আমার কোনো কষ্ট নেই (পর্ব – এক)

দীলতাজ রহমান
গল্প, পডকাস্ট
Bengali
আমার কোনো কষ্ট নেই (পর্ব – এক)

জ্যৈষ্ঠ মাস। আম কাঁঠালের ম-ম ঘ্রাণ যেমন, তেমনই আবার ঠাঠা রোদ্দুর। নূপুর, দুপুর মাথায় করে কাজে নেমে পড়েছে। এইমাত্র চিঠি পেলো পরশু মঙ্গলবার এজাজুল বাড়ি আসছে তার বউ নিয়ে। নতুন বউ। বউটা এই প্রথম আসছে। খবরটা শুনেই বাড়িঘর আবর্জনার স্তূপ মনে হচ্ছে তার কাছে। তবু রক্ষে ক’দিন বৃষ্টি হচ্ছে না। হলে তো ভেসে যাবে পুরো ঘর। ঘরখানা এখন ভেঙে ঝরঝরে প্রায়। এখন আর পানিপড়া ঠেকিয়ে রাখা যায় না। বোল, বাটি, পাতিল, ঘরে আরো যা তৈজসপত্র আছে তার সব পেতে দিয়ে, যেখানে যেখানে পানি পড়ে, নূপুর আর অপু সবটুকু ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তবু ঠেকাতে আর কতটুকু পারে!

 

শীঘ্রই গল্পটির অডিও শুনতে পাবেন এখানে –

নূপুরের দাদার আমলের এ ঘরখানা। গাছগাছালিতে তা এমনভাবে চাপা পড়ে আছে যে, ঝড়বৃষ্টির ঝাপটাও একে এখন তেমন করে স্পর্শ করতে পারে না। বতরের সময় অন্যখানে ফসল শুকাতে হয়, উঠোনে রোদ আসে না। অচেনা কেউ কাছে এসে না দাঁড়ালে তার বোঝার উপায় নেই যে, এখানে এমন একখানা বসতি আছে। তাছাড়া বাবা কোনদিন এর চালখানার জোড়াতালির কাজটুকুও সারেনি। বেড়ার ফাঁকগুলো বড় হয়ে উঠলে ভাঙা কুলো, ছেঁড়া চাটাই, যখন যা পায় তাই দিয়ে জোড়া দিতে দিতে এখন জোড়াজুড়ির কাজও ভালোই পারে নূপুর। এসবের জন্য বাবাকে বা নূপুর দোষ দেয় কী করে! সে তো সংসারের এ ক’জনের পেট পালতেই নিজের নাভিশ্বাস তুলেছে মুখ বুঁজে। এখনো তা থেকে তার রেহাই নেই। বুবুকে বিয়ে দিয়েছিলো ভালো ঘর দেখে। প্রথম সন্তান প্রসব করতে মৃত্যু ঘটলো নূরীর। আর সেই থেকে জামাই হলো বিবাগী। অপুকে এ বাড়িতে আলাদা করে আনার কাজটি আর বাবাকে সারতে হয়নি। সে এসেছিলো তার মায়ের ন’মাসের পেটে বয়ে। সে কাজটিও অবশ্য নূপুরের বাবা, হুরমত মোল্লাই করেছিলো। সানন্দে। কারণ, তার প্রথম সন্তানের সন্তান হতে যাচ্ছে তাই সে আনন্দই ছিলো তার পৃথিবী ছাপানো।

হুরমত মোল্লার জীবিত ছেলে নেই। মরে ছেড়ে মেয়েও ছিলো দু’টি। নূরী আর নূপুর। দু’বোনের বয়সে ব্যবধান ছিলো বছর সাতেকের। জামাই তমিজ আলীর সঙ্গেও নূরীর বয়সের ব্যবধান ছিলো প্রায় দ্বিগুণ।

হুরমত মোল্লা গ্রামে সৎ এবং নিরীহ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি। পরিশ্রম করা ছাড়া তার আর কোনো ধরণের বিলাসিতা নেই। জোয়ানকালে তার যে গতি ছিলো ঝড়ের, এখন তাই ঠেকেছে ধীরলয়ের বাতাসে। তবু রহিত হয়ে যায়নি। বা রহিত করতে সে পারেনি। তবে হুরমত মোল্লার দোষ একটা আছে এবং তা এতই বড় যে, পাড়া-পড়শীরা তাকে ক্ষমা করে মনের উঁচুস্থানে রাখলেও নিজেকে সে আর এখন নিজে ক্ষমা করতে পারছে না।

শুরুতেই হুরমত মোল্লার স্ত্রী শরীফা বানু স্বামীকে বিষয়টি নিয়ে কথায় কথায় লেপের তুলোর মতো ধুনো করে ছাড়তো, ‘নিজিগে প্যাটের ছাওয়্যাল বাঁইচে নাই। পত্থম বয়সের সব মইরে ছাইড়ে শুধু আছে এ্যকটা মাইয়ে! এহন পড়ন্তি বয়সে কোহানে নিজিগি আখের গুছাবে, তা না! তুইলে আনলো একখান পথের কাঁটা!’

হুরমত মোল্লার তার অকাল-মৃত চাচাতো ভাইয়ের অসহায় ছেলেকে নিজের আশ্রয়ে রেখে বড় করেছিলো। মা’ও যার অন্যখানে নিকাহ বসে বাঁচতে চেয়েছিলো। অবশ্য শাফিয়া বেগম ছেলেকে তার কাছে রাখার প্রতিশ্রুতি নিয়ে, তবেই দ্বিতীয়বার বিয়েটি বসেছিলো। স্বামী আর তার বড় ছেলে-মেয়েগুলোর মন যোগানোর চেষ্টাও সে কম করেনি। কিন্তু হলো না। সবার চোখ ওই বছর-দশেকের এজাজুলের পাতে ‘সব খাইয়্যে শ্যাষ কইর‌্যা ফ্যালালো।’ শাশুড়িও তখন জীবিত শাফিয়া বেগমের এ পক্ষের। তবে আর যায় কোথায়?

মা-বেটাকে তাদের ধর ধর, মার মার, কাট কাট, অবস্থা প্রতিদিন। শাফিয়া বেগমেরও তখন আর ফেরার পথ নেই। নিজের বাপের বাড়ির অবস্থা আরো খারাপ। তবু আগে ছেলেকে সেখানেই রাখার চেষ্টা সে কম করেনি। অগত্যা, ন’মাসের ভরা পেট আর দশ বছরের ছেলের হাত ধরে এক ভোররাতে পা রাখলো দশ মাইলের পথে। বুকভাঙার পুরনো সেই ভিটেয় ফিরে আসতে তাদের বেলা দুপুরে এসে গড়ালো। তারপর ছোট দেবরের হাত ধরে, জা’র পা ধরে,ওদের চৌদ্দ-পুরুষের মাথা খাইয়ে, ছেলেটাকে আবার গছিয়ে গিয়েছিলো, তার একটু আশ্রয়ের আশায়।

এজাজুলের বাপের পড়োপড়ো ঘরখানা ততদিনে ঠিকঠাক করে সালাম মোল্লার গোয়ালঘরে পরিণত হলো। তবু এজাজুলের তাদের ঘরে আশ্রয় জুটল না। তার আপন চাচির নিষ্ঠুরতা আর চাচার বেধড়ক মার প্রতিদিন ঠেকাতে ঠেকাতে নরম প্রাণের মানুষ হুরমত মোল্লা একদিন ছোঁ মেরে এজাজুলকে এনে ওঠালো নিজের ঘরে। পরদিনই তার বই-খাতার ফাংগাস ঝেড়ে, নিজে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে স্কুলের খাতায় আবার নামটি তুলে দিয়ে এলো।

টানাটানির সংসারে আরো একটি পেটের ভার? তার ওপর তার স্কুলে যাওয়া? ফুট-ফারমাশ খাটলে তাও নাহয় কিছুটা উসুল হতো। শরিফা বানু আসমান থেকে নেমে আসা কোনো ফেরেশতার কন্যা নয়। শেষে সেও হিসেব কষে ফেলেছিলো। তাও শুধু মনে মনে নয়। আর এসব কথা থাকেও না মনের ভেতরে। তারপর শুধু কষ্ট করে ছাগলের ওলান থেকে দোয়ানো দু’ছটাক কি তিন ছটাক দুধের ভাগই নয়, পুরো সরটুকু চলে যেত এজাজুলের পাতে। বড় কন্যাটি অকাল প্রয়াত হয়ে যে ছেলেটিকে মায়ের কোলে স্থাপিত করে, মা’র পুত্রসন্তানের সাধ এতদিন ধরে মিটিয়ে আসছিলো, অপু। তারও তখন ও-বাড়িতে কোণঠাসা অবস্থা।

শরীফা বানু তার ভগ্ন শরীরটি হঠাৎ বিনা কোঁকানো-কাতরানো অবস্থাতেই টেনে তুলে আবার হাঁস-মুরগী, ছাগলের পিছনে দৌড়ানো শুরু করলো। লাউয়ের মাচা, পুঁইয়ের মাচা বাঁধতে আর স্বামীর আশায় বসে থাকত না। অনাগত দিনগুলোর আশায় হতাশার ছবি এঁকে কারো সঙ্গে খিটমিটও করতো না। নূপুরের কদর ক্রমেই তার কাছে আগের চেয়ে বেড়ে যাচ্ছিলো। এজাজুলকেও শিখিয়েছিলো নিজেকে মা বলে ডাকতে। না হলে আম্মা। কিন্তু এজাজুল চাচির এ বায়না শুনে লজ্জায় কুঁচকে যেত। তাছাড়া তার মাও তো জীবিত! প্রায়ই এসে হাউমাউ করে কেঁদে, বিলাপ জুড়ে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ রেখে যেতে সে কেমন ফালাফালা করে রেখে যেত ছেলের অসহায় বুক! ঘিরে থাকা মানুষগুলোর ভিতরে তার তখন সে কি নাজেহাল অবস্থা!

আঁটো-সাঁটো, খাটো বোরখাটির ভেতরে করে একটু পাটালি গুড়, একটু ভাঙাচুরো পিঠে, ক’টা চিড়ে, যা পেরেছে এনে ছেলের মুখে পুরে দিয়ে গেছে মা। শাফিয়া বেগম যখন কাঁদতে কাঁদতে হিক্কা নিয়ে রাস্তায় নেমে গেছে, তখনও এজাজুলের চোখ শুকনো থেকেছে। কারণ হুরমত চাচা বুকে আশ্রয় দিয়ে তাকে এবং তার চেয়ে বড় কথা তার মা’কেও যে বাঁচিয়েছে সেটাই এখন সত্যি।

আঁচে সিদ্ধ হয়ে বাতাসে দাঁড়ানোর যে স্বস্তি, তা এজাজুলের মতো আর কেউ জানে না। তখন যারা তাকে ঘিরে থেকে তার চোখে একফোঁটা পানির জন্য চাতকের মতো অপেক্ষা করতো, মাতৃত্বে হৃদয় থইথই করিয়ে নিতো, অন্য সময়ে তো তাদের কেউ তার হাতে এক টুকরো পিঠে, একটা কলা বা চারটে ভাত কখনো দেয়নি? বরং অহেতুক খাটিয়ে নিয়ে খাবার সময়ে অজুহাত খুঁজে তাড়িয়েছে। তার মায়ের নামে নিন্দেবাদ করে বলেছে ‘বাতারখাগী মাগী প্যাটের ছাওয়ালডারে ভাসাইয়্যা নিজির সুহি আবার যাইয়্যে বিয়্যে বইছ্যে, তয় আর মানষির আর পোড়াব্যে ক্যা?’ শুধু হুরমত চাচাই কিছু বলেনি, বরং তার মা এলে চাচিকে বলেছে খাতির-যত্ন করতে। বাঁধনবিমুখ তাকেও ডেকে মা’র কাছে বসিয়ে রেখেছে, যে বাঁধন থেকে সে একটু আগে নিজেই মুক্তি চেয়েছিলো।

এজাজুলকে তার সেই দশ বছর বয়সে যখন ক্লাস ফাইভের খাতায় আবার নামটি তুলে দিয়ে আসে, নূপুর তখন ক্লাস টু’তে। এতে ভালোই হয়েছিলো, নূপুরকে আর আলাদা করে তাড়া দিতে হতো না। অপুও আদর্শ লিপিখানা নিয়ে ওদের সঙ্গে স্কুলের পথে পা রেখেছিলো। তাতে শরিফা বানুর পুরনো মরচে-ধরা বিদ্যেটুকু আবার ঝিলিক দিয়ে উঠতো নাতির জ্ঞানস্পৃহায় ধার দিতে। তাছাড়া বনেধি পরিবারের সন্তান সে, বিদ্যার মহিমা সে বোঝে। বাপের বাড়িতে দেখেছে কত বিদ্বান লোকের আনাগোনা। শ্বশুর তাকে বড় আগ্রহ করে এনেছিলো এ বাড়ির বউ করে। তার বংশধর শিক্ষিত বংশধর হয়ে উঠবে এ আশায়।

এখন আর রান্না-বাড়া-খাওয়াতে সব শেষ হয়ে যায় না। সেই স্বপ্ন দিয়েই ঝলমলে ভবিষ্যৎ বাঁধে শরিফা বানু। এজাজুলের সঙ্গে নূপুরকে বিয়ে দেবে সে এজাজুলের লেখাপড়া শেষ হলেই। তখন তার স্বামী হুরমত মোল্লা কেন, কারো বাঁধাই মানবে না সে। বাধা কি সে তখনও মানতো? ওদের সেই শিশু বয়স থেকে চেষ্টা সে কম চালায়নি, কিন্তু পেরে ওঠেনি স্বামী হুরমত মোল্লার নীতির জোরে!

তবু ও ছেলে তো তাদেরই গড়াপেটা। খাইয়ে মানুষ করা। সে শুধু জামাই-ই নয়, সে হবে এ বাড়ির ছেলেও। হুরমত মোল্লার যে দু’বিঘে জমি, আর ভিটেটুকু তাও তো এজাজুলেরই। এজাজুল এই খুপরি ঘরখানা ভেঙে চার পোতায় একাই চারখানা ঘর করে বাড়ি ভরবে। নতুন টিনের রোশনাইতে ঝলসে যাবে পাড়ার মানুষের চোখ! আর তখন তার বাপের ভিটের জায়গাটুকুও তো দখল নেবে সে! তারপর তাদের মেয়ে নূপুরকে নিয়ে তাদের কল্পিত রাজার হালে থাকবে। শরিফা বানু আর হুরমত মোল্লা শুধু তা প্রাণভরে দেখে উপভোগ করবে। এই তো!

অপুর বাপেরই তো কত জমিজমা! সে আর এটুকুর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে না! এমনিতে তার দাদা-দাদি প্রায় এসে তাকে দেখে আফসোস করে যায়। একজন থামলে আর একজন শুরু করে‘ছাওয়ালডা আবার গরে মাথা দিলি নাতিডারে নিয়া যাবো। যার সুংসার তারই খোঁজ-খবর নাই! বাদাইম্যাডা হঠাৎ আসে, দুইদিন থাহে… আর খুঁজে না পালি ধরে নিতি হয় আবার কোনোহানে গান গাতি চলে গেছে!’

গানের দিকে তমিজ আলী আগেও ঝোঁক ছিলো। যার জন্যে বিয়েটা তার একটু দেরিতেই হয়েছিলো। না হলে হুরমত মোল্লা কেন, তমিজ আলীকে জামাই করতে বহু মেয়ের বাপের তখন লোভ উথলে পড়েছিলো। কিন্তু তমিজ আলীর বাপ পাকা বুদ্ধির মানুষ। ছেলের খেয়াল বুঝে, বিষয়ে-আশয়ে নিচু ঘরেই হাত বাড়ালো সে। বউটা মরে শুধু জন্ম-বাউলটার আবার ঘোর ভাঙিয়ে দিয়ে গেলো। এভাবেই তো চলছিলো!

মা মরে নূপুরের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলো মাত্র এসএসসি পরীক্ষার ক’দিন আগে। অপুর বাবা তমিজ আলীরও এখন আর শরীরে জোর নেই। মা-বাবা দু’জনেই মরেছে পর পর। তাদের কবরে এক মুঠো মাটি দিতেও তমিজ আলীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাপের কাজ সারতে হয়েছে শৈশব-কৈশোরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো অপুকেই। এখন সেখানে শূন্য ভিটে। তমিজউদ্দিনের আর কোনো ভাই নেই। বোন একটা দূর গাঁয়ে বিয়ে হয়ে বড়সড় সংসার নিয়ে ভালোই আছে। ভাইকে একবেলা কাছে পেলে যেন আকাশের চাঁদ পায় বোন। শেষে একদিন ধোঁয়াওঠা গরম ভাত খেতে দিয়ে তালপাতার পাখায় বাতাস তুলতে তুলতে বলে ‘বাইজান, কই কী বাড়ি-ঘর-দুয়্যার সবই আছে। অপুর খালাডাও বেশ ঢাঙর অইছে। আর অপুও তো ওয়ারে ছাড়া কিচ্ছু বোজে না। আপনি তাওই সাবেরে কন, আপনি না পারলি আমি কই গিয়ে, ঘর দুইখানা কোন সুমায়ে ভাইংগে পইড়ে থাহে ভাইজান। খালি ঘর। এতদিন যে দাঁড়াইয়ে আছে এই তো আমাগো ভাগ্যি!

তমিজউদ্দিন বোনের কথার উত্তর খুঁজে পেলো না। তবে সম্মতিটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার চোখের ভাষায়। কোনো জটিলতা নেই তাতে। আর এটুকু বুঝতে পেরেই বিষয়-বুদ্ধি, গৃহকর্মে পটিয়সী রিজিয়া বেগম আর একটু বাড়ে, বলে, মা-বাবা দুইজনেই মরার সুমায় আমারে সেইরকমই ইঙ্গিত দিয়ে গ্যাছে। আপনি এ্যট্টা মাত্তর বাই! আপনারে এরমির দেখলি আমার বুকডা ফাইটা যায়! আপনি কন তো, আমি কালই যাই!

বৃদ্ধ হুরমত মোল্লার তার দুর্বল শরীর বহু কষ্টে তুলে, এখনো লাঙ্গল কাঁধে গরু নিয়ে মাঠে যায়। হাল জোড়ে। বীজ বোনে। ফসল ঘরে আনে। স্ত্রী বেঁচে থাকতে উঠোন থেকে তা ঘরে তোলার দায়িত্ব তার স্ত্রীরই ছিলো। এখন মেয়ে নূপুরকে নিয়ে এ কাজটিও তাকেই করতে হয়। অথচ, জোয়ান মর্দ জামাই এসে তার ঘরে জায়গা নিয়েছে এবার মেলা দিন হলো। প্রথম প্রথম তার দুর্লভ আগমন শ্বশুর হুরমত মোল্লার ভালো লাগলেও যখন-তখন হয়ে ওঠায় এখন তা হুরমত মোল্লা কেন, নূপুরেরও ভালো ঠেকছে না। আর তমিজ আলীর সন্তান-বাৎসল্য বা অপুর পিতৃত্বের তৃষ্ণা কোনোদিনই গিয়ে অমন একবিন্দুতে পৌঁছেনি, যাতে করে রিজিয়া বেগমের লক্ষটা কোনোভাবে জোড়াতালি দিয়েও পরিণতির আশা পায়। এখন নাতিও হুরমত মোল্লার চোখে বিষ হয়ে উঠেছে। শুধু কখন যেন বলে ফেলে ‘মিঞার বিট্যা ছাওয়ালডারে নিয়া ইবার বাপের বিটায় ফিরা যান! আমার দিন এহন শাষ! খালি বাঁইচ্চা আছি অই অবাগিডার নাইগা। অর এক পথ অলিই আমি আত-পা ছাইড়ে বাঁচি…।’

কিন্তু হুরমত মোল্লাকে কোন কিছু না জানিয়ে রিজিয়া বেগম তার বাড়িতে এসে উঠলো। সাতটি ছেলেমেয়ের রেখে আসেনি কাউকেই। হুরমত মোল্লার পালের মুরগির সালুন, আর আস্ত আস্ত ডিম ভাজা দিয়ে দুপুরে দীঘার রাঙা চালের ভাত খাওয়া সারা হলো। ঢেঁকুর তুলতে তুলতে, অর্ধেক বারান্দাজোড়া চৌকির কোণায় বসা তার তাওইয়ের হুক্কোটানা অবস্থায় নিজের মনোবাঞ্ছা বলে  ফেলে।

হুক্কো থেকে ধীরে ধীরে মুখ আলগা করলো হুরমত মোল্লা। তারপর চোখ বন্ধ করেই বললো, ‘কও কী ঝিয়্যারি? নূপুরেরতে মিঞার বিট্যার দুইগুণির বেশি বয়স! না, না এইরম দুরমুইষ্যা কতা আর কইও না। তুমি আমার মাইয়ার মতো! তোমারও বাপ-মা নাই। তুমি এ বাড়ি আইসো, যাইয়ো খাইয়ো, কিন্তু অইরম কতা আর কইয়ো না। মাইয়াডা আমার এমনিই দুঃখী।’

আমার বাপের বিট্যাখানই লাখ টাকার সম্পিত্তি…।’ হাতের গ্লাস থেকে আরো এক ঢোক পানিতে মুখ ফুলে ছিলো। দীর্ঘক্ষণ পর মুখভরা কুলি ঘাড় ফিরিয়ে দরজার বাইরে ঝেড়ে ফেলে বললো রিজিয়া বেগম।

তোমার বাপের কোনহানে কী আছে, সিইডা কী তোমারতে নতুন করয়্যে আমার জানতি অবে?’ হুরমত মোল্লা একটু চড়াস্বরেই কথাগুলো বলে ফেললো তার গা-ভরা গয়নার অতি আশায় বুকবাঁধা ঝিয়ারিকে।

আপনি তো একজনিরি খাওয়াই-পরাই মানুষ হরছিলেন নূপুররি বিয়া দেবেন বুইলা….!’ বড় দুর্বল জায়গায় আঘাত করলো এই মেয়েমানুষটি তার। তবু সে তার নীতির জোরে উঁচু গলায়ই বলে দিলো, ‘তাই যদি জানো, তো এটুকুও জাইনো তয়, সে মানুষই অয়নাই!’

আকাশ  মেঘ হরছে। দূরির পথ। আরেকদিন আইস্যা কথাডা পাইড়ো। তাওইয়েরও মেজাজ ঠা-া হোক! বিয়েশাদি কম কথা না!’ তাওইয়ের কাছে ভালো সাজার ভান করে আসমত আলী তাদের সিকি-আধুলির তারতম্যের মতো সাইজের ছেলেমেয়েগুলোকে টেনেটুনে একত্র করতে করতে স্ত্রীকে ইশারায় মানা করেছিলো, আর কথা না বাড়াতে। রাখি-মালের ব্যবসায়ী আসমত আলী। সে খুব ভালো করেই জানে কেনা-কাটায় কখন শুরু করতে হয়, আর কথারও কখন থামতে হয়।

‘কী সোন্দর রান্দা-বাড়া! গায়ের রঙডা য্যান কাঁচা অলদির মতো! গড়নে-গাড়নে হিন্দি ছবির নায়িকাগো মতো। আমি থাকতি এমোন বিয়্যাইন আমার সমুন্দির বউ অবে না, তো কোন কালা-চুরার সমুন্দির বউ অবে? আসতিছি আমি আর কয়ডা দিন পর! আম-কাঁঠাল বালো কইরে পাহুক! তাওইরে খাওয়ায়ে এহেবারে মশগুল হইরে ছাড়বো!’ কথাগুলো মনে মনে ভাবতে ভাবতে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে সেও অপুকে টানাটানি করতে লাগলো তাদের বাড়ি যেতে। ফুপুও তাকে ধরাগলায় কম সাধলো না। কিন্তু অপু যেতে রাজি হয়েও যখন বেঁকে বসলো তখনই আসমত আলী বলতে সুযোগ নিলো, ‘তয় আজ থাক, খালারে নিয়ে কবে যাবা কও? আমি নিজি আইসা তুমাগে নিয়া যাবানি!’

অপু গেলে অয়ারে আপনারা যহন-তহন নিয়া যান! কিন্তু এই বাড়ি ছাইড়ে আমার স্বর্গে যাবারও সাধ নাই!

বেয়াইনের কথায় অনেকখানি দমে যায় আসমত আলী। তাই বাজিয়ে দেখতেই বলে, স্বর্গ দেখছেন আফনি?

আমার মনের মইধ্যে যে স্বর্গ, তারতে আর কে আমারে টাইনে নামায়? শোনলেন না, আমার বেয়াইন কলো, কিডা আমারে বিয়া করে নাই? শরীরে-গতরে যারে আমার বাপ বড় হরছে, তার অধীন অইয়ে থাহার মতো মাইয়া আমি না, এইডাও জানবেন!

কিছুটা ভগ্ন আশা নিয়েই ফিরতে হলো অতঃপর সস্ত্রীক আসমত আলীকে। কারণ, তাওইয়ের অনটনের সুযোগে পর্যাপ্ত আলো ঠিকরোলেও স্বয়ং বেয়াইনের আঁচ তা বেশ দমিয়ে রাখলো। অপুও একলাই রাজি হয়ে আবার দমে যাওয়াতে তাদের আশা আরো ক্ষীণ হলো।

খালার ওই মুখখানা না দেখলে অপুর ত্রিভুবন শূন্য ঠেকে। অবশ্য সে তা কাউকে বোঝাতে পারে না। তার সমস্ত জীবনের অন্নদাতা নানাকেও তার নিষ্ঠুর দৈত্য বলে মনে হয় তার ইদানিংকার কথাবার্তায়। এই ভিটের চৌহদ্দি ছাড়া, খালার ওই মুখখানা ছাড়া, এই বিশ্ব-ব্রহ্মা-ের তার আর কিছুই প্রয়োজন নেই। মাঝখানে দুইটি গ্রাম পরেই তাদের গ্রাম। তার বাপ-দাদার চৌদ্দ-পুরুষের ভিটে সেখানে। বিরাট বিরাট দু’খানা ঘরে মানুষের অভাবে স্থায়িভাবে তাতে উইপোকা বসবাস করছে। তবু অপুর মনে হয় একদিন ভীষণ একটা ঝড় এসে ভিটেসহ উড়িয়ে নিয়ে যাক ওই ঘর। উঠোন। বাগান। অই ঘর মানেই এখানে তার স্থায়িত্বের চিড়অবস্থা।

ইদানীং নিজের বাপকেও গাড়ল গাড়ল মনে হয়। ফুলের মতো সুন্দর খালার দিকে চতুর শেয়ালের মতো কেমন কুতকুত করে সে তাকিয়ে থাকে। ঘরের পিছনে অপুর মা’র কবরটা। সে আগে দেখেছে, বাবা এক-আধটু যখনি এখানে এসেছে, ওই কবরটা সামনে করে কিছুক্ষণ বসে থেকেছে। কিন্তু এখন তার খালি ঘরের কোণায় সিঁধিয়ে থাকা। আর এটা-ওটা চেয়ে খালাকে অস্থির করে রাখা! অপুকেও সে আগের মতো কাছে টেনে নেয় না। সে চেষ্টা বরাবর অবশ্য কমই ছিলো। বরং আপন মনে কথা আর সুর নিয়ে পড়ে থাকতেই তার স্বাচ্ছন্দ্য ছিলো।

অপুর যখন খুব কষ্ট হয়, তখন সে কল্পনা করে সে খালাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। শুধু যাচ্ছেই। লোকালয় তার আর ভালোলাগে না। সবাই স্বার্থপর! বাবা-নানা-ফুফু। এজাজুল মামাও কত কষ্ট দিলো খালাকে। তবু কাউকে খালা অভিশাপ দেয় না। কারো নিন্দেবিবাদ করে না। বরং বই পড়তে পড়তে ভালো কোনো কথা পেলে অপুর জন্য তা দাগ দিয়ে রাখে। সে যে পরীক্ষায় ভালো করে, তাও তো খালার জন্য পারে।

ঘর-সংসার আর অপুকে আগলে রাখতে রাখতে কত সময় পার হয়ে গেছে বোঝেনি নূপুর। মা শুধু ওর বাবাকে বলতো, এজাজুল যে ঢাকায় গ্যাছে এমএ পড়তি, ওর খোঁজ-খবর আমাগেই রাহার দরকার। টাহা-পয়সার অভাবে যেন ওয়ার লেহা-ফড়া নষ্ট না অয়! মা তার হাতের চুড়ি, কানপাশা জোড়া, গলার তাবিজ কটা পর্যন্ত বিক্রি করেছে, এজাজুলের লেখাপড়ার জন্য। তারপর ফসল বিক্রি, শাকসবজি বিক্রির টাকাটা পর্যন্ত গেছে। আশপাশের মানুষ বলাবলি করেছেজান কাইটে যে মোল্লা আর মোল্লার বউ এজাজুলকে খাওয়াতিছে, শ্যাষ পর্যন্তি ও ছাওয়্যাল নূপুররি বিয়্যা হরে কিনা দেহো! কতহ্যানে এমোন অলো! সরা-কলমা দিয়ার পরেও জামাই শিক্ষিত অইয়্যা অন্যদিকি মুখ ফির‌্যা যায়।’ এসব কথা শুনতে শুনতে শরিফা বানুর হঠাৎ মৃত্যু হলো ক’দিনের টাইফয়েড জ্বরে। ওষুধ-পথ্য পেলে হয়তো টিকে যেত।

হুরমত মোল্লার মধ্যে কোনোদিন কোনো সন্দেহ কাজ করেনি। যে ছেলেকে সে হাত ধরে মানুষের লাথি-ঝাঁটার কবল তেকে ঘরে তুলেছিলো। স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলো, নিজেরা ভাগের খাবার খাইয়ে বড় করেছিলো, সে তার ঘরে ফিরবে না তো কোথায় ফিরবে! তাছাড়া ওর চাচি কী চাইতো তাও তো সে জানে! ছুটি ছাটায় এজাজুল বাড়ি এলে কতজন বলেছে ‘মোল্লা, কলমাডা এহোনো দিয়্যা রাহো!’ কিন্তু হুরমত মোল্লার তাতে লজ্জা ঠেকেছে। একটা অসহায় বাচ্চাকে বুকে টেনেছিলো বলে তার থেকে সুযোগ নেয়া হয়ে যায় কিনা। না এমন বেহায়া আচরণ সে করতে পারবে না। ‘যা আছি নূপুরির কপালে! মানুষ ভাইবা-চিন্তা কইরা যে সিদ্ধান্ত আসে সেইডাই ঠিক! চাপানি সিদ্ধান্ত ঠিক না। তা ছাড়া আমার মাইয়াও তো পরীর মতোন! স্কুলে না গেলিও লেহা-ফড়া সে কম করে না। তার কাজে কর্মে সাত গেরাম ফেল অইয়া যায়।’ জোরের সঙ্গে ভেবেছিলো হুরমত মোল্লা।

একদিন গ্রামের একজনের মারফত এজাজুলের চিঠি এসেছিলো, তার চাকরি হয়েছে একটি ওষুধ কোম্পানিতে দ্বিতীয় এক্সজিকিউটিভ হিসেবে। হুরমত মোল্লা খবরটা পেয়ে তখনই ময়রা বাড়ি থেকে পাঁচকেজি টাটকা মিষ্টি কিনে এনে ভাগ করতে লাগলো। আর অপু নেচে নেচে তা ঘরে ঘরে বিলি করতে গিয়ে খবরটা বলে এলো। বহুদিন পর হুরমত মোল্লা বিনা কারণে হেঁটে বড় রাস্তার দোকানে জমে থাকা ভিড়ে ঢুকে পড়লো। সবাই আগেই জানতো এজাজুলের চাকরি হয়েছে। মোল্লাকে দেখে নতুন করে আবার তারা রব ওঠালো। হুরমত মোল্লাও সেদিন আগ বাড়িয়ে বলেছিলো অনেক কিছু। সেদিন সন্ধ্যা পার করে উঁচু ভিটেটুকু বেয়ে উঠতে সে ওঁৎ পেতে থেকেও একটু বাতের কামড় টের পায়নি। তারপর ঘরে এসে মোল্লা নিজের জবানিতে পুরনো হারিকেনের শিখাটি দপদপিয়ে দিয়ে, এজাজুলের কাছে মেয়েকে দিয়ে চিঠির উত্তর লিখিয়েছিলো। নূপুর নিজেও একখানা লিখেছিলো। প্রতি সপ্তাহেই সে লেখে। যদিও ইদানীং উত্তর পেতে হেরফের হয়। অপু সেবার আরো বড় করে লিখেছিলো।

লিখেছিলো ‘মামা তুমি যখন গা-ভরা গয়না পরিয়ে, লাল বেনারসি পরিয়ে খালাকে নিয়ে যাবে, আমিও তখন সঙ্গে যাবো। ঢাকার স্কুলে আমাকে ভর্তি করিয়ে দেবে। আমি ওখানেও টিকতে পারবো। স্কুলে স্যারেরা ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘হুরমত মোল্লার ঘরে এসে ভাঙা থালাগুলো সোনার থালা হয়ে উঠলো।’ আমি তোমাদের কাছে থাকবো মামা! আমাকে কিন্তু গ্রামে ফেরৎ পাঠাতে পারবে না। তা হলে আমি ইচ্ছে করে হারিয়ে যাবো….। তোমার চাকরির খবর শুনে নানা খুব খুশি। বাড়ির সবাই খুব খুশি। আমি আর খালা একসঙ্গে নামাজ পড়েছি… প্রতি বারের মতো অপু এবারও তার চিঠি কাউকে দেখালো না। তিনজনের তিনখানা চিঠি একই ইনভেলপে ভরে মুখ এঁটে, নূপুর তার বরাবরের লেখার খাতাটির মধ্যে রেখে যখন তার বালিশের নিচে রাখলো, বাড়ির পাশে মসজিদে তখন মুয়াজ্জিন চাচার আজান দেয়া শেষ।

উত্তরের উদগ্র আগ্রহ তিনজনেরই একসময় মিইয়ে আসতে আসতে এক সন্ধ্যায় এজাজুল উদয় হলো নিজেই এসে। উদ্দীপ্ত হুরমত মোল্লার বৃক্ষনিবিড়, অন্ধকারাচ্ছন্ন, অতি জীর্ণ গৃহে। সবার জন্য নতুন কাপড়, দই, মিষ্টি, ফল-ফলারি ছাড়াও ভিড় করে থাকা মানুষের হাতেও পড়লো কিছু। কাপড়-চোপড়, ফল-ফলারির সমান ভাগ গেলো এজাজুলের আপন চাচা সালাম মোল্লার ঘরেও। নাহ্, এ আনন্দের ভাগ হুরমত মোল্লা আজ কাউকে দিতে রাজি নয়! রাতে খেতে বসে হুরমত মোল্লা সাদা দিলে সাফ সাফ বলে ফেললো, ‘আমি চাই না সালামের পরিবার এহন তোর ছায়াডাও দেহুক!’ তয় তোর মা’র খবরডা নিস! বহুবছর সে এদিক আসে না। মানুষের কপাল! বাবে এ্যাক, অয় আর এ্যাক! মারে কোনোদিন ফেলিস না!

চাচা মনটারে বড় করেন। পুরনো কথা ভুলে যান। চাচার কাজ চাচা করেছে। আমার কাজ আমারে করতে দেন। তাছাড়া আমার বাবার মুখখানা মনে পড়লে তো ওই চাচার মুখখানাই মনে পড়ে!

এজাজুলের কথা শুনে হুরমত মোল্লার মুখখানা ব্যাজার হয়ে যায়। দীর্ঘক্ষণের জন্য ‘থ’ বনে যায় সে। আজ এজাজুলের যেকোনো ধরনের মহত্ত্বের কারণেই তার বাপের মুখ ব্যাজার হোক, এমন মহত্ত্ব চায় না নূপুর। নিজেদের অহংকার ভাগ হওয়াতে অপুরও মুখের প্রসন্নভাবটি নিষ্প্রভ হয়ে আসে। এজাজুল মামা আগের মতোই এখনো শুধু তাদের নয় কেন!

উনিশ হাত ঝুরঝুরে ঘরের ঠিক মাঝখানে, চাল সমান জোড়াতালির হোগলার বেড়া। হুরমত মোল্লা তা কদিন হলো আরো জোড়াতালি দিয়ে শক্ত করে বেঁধেছে। কারণ তার মৃত-মেয়ের স্বামী তমিজ আলী এখন দ্রুতই ক’দিন পর পর বৈরাগ্য সংক্ষিপ্ত করে শ্বশুরবাড়িতে উঠতে শুরু করেছে। তাই একরুম থেকে আরেক রুমে যেতে হলে বারান্দায় নেমে তারপর যাওয়া-আসার ব্যবস্থা। দরজা দু’টিও ঘরের দুই কোণায়। বারান্দায়ও চৌকি পাতা। ক্ষেতের কাজ ছাড়া হুরমত মোল্লা বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে অনেকদিন হলো। পথ সংক্ষিপ্ত করতে যারা অন্যের বাড়ির উপর দিয়ে চলাচল করে, বিপজ্জনক তেমন কাউকে পেলে সে ধুয়ে ফেলে। আর আগন্তক নওল হলে, মোল্লার তার কথার আঁচে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি দশা করে!

সে রাতে কোনাখান থেকে ঘুরে এসে, চাচার মাথার কাছ দিয়ে পাশের রুমে শুতে যাওয়ার আগে এজাজুল নূপুরকে শোয়া থেকে ডেকে তুলে আনলো বাইরে। ঝিরঝিরে নিমহাওয়া উঠোন অব্দি নেমে আসা গাছ-গাছালির লতাপাতা। মাথার উপরে একাদশীর চাঁদ। আলো খুব ফুটফুটে নয়। দু’জনের কাছে দুজন তাই বিগত দিনগুলোর মতোই অস্পষ্ট! তবু এজাজুলের এই ডেকে তোলা নূপুরেকে চঞ্চল করে তোলে। দু’জনের পাশে পা টিপে টিপে কখন অপু গিয়ে দাঁড়ালো। এজাজুল এতে কিছুটা ভর্ৎসনার স্বরেই বলে ওঠে, ‘বড়দের কথার ভেতরে থাকতে নেই।’ নূপুর এতে ক্ষুদ্ধ না হয়ে কিছুটা শিহরণ অনুভব করে। কারণ আগে এজাজুল কেমন জড়সড় হয়ে থাকত এবং তা অপুর কাছেও। এজাজুল এখন দামি মানুষ। তাকে এতটা গুরুত্ব দেয়ায় তার একধরনের ভালো লাগাতে থাকে। কিন্তু কথাটা বলতে দেরি করছে এজাজুল, নূপুরের তর সয় না। সে পাল্টা প্রশ্ন করে ওঠে ‘কী এমন কথা কবেন, যা ছোটরা শুনতি পারবে না?

নূপুর, একজন আমাকে ভালোবাসে, সে আমাকে ছাড়া বাঁচবে না! ব্যাকুলতাহীন বৈষয়িক কথার মতোই শোনাল এজাজুলের কণ্ঠ। ওই এক কথার ধরনেই নূপুর বুঝে ফেলে, ও কোথাও বড় টোপ পেয়েছে!

হঠাৎ পাতাল ফুঁড়ে উঠা এই একজনডা কিডা? খোঁটা দেয়ার জন্যই বলে নূপুর।

আমার ক্লাসমেট’র বোন! বড় সেন্টিমেন্টাল মেয়ে সে!

নূপুরের আর কিছু শোনার রুচি হয় না। প্রয়োজনও নেই। তাই ওইটুকু শুনেই বলেছিলো, তো, সে আপনাকে ছাড়া বাঁচপে না, আপনি বাঁচপেন তারে ছাড়া?

নূপুরের এ প্রশ্নে এজাজুল আমতা আমতা করতে থাকে। নূপুর বুঝে গেছে ওর সবকথা মূল্যহীন। তাই এবার কড়া আদেশের সুরেই বললো ‘তা আমার কী করাা লাগবে সিইডা কন?

তুই শুধু বলবি, এজাজুল ভাই প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো আমি রাজি হইনি!

ঠিক বুদ্ধিডাই শিহাইছেন, আমি আসলেই এমন এট্টা কিছু ভাবতাছিলাম। কিন্তু শেকড়-বাকড়ের মতো জীবনগুলোর যে একলার বুইলে কোন কথা নাই! পারি নাই খালি তারই জন্যি! তা, আপনার প্রস্তাব রাহা না রাহার আমি কিডা? আমার মাথার উপর বাবা নাই? তারে কী কবেন?

এজাজুল এবার কথা খুঁজে পায় না। মেয়েটাকে এত মুখরা সে আগে ভাবেনি। অনেকক্ষণ কথা নেই দু’জনের কারো মুখে। ছোটবেলা মধুমতি নদীর ফোঁসফোঁস শব্দ শুনেছে নূপুর, ধপাস ধপাস পাড়ও ভাঙতে দেখেছে। আজ তার সেই ফোঁসফোঁস গর্জন, আর নিজিরে ভাঙার মত টান হারিয়েই সে মরেছে। মানুষ এখন তাকে বলে মরা নদী। ‘তাই সব শ্যাষ যদি করতিই অয় তো আমি করি! আমার বাপের পরিশ্রমের গর্বটুকু অন্তত আমি রাখি! আরেক জনেরে সুযোগ দিবো ক্যান?’ ভেতরে ভেতরে উত্তাল হয়ে ওঠে নূপুর, ঠিক মধুমতি নদীটির যৌবনকালের মতো। এসময় চাকুর কোপের মতো বলে উঠলো নূপুর ‘আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান গিয়্যা!’ বলেই দ্রুত এগিয়ে আসে ঘরের দিকে। হুরমত মোল্লার তন্দ্রা ভেঙে যায় মেয়ের পায়ের শব্দের ওটুকুতেই। সে জড়ানো কণ্ঠে জানতে চায়, এজাজুল ঘুমাইছিস, বাবা? ঘুমা, রাইত মনে অয় মেলা অইছে। কাইল বিয়্যানে একবার তোরে সাতে কইরা মাস্টারসারের বাড়ি যাবো। তারে দেহাই আনবো কেমন মানুষ আমি তোরে বানাইছি। গ্রামের মানষি কি আমারে কোম ভাঙানি দেছে? সগলির মুহি ছাই দিছিস তুই বাজান! ছাই দিসিছ…।

অন্যখান থেকে কেউ কিছু উত্তর দেয়ার আগেই নূপুর বলে উঠলো ‘এতক্ষণে ঘুমাইয়্যা ক্যাঁদা অইয়্যা আছে, যার সাতে তুমি কতা কও! তুমি এহন নিশ্চিন্তে গুমাও বাবা!’ অপু চাপা স্বরে ফুঁপিয়ে ওঠে, ‘আমি সব শুইন্যা ফেল্যাইছি! আমি সব শুইন্যা ফেল্যাইছি খালা!’ নূপুর অপুর মুখ চেপে ধরলো। বুক থেকে সে মুখ সরিয়ে দিতেই হীম হয়ে আসে তার শরীর! ঘরের চালের পর বরই পাতা ঝরে পড়ার শব্দও এখন বড় বেশি লাগছে। ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তার চৌদিকের নিস্তব্ধতা। ওইটুকু টুকু পাতা থেকে পড়া শিশিরের শব্দ আগে তো কখনও শুষে খায়নি তার কোনোরাতের ঘুম! এইটুকু আলোড়ন কেমন তোলপাড় করে দিচ্ছে তার মায়ের স্বপ্নের মধ্যে সাজিয়ে রাখা সুনশান গেরস্থালি! মা কি এখন টের পাচ্ছে, তার স্বপ্নভাঙা উত্তাপে ছাই হতে যাচ্ছে তার প্রতিদিনের নিকানো সবুজ আঙিনাটি! যেখানে বসত করে তার প্রাণের তিনটি মানুষ!

 

আগামী পর্বে শেষ হবে।

দীলতাজ রহমান। কবি, লেখক ও গল্পকার। দীলতাজ রহমানের জন্ম ১৯৬১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামে। মা রাহিলা বেগম। বাবা সূফী ভূইয়া মোহাম্মদ জহুরুল হক। ব্যক্তিগত জীবনে দীলতাজ আশিক, ফারহানা, ফারজানা ও আরিফ এই চার সন্তানের জননী। আর এদের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..