আমার আম্মা

শাহীদ লোটাস
গল্প, নন ফিকশন
Bengali
আমার আম্মা

আমি আবার সঙ্গে ছিলাম ৭/৮ বছরের মতো সময় । বাকিটা সময় আব্বা আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগেই রাখেননি । দিনের পর দিন চলে গেছে, মাসের পর মাস পার হয়েছে, বছর পররে বছরো গেছে, আমার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে, আমি কি ভাবে চলছি, আমরা কেমন আছি, কিছুই জানার আগ্রহ দেখাননি তিনি ।

কিন্তু আম্মা আম্মাকে ছাড়া একটি দিনও থাকেননি, কোন না কোন ভাবে আম্মা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, মৃত্যুর সময়েও আম্মা আমার বুকে মাথা রেখে শুয়েছিলেন ।

দুই

আমি খেতে বসলেই আম্মা অযথা আমার পাশে বসে থাকতো, আম্মার এই বসে থাকাতে আমি বিরক্ত হতাম খুব । আম্মা এটা বুঝতে পেরে আমার আশপাশে অযথা ঘোরাঘুরি করতো, যেন সে আমার জন্য বসে নেই বা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত আছে আর তার এই ঘুরাঘুরির মাঝেই আমার থালায় বেশী ভাত বেশী তরকারী দিয়ে দিতো ফাঁক পেলেই, আমি খুবেই বিরক্ত হতাম আম্মার এই কর্ম কাণ্ডতে । আম্মা আমার এই বিরক্তিতে কথা বলতো না একদম, মাঝে মাঝে খুব ব্যস্ততা দেখাতো বা একটু হাসতো, সত্যি বলতে আম্মার উদ্দেশ্য থাকতো আমাকে বেশী বেশী খাওয়ানোর। আমি টোকা লবণ খাই না তবোও আম্মা আমার প্লেটে টোকা লবণ দিতো বা বার বার বলতো একটু লবণ দেই, একটু লবণ দেই ! এই নিয়েও আম্মাকে আমি এই সেই অনেক কিছুই বলতাম, বলতাম টোকা লবণে এই ক্ষতি হয় টোকা লবণে সেই ক্ষতি হয় । আম্মা আমার কথায় কখনো রাগ করতো না, খুব মনোযোগ দিয়ে শোনতো আর বিশ্বাসো করতো, আম্মার শোনার ভঙ্গি দেখে বুঝা যেত আমি যেন পৃথিবীর সব চেয়ে মূল্যবান কথা গুলো বলছি তার সামনে, আমার কথা গুলো যেন সবারই শোনা খুব দরকার ।

আজ আম্মা নেই, আমি কখনো ভাবতে পারিনি আম্মা আমার জীবনে থাকবেন না, চিরদিনের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন । ব্যাপারটি অবিশ্বাস মনে হয়, সত্যিই কি আম্মা আর নেই ? এই জীবনে আম্মা কখনই কি আর আসবেন না ?

তিন

আমি গোসল করতে গেলেই আম্মা গরম পানি নিয়ে হাজির হয়ে যেতো । আম্মা যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত তার নিজের জীবনেই যখন আশংকা জনক তখনো এই কাজ করতো আম্মা, নিজে নিজেই আমার জন্য গরম পানি করে নিয়ে আসতো, আমি যেন ঠাণ্ডায় কষ্ট না পাই সেই চিন্তাই ছিলো আম্মার মাঝে সব সময় । আমি কোথাও বেড়াতে গেলে আম্মা আমাকে ফোন করে সাবধান করে দিত, আমি যেন ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল না করি ।

আম্মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন ! তারপর থেকে আমি আর গরম পানি দিয়ে গোসল করি না । ঠাণ্ডা পানি দিয়ে যখন গোসল করি তখন খুব শীত লাগে, এই ঠাণ্ডা লাগতে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি আম্মা সত্যি সত্যিই আর পৃথিবীতে নেই ।

চার

আমি যখন রাতের খাবার আর অন্যান্য কাজ গুলি শেষ করে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে শুয়ে পড়েছি তখনো আম্মা জেগে থাকতেন, আমি ঘুমিয়ে পড়ার আগে সচরাচর আম্মা কখনই ঘুমাতেন না । আমি শোবার পর আম্মা আমার কাছে একবার হলেও আসতেন আমাকে দেখে যেতেন । আমার উপড়ে লেপ বা কাঁথা ঠিক আছে কি না তা পরীক্ষা করতেন, পরীক্ষার ফলাফল যাইহোক না কেন তিনি নিজের মতো করে আবার আমার চারদিকে লেপ কাঁথা সুন্দর ভাবে গুজে গুজে দিতেন, আম্মা এমন ভাবে সেই কাজ গুলো করতেন যেন বাইরের আবহাওয়া আমার লেপ কাঁথার ভেতরে কোন ভাবেই ঢুকতে না পারে, বাইরের আবহাওয়া ভেতরে না যাওয়ার মানেই হলো আমি উষ্ণতায় থাকবো, প্রচণ্ড শীতের মাঝেও আমার শরীর থাকবে গরম ।আমি ঠাণ্ডায় কোন কষ্টিই পাবো না । আম্মাই মশারি টাঙ্গিয়ে দিতেন সব সময়, তারপরেও আমি শোবার পর মশারিটাও ঠিক আছে কি না তাও আবার দেখতেন আর বিছানার চারিপাশ তোষকের নিচে এমন ভাবে মশারির ঝুলন্ত বাড়তি অংশটুকু ঢুকিয়ে দিতেন যেন মশা বা অন্যান্য পোকা কোন ভাবেই মশারির ভেতরে যেতে না পারে । সত্যি বলতে আমি যেন খুব আরামে ঘুমাতে পারি তার প্রক্রিয়া ছিলো আম্মার এই গুলো ।

আজ আর সেই ভাবে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমানো হয় না আমার, খুব ক্লান্ত লাগে, কোন ভাবে বিছানায় গড়ান দিতে পারলেই যেন হয় । মাঝ রাতে মশার কামড়ে কখনো কখনো ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার, আর তখন আম্মার কথা খুব মনে পড়ে ।

পাঁচ

শীতের সময় আমি যখন রাতে বাড়ি ফিরতাম আম্মা তখন আমাকে আমার লুঙ্গি আর গামছা দেখিয়ে দিত ভাজ করা লেপের ভেতরে । লুঙ্গি আর গামছাটা দিনে রোদ লাগানোর পর ভাজ করে এগুলো গরম লেপের ভেতরে রেখে দিয়েছেন আম্মা, আমি যেন গরম গরম পোশাক পড়ে খুব আরাম পাই তাই তিনি চাইতেন । আমার হাত মুখ ধোবার জন্য চুলার উপড়ে গরম পানিও রাখা হয়েছে তাও আবার বলে দিতেন আম্মা, আমি জানি তিনি প্রতিদিন এই কাজ গুলো করেন আর করবেনেই । আমি আম্মার এই অতিরিক্ত আদরে খুবেই বিরক্ত হতাম, এই বিরক্তির কারণে কোন কোন দিন আম্মার রেখে দেওয়া গরম পানি দিয়ে হাত মুখ ধুতামেই না আমি । আমি ঠাণ্ডা পানি দিয়ে হাত মুখ ধুচ্ছি এই দৃশ্য আম্মা দূর থেকে দেখতেন কিন্তু ভয়ে কিছুই বলতে পারতেন না আমাকে ।

আচ্ছা আম্মা তো তখন অনেক কষ্ট পেতেন তাই না ? আম্মা কি এই কারণেই আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন ???

ছয়

আমি আম্মার জীবনসংগ্রাম দেখে স্পষ্ট বুঝেছি, যে নারীর স্বামী থাকে না বা ভালো স্বামী কপালে জুটে না সেই নারী সমস্ত পৃথিবীকেই ভয় পায়, কোথাও তার জন্য তেমন স্বাচ্ছন্দ্য বা স্বাধীনতা থাকে না, তার মনে যতই স্বপ্ন থাকুক সেই স্বপ্ন সত্যি হবার আগেই সে হারিয়ে যায় চিরদিনের জন্য । আমি আমার আম্মাকে দেখে আরো বুঝেছি একজন নারী যতই সম্ভ্রান্ত পরিবারেই জন্মগ্রহণ করুন না কেন তার স্বামী যদি থাকে আমার বাবার মতো তবে তার পরিচিত অপরিচিত সবার কাছেই সে হয়ে যায় করুণার পাত্রী, তার গর্ভ-করার মতো অনেক কিছু থাকলেও তা শ্রবণ কারীকে তেমন আকৃষ্ট করতে পারে না । এই কারণেই বেচে থাকার জন্য যতটুকু শক্তি আর সুখ প্রয়োজন তা আমার আম্মার মতো নারীদের ভাগ্যে জুটে না কখনো ।

সাত

আমাদের নতুন বাড়িতে উঠার পর ( তখনো কাজ শেষ হয়নি) ঘরের চারদিক ছিলো ঘন ঘাসে আচ্ছাদিত, চারদিকের এমন অবস্থা যে তাকে আর বসবাস উপযোগী বাড়ি বলা যাচ্ছে না । আমি প্রতিদিন সকালে উঠেই কোদাল নিয়ে ঘাস পরিষ্কারের কাজে লেগে যেতাম যাতে আঙ্গিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে, কাজ বেশীক্ষণের না, তারপরেও এই সামান্য কাজেই আমার শরীর ঘেমে যেতো খুব, আম্মা এই সব দেখে খুব বিরক্ত হতেন, আর একটু পর পর আমাকে ডাকতেন, জোরে জোরে বলতেন, অযথা পরিশ্রম করার কি দরকার ? আবার তো ঘাস গজাবেই। আম্মার কথা উপেক্ষা করে আমার কাজ করেই যেতাম আমি, কারণ আমি চার অথবা পাঁচ দিনের একটি শিডিউল তৈরি করেছি, আমার শিডিউল অনুযায়ী কাজ করলে পাঁচদিন পর ঘরের চারপাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে, তখন আমাদের ঘরটি অনেক সুন্দরও লাগবে ।

নির্দিষ্ট সময় পর আমাদের বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কারও হয়ে যেতো, তখন বাড়ি আর ঘরটি সত্যি সত্যি সুন্দরও দেখাতো । আমি যখন আঙ্গিনায় হাঁটি তখন আম্মা আমার কাছে আসতেন, বলতেন, এখানে অমুক গাছ লাগাতে হবে, ওখানে তমুক গাছ লাগতে হবে, বলতে বলতে আম্মা আঙ্গিনার চারপাশ দেখিয়ে দিতেন আমাকে, আমি তখন আম্মার চোখে মুখে আনন্দ জোয়ার দেখতে পেতাম, আম্মার চোখে স্পষ্টই লক্ষ্য করতাম আম্মার চোখে স্বপ্ন আর প্রত্যাশিত সুখের স্রোত বইছে, ভবিষ্যতে কেমন সুন্দর হবে আমাদের বাড়ি তা যে আম্মা দেখতে পাচ্ছেন । এমন ভাবনার পর তখন তৃপ্তিও পেতেন আম্মা, সব কিছু নিজের মতো করে পরিচালনাও করবেন তা তিনি ঈশারা ইঙ্গিতে আমাকে বোঝাতেন ।

আজ আমাদের বাড়ি ঠিক আগের মতই আছে, বর্ষা হলেই ঘাস গজায়, পানি জমে, প্রতিদিন ঘর দোয়ার ঝাড়ু দেওয়া হয়না আগের মতো, কারণ আম্মা আর বাড়িতে নেই ।

আম্মার কবর সেদিন মেরামত করলাম, বর্ষার বৃষ্টির কাড়নে কবরের বুকের মাঝখানের দিকে ভেঙ্গে গেছে, মাটিও সরে গেছে কোথাও কোথাও । আমি অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে আম্মার কবর সমান করে দিলাম, অনেক গরম ছিলো সেদিন, আমার শরীর ঘেমে ঘাম ঝরছিল, আম্মা যদি বেচে থাকতেন তবে নিশ্চয়ই তিনি খুব বিরক্ত হয়ে আমাকে বলতেন, এই রোদের মাঝে তোকে এই সব করতে বলেছে কে ? কাজ নাইত কাজ করছস ? আমার কবর ভেঙ্গে-ছেতো কি হয়েছে ? আমি খোলা আকাশের নিচে ভালোই আছি, বৃষ্টি আসলে আসুক, তাতে কি ? তুই কষ্ট করিস না, যা ঘরে গিয়ে শোয়ে থাক… আমি কোন কারণে কষ্ট পেলে আম্মা আমার থেকেও বেশী কষ্ট পেতেন । এখন আমার কষ্টতে কি আম্মা আগের মতই কষ্ট পায় ?

আট

আমি কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলেই আম্মার টেনশন বেরে যেতো, গন্তব্যে পৌঁছানের আগেই আম্মা বেশ কয়েকবার ফোন দিতেন আমাকে, কোথায় আছি ? কি করছি ? কোন সমস্যা হচ্ছে কি না ? খেয়েছি কি না ? আরো নানান বিষয় জানতে চাইতেন, বলতেন আম্মা । গন্তব্যে পৌছার পর আম্মাকে যখন ফোন দিয়ে বলতাম, ‘ আম্মা আমি ঠিকঠাক পৌঁছেছি, পথে কোন সমস্যা হয় নি আমার,’ তখন আম্মা সুস্তি পেতেন । আম্মার এমন টেনশন করার কারণে আমি আম্মাকে মাঝে মাঝেই বলতাম, ‘ আমি কি ছোট্ট বাচ্চা নাকি ? কোথাও গেলে হারিয়ে যাবো ! না আমি প্রতিবন্ধি যে আমাকে নিয়ে এত টেনশন করতে হবে ?’ আমার কথা শুনে আম্মা তখন আমাকে বলতেন, তুমি ঘর থেকে বাইর হইলেই আমার আত্মা ধুকধুক করে, আমি চইমকা উটি, যহন তুমি বাসে থাকো তখন আমার শান্তি লাগে না, তোমার সাথে কথা না কইলে আমার কি রহম জানি লাগে, যখন হুনি তুমি ঠিকমতো গেছো তহন শান্তি লাগে আমার, বুকের ধুকধুকটা কমে ।

আচ্ছা, আমার জন্য আম্মার বুক ধুকধুক করতো কেন ? আমি যদি এক্সিডেন্ট করে মরে যাবো এই ভয়ে ? মানে মৃত্যুটা খুব খারাপ কিছু ? মৃত্যুতে ভয় আছে ? মৃত্যুই হলো দুনিয়াতে সব চেয় ভয়পাওয়ার মত বড় ব্যাপার ? আজ আম্মা নেই ভয় জাগানিয়া মৃত্যুতে আম্মা চলে গেছে মৃত্যুর ওপারে ।

এখনো কি আম্মার বুক আমার জন্য ধুকধুক করে ?

এখন কেন যেন আমার মনে হয় মৃত্যুর মত ভালো-ব্যাপার আর কিছুতেই নেই। মৃত্যুর মাধ্যমেই একদিন আমি চলে যাবো আম্মার কাছে । আমি আবার আম্মার কাছে যাবো, এই ব্যাপারটি ভাবতেই খুব ভালো লাগে আমার ।

নয়

বিকেল বেলায় আম্মা আমাকে কল করলেন, ফোন রিসিভ করতেই আম্মার হাউমাউ কান্না শুনতে পেলাম, আম্মার কান্না কিছুতেই থামে না, আমি আম্মার কান্না শুনে বিচলিত হয়ে গেলাম, বার বার প্রশ্ন করি, কি হয়েছে ? কি হয়েছে ? আপনি কাঁদছেন কেন ? আম্মা তার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার কারণে কিছুই বলতে পারেন না । কিছুক্ষণ পর আম্মার কান্না একটু কমলো, তখন আম্মা আমাকে বললো, সেদিন ডাক্তার যে আমাকে(আম্মাকে) টেস্ট করাতে দিছিলো, প্লাবন ( আমার ছোট খালাম্মার ছেলে ) আজ রিপোর্ট আনছে, রিপোর্টে আমার ডাইবেটিস ধরা পড়ছে, এত টুকু বলেই আম্মা আবার কান্না শুরু করলেন । আম্মার ডাইবেটিস ধরা পরেছে আম্মা এটা মেনে নিতে পারছেন না, আম্মা ভয় পেয়ে গেছেন, এখন তার কি হবে ? ডাইবেটিস রোগীদের-তো নানান সমস্যা হয়, শরীর স্বাস্থ্য ঠিক থাকে না এই ভয় আম্মাকে কাতর করে ফেলেছে । আমি ব্যাপারটি স্বাভাবিক করার জন্য হাসতে হাসতে আম্মা কে বললাম, আপনি এই ডাইবেটিস নিয়ে এত গাবরে গেছেন কেন ? ডাইবেটিস এখন প্রায় মানুষের হয়, এটা বড় কোন রোগ না, আমি পরীক্ষা করলে আমারো ডাইবেটিস ধরা পরতে পারে, এটা ভয়ের কিছু নাই, বরং ডাইবেটিস হলে ভালোই হয়, নিয়মের ভেতরে চলে আসে সব কিছু । আমি আরো এই সেই অনেক কিছু বলে আম্মাকে সান্ত্বনা দিলাম, আম্মা কান্না থামালেন, কিন্তু ভয়টা একেবারে দূর হলো না তার ।

তার মাস ছয় পরেই আম্মার ক্যান্সার ধরা পড়লো, আর তিন বছর আঠারো দিন পর আম্মা মারা গেলেন । মৃত্যুর আগে আম্মার ডাইবেটিস ছিলো না, ডাক্তার তখন আম্মার ডাইবেটিসের সব ওষুধ বন্ধ করে দিয়েছিলেন ।

দশ

আম্মাকে যখন কেমো থেরাপির জন্য হসপিটালে নিয়ে যেতাম তখন আম্মা খুব খুশী হতেন, তার হাসিমুখ দেখলেই বুঝা যেতো, তিনি সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন এই বিশ্বাস পাকাপোক্ত হয়ে যাচ্ছে আম্মার মনে। কিন্তু যখন কেমো থেরাপির শুরু হতো তখনেই বুঝা যেতো আম্মার কষ্টটা, স্যালাইন চলছে, আম্মার শরীর ফোলা ফোলা ভাব শুরু হয়েছে, যখন ইনজেকশন দেওয়া হয় তখন আম্মা বাচ্চাদের মতো কান্না করে, আম্মার চোখ বেয়ে অঝরে অশ্রু ঝরে, আম্মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার সারা জীবন গেছে কষ্টে, এখনো কষ্টই, আর কত কষ্ট পামো আমি, আমার কপালে কি সুখ নাই ?

নাহ আম্মার কপালে সত্যি সত্যিই সুখ লেখা ছিলো না, আম্মা মারা যান একটি অপুণ্য জীবন অতিবাহিত করে ।

এগারো

আম্মার অপারেশনের পর ৯ দিন ক্লিনিকে রাখা হয়, এই ৯ দিনের প্রায় সব সময় স্যালাইন, ইনজেকশন ও ওষুধ চলে আম্মার। মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য এই সব মেডিসিন বন্ধ থাকতো, কিন্তু এই বন্ধের অল্প সময়েই ঘটে যেতো অন্য ঘটনা, অধিকাংশ সময়েই দেখা যেতো আম্মার হাতের কে-নুলা বন্ধ হয়ে গেছে, রক্ত জমাট হয়ে গেছে , এই অবস্থায় স্যালাইন, ইনজেকশন যখন আম্মাকে আবার নতুন করে দিতে যেতো নার্স তখন আম্মার খুব কষ্ট হতো, প্রচণ্ড ব্যথায় আম্মার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকতো, তখন আম্মা শব্দ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন, এই রকম কষ্ট আম্মা আরো অনেকবার পেয়েছিলেন, আমি যখন খুব ছোট তখন আম্মার পেটে ব্যথা হয়, প্রচণ্ড ব্যথা, প্রায়-দিনেই দেখতাম আম্মা বিছানায় জড় সড় হয়ে শুয়ে আছে, শুয়ে শুয়ে কাঁদছে, সেই সময়ও সীমাহীন ব্যথার কষ্টে আম্মা অনেক কান্না করতেন আর সেই কান্নার ভেতরে পার হয় আম্মার বারোটি বছর । আম্মার জীবনে এত কষ্ট ছিলো কেন ?

বারো

আমি ছিলাম আম্মার দুনিয়া। আম্মার যত স্বপ্ন সব ছিলো আমাকে ঘিরে, আমাকে নিয়ে আম্মার স্বপ্ন ছিলো অনেক, আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন, দুনিয়ার সব স্বপ্ন । আমার স্ত্রী কেমন হবে, আমার স্ত্রীর সঙ্গে আম্মা কেমন করবেন, স্ত্রী যদি উল্টা পাল্টা করে আম্মা তাকে কেমন করে শাসন করবেন, আমার স্ত্রীকে আম্মা কেমন করে আদর করবেন, আমার স্ত্রী ভালো হলে আম্মা সেই মেয়েকে তার কলিজা কেটে দেবেন এই সব নানান কথা বলতো আম্মা আমার সঙ্গে, আম্মার দু চোখ জুরে ছিলো আমাকে নিয়ে যত স্বপ্ন ।

আমার সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের একটি জীবন, সহজ সরল সুন্দর একটি মেয়ে আমার স্ত্রী, আমার সন্তান এদের নিয়ে আম্মা, এই ছিলো আম্মার প্রত্যাশিত ভবিষ্যৎ ।

আম্মা আজ নেই , সব স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে আম্মাকে বিদায় নিতে হয়েছে । আমার মামা একদিন আমার বিয়ের জন্য আমাকে নিয়ে পাত্রী দেখত গিয়ে ছিলো, সেই দিন আম্মা আমাকে নিজ হাতে গোসল করালেন, সাবান ফেনা ফেনা করে আম্মা আমার শরীর ডলে ডলে সেই দিন গোসল করালেন নিজ হাতে । আমি যেন বিয়ে করতে যাচ্ছি এমন ভাব হলো আম্মার মাঝে । আম্মাকে নিয়ে সবাই হাসা হাসি শুরু করলো এই কারণে । আম্মাও মুচকি মুচকি হাসলেন তখন ।

তেরো

যতক্ষণ আমি বাড়িতে থাকতাম তার প্রায় সবটুকু সময় আম্মা আমার সঙ্গে এটা ওটা নিয়ে কথা বলতেন, কাছে আসতেন, এইটা সেইটা খাওয়াতেন । যদি কোন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বা বাসায় বেড়াতে যেতাম আর আম্মাও যেতেন সঙ্গে সেখানেও আম্মা এমন করতেন সব সময় । আমার সঙ্গে কথা বলা, আমাকে এটা ওটা খাওয়ানো, সেখানে বা আত্মীয়দের মাঝে কি কি ঘটলো তার সবটুকুর আমার কাছে বর্ণনা করা এ গুলোই যেন ছিলো আম্মার প্রধান কাজ । কিন্তু একটি দিন আম্মা আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি । আমার দিকে ফিরেও তাকান নি সেদিন । আমি অনেক বার আম্মার কাছে গিয়েছি তারপরেও আমার উপস্থিতিতে আম্মার ভাবাবেগের কোন পরিবর্তন হয়নি, আম্মা নীরবে শুয়ে ছিলো সেদিন । আম্মাকে কয়েকজন গোসল করালো, গোসলের পর ঘরের বাইরে আম্মাকে রাখা হলো, আম্মার চোখে সেদিন সুরমা দিয়েছিলো ওরা, আম্মাকে অনেক সুন্দর লাগছিলো, আর যোহরের নামাজের পর আমাকে কিছু না বলেই আম্মা চিরদিনের জন্য চলে গেলো ।

চৌদ্দ

আম্মা আমাকে মাঝে মাঝেই বলতো মানুষ যখন সুখে পরে তখনেই মারা যায়, সারা জীবন কষ্ট করে, কষ্ট বিষ্ট কইরা যখন কেউ সুখের মুখ দেখে তখনেই আল্লাহ তারে নিয়া যায় । আম্মার কথাটি আম্মার জীবনেই সত্যি হয়ে গেলো । আম্মা সারা জীবন কষ্ট করেছেন, সীমাহীন কষ্টের পর যখন সুখে পরার মুহূর্ত এলো ঠিক তখনেই আম্মা মারা গেলেন ।

পনেরো

আমার বাড়ি যাওয়া মানেই আম্মার কাছে যাওয়া। বাসে যখন উঠবো তার আগে বেশ কয়েকবার আম্মা আমাকে ফোন দিতো, বাস থেকে নামার আগেও ফোন আসতো আম্মার, বাড়ি পৌছাতে একটু দেরী হলেই আম্মা বার বার ফোন দিয়ে বলতো ‘ কোন পর্যন্ত আইছস, এত দেরী অইতাছে কে ?’ যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি ঘরে পৌঁছতাম ততক্ষণ পর্যন্ত আম্মা জেগেই থাকবো, ঘরে গিয়ে দেখতাম আম্মা আমার অপেক্ষায় বসে আছেন, অনেক কিছু রান্না করে রেখেছেন । কোন প্রকারে ফ্রেশ হয়ে আমি যখন খেতে বসতাম তখন আম্মা আমার সামনে বসে থাকতো নয়ত সামনেই থাকতো দাড়িয়ে। আমি আম্মার দিকে তাকিয়ে দেখতাম খুশিতে ঝলমল করছে আম্মার মুখ, আমি সব খাবার খেতে পারতাম না, আম্মা খুব জোরাজুরি করতো রাগা রাগিও করতো কম খেতাম বলে, আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আম্মা এটা ওটা জোর করে পাতে তুলে দিতো আমার।

এখন বাড়ি যাই! এখন আমাদের ঘর সব সময় তালা লাগানো থাকে, ঘরে কেউ থাকে না, খুব নির্জন থাকে বাড়িটা, আমি কবে আড়ি যাবো, কখন বাসে উঠবো, কখন বাস থেকে নামবো, তা জানার জন্য কেউ আমাকে আর ফোন করে না, বাড়ি যেতে যত রাতেই হোক কেউ বলে না ‘ এত দেরী অইতাছে কে ?’ বাড়িতে কোন খাবারো রান্না থাকে না আমার জন্য । কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে না রাত জেগে।বাড়ির চারপাশ গুট-ঘুটে অন্ধকার থাকে এখন যখন আমি বাড়ি যাই ।আমি অন্ধকারে একা একা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করি, মোবাইলের ক্ষীণ আলোতে সুইচ গুলো খুঁজি,আলো জালাই, হাতমুখ ধুয়ে না খেয়ে শুয়ে পড়ি, কারণ আমার জন্য কিছু রান্না হয় না এখন আমাদের ঘরে । শোবার পর ঘুম আসে না আমার, শোয়ে শুয়ে ভাবি আম্মা এখন কি করছে ? আম্মা কি কবর থেকে দেখছে আমাকে ?

ষোলো

মৃত্যুকে আমি আর ভয় পাই না, মৃত্যু এখন আমার কাছে এক যাত্রা বা ঘরে ফেরার মতো ব্যাপার মনে হয় । মনে হয় আমার মৃত্যু হলেই আমি আম্মার কাছে চলে যাবো, আম্মাকে আমি দেখতে পাবো, আম্মা আমাকে দেখে অনেক খুশী হবেন, এটা ওটা নিয়ে কথা বলবেন, আমি রাগারাগি করবো তারপরেও আম্মা আমাকে এটা ওটা খাওয়াবেন । আমাকে দেখলে আম্মা সব কষ্ট ভুলে যাবেন, আমাকে দেখার পরেই আম্মা প্রাণ খোলা একটা হাসি দিয়ে বলবেন ‘ লোটাস … !

শাহীদ লোটাস। বাংলা ভাষার লেখক, বাংলাদেশ-এর নেত্রকোনা জেলায় মোহনগঞ্জ থানায় ৩০ মে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ও ভারতে শাহীদ লোটাস-এর বেশ কয়েকটি উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লিখতে উৎসাহবোধ করেন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..