্রান্সের যে রাণী ক্ষুধার্ত মানুষের রুটির অভাব দেখে বলেছিলেন, ওরা কেক খেলেই তো পারে!
সারাক্ষণ ওপর চালাকি প্রতিহিংসা দলীয় উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার ফন্দি গলার জোরে ফট ফট করে অযৌক্তিক কথা বলা, এসবই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ফজিলত।
আমাদের ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি পশ্চিমে স্বাস্হ্যপ্রদ পরিবেশে থাকে তাই বাংলাদেশের দেবশিশুরা ডেঙ্গিতে মরে গেলে আমাদের কী!
আমরা নরভোজি, আমাদের প্রায়োরিটি দ্রব্যমূল্যের আগুন থেকে মানুষ বাঁচানো নয়; আমরা ক্ষুধার্ত, আমাদের প্রায়োরিটি, হাউ মাউ খাউ, নোবেল বিজয়ী ইউনুসের গন্ধ পাও!

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..