আমেরিকা কোথায়

সুপ্রিয় সাহা
গল্প
Bengali
আমেরিকা কোথায়

‘ভারত জিতলে বিপ্লব সফল হবে’

মাথার উপর ছাউনি সরে যাওয়া পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যায়। এখানকার আকাশ আর কলকাতার আকাশের মধ্যে খালি চোখে পার্থক্য ধরাটা , কোনও পাড়া গাঁয়ের উঠতি যুবক যুবতী’র ইচ্ছে-সখ-স্বপ্নের সাথে আমার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে, বসে, পাহারায় বা রান্নায় থাকা ছেলে-মেয়ে গুলোর স্বপ্ন-সখ-ইচ্ছে’র পার্থক্য ধরার চাইতেও কঠিনতম। শুয়ে শুয়ে আমি চারপাশের মানুষ গুলোর উপর আর একবার নজর ডালি।

পেঁপে সেদ্ধর দারুণ বাস ভেসে আসলে আমার হটাৎ খিদের কথা মনে পড়ে। জলপাই রঙের পোশাক আর আলকাতরা মাখা গায়ের রঙের মানুষ গুলোকে এই অন্ধকারে জানা তো অনেক দূরের কথা, চেনাই মুশকিল!

মাটির উনুনটার নীচে একগাদা শুখনো পাতা গেদে দিতে দিতে রজনু আমার দিকে জিজ্ঞাসা ছুড়ে দেয়, সাংবাদিক দাদা’র ভুখ বেড়ে গেল নাকি!

আমি উত্তর না দিয়ে খড়ের বিছানা ছেড়ে উঠে বসে কিছুটা সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ি। মনে হয় সে দেখতে পায়।

ভগত আমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে রেডিওটা অন করে একটা গাছের ডালে টাঙিয়ে দেয়। সকলেরই যেন কিছুটা আরাম হয়। রেডিও ছাড়া এই জীবন সত্যিই অন্ধকার। বিবিসি’র খবর শেষ হলে অল ইন্ডিয়া রেডিও। শুরু হচ্ছে ভারত-পাকিস্তান সেমিফাইনাল ম্যাচের ধারাবিবরণী। টস করতে যাচ্ছেন ভারতীয় ক্যাপ্তেন ধোনী।

এই ছ’জনের দলটার সবথেকে কমবয়সী সদস্য মান্তারী হটাত জিজ্ঞাসা করে, আপনি ধোনীকে দেখেছেন? কেমন দেখতে তাকে? কত টাকা তার রোজগার?

ভাবতে থাকি তাকে ঠিক কি উত্তর দেব। কেমন দেখতে সেটা বিষয় নয় কিন্তু মান্তারীর পরের প্রশ্নটা আমায় বিচলিত করে।

ভগত বলে, মান্তারী তুই কি ধোনীকে বে করবি নাকি রে? অবশ্য ধোনীর লম্বা লম্বা চুল, তোর পছন্দও হতে পারে!

সবাই ওর কথা শুনে হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। মান্তারী কিন্তু একটু রেগেই যায়। বয়স অল্প। এখনও সবধরনের কথা সহজে মেনে নেওয়া ধাতে সয়নি। এত কম বয়সে সাধারণত পার্টি মেয়েদের নেয় না। ওকেও নাকি নিতে চায় নি। কিন্তু মান্তারী কে তার বাড়ি থেকে তখন বিয়ে দিতে চাইছে। তাই সে পালিয়ে পার্টির কাছে গিয়ে বারবার জোরাজুরি করে ঢুকে যায়।

রান্না প্রায় শেষের দিকে। রজনুও রেডিও’র সামনে এসে বসে। এই ছোট্ট স্কোয়াডের সেই নেত্রী, সেই রাধুনী আবার সেই আমার এ’কদিনের গাইড। শহর হোক বা গভীর অরন্য, ক্রিকেট কিন্তু সকলকেই বিনোদন দিতে প্রস্তুত। রজনু তার বিপ্লবকেই বাজী ধরে ফেলে ‘ভারত জিতলে বিপ্লব সফল হবে’।

স্কোয়াডের সকলের উত্তেজনা বাড়তে থাকে।

“এটা একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ, আমি মারা যাব কিন্তু বিপ্লব ঘটবে”

এখানে কোন স্কোয়াডই একটা ছাউনিতে এক রাতের বেশি কাটায় না। যদিও জঙ্গলের এই গভীরে পুলিশের ঢোকা দুঃসাধ্য, তবুও সাবধানতার কোন মার নেই। কোন ছাউনিকে কখনো যদি সুরক্ষিত না মনে হয় তবে আশে পাশের স্কোয়াডের কাছে খবর পৌঁছে যাবে দ্রুত। এরা না ব্যবহার করে মোবাইল না আছে এদের ওয়াকিটকি। তবুও খবর পৌঁছয় ঠিক সময়ে ঠিক খবরির মাধ্যমে। গতরাতের আস্তানা ছাড়ার পর টানা হেঁটে যখন থামলাম, তখন ভর দুপুর। সামনে ৪/৫ টি ঘর নিয়ে একটা গ্রাম। রজনু জানাল এটা মূলত তাদেরই গ্রাম।

আগে থেকেই আমাদের আসার খবর ছিল, তাই রান্নাও হয়েই ছিল। দুপুরের খাবার পর গাছের নীচে যে যার মতো জিরিয়ে নেওয়ার সময় আবার বাজতে থাকল রেডিও। কিন্তু রেডিওর সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে স্কোয়াডের সদস্যদের বিষণ্ণতায় ভরিয়ে দিল- অন্ধ্রপ্রদেশে ২২ জন  আত্মসমর্পণ করেছে। আবার রাজমান্দায় দুজন দম্পতিও আত্মসমর্পণ করেছে।

আরো কিছুক্ষণ চলার পর রজনু নিজেই বন্ধ করে দিল রেডিওটা। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বেশিক্ষণ চললে মনে হয় আছাড় মেরে ভেঙে ফেলি।

রেডিওটা ফের চালু হল যখন আমরা পৌঁছলাম রাতের আস্তানায়। এবং দান্তেওয়ারায় মাওবাদিদের দ্বারা পাঁচ জন পুলিশ খতম করার খবরে রজনু বাদে বাকিদের মধ্যে প্রায় উৎসব নেমে এল। এসব থেকে সচেতন ভাবেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে সে , লড়াইটা দীর্ঘ । নিজেদের ক্যাডারদের মৃত্যুতে তাদের হতাশ হলে চলবে না কিংবা পুলিশের খতম হওয়ার খবরেও উল্লসিত হওয়াও যাবে না। খুশিও না, দুঃখও না,  মাঝামাঝি অবস্থানে থাকতে হবে।

আমি বললাম, কিন্তু এই যে তোমাদের এত লোক আত্মসমর্পণ করছে, সরকার হয়তো সংখ্যাটা একটু বেশি করেই দেখাচ্ছে, কিন্তু কিছু কমরেড তো আত্মসমর্পণ করছেই। এর কারন কী? যারা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলনে আছে, তাদের কী অবস্থান? সবাই কি সঠিক ভাবে বোঝে কীসের জন্য বিপ্লব?

ঘন অন্ধকারের মধ্যে হাত দুটোকে পিছনে ছড়িয়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভাঙল রজনু, আমাদের এখানে প্রায় প্রত্যেক ক্যাডার জানে ও বিশ্বাস করে যে সে বিল্পবের আগেই মারা যাবে। সত্যি বলতে কি, অনেকের মধ্যেই বিল্পবের সুদীর্ঘ লক্ষ্যটা অনেকবেশি অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে। আবার সকলেই যে একই লক্ষ্যে লড়ছে তাও তো নয়। এই যে মান্তারী, স্বেচ্ছায় এই জীবন বেছে নিয়েছে, ও কি বোঝে কীসের জন্য বিপ্লব, বা কী এর আসল উদ্দেশ্য! কিন্তু ওরও নিজস্ব একটা বিপ্লব আছে, তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যও আছে। সেটা হয়তো অনেকটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। কিন্তু সেটাও তো বিপ্লবেরই অঙ্গ। আবার এই যে ভগত, সুখিয়া এদের কাছে এই লড়াইটা নিজেদের জল-জমি-ইজ্জত রক্ষা করার লড়াই। এভাবে কত কত দিক, কতশত কারন আছে সংগ্রামের, একটু চোখ কান খোলা রাখুন, নিজেই ধরে নিতে পারবেন।

অন্ধকারে মান্তারীও কখন পাশে এসে বসেছে খেয়াল করিনি। এইসব গুরুগম্ভীর আলচনার সময় সে সাধারণত একনিষ্ঠ শ্রোতার ভূমিকা পালন করে। নিজেকে হয়তো ভবিষ্যতের জন্য তৈরী করে। বাকীরা তখন শুয়ে বসে রেডিওতে নাটক শুনতে ব্যস্ত। খাবার সময়ও হয়ে আসছে। আমি বলি, কিন্তু আত্মসমর্পণের বিষয়টা?

উঠে যেতে যেতে রজনু বলে, শহরে তো মানুষ কতরকম আধুনিক জিনিসপত্র নিয়ে সুখে সংসার করে। তার মধ্যেও তো মাঝে মাঝে কত লোক সুইসাইড করে, বিবাগী হয়ে যায় সংসার ত্যাগ করে। কেন করে বলুন তো? তাদের তো এত এত সুখ, তাও কেন করে? নিশ্চয় এই সুখের প্রদীপের নীচেও কিছুটা অন্ধকার আছে, অনেক না পাওয়া, হতাশা, মান-অভিমান, আরও একটু ভালো থাকার চাহিদা আছে। আমাদের এই  আত্মসমর্পণের বিষয়টাও অনেকটা এইরকম। এক মায়ের পেটের পাঁচটা ছেলে কি এক হয় কখনও?

রজনু উঠে যায়। ওর ভিতরের অনিশ্চয়তাটা অনেকখানিই সামনে উঠে আসে। মনে হয় মাঝে মাঝে সে নিজেও নিশ্চয় নিজ পরিবার, ঈশ্বর, ঘাটুল ছেড়ে বিল্পবের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার হতাশাকে ঢাকতে নিজেকে ‘ইতিহাসের পাতায় ঠাই’ পাওয়ার সান্তনা দেয়(?)

পাশে বসে থাকা মান্তারী হটাৎ জিজ্ঞাসা করে, আপনি জানেন আমেরিকা কোথায়?

আমি যখন বলি এই গ্রহের যেখানে আমরা বসে আছে আমেরিকা ঠিক তার বিপরীতে, তখন অবিশ্বাসে তার চোখ দুটো গোল হয়ে যায়। এরকমও আবার হয় নাকি!!!

“এখন নারীরা পুরুষদের পাশাপাশি সমান অধিকার পাচ্ছে কারণ পার্টি পিতৃতন্ত্রের ইতি টেনেছে”

দুপুর দুপুর থামা হল একটা পাহাড়ি ছোট্ট ঝোরার কাছে। জায়গাটা চারদিকে জঙ্গলে এমনভাবে ঘেরা যে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নাই। স্কোয়াডের ছেলে সদস্যরা সকলেই কিছুটা আড়ালে পাহারায় থাকলে, প্রথমে স্নানে গেল রজনু আর মান্তারী। আমি একটা পাথরের ছায়ায় বসে পড়লাম। বসে বসে যেটা বারবার মনে হচ্ছিল,এই যে চারজন যুবক, পাহারা দিচ্ছে দুটো মেয়ের নগ্ন স্নান,এরা কি কখনও একবারও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেনি? আর যদিও বা না দেখে থাকে, তবুও দেখার ইচ্ছে কি মনে জন্মায়না কখনও বা কখনও কি কামভাব জেগে ওঠে না? নাকি এরা সকলেই কামকে জয় করেছে? আবার মনে হল যে আমি শহুরে মানুষ বলেই হয়তো আমার মনেই এসব পাপবোধ জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু কামবোধ কে কি পাপবোধ বলা সম্ভব?

সকলের স্নানের পর আবার পথ চলতে চলতে রজনুকে আলাদা পেয়ে একথা জিজ্ঞাসা করলে সে হেসে ওঠে,

– নারী পুরুষের সম্পর্ক বিষয়ে কঠোর নীতিমালা রয়েছে আমাদের। আমাদের কোড বইতে নারী কমরেডদের সাথে ঠাট্টা করার ব্যাপারেও পুরুষ ক্যাডারদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

কেমন যেন সেই নোট বই থেকে টোকা উত্তরের মতো কথাবার্তা।  সবই যদি কোড বইয়ের নিয়মে চলতো তবে তো পৃথিবীটাই উল্টে যেত কবে! – মনে হলেও মুখে কিছু বলি না। বরং আলোচনা জারি রাখার চেষ্টা করি- প্রায়শই পেপারে পড়ি যে নারী ক্যাডাররা উর্ধ্বতন নেতাদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়? এবং এই কারন দেখিয়েও অনেকে আত্মসমর্পণ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়।

আমার কথা ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেয় সে, সবটাই পুলিশের প্রচার। এমন ঘটনা যদি ঘটত তাহলে আমি এবং আরো অনেক মেয়েই এখানে থাকতে পারত না। পার্টি মেয়েদের জন্য অনেক কিছু করেছে। এমন অনেক কিছু যা আপনাদের সরকার করতে পারেনি। দিল্লির গণধর্ষণের ঘটনা মনে আছে? ঐ ধরনের ঘটনা এখানে কখনো শুনতে পাবেন না। বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও এর শাস্তিও কঠোর- নারী সদস্যদের ও বিপ্লবের মর্যাদা নিশ্চিত করতে এই নিয়ম করা হয়েছে। আর তাছাড়া আমাদের নিজেদের ভেতরে বিয়ের অনুমতি রয়েছে, তবে হ্যাঁ বিবাহিত জীবনেও বিপ্লবের প্রয়োজনকে অবশ্যই মেনে চলতে হয়। তবে যে বিষয়টি নিয়ে ভিতরে ভিতরে অনেকেই ক্ষুব্ধ তা হল পার্টিতে সন্তান নেয়া নিষিদ্ধ। আপনিই বলুন, আমার সাথে যদি একজন শিশু থাকে তাহলে কি আমার পক্ষে গেরিলা হওয়া সম্ভব ?

আমি ঠিক দোলাচলে থাকি। অনেক প্রশ্ন মাথার মধ্যে কিলবিল করতে থাকে, ফলে ওর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয় না। এদের মধ্যে বিয়ে করলেই পুরুষের বন্ধ্যাত্বকরণ বাধ্যতামূলক। প্রত্যেক পুরুষ এটা ভালো ভাবে নেবে, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। আবার বিয়ে করা মানে তো শুধু শারীরিক চাহিদা মেটানোই নয়, বরং মনের ভিতরে খুব অল্প হলেও সংসারের বাসনা তৈরী হবে, একে অন্যের প্রতি আলাদা টান তৈরী হবে, মানে সন্তান চাহিদা একেবারে স্বাভাবিক। কিন্তু বাধ সাধবে কোড বই। আবার সেন্ট্রাল কমিটি যদি বিয়ে টাই তুলে দেয়, সেও এক ঝামেলা, তখন দিল্লীর মত ধর্ষণ কাণ্ড যে ঘটবে না তার গ্যারান্টিই বা কে দেবে?

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে একটা ছোট্ট গ্রামের ভিতর চলে এসেছি খেয়াল ছিল না। গ্রামের একটা ঘর থেকে চাপা গোঙানির শব্দে আমার চিন্তা বাঁধা পায়। বাকিরা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় সেই ঘরের দিকে। আমিও পিছন পিছন। মাটির দাওয়ায় শুয়ে আছে একটি বছর তেরোর কিশোরী, যার ছেঁড়া ফ্রক ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে থেতলে যাওয়া স্তনের মাংস। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা গলা-বুক। আমি সরে আসি। আমাদের আগেই সেখানে পৌঁছানো আর একটি ছোট স্কোয়াড ইতিমধ্যেই প্রাথমিক চিকিৎসার কাজ শুরু করেছে। মান্তারী আর রজনুও তাদের সাথে হাত মেলায়।

আমার পাশে এসে বসে সুখিয়া। এমনিতেই তার মুখ সর্বদা কঠোর, এখন আরও কঠিন হয়ে যায়। মুখের যাবতীয় শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচল বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। কিছুক্ষণ পর সে নিজেই বলে, দেখুন আপনাদের মিলেটারি দের ‘নকশাল পরীক্ষা’র পরিণাম। কত বড় শয়তান তারা।

আমি ঠিক বুঝতে না পেরে একটু চুপ থেকে জিজ্ঞাসা করি, নকশাল পরীক্ষা?

সে বলে, পুলিশ আর মিলিটারি মিলে সব আদিবাসী মেয়েদের উপর মাঝে মাঝেই নকশাল পরীক্ষা নেয়। ওদের ধারনা নকশালরা কখনও বিয়ে করে না। আর বিয়ে না করলে মেয়েদের বুকে দুধ আসে না। তাই যে সব মেয়ের বুকে দুধ নেই, তারা নকশাল। আর যারা তাদের বুক টিপে দুধ বার করে দেখাতে পারবে তারা ছাড় পেয়ে যাবে। যদি কেউ পুলিশের সামনে এই পরীক্ষা না দিতে চায়, তবে পুলিশ নিজেই তার জামা খুলিয়ে খামচে, কামড়ে, টিপে, বন্দুকের ঘা মেরে মেরে দেখবে, তারপর কী অবস্থা তা তো নিজের চোখেই দেখলেন। আর যদি কাউকে পছন্দ হয় তবে সোজা তুলে নিয়ে চলে যাবে। কখনও হদিস পাওয়া যায় আবার কখনও মেলেনা। তারা মনে করে এই মেয়েগুলো এখানে জন্মেইছে শুধু তাদের শরীর দিয়ে খুশি করবার জন্য।

মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কাকে দোষ দেব! মনে হয় এখানকার মাটিই হল মূল শয়তান। যদি এই মাটি তার গর্ভে এত খনিজ-বনজ ধারন না করত, তবে মুনাফালোভীদের নজরও পড়ত না, আর সরকারও এমন অত্যাচার চালাত না, তৈরী হতো না বিরোধিতাও। আবার পরক্ষণেই ভাবি, কী যাতা ভাবছি! কোন রাষ্ট্র কবে তার আদিবাসীদের জল-জমি-অধিকার রক্ষায় পাশে দাড়িয়েছে(?) তারা তো কোনসময়ই এদেরকে শোষণের বস্তুর বাইরে কিছু ভাবেনি।

শরীর মন দুটোই বড্ড ভার লাগে। ঘরের ভীতর থেকে তখনও গোঙানির শব্দ মিলিয়ে যায়নি।

“ বিশ্বাসঘাতকতা এখন আদিবাসীদের টিকে থাকার পূর্বশর্ত। প্রতিটি স্থানে একজন আদিবাসীর মৃত্যু হয় আর একজন গুপ্তচরের জন্ম হয়। রূপান্তর ঘটতে এখনো অনেক বাকী”

গত দুদিন একই ছন্দে নিয়মমাফিক বয়ে চলে। আজ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের পৌঁছে যাওয়ার কথা একটি নতুন ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ শিবিরে। এই দুদিনে মাঝে মাঝে হালকা নানান কথার মাঝে আমি মান্তারীদের বোঝার চেষ্টা করতে থাকি, তবে সে বড় দুরুহ কাজ। তর্ক লাগে মাঝে মাঝেই।

আমি বলি, একজন আদিবাসী নারী যিনি বন্দুকের নলের মুখে যৌন নির্যাতিত, ধর্ষিত হচ্ছেন, তার নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে সংগ্রাম করছেন এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছুই হতে পারে না। এর জন্য কী কোন দায় আপনাদের নেই ?

রজনু তীব্র বিরোধিতা করে ওঠে, আমরা কিন্তু আদিবাসীদের সেই অপমানের বদলা সুযোগ পেলেই নিচ্ছি। আর আমরাই এই মানুষ গুলোকে বনরক্ষী, পাটওয়ারীদের জুলুম থেকে বাঁচিয়েছি। আমাদের আন্দোলনের জন্যই তারা আজ যে কোন কাজের কিছুটা হলেও ন্যায্য মজুরী পেতে পারে। কীভাবে জঙ্গলের সম্পদকে আরও বেশি করে কাজে লাগিয়ে জীবন চালান যেতে পারে সেটাও আমরাই প্রতিনিয়ত দেখিয়ে দিই। তাদের জন্যই ‘জনাতনা সরকার’ চালু করেছি। সমস্ত লড়াইটা তো তাদের জন্যই।

কিছুক্ষণ থেমে থেকে নিজেই আবার শুরু করে, আদিবাসীদের মন জয় করতে না পারলে রাষ্ট্র আমাদের কখনই পরাস্ত করতে পারবে না। এই যুদ্ধ যত বেশী দীর্ঘায়িত হবে রাষ্ট্র ও আদিবাসীদের ভেতরে ব্যবধান তত বেশী বৃদ্ধি পাবে। আপনাদের সরকার তো প্রায়ই আমাদেরকে দোষারোপ করে যে আমরা আদিবাসীদের চালাচ্ছি কিন্তু তারা এই বাস্তবতাটা দেখতে পায় না যে তাদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে আমাদের থেকে সরকার যে বেশী কার্যকরী এ বিষয়ে আদিবাসীদেরকে তারা আশ্বস্ত করতে পারেনি। এই দণ্ডকারণ্যতে এমন অনেক গ্রাম আছে যাদের হিসেব সরকারের খাতাতেও নেই।

তর্ক, বিতর্ক যতই চলুক, এদের সাথে থাকতে থাকতে এদের আত্মত্যাগকে একটা লাল স্যালুট জানাতেই হয়। তবে তাদের মতাদর্শের ভিতরে যে ফাঁক আছে সেটাও বোঝা যায়। একবার কোন এক কথায় কথায় রজনু বলে, সব ধরনের সম্পত্তিই খারাপ, কাজের বিনিময়ে অর্থ মানুষকে খারাপ বানিয়ে ফেলে। তার কথায় বাকিরা সায় দেয়।

আমি বিরোধিতা করি, এই যে আদিবসীরা নিজেদের বাড়িতে মুরগি, ছাগল পোষে। এও তো একধরনের সম্পত্তি। তাও কি খারাপ? আমি একটা অফিসে কাজ করি, অফিস তার বিনিময়ে আমায় বেতন দেয়। আমি যদি আরো বেশি কাজ করি তাহলে বেশি বেতন পাব। তার মানে কি আমি একজন খারাপ মানুষ?

ওরা থমকে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, এ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের বক্তব্য জানতে হবে।

সেই পার্টি লাইনেই সব কিছু আটকে আছে। দল যা বলবে।

আমরা নতুন ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ শিবিরে পৌঁছে যাই। একটা নতুন ছেলে ক্যাম্পে যোগ দিয়েছে। বয়স পনেরো হবে। ছেলেটা হোস্টেলে পড়ত। এবার ছুটিতে গ্রামে এসে বেশ কিছুদিন ছিল। তখন মাওবাদিরা তাকে দলে যোগ দেওয়ার জন্য নিয়ে আসে। ওকে বিপ্লবী রাজনীতি, মতাদর্শ ও কিছু কিছু যুদ্ধের অনুশীলনও শেখানো হচ্ছে। ছেলেটার মধ্যে একটা ছটপটানি ভাব আমার চোখ এড়ায় না। তার সাথে গোপনে কথা বলি। সে বাড়ি যেতে চায়। তার পড়াশুনোর ভবিষ্যৎ নিয়ে সে যথেষ্ট সন্দিহান। তার ধারনা আর তার হোস্টেলে ফিরে যাওয়া হবে না। ফিরলেও পুলিশ হয় তাকে তুলে নিয়ে যাবে আর না হলে নিজেদের গুপ্তচর বানাবে। ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবার ইচ্ছে তার মধ্যে চোখে পড়ে না। নিজেকে সে দুই শিবিরের মধ্যবর্তী এক গিনিপিগ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না।

আমি রজনুকে জিজ্ঞাসা করলাম যে ছেলেটা যখন যোগ দিতে চাইছে না, তখন ওকে জোড় করে নেওয়া হচ্ছে কেন?

প্রথমে সে বলল যে ছেলেটা ওদের সাথেই থাকতে চায়। তারপর আবার কি ভেবে বলল, কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের বক্তব্য জানতে হবে।

আমি আর কথা বাড়লাম না। দুপুরের খাওয়া হয়ে গেছিল। আমাকে এখনো আরও কয়েকটা দিন এখানে থাকতে হবে। বেলাও বেশ পড়ে এসেছে। হালকা ছায়াচ্ছন্ন এই মায়াবী পৃথিবী। হটাত মনে হল যদি এই পৃথিবীটাই না থাকতো তবে আর এত কিছুর ঝামেলাই হতো না!

ব্যাগটা কাঁধে ফেলে আবার হাঁটতে শুরু করলাম, এখনো অনেকটা পথ পার হওয়া বাকী…

*(সম্ভবত এই ঘটনা প্রবাহের সমস্ত চরিত্রই কাল্পনিক। কিছু তথ্যের জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা রয়ে গেল লাল সংবাদ এর কাছে। )

জন্ম ১৯৮৭, দেবগ্রাম। পেশা - বিশ্ববিদ্যালয়ের অশিক্ষক কর্মচারী। সম্পাদিত পত্রিকা – ‘অলিন্দ’ এবং ‘ব্ল্যাঙ্ক স্পেস’। একমাত্র গল্প সংকলন ‘ঈশ্বর অথবা যৌনতার গল্প’ ২০১৫ সালে ‘নতুন শতক’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..