আমার মল্লিকা দি

জাকিয়া শিমু
ছোটগল্প
Bengali
আমার মল্লিকা দি

আমার সাথে মল্লিকাদির বন্ধুত্ব অবুঝবেলা থেকে। আমাদের বাড়ির অদূরে তাঁদের বাড়ি। আমাদের পূবপাড়া ঘেঁষে ডোরাসাপের দেহের মতো মসৃণ এবং আঁকাবাঁকা সরু একটা মেঠোপথ চলে গিয়ে মিশেছে উপজেলার পাকা সড়কের সাথে। সেই মেঠোপথ ধরে অল্প দূর পায়ে হেঁটে এগুলে বহু পুরনো শিকড়বাঁকরে আবৃত বয়োবৃদ্ধ এক বটগাছ। বটগাছের চারিপাশ ঘিরে মল্লিকাদি’দের পালপাড়া। আদি-নাম পালপাড়া হলেও অধিকাংশ লোকে এখন উত্তরপাড়া নামে ডাকে। একসময় এপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের একচেটিয়া বাস থাকলেও এখন দু’চারঘর হিন্দু পরিবার অবশিষ্ট আছে বাদবাকিরা জন্মভিটা বেঁচে দিয়ে দেশ ছেড়েছে।

আমি আর মল্লিকা দি’ স্কুল ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই রেডিওতে অনুরোধের আসরে গান শুনি। স্কুলে যাওয়ার নাম করে বইপত্র নিয়ে সাতসকালে মল্লিকাদির বাড়ি চলে আসি। আমাদের বাড়ির সাথে তাঁদের বাড়ির সম্পর্ক বহুবছরের পুরনো! আমার পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি পদ্মার গর্ভে তলিয়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে আমার পূর্বপুরুষ ( বাবার মুখে শোনা সাত পুরুষ আগের) এই গাঁয়ে এসে বসত গড়তে উদ্যত হলে গাঁয়ের লোকজন তাঁদের ফিরিয়ে দেয়। তখন এ-তল্লাটে হিন্দুদের দাপট ছিল চরমমাত্রার। কোনো মুসলমান তাদের সাথে একত্রে বসবাস করবে, সেসময়ে এমন চিত্র ছিলো অকল্পনীয়। মল্লিকাদির বড়দাদা কিংবা তারও আগের প্রজন্মের কেউ নাকি আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি সদয় হয়েছিলেন। এবং তাঁর কল্যাণে আমাদের পূর্বপুরুষ এ গাঁয়ে কোনোমতে মাথাগোঁজার সুযোগ পেয়ে যায়। সম্পর্কের শুরুটা সেই থেকে এবং বংশ পরম্পরায় আজও পাকাপোক্ত হয়ে পুরনো সংস্রবটা রয়ে গেছে।

মল্লিকাদি বয়সে আমার চেয়ে ঢের বড় হবে। আমি প্রাইমারি স্কুলে পাঁচ ক্লাসে পড়ি, আর মল্লিকাদি হাইস্কুলের শেষের দিকে। আমাদের বয়সের তফাৎ বন্ধুত্বের সম্পর্ককে টলাতে পারে না। মল্লিকাদি দেখতে হিন্দুদেবী দুর্গার মতো। বৃদ্ধ বটগাছটার ছায়াতলে এ পাড়ার হিন্দুদের ঠাকুরঘর। বছরের বিভিন্ন সময়ে পূজার আগে মাটির কারিগর-কুমাররা এসে নানান ধরণের ঠাকুর গড়ে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাদের কাজ বসে বসে দেখি। দেবী দুর্গার মুখশ্রী ঠিক যেন আমার মল্লিকাদির মুখের আদলে রূপ দেয়া ! তাঁর গায়ের রং অবশ্য একটু ময়লা। যদিও এ বিষয়ের সাথে আমি একমত নই, আমার চোখে কখনো পড়েও না। এ বিষয়ে আমার মা এবং মল্লিকাদির মায়ের (আমি তাকে মাসি ডাকি) মধ্যে বেশ ব্যাকুলতা টের পাই। আমি তাঁদের গল্প শুনে মল্লিকাদির সাথে মিলিয়ে দেখি। তা অবশ্য একটু হবে বৈকি কিন্তু আমার কাছে তাঁর কিঞ্চিৎ ময়লা-বরণ বেজায় লাগে। এমন দেবীরূপী মানুষটাকে পরিষ্কার রঙে বেখাপ্পা লাগত, একদম মানাত না। মল্লিকাদির টিকালো নাকের ঠিক নিচে, বাম পাশটায় কালো একটা আঁচিল ঘাস ফড়িঙের মতো করে বসে আছে। আমি ছলে-বলে-কৌশলে প্রায়ই ঘাস ফড়িঙটা ছুঁয়ে দিই। মল্লিকাদি যখন কথা বলেন আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। মিহি আওয়াজে শব্দ বুনে বুনে গল্পের মতো কথা বলেন। যখন হাসেন তার সমস্ত শরীর হেলেদুলে হেসে উঠে। তাঁকে দেখি এবং আমি আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে-পেচিয়ে দেখি,তখন নিজেকে নিয়ে বড় আক্ষেপ হয়। আমার তাঁর মতো হতে মন চায়। মল্লিকাদিকে খুলে বলি। তিনি হেসে গড়াগড়ি যান।

ভিন্ন ক্লাস হলেও আমাদের স্কুল একই সময়ে শুরু হয়। আমি সাতসকালে বইখাতা কাঁখে নিয়ে মেঠোপথ পেরিয়ে পৌঁছে যাই মল্লিকাদির বাড়ি। সপ্তাহে দু’দিন ঠিক স্কুল বসার সময়টাতে রেডিওতে অনুরোধের আসর বসে। মল্লিকাদি প্রায়ই সেসময়ে মাসির চোখ ফাঁকি দিয়ে স্কুল কামাই করেন। আমিও তাঁর সাথে তাঁদের রেডিওতে গান শুনতে বসে যাই। এসময়ে মাসি বাগানের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমি আর দিদি লুকিয়ে পুকুরঘাটে রেডিও নিয়ে গানের আসরে বসে পড়ি। আমি গানের আগা-মাথা তেমন কিছুই বুঝি না। শুধু মল্লিকাদি যখন রেডিওর খাঁজকাটা নবটা উপর দিকে খানিক ঘুরিয়ে দিয়ে শাহাদত আঙ্গুলটা তার সরু-চিকন ঠোঁটজোড়ায় চেপে ধরে আমাকে চুপ থাকার ইশারা করেন তখন বুঝতে পারি এ মুহূর্তে আমার গলায় আটকে যাওয়া শেষ শব্দটাও চেপে ধরে বসে থাকার সময় হয়েছে। আমি কথা বলতে পছন্দ করি, কারণে অকারণে সত্য-মিথ্যায় মালা গেঁথে গল্প করতে পছন্দ করি। তারপরও রেডিও-র গান শুরু হলে আমি তাঁর নির্দেশ মতো নীরব-নিথর হয়ে বসে থাকি। মল্লিকাদি গানের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। চোখ বুজে থাকেন, চোখের ওপরের কপালটাতে তিরতির কাঁপন ধরে। গানের তাল-লয়- সুরের সাথে তাঁর হাতদু’খানা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উঁচুনিচু হয়ে খেলে যায়। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রই।

মাঝেমধ্যে অবশ্য মাসি এসময়ে আমাদের বাড়ি মায়ের সাথে সুখদুঃখের গল্প পাড়তে যায়। তখন  তাঁর ঘরে বসেও বেশ চলে আমাদের গানের আসর। তাঁর পড়ার টেবিলের সামনে খোলা জানালার বাইরের দিকটায় বনজঙ্গলে ভরা। যতদূর চোখ যায় ঘন বন, ঝোপঝাড়। হিজল মহুয়ার বন। উদাস করা ফুলের গন্ধে মল্লিকাদি উদাস হয়ে সেদিকে চেয়ে থাকেন। গানের সুর তালের সাথে হারিয়ে যান। টলমলে স্বচ্ছ জলে ভরা ডোবার মতো চোখজোড়ায় রাজ্যের ভাবনারা খেলা করে। আমি অধীর হয়ে চেয়ে থাকি। এক সময়ে কবিতার মতো সুন্দর চোখদুটো অবলীলায় বুঁজে যায়, গাল বেঁয়ে অশ্রুধারা নেমে আসে। সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ হয়ে মল্লিকাদি সেদিন আর আমার সাথে গল্প করেন না। আমাকে ছুটি দেন। আমি স্কুলের দিকে একা পা বাড়াই।

মল্লিকাদি সকাল বিকাল হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরেন। তিনি তার দাদুর কাঁছে গান শিখেছেন। দাদু চিতেয় ওঠেছে তাও বেশ কবছর হলো। একসময়ে দাদু কলকাতায় যাতায়াত করতেন। সেখানে তার গান শেখা। মল্লিকাদি খুব ছোটবেলা থেকে দাদুর কাঁছে গান শিখত। রবিঠাকুরের গানই সে বেশি গায়। আমি তার একমাত্র শ্রোতা। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গান শুনি। গানের কিছুই বুঝি না তারপরও আমার পছন্দের গান সে জানতে চায়। রবিঠাকুরের গানের সুর আমার ভালো লাগে। গানের সুরে শান্ত স্নিগ্ধের নির্যাস আছে। কেমন কেমন নরম মিহি সুর, আমার মনে হয় এসব গানগুলো যেনো মল্লিকাদির জন্যেই লেখা হয়েছে। আমি বিজ্ঞশ্রোতার ভাব নিয়ে হারমোনিয়ামের উপর থেকে তার দাদুর আমলের গীতবিতানটা তুলে নিই। গভীর মনোযোগ দিয়ে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে যে কোনো একটা গানের কলিতে আঙ্গুল রাখি। মল্লিকাদি হাসেন তারপরও সে গানটি গায়।

মল্লিকাদির বাড়ি আমার খুব পছন্দ। বাড়িটি বহু পুরনো এবং প্রাচীন বিরলসব গাছ গাছালিতে ঠাঁসা। গাঁয়ের অন্যকোনো বাড়িতে এতসব ফুলফলাদির গাছ-গাছড়া চোখে পড়ে না। কিছু গাছ সেই কলিকাতা থেকে সংগ্রহ করা। অত্র অঞ্চলে এসব গাছ সাধারণত দেখা যায় না। এবাড়ির মূল বসতঘরের দেয়ালের পলেস্তেরা ক্ষয়ে খসে পড়েছে সেই কতকাল আগে। ভারী এবং মোটা দেয়ালের বেখাপ্পা সাইজের লাল ইটগুলোতে ফোস্কার মতো সবুজ শ্যাওলার মোটাকাটা স্তর জমে এর বয়েস কালের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। দেয়ালের ভেতর থেকে গজে ওঠেছে নানাপদের বন্যগাছ।

বাড়ির দক্ষিণ দিকে প্রায় মাটির নিচে দেবে যাওয়া ভগ্নস্তূপের একটি বহুপ্রাচীন দ্বিতল ভবনের অস্তিত্ব জানান দেয় এ বাড়ির পূর্বপুরুষদের ঐশ্বর্য এবং আভিজাত্য। ওই ভবনটি নিয়ে আমার ছোট্ট মনে সহস্র প্রশ্নের জন্ম হয়। মূল বাড়ি থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এবং জঙ্গল – ঝোপঝাড়ে ঘেরা সে ঘরে বহুকাল কারো পায়ের চিহ্ন পড়েনি। ঝোপঝাড় লতাগুল্ম পেরিয়ে মল্লিকাদি খুব সাবধানী পায়ে আমার হাত শক্ত করে ধরে টেনেহেঁচড়ে ভাঙ্গাচোরা পিচ্ছিল অজগরের পিঠের মত সিঁড়ি বেয়ে শেষ সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়ে পড়েন। ঘরে প্রবেশের কোনো পথ নেই। সিঁড়িঘরের জানালার শ্যাওলাপড়া লোহার ফ্রেমের ভেতর দিয়ে কাঠের পাটাতনের মেঝের উপর এক চিলতে রোদ এসে বিছানা গেড়েছে। ভাঙ্গাচোরা ঘরটার যৎসামান্য অস্তিত্ব আমাকে বহু বছর পেছনে টেনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়…

 

মল্লিকাদির কাছে সেসব দিনের বহু গল্প শুনেছি। পূজাপার্বণে এ বাড়িতে কলিকাতা থেকে বিখ্যাতসব বাঈজীরা আসতো। সারা সপ্তাহ জুড়ে গান-বাজনার আসর বসত। তখন এ অঞ্চলের জমিদার এবং উচ্চবর্ণের বিত্তশালী হিন্দুদের সামাজিক কার্যক্রমের অংশ ধরা হত এসব নাচ-গানের জলসাকে। তাঁরা কলিকাতার নামকরা সব বাঈজীদের ভাড়া করে এনে রঙতামাশায় মজে থাকতেন। তাঁদের সব বাড়িতে বৈঠকখানা কিংবা বাংলাঘরের মতো প্রয়োজনীয় ছিলো বাইজীঘর। বছরজুড়ে পূজাপার্বণে এবং বিভিন্ন উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ এবং অনুষঙ্গ ছিলো এসব বাঈজীরা। কে কত বিখ্যাত এবং উচ্চমূল্যে বাঈজী ভাড়ায় সক্ষম সে নিয়ে নোংরা প্রতিযোগিতাও প্রকাশ পেত। রূপ, বয়স এবং নাচের পারদর্শীতার উপর বাঈজীদের দরদাম হত। তাদের নাচগান- রঙঢঙ কাছ থেকে দেখার সুযোগ সর্বসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত ছিলো না। এমনকি তাঁদের নিজেদের ঘরের বউ-ঝিরাও এসব বিনোদন থেকে বঞ্চিত ছিল। জমিদারের পছন্দের ঘনিষ্ঠজনেরা বাঈজীঘরে নাচ-গান এবং পানাহারের বিশেষ ব্যবস্থায় উপস্থিত থাকত। কিন্তু কাঠের পাটাতনের মেঝের সাথে বাঈজীদের পায়ের ঘুঙুরের মিশ্র আওয়াজ বহুদূর থেকে শোনা যেত। হতভাগা সেসব মানুষ সে আওয়াজেই বিভোর হত। এ ঘরের কাছে এলে আমি একটা ঘোরের মধ্যে চলে আসি। বাঈজীদের রঙচঙ মাখা মেকি চেহারার ভেতরের আসল রূপটা স্পষ্টতই চোখের সামনে ভেসে উঠে, কান পাতলে বিরহঘুঙুরের আওয়াজ শুনি। জমিদারের বউঝিদের বোবাকান্নার সুর আজও এ বাড়ির বাতাসকে ভারী করে ভেসে বেড়ায়।

 

এবাড়ি ঘিরে অনেকগুলো বসতঘর ছিলো, অনেক মানুষজন ছিলো এবং অনেকগুলো জীবনের গল্পও ছিল। সেসব এখন ধুলোজমা ইতিহাস। চিহ্ন বলতে দু’চারটে ইট- কাঠ- সুরকির ভগ্নাংশ মাটির গভীরে লুকিয়ে আছে। মাটি খুঁঁড়লে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে এসে অতীতদিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। মল্লিকাদির মুখে কিছু গল্প আমি শুনেছি বাদবাকি দিনের মানুষজনের গল্প আমার মাথার মধ্যে কল্পনার পাখায় ভর করে উড়ে এসে গেঁড়ে বসে। আমি এ বাড়ির চারপাশের বাতাসে সেসব গল্প ভেসে বেড়ানো ঝনঝনানি শব্দ শুনতে পাই, চোখ বুজঁলে ছায়াছবির মতো সেসব গল্পের মানুষগুলোর ছুটোছুটি স্পষ্টতই যেন দেখতে পাই। মল্লিকাদি আমার কথা শুনে সারা শরীর দুলিয়ে হেসে উঠেন, মুহূর্তে কেমন উদাস হয়ে যান। তিনি নিজেও নাকি রাতদুপুরে তাদের হেঁটেচলার শব্দ পান। কান বিছালে ফিসফিসানি গল্পকথার আওয়াজ শুনতে পান।

বাড়ির পূবদিকের পুরনো দীঘিটা কাকচক্ষুর মতো পরিষ্কার ঠাণ্ডা জলে ভরে থাকে বারোমাস। দীঘির চারিপাশে হিজল- কদম- মহুয়ার সারিবদ্ধ গাছগাছালিতে ঠাঁসা। বাড়ির মূল অংশ থেকে সাপের দেহের মতো নেতিয়ে পেচিয়ে লাল ইট- সুরকির সিঁড়িটা নেমে এসে সখ্যতায় মিলেছে দীঘির জলের সাথে। সিঁড়ির অস্তিত্বও মুছে যাওয়া এ বাড়ির ইতিহাসের মতোই ক্ষয়ে গেছে। উপরে প্রলেপের চিহ্নমাত্রা নেই। গুটিকয় ইট সুরকি শতায়ু বৃদ্ধের দাঁতের মতো ধারালো অথচ ঠুনকো- নড়বড়ে হয়ে কোনোমতে টিকে আছে।

দীঘিরপাড়ের গাছের ডালে জানা অজানা পাখিদের আড্ডাখানা। মল্লিকাদি আমার কাছে পাখি বিশারদ। বিকেলবেলায় আমরা দীঘির পাড়ে ঘুরে বেড়াই। মল্লিকাদি আমাকে ইষ্টিকুটুম পাখি চেনান। যে পাখি ডাকলে বাড়িতে কুটুম আসে। আমাদের পায়ের তলায় পিষে যাওয়া শুকনো পাতার মচমচ আওয়াজে পাখি ছুটে পালায় দূরে কোথাও। আমরা পাখির পেছন ছুটতে ছুটতে দীঘির সীমানা ছেড়ে খানদের অন্দরমহলে অনেকটা বেখেয়ালে ঢুকে পড়ি। অবশ্য দীঘিটা এখন আর মল্লিকাদিদের নিজেদের নাই ঠিক যেমন নাই- তাদের বসতবাড়ির বারোআনি। মল্লিকাদির বড়দাদা তাঁর দাদাকে রেখে অন্যসব ছেলেমেয়ে নিয়ে ওপার বাংলায় পাড়ি দিয়েছেন সেই সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পরপর। তাঁর দাদাকে অবশ্য বহু চেষ্টা তদবির করেও সাথে নেওয়া যায়নি। এরপর তাঁর দাদার ভাইরাও বারকয়েক কলিকাতা থেকে এসেছেন তাঁকে ফিরিয়ে নিতে কিন্তু তিনি দেশ ছেড়ে যাননি। মল্লিকাদির বাবাও ঠিক তাঁর দাদার মতো। একাত্তর এর পর তাঁর বড় জ্যাঠামশাই তাঁকে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি কিন্তু তাঁর একই কথা। দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু হওয়ার বাসনা তাঁর নেই। তাঁর কাছে ব্রিটিশ ভারত- পাকিস্তান- বাংলাদেশ বলে কোনো বিভাজন নেই, নেই কোনো সীমারেখা। তাঁর সাতপুরুষের নাড়িপোঁতা ভিটেটাই আসল বাকিসব মানুষের তৈরি বিভাজন- তিনি তা মানতে নারাজ।

মল্লিকাদির বড়দাদা খানদের সাথে তাঁর বাড়ি অদল বদল করে দেশ ছেড়েছেন। খানরাও একসময় দাপুটে ছিলো ওপার বাংলায়। সাতচল্লিশের পর তাঁরা সেখানে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন। সিরল র‍্যাডক্লিফের পেন্সিলের আঁচড়ে ব্রিটিশ ভারত কেটে ছিঁড়ে রক্তাক্ত হয়। তিনি পালিয়ে বেঁচে যান কিন্তু কোটি কোটি মানুষের অন্তরে জ্বালিয়ে দিয়ে যান তুষের আগুন। যে আগুনে পুড়ছে বংশ পরম্পরায় আজও শত সহস্র লোক। হাজার হাজার বছরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ধর্মবর্ণের মানুষের ইতিহাস -ঐতিহ্য, পারস্পারিক সহাবস্থান, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এসব কিছুকেই মুহূর্তে ধূলোয় লুটিয়ে দেয়া হয় দেশভাগের অভিশাপে। মানুষ হন্যে হয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। তাদের অতি কাছেরজন, চির পরিচিত পথঘাট সহসাই অচেনা হয়ে উঠে। প্রায় একশ থেকে দুইশ লক্ষ লোক বাস্তুচ্যুত হয়।। এক থেকে বিশলক্ষ লোক মারা যায়। সেসময় খানরা নিজেদের ভিটেমাটি বদল করে এপার বাংলায় মল্লিকাদিদের প্রাচীন এই বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন।

নোমান আলী খান- বয়সে মল্লিকাদির চেয়ে বছর চার পাঁচেকের বড় হবে বৈকি- খানদের বংশের ছোটছেলে। মাথাভর্তি পাটল রঙের কোঁকড়া ঝাঁকড়া একগুছা চুল। গায়ের রঙ পরিষ্কার দুধে আলতা, লম্বা- চওড়া মেদহীন সুঠামদেহী- দীঘিরপাড়ে হাওয়া বাতাস খেতে বিকেলে হেঁটে বেড়ান। আমাদের পায়ের আওয়াজ পেতে আজ একটু জলদিই এসেছেন বোধকরি। আমি মল্লিকাদির চোখের ইশারায় প্রতিদিনের মতো তার কাছে ছুটে যাই। সে খুব গোপনে হাসিমুখে দোয়াতকলমের আঁচড়ে লেখা একগুচ্ছ স্বপ্ন আমার হাতে তুলে দেন। আমি স্বপ্ন নিয়ে ভোঁ দৌড়ে দীঘির এপারে অপেক্ষায় থাকা মল্লিকাদির কাছে ফিরি। মল্লিকাদি খুব গোপনে কাগজগুলো লুকিয়ে রাখেন। এসময়ে আমি চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখি, পাছে কেউ যদি দেখে ফেলে। পরেরদিন বিকেলে মল্লিকাদির স্বপ্নগুলো নোমান আলী খানের কাছে ডাকহরকরার মতো পৌঁছে দেই।

স্বপ্নগুলোর রঙ কেমন! যেমন জানি না, জানতেও চাইনা। কিন্তু বিশ্বাস করি আমার মল্লিকাদির চাওয়া অসুন্দর হতে পারে না। নোমান আলী খান শহরে পড়াশুনা করেন। ছুটিছাটায় বাড়ি চলে আসেন। ছুটি পার হলেও তাঁকে লম্বা সময় ধরে বাড়িতে দেখা যায়। বিকেলে সময় করে তাঁদের স্বপ্ন বদল হয়। এক সময় নোমান আলী খান শহরে ফিরেন। তখন স্বপ্নেরা অদল বদল হয় না কিন্তু দুজনের মাঝের স্বপ্নগুলো সকাল সন্ধ্যায় মল্লিকাদি হিজলফুলের মালায় গেঁথে রাখেন, মহুয়ার বনে উতলা হয়ে গুনগুনিয়ে গান গান। মল্লিকাদি তখন অন্যমানুষ হয়ে যায়। আমি মল্লিকাদির পেছন পেছন ঘুরঘুর করি।

মল্লিকাদির বাবা এমনিতে বেশ আমুদে মানুষ। তিনি নিজেও গান জানেন এবং গানবাজনার সমঝদার। বছরখানেক আগেও তাঁকে সকালবেলা মল্লিকাদির সাথে হারমোনিয়াম নিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইতে দেখা যেত। আমাকে খুব করে চাইতেন গান শেখাতে। সে চেষ্টারও সে ত্রুটি করেন নাই। আমি নিজেও গান খুব পছন্দ করি। কিন্তু আমার হেড়ে গলা আমাকে গায়েন নয় মনোযোগী শ্রোতা বানিয়ে রাখে। তাঁর স্থানীয় বাজারে সোনারূপার গহনা গড়ার দোকান আছে। আমার জন্মের পর তিনি নিজ হাতে আমাকে একজোড়া সোনার কানের সাদা পাথরের ফুলের দুল বানিয়ে উপহার দেন। দূর থেকে সাদা পাথর হিরকখণ্ডের মতো জ্বলজ্বল করে। আমার যখন দুই বছর তখন কান ফুঁটা করে হিরকখণ্ড আমার কানে ঝুলিয়ে দেয়া হয় আজ অব্দি তা আমার কানে জ্বলজ্বল করছে।

এক সময়ে এ তল্লাটের জমিদারের সাথে বিষয় সম্পদে তাঁদের তুলনা করা হত। এবং জমিদার তাঁদের বিশেষ সম্মন দিতে বাধ্য হতেন। কিন্তু কালক্রমে সেসব সম্পদ- সম্মান হারিয়ে এখন কোনমতে টিকে আছেন। সম্পদও নেই কাছের আপনজনরাও তাঁকে রেখে ওপার বাংলায় পাড়ি দিয়েছে। তিনি শুরু থেকেই দেশ ছেড়ে অন্যদেশে পালিয়ে যাওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। তাঁর কাছে পালিয়ে বাঁচার নাম মরণ। নিজের দেশ তাঁর কাছে মায়েরমতো, পূর্বপুরুষের পদচিহ্নমাখা ভিটেমাটিও যেন স্বর্গ। মাকে বিসর্জন দিয়ে অন্যদেশে পালিয়ে বাঁচা জীবন নয় তা মরণের শামিল। সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু ইদানিং তাঁকে কেমন অন্যরকম দেখায়। উদভ্রান্ত হয়ে ছুটে ফেরেন। তাঁর চলাফেরা, আচার ব্যবহার কেমন যেন ছন্নছাড়া অচেনা মনে হয়। সকাল-বিকাল আমার বাবার কাঁছে গোপন কিসব বিষয় নিয়ে শলাপরামর্শ করেন। আমি আমার স্বভাব মতো কান পেতে রাখি। কিন্তু দুর্ভেদ্য সে বিষয় বুঝতে না পারলেও বিষয়সম্পত্তি বিষয়-আশয় নিয়ে কথা হয় তা অবশ্য আন্দাজ করতে পারি।

মল্লিকাদির মা মাটির মানুষ। চেহারা সুরত মল্লিকাদির সাথে শতকরা একশভাগ মিলে যায়। কিন্তু গায়ের রঙ টকটকে লাল জবার মতো। কণ্ঠস্বর মাঘমাসের দীঘিরজলের মতো শীতল। আমি এ পর্যন্ত তাঁর চড়া গলার কথা শুনতে পাইনি। কোমল কণ্ঠে এবং ধীরগতিতে যখন কথা বলেন মনে হয় যেন কলের পুতুল, ব্যাটারি চেপে কথা বেরিয়ে আসে। যখন কথা বলেন শুনতে হলে বাড়তি মনোযোগ লাগে। তিনি যখন কথা বলেন আমি বাড়তি মনোযোগে কান বিছিয়ে শুনি। বাবার বাড়ি পার্শ্ববর্তী জেলায়। সেসব আপনজন অবশ্য বহুকাল আগেই দেশ ছেড়ে জায়গামতো ওপার বাংলায় চলে গেছেন। এদেশে তাঁর নিকট কোনো আত্নীয়স্বজন নাই বলেই জানি। আমার মায়ের সাথে তাঁর বেশ ভাব।

গাঁয়ের অন্যসব বাড়িতে তাঁকে তেমন যেতে দেখা যায় না। সারাক্ষণ বাড়ির ভেতর বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখেন নিজেকে। সকাল – সন্ধ্যা পূজা অর্চনা করেন। গাছগাছালির যত্নআত্তিতেও বেশ পারদর্শী। তাঁর রান্নাঘরের চালের উপর বারোমাস চালকুমড়ো ঝুলে থাকে। তাঁর হাতের চালকুমড়োর মুরব্বা আমার কাঁছে অমৃত লাগে। মল্লিকাদি যখন পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকেন আমার সময়টা তাঁর সাথে গাছগাছড়ার পরিচর্যায় মন্দ কাটে না। আমাদের বাড়িতে আমার মায়ের কথার চড়া-দাম আছে। মায়ের পরামর্শ ছাড়া কোনোকিছুই ঘটবার নয়। আমার বাবা মায়ের কথার বেশ মর্যাদা দেন। সে হিসেবে আমাদেরও মায়ের নির্দেশ এর বাইরে যাওয়ার উপায় থাকে না। কিন্তু এ বাড়িতে তার বিপরীত চিত্র দেখি। মল্লিকাদির মা কথা বলেন না। তাঁর কথা বলার কোনো সুযোগ থাকে না। মল্লিকাদির বাবার আদেশ নির্দেশ মতো সবকিছু চলে। মাছের সাথে কোন আনাজ যাবে সেটাও তাঁর বাবা ঠিক করে দেন এবং তাঁর মা কিংবা মল্লিকাদি তাঁর বাবার চাওয়াগুলো বিনাবাক্য ব্যয়ে পূরণ করে চলেন।

মল্লিকাদির হাইস্কুল পাশ হয়। আমিও পরের ক্লাসে উঠে যাই। এ সময়টাতে আমাদের পড়াশুনার চাপভাব তেমন নেই। আমার নতুন বইয়ে মল্লিকাদি বিদেশী ম্যাগাজিনের ভারী কাগজে মলাটের নেকাব পরিয়ে দেন। আমি পাঁশে বসে নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকি। মলাটের উপর লাল-নীল পেন্সিলে আমার নাম লেখেন, পাঁশে গুটিকয় হৃদয় চিহ্ন এঁকে দেন। আমি ভারী লজ্জায় লাল হয়ে যাই । মল্লিকাদি আমাকে চিহ্নটার বিষয়ে জ্ঞান দেন। আমি অবশ্য এ জ্ঞান আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে আগেই জেনে নিয়েছি। কিন্তু সেকথা তাঁর কাছে গোপন করি। মল্লিকাদির কাছে আমি এখন অনেক বিষয় গোপন রাখি। যদিও আমি তা চাই না। মল্লিকাদি আমার আধার- আশ্রয়। বুঝতে শেখার পর থেকে আমি তাঁর কাছে সবচেয়ে খোলামেলা এবং স্বচ্ছন্দ। কিন্তু কেন গোপন করি তা নিজেও জানি না, শুধু জানি গোপন করতে হয়। কিছুদিন আগে আমার ক্লাশের এক ছেলে ঠিক এরকম একটি চিহ্ন এঁকে আমাকে খুব গোপনে হাতে ধরিয়ে দেয়। আমি অন্যদের কাছ থেকে লুকাতে বইয়ের ভাঁজে যত্ন করে রেখে দিই। বাড়ি এসে সঙ্গোপনে সে চিহ্ন আঁকা কাগজটির ভাঁজ খুলি, অসম্ভব ভালোলাগায় চোখে জল চলে আসে অবশ্য লজ্জার মাত্রাও ভালোলাগার চেয়ে কম ছিল না। বারকয়েক চিহ্নটাতে হাত বুলিয়ে ছিঁড়ে কুচিকুচি করে বাড়ির পাশের মরা ডেঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছি। পাছে কেউ যাতে দেখে না ফেলে। কাউকে তো নয়- ই মল্লিকাদিকেও সেকথা বলিনি।

আমাদের গাঁ থেকে পাশের গাঁয়ের দূরত্ব হেঁটে গেলে বড়োজোর কয়েক কদম কিন্তু দু’গাঁয়ের সীমানা ঘেঁষে এক চিলতে বাঁশের ফালির মতো একখানা মরানদী জলকাঁদায় মাখামাখি অবস্থায় সীমানা খুঁটি হয়ে সেই কতকাল হয় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। নদীর এপার আমাদের গ্রাম ওপারে নয়ানগর গ্রাম। গ্রামের নাম শুনেই আঁচ করা যায় গ্রামগুলির গোঁড়াপত্তনের ইতিহাস। ইতিহাস সেকথাই বলে।

আশেপাশের গ্রামগুলো নাকি নদীরই অংশ ছিলো। এ নদী দৈর্ঘ্যে প্রস্থে সে সময়ের প্রমত্ত পদ্মা নদীকে ছাড়িয়ে ছিল। মানুষ ধীরে ধীরে নিজেদের প্রয়োজনে নদীকে দুদিক থেকে ভরাট করে গিলে খেয়ে মরা খালে এনে দাঁড় করিয়েছে। উন্নাকালে নদীর পানি শূন্যে নেমে আসে। অবশ্য তাতে নদীর না যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, মানুষের হয়েছে তাঁর থেকে ঢের বেশি। নদীকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিল এ অঞ্চলের মানুষ। নিজেদের স্বার্থ হাসিলে সে নদীকে হজম করে,পানিশূন্য করে এখন পানির জন্যে হাহাকার করে বারোমাস। মল্লিকাদি যখন আমাকে এসব গল্প করেন আমি অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রই। মুখ চোখে কেমন মনকাড়া অভিব্যক্তি,হাত-পা নেড়েচেড়ে অনেকটা আমাদের স্কুলের বাংলা স্যারের মতো করে বুঝিয়ে কথা বলেন। প্রকৃতির প্রতি এত টান- ভালোবাসা প্রকাশ করার ধরণে আবেগে তাঁর গলা ধরে আসে। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি এবং নদীর উৎপত্তিস্থল হতে চুইয়ে ঝরিয়ে নদীর বুকে কিছুটা হলেও জলের দেখা মেলে। নদীর উপর বাঁশের সাঁকো। ওপারের গাঁয়ে মল্লিকাদির বন্ধুর বাড়ি। আমরা সাঁকো পেরিয়ে তাঁর বন্ধুর বাড়ি যাই। বন্ধুর বাড়ি আমরা ইদানিং একটু বেশিই যাই।

মল্লিকাদি গল্প করেন আমরা চুপচাপ তাঁর গল্প শুনি। মল্লিকাদি বার কয়েক কলিকাতা ঘুরে এসেছেন। সেসব গল্প আমার কাছে যেমন আকর্ষণীয় তাঁর বন্ধুর কাছেও। আমরা আমাদের বাড়ির সীমানার বাইরে তেমন কোথাও যাওয়ার সুযোগ পাইনি, বড়জোর পাশের জেলায় নানার বাড়ি অব্দি গিয়েছি। মল্লিকাদি কলিকাতার ভাষাও রপ্ত করেছেন। কলিকাতার শাড়ি পরে নিজেকে ঘুরিয়ে পেচিয়ে আমার সামনে যখন দাঁড়ান, আমি অচেনা মল্লিকাদির দিকে তাকিয়ে থাকি। সেদিন তাদের পুরনো প্রাচীন লোহাকাঠের কচ্ছপের পিঠের মতো অমসৃন আলমিরাটা থেকে সাক্ষাত কলিকাতা থেকে আসা তাঁর নীল সিল্কের শাড়িটা আমাকে বের করে দেখায়। আসছে দুর্গাপূজার জন্যে কলিকাতার স্বজ্নদের কাছ থেকে উপহার পাওয়া। মল্লিকাদি বাসায় সবসময় চওড়া পাড়ের ঢাকাই তাঁতের শাড়ি পরে। শাড়ির সাথে মিলিয়ে কুমকুমের একটা গোলাকৃতি টিপ দুচোখের মাঝ বরাবর কেমন রহস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার কাছে মনে হয় যেন বিশাল আকাশের গাঁয়ে লাল টুকটুকে সূর্যটা ভেসে আছে। আজ সে কলাপাতা রঙের জমির উপর লাল নীল ছোট ছোট বন্যফুল বসানো চওড়া লাল পাড়ের তাঁতের শাড়ি পরে বন্ধুর বাড়ির উত্তরপাশের দীঘিরজলে পা ডুবিয়ে বসে আছে। নোমান আলি হাত নেড়ে নেড়ে গল্প বলছেন। আমি আর মল্লিকাদির বন্ধু, দীঘির দুপাশে সতর্ক চোখে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা বিকেলবেলায় প্রায়ই এখন ঘটা করে তাঁর বন্ধুর বাড়ি চলে আসি। এবং একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।

নোমান আলীর বাপ চাচারা অত্র অঞ্চলে বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন বিশেষ করে বাংলাদেশ পাকিস্থান পৃথক হওয়ার পর থেকে। শিক্ষিত এবং মার্জিত এই বৃহদাকার পরিবারটি সাতচল্লিশ এর বিভাজনের পর যখন এদেশে আসে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। আস্তে-ধীরে অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। একসময়ে বাড়ির ছেলেরা শহরমুখী হয়। চাকুরিবাকুরির ব্যবস্থা হয় মানুষজনের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয় এবং সে অবস্থান থেকে বেরিয়েও আসে। মুক্তিযুদ্ধের সময় খানরা বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে কাজ করেছে। অবশ্য সেসময় মল্লিকাদিদের আশ্রয় না দিলে তাঁদের জন্য টিকে থাকা মুশকিল ছিলো বটে। এ সময়ে বহু হিন্দুপরিবার ওপারে পালিয়ে জানে বেঁচেছিল। মল্লিকাদির পরিবার কোনমতে বাড়ির এককোনে শিকড় আঁকড়ে পড়েছিলেন ঠিক যেমন এখনো আছেন।

কিন্তু লোকমুখে চাওর হয়ে ঘুরে বেড়ায় ভিন্ন কথা- পুরোবাড়ির মালিকানার কাগজপত্র খানদের দখলে আছে। খানদের মহানুভবতায় এরা এ বাড়িতে বাস করছে। নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে আসার কষ্ট খানদের জানা আছে। তাইতো বাড়ির এককোনে পড়ে থাকা নির্ঝঞ্ঝাট পরিবারটিকে এরা বাস্তুহারা করেনি। বাড়ির যখন অদল- বদল হয় তখন নাকি পুরোবাড়ির মালিকানার কথাই কাগজে লেখা হয়।

অবশ্য খানরা প্রাসাদসম বাড়ি ফেলে এসেছে কলিকাতায় যেটা এখন মল্লিকাদির চাচা জ্যাঠারা বাস করছেন। জান নিয়ে বেঁচে থাকাই তখন মূল উদ্দেশ্য ছিল। দাঙ্গার সময় খানদের খুব কাছের বেশ কজন স্বজন জীবন হারিয়েছে। তাঁদের পরিবার সেসময়ে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনার ভেতর দিয়ে যায়। ইতোপূর্বে এমন নির্দয়ভাবে কেউ হয়তো খুন হয়নি- এমন কী ধর্মের কারণে বন্ধু তাঁর খুব কাছের বন্ধুকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করার নজির বোধহয় ভারতবর্ষে এর আগে এমনভাবে ঘটেনি। খানদের পরিবারের প্রধানকে তাঁর খুব কাছের প্রায় চারযুগ একসাথে সুখদুঃখ ভাগ করে চলা বন্ধু খুন করে। খানরা সেসময়ে এমন চরম অভিজ্ঞতার ভিতর থেকে এবং খুব দ্রুত সময়ে তাঁদের পরিচিত এক প্রতিবেশীর সাহায্যে মল্লিকাদিদের বাড়ির সাথে নিজেদের প্রাসাদবাড়ি বদলে চলে আসেন।

মল্লিকাদির কাছে খানদের প্রাসাদবাড়ির গল্প আমি বহুবার শুনেছি এবং নিজের মনে এ বাড়ি এবং বাড়ির মানুষজন নিয়ে কল্পনায় গল্পও এঁকে নিয়েছি। চোখ বন্ধ করে আমি সেসব যেন স্পষ্ট দেখতে পাই— সামনের বিস্তর ধুধু খোলা প্রান্তর ( এক সময়ে এখানে ঘোড়াহাতির বিচরণ ছিল ) পেরিয়ে মূল ফটকে এসে চোখে পড়ে সিংহখচিত প্রবেশদ্বার। বহুকালের পুরনো সেই প্রবেশদ্বারের কাঁছে এলে যে কেউ থমকে দাঁড়াবে। ফিরে যাবে শতবর্ষ কিংবা কয়েক শতবর্ষ পেছনে ফেলে আসা পূর্বপুরুষদের সোনালী অতীতের দিনগুলোতে। স্বভাবত চোখ উৎসুক হবে ভেতরে দৃষ্টি রাখতে- সাদা ধবধবে ধবল বকের পাখার মতো শুভ্রসাদা বহুকক্ষ নিয়ে ইংরেজি ‘ই’’ অক্ষর আকৃতির দ্বিতল ভবন। ভবনের ভেতর প্রতিদিন হাজার লোকের কোলাহল, হাজার রকমের গল্প। একসময় হঠাৎ করেই অনেকটা রাজকন্যার আগুনকাঠির স্পর্শে গল্পরা সব নিভে যায়। একটা সময় পর অবশ্য নতুন গল্পরা এসে সে বাড়িতে ভিড় করে কিন্তু এ গল্পগুলো হয় প্রচণ্ড মন খারাপের গল্প, শিকড়বিহীন বিষাদ পালকে ভর করে কোনোমতে বেঁচে থাকার গল্প। কল্পনা নয় সত্যি এসব গল্পের এখানটাতে এসে আমি আমার চোখ খুলে ফেলি। আর এগুতে পারি না। গলার নিচের অংশ কেমন বুজে আসে, বুকটাতে ভিড় করে কষ্টের মেঘেরা। দেশ বিভাজনে আমরা প্রাণহীন,কষ্ট বিষাদে ভরা একখণ্ড ভূখণ্ড পেয়েছি; হারিয়েছে হাজার হাজার বছরে গড়ে ওঠা নানান ধর্ম বর্ণ গোত্রের মাঝের ভাতৃপ্রতিম বন্ধুর সম্পর্ক। দেশ বিভাজন এবং দাঙ্গার পর আমাদের পরস্পরের মধ্যে যে বৈরিতা এবং সন্দেহের বীজ বোনা হয়েছে তা আজ অবধি আমাদের রক্ত ধারায় বয়েই চলেছে !

মল্লিকাদির বাড়ি এবং আমাদের বাড়ির পরিবেশ বেশ কদিন হয় একটু বেশিই চুপচাপ। অসারতা – নিরবতায় ঢাকা- যা হরহামেশা থাকে না। তাঁর বাবাকে দেখি সারাক্ষণ বাড়ির সামনের তুলসীতলের ধার ঘেঁষে পুরনো একটা ক্ষয়ে যাওয়া ইমারত খণ্ডের ওপর চুপচাপ বসে থাকেন। চোখের দৃষ্টি পাথরের মতো ঠাণ্ডা এবং স্থির, তাকিয়ে থাকেন বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে- কদম মহুয়ার বনের দিকে। আমার সাথে তাঁর একটা দূরত্বের সম্পর্ক ছিল সবসময়ই কিন্তু এতোটা ছিলো না এখন যতটা অনুভব করছি। হাসিমুখে কথা বলেন খোঁজখবর নেন। আমাকে তিনি খুব স্নেহ করেন কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আমি তাঁর ধার খুব একটা ঘেঁষতাম না যেমন সম্পর্ক মল্লিকাদি কিংবা তাঁর মায়ের সাথে আমার ছিল কিন্তু তাঁর সাথে তেমনটা হয়ে ওঠেনি। শুনেছি তাঁদের জাত ব্যবসা- সোনারু দোকান বেচে দিয়েছেন। মল্লিকাদির মা আগাগোড়া চুপচাপ স্বভাবের। দুনিয়ার তাবৎ পরিবর্তন তাঁর উপর তেমন প্রভাব ফেলে না। তাঁকে চন্দ্রের দেশে ফেলে আসলেও বোধহয় তাঁর স্বভাবের পরিবর্তন ঘটবে না। তাঁকে দেখা যায় সকাল-বিকাল আমার মায়ের কাঁছে ছুটে আসতে। খুব সাবধানী গলায় শলাপরামর্শ করে আস্তে ধীরে বাড়ি চলে যান। আমি কঠিন মনোযোগ দিয়েও বিষয়ের আঁচ করতে পারি না। তাঁদের বাড়ির অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাতের অন্ধকারে আমাদের বাড়িতে রেখে যান।

মল্লিকাদির কপালের টিপের কুমকুমের সাতরঙা কৌটার প্রতি আমার আক্ষেপনজর বহুদিনের। কলকাতার জিনিস। আর তাঁর ঝুমকো পায়েল জোড়া- নিজ হাতে তার বাবা বানিয়ে দিয়েছেন। কত রাত ঘুমোতে পারিনি তার মত পায়েল পরে দেবী হয়ে ঘুরে বেড়াব পুরো তল্লাট ! মল্লিকাদি কুমকুম আর ঝুমকো পায়েল জোড়া আমার হাতের মুঠে শক্ত করে ধরিয়ে দেন। আমি মাথা নিচু করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকি। মুখে কিছুই বলেন না কিন্তু আমি তাঁর গলা বুজে আসা কণ্ঠস্বরে কষ্টের সমস্তটা আঁচ করতে পারি। বর্ষার জলে ভরা থৈ থৈ দীঘির মতো চোখজোড়া অশ্রুজলে টলমল করে।

আমি তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করি না। খুব কঠিন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, বুঝতে বাকি থাকে না। বিকেলে নিঃশব্দে দুজনে সাঁকো পেরিয়ে নদীর ওপারে মল্লিকাদির বন্ধুর বাড়ি যাই। পথে আমাদের একবাক্য কথাও ব্যয় হয় না। নোমান আলী খানের সাথে সেই দীঘির শাণবাঁধানো- ঘাটে তাঁদের পাশাপাশি বসা হয়। আগের মতো জলে পা ডুবিয়ে আয়েশি আমেজের দেখা মেলে না। শেষ বিকেলে নিঃশব্দে আমরা বাড়ির পথে পা বাড়াই। সাঁকোর মাঝপথে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে দৃষ্টি ফেরালে লাল টকটকে বিদায়ী সূর্যটায় চোখ আটকে যায়। সূর্যাস্তে বিষাদের সুর থাকে ঠিক যেমন সূর্যোদয়ে থাকে সুখস্বপ্ন- মল্লিকাদির কথা। আমরা প্রায়ই সূর্যাস্ত দেখতে বাঁশের সাঁকোর মধ্যিখানে নীরবে দাঁড়িয়ে যেতাম আজও স্বভাব মতো থমকে দাঁড়াই। পশ্চিম আকাশ বিষাদের লাল আভায় মুড়ে আছে। মল্লিকাদির কান্নাভেজা চোখজোড়ায় বিষাদের রঙের বড় বেশি মাখামাখি টের পাই। আমি আমার বাড়ির পথে পা বাড়াতে মল্লিকাদি আমার হাতজোড়া তাঁর হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরেন। দীঘির জলের টলমল অশ্রুফোঁটা আমার হাতে গড়িয়ে পড়ে। আমি আলতো ভাবে হাত ছাড়িয়ে বাড়ির পথ ধরি।

এরপর দিন-মাস-বছর ক্ষয়ে গেছে বহুবার, দু’যুগেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। মল্লিকাদি ওপার বাংলায় চলে যাওয়ার পর আমার সাথে আর তাঁর দেখা হয় নাই। কিন্তু বহু বছরে অযত্নে ধুলোর আস্তরণ ঢেকে থাকা পুরনো আমলের কাঠের আসবাব থেকে জমাটবাঁধা ধুলো সরালে যেমন ঝকঝকে তকতকে হয়ে উঠে, আমার নিউরনে জমে থাকা সেসব স্পষ্ট স্মৃতিরা বর্তমানকে পাশ কাটিয়ে অতীত দিনের ঝালট খুলে আমাকে মল্লিকাদির পাশে নিয়ে প্রায়ই দাঁড় করিয়ে দেয়।

 

জাকিয়া শিমু। পেশায় শিক্ষক। লিখছেন দীর্ঘদিন ধরেই। বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলা, যাকে বিক্রমপুরও বলা হয় সেখানে জন্ম তার। এখন আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ