আমি লিখি এমনি এমনি

কাকন রেজা
কবিতা, প্রবন্ধ
Bengali
আমি লিখি এমনি এমনি

কবিতা কেন পড়ি এবং লিখি, প্রশ্ন দুটোর উত্তর দেয়া একই সাথে জটিল আবার সোজা। নিজেকে অকপট প্রকাশ করতে চাইলে সোজা, আর বুদ্ধিজীবী সাজতে গেলে কঠিন। আমি যদি আমার জায়গা থেকে বলি, তবে কবিতা পড়া এবং লিখা দুটোই আমার জন্মগত। বলতে পারা যায় জেনেটিক। সোজা কথা আমার বাবা কবিতা লিখতেন। ধরাধামে আসার পর চোখ খুলে হয়তো ঘরে বইয়ের দর্শন আগে ঘটেছে। হয়তো বললাম এ কারণে জন্মকালীন স্মৃতি মনে নেই, মনে থাকার কথা নয় বলে। তবে যখন বুঝতে শেখা শুরু করেছি, তখন থেকেই দেখছি বাবা পড়ছেন এবং লিখছেন। একাধারে তিনি সাহিত্য রচনা করেছেন, করেছেন সাংবাদিকতা। বাবার পদছাপ অনুসরণে আমিও ওই দুটো কর্মই করে যাচ্ছি। তবে বাবা গল্প এবং উপন্যাসও লিখেছেন। আমার পক্ষে উপন্যাস সম্ভব হয়ে উঠেনি ধৈর্যহীনতার কারণে। গল্প দু’একটা লিখলেও সেই একই কারণে ধরে রাখতে পারিনি। অতএব আমার ক্ষেত্রে বলাটা সহজ এবং অকপট, আমি পরম্পরায় কবিতা পড়া এবং লিখা শুরু করেছি।

তবে বুদ্ধিজীবী সাজতে চাইলে বলতে পারতাম, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমার কবিতা লিখার শুরু। হ্যাঁ, আমার কবিতার ধরণটাও তাই; বললে চালানো যেতো। প্রেমের সাথে বিপ্লবের মিশেল রয়েছে। রয়েছে শরীরী কথকতাও। সে অনুযায়ী ইচ্ছার প্রাধান্যে কবিতাগুলো নানা ‘বাদ’ সহযোগে আখ্যা দেয়া কঠিন কিছু ছিলো না। তবে আমি তা দিইনি বা দিচ্ছি না। কবিতা আমার জন্মগত, রক্তগতও বলতে পারেন। আমি যা দেখেছি যা অনুভব করেছি তাই লিখতে চেষ্টা করেছি।

আমার লিখার ধরণটা সহজ। খুব সহজবোধ্য শব্দের ব্যবহারে আমি সচেষ্ট থেকেছি কবিতায় বা লিখায়। আমি পরিষ্কার ভাবে বলতে চাই, আমি সাধারণের জন্য লিখি, বোদ্ধাদের জন্য নয়। কঠিন শব্দ এবং বাক্যের অহেতুক ও অর্থহীন কাঠিন্য দিয়ে পাঠকদের কাছে দুর্বোধ্য হতে চাইনি কখনো। আমি পাঠকদের সাথে একাত্ম হতে চেয়েছি। কথিত বোদ্ধারা আমাকে কী ভাবলেন তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি তাদের সেভাবে গুনিও না। আমাদের দেশে বেশির ভাগেরই বোদ্ধা হতে গিয়ে লেখক হয়ে উঠা হয়নি। সঙ্গতই বেশির ভাগ লেখক বা কবি মানুষের কাছাকাছি যেতে পারেননি। সেই না পারার ব্যর্থতাকে তারা ঢাকতে চেয়েছেন নানা গালভরা বুলি দিয়ে। যা মূলত বুলশিট।

কবি বা লেখকের কাজ কী, এই প্রশ্নটাই বড়। তাদের কাজ হলো মানুষের কাছে মেসেজ, বার্তা পৌঁছানো। পৌঁছে দেয়া সেই মেসেজ যদি মানুষ বুঝতেই না পারে, তবে সেই মেসেজ আর পথে পড়ে থাকা বুলশিটের পার্থক্য কী? আর কথিত বোদ্ধারা কি আলাদা জাতের জিনিস, আলাদা ভাষার পাবলিক, যে সাধারণের জন্য পাঠানো মেসেজ তারা বুঝবেন না! যদি বুঝতেই পারেন, মেসেজটা সাধারণের বোধগম্য করে লিখাই উচিত। তাহলে এক যাত্রায় দুই ফলেরই প্রাপ্তি ঘটবে।

বোদ্ধাদের জন্য একটি প্রশ্ন রাখি, লালন যখন গান বাঁধতে শুরু করলেন, ‘ভাববাদ’ কী জিনিস, তিনি কি তা জানতেন? কথা না পেচিয়ে আদালতের ভাষায় হ্যাঁ আর না এর মধ্যে উত্তর দিতে বলা হলে, কী করবেন আপনারা? আমি আমার উত্তরটা বলে দিই এবং তা এক কথায়, ‘না লালন জানতেন না’। মানুষ যখন তার চিন্তার প্রকাশ ঘটান তখন তার কোন নাম থাকে না, বিভাগ থাকে না। পরে তা বিভক্ত হয়, নাম পায়। স্বার্থক চিন্তা হয় সহজবোধ্য। আর সফল চিন্তা হয় দুর্বোধ্য। স্বার্থক আর সফলের পার্থক্য করতে গেলে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ব্যাখ্যায় যেতে হয়। বলতে হয়, সফল অনেকেই হতে পারেন। চোর-বাটপাররাও সফল হয়ে যায়। আমাদের চোখের সমুখেই অনেক চোর-বাটপারের সাফল্যের কাহিনি রয়েছে। কিন্তু স্বার্থকতা আলাদা। তিনিই স্বার্থক যিনি অসংখ্য সফল মানুষ তৈরি করতে পারেন। স্বার্থক চিন্তা সহজবোধ্য, না হলে সফলতা পাওয়া সম্ভব হতো না।

যাক গে, তত্ত্ব কথা থাক। আবার আসি সোজা কথায়, কেন কবিতা পড়ি এবং লিখি এই প্রশ্নে। হরলিকসের একটা বিজ্ঞাপন ছিলো। ‘আমিতো এমনি এমনি খাই’ কথাটি সে বিজ্ঞাপনেই খ্যাত হয়েছিলো। আমার কবিতা পড়া আর লিখাও তাই, ‘এমনি এমনি’। বাবা লিখতেন, পুত্র বাবার অনুসরণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। এরমধ্যে কোন ঘোরপ্যাঁচ নেই। পরম্পরার ধারায় লিখার লাইনে আসা। তবে আসতে আসতে, পথ মাড়াতে মাড়াতে চিন্তার সমৃদ্ধি ঘটেছে, বুঝতে শিখেছি। সেই অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়গুলো স্বাভাবিক ভাবেই লিখায় চলে এসেছে। চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব শৈল্পিক মান বজায় রেখে সহজবোধ্য ভাবে লিখতে। চেষ্টা করেছি সেভাবেই মানুষের কাছে পৌঁছাতে। চেষ্টা করেছি একটা লিখা বুঝে উঠতে মানুষকে যেন দশবার অভিধান না খুলতে হয়। আমার ধারণা যদি ভুল না হয়, যারা অভিধান খুলে লিখেন, তাদের লিখা পড়তেই অভিধান খুলতে হয়। আমি লিখাকে ধর্মগ্রন্থ বানাতে চাই না, যা শুধু একটা শ্রেণিই পড়তে পারবে এবং বোধ্যতার স্বীকৃতি থাকবে শুধু তাদের হাতেই। আমি মানুষকে বোধ্যতার স্বীকৃতি দিতে চাই, সে হোক কবিতা, প্রবন্ধ কিংবা খবর। লেখা হোক মানুষের জন্য, সাধারণের জন্য। অসাধারণরা আলাদা প্রজাতি গড়ে তুলুক।

কাকন রেজা। লেখক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। জন্ম ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ মার্চ, বাংলাদেশে, ঢাকার উত্তর শাহজাহানপুরে। তারুণ্যের দিনগুলো পাড়ি দিয়েছেন লেখকের নিজ জেলাশহর শেরপুরে। তাঁর বাবা মরহুম আব্দুর রেজ্জাক ছিলেন, একাধারে লেখক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক। মা জাহানারা রেজ্জাক এক সময়ে ছিলেন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ফ্রেম

ফ্রেম

দেবী না পরিণীতা রাতটা একা থাকে এবং নিঃসঙ্গ অন্ধকার মানে রাত; তাহলে অন্ধকার নিজেও একা…..

সীমানার শর্ত

বিজ‌য়ের সব মুহূ‌র্তেই… তার অ‌ধিকার! কেন্দ্র হোক আর কেন্দ্রা‌তিগ ব‌লের আসন; কেউকেউ বোরকায় রমনীয় স‌ঙ্গানুসঙ্গের;…..