প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
সম্রাট ভাইকে নিয়ে কৃষকদের একটা মিটিংয়ে যাচ্ছি। সিনজেনটা নামীয় কীটনাশক কোম্পানির বিভিন্ন ওষুধের আলোচনা হয়ে থাকে এসব মিটিংয়ে। আমি ইতিপূর্বে বেশ কয়েক বার অংশ গ্রহণ করেছি। মন্দ লাগে না ওদের আলোচনা। গ্রামের নির্জনতার মধ্যে সরল কৃষকদের সৎ পরামর্শ বিলিয়ে দেওয়া দেখতে আনন্দ হয়। তাছাড়া দোকানে বসে থাকার পাশাপাশি ঘুরে বেড়ানো, নতুন জায়গার সঙ্গে পরিচিত হতে বেশ লাগে। একগুঁয়েমি কাটে। অল্প সময়ের জন্য হলেও মন ফুরফুরে হয়।
আষাঢ় মাসের প্রথম দিকের সময়। বেশ কদিন বৃষ্টি নাই। আকাশ উত্তপ্ত। মেঘের ছায়াও নাই। আবহাওয়া এমন যে বৃষ্টি যখন শুরু হয় তখন থামে না, রোদ শুরু হলে না পুড়িয়ে শেষ হয় না। আগের আবহাওয়া কত মিষ্টি ছিল। রোদের মধ্যে একটা মায়া মায়া ভাব থাকত, শীতের মধ্যে স্নিগ্ধতা থাকত, বর্ষার মধ্যে স্নেহ থাকত। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ঋতুগুলো ভয়ংকর রকম বিদ্রোহী হয়ে গেছে। অসহ্য করে ছাড়ে মানুষদের। প্রকৃতির স্রষ্টা হয়ত মানুষ নিষিদ্ধতায় আসক্ত হওয়ার দরুণ এক আধটু অসন্তোষ হন। যার পরিণাম আবহাওয়াতে প্রভাব ফেলে। দোকানে বসে চায়ের পর পান মুখে নিয়ে সম্রাট ভাই বাইক স্টার্ট করে বললেন, -‘এবার যাওয়া যাক, ওরা অপেক্ষায় আছে।’
আমি বাইকে ওঠে বসে বলি, -‘আজ কোথায় মিটিং?’
সম্রাট ভাই বললেন, -‘মুন্সির হাটের দক্ষিণ দিকের একটাগ্রামে।’রাস্তা ভালো না থাকায় হোন্ডা ধীরে চালাতে বাধ্য হতে হয়। উঁচুনিচু গর্তময় রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে যায়। উত্তপ্ত রোদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলি যে ‘আপনাদের সিঙ্গাপুর, না?’ সম্রাট ভাই হাসেন। মৃদু গলায় বলেন, ‘কত মজা যে করেন।’
একটা সিএনজি সাইট নিতে গিয়ে পুকুরের মত গোল গর্তে অর্ধেক ডুবে যায়। সম্রাট ভাই সেদিকে তাকিয়ে বলেন,-‘ঢাকা শহরই ভালো। দু’দিকে পানি রোড হয়েছে। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো পানি গাড়ী এখনো চালু হয় নি।’
হেসে হেসে বলি, ‘যেহেতু পানি রোড হয়েছে। পানি গাড়ীও হবে। নৌকার মত পানির উপর দিয়ে গাড়ী চলবে। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সে উন্নয়নের জন্য।’
সম্রাট ভাই বলেন, ‘আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সুস্থ্য, সুন্দর, নিরাপদ জীবনের জন্য। তারপর আমাদের পরবর্তীরা অপেক্ষা করবে। এই অপেক্ষার শেষ কবে?’
আমি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলি- ‘মুন্সির হাট আসছে। কোনদিকে যাবেন?’
সম্রাট ভাই বললেন- ‘উত্তর দিকে।’
মুন্সির হাট বাজার পার হয়ে দক্ষিণ দিকে যেতে থাকি।পথে একটু সময়ের জন্য থামি এই কারণে যে, একটি বকুল ফুলের গাছ দৃষ্টি স্থিত হয়। রাস্তার এক পাশে বাইক রেখে ছোট আল দিয়ে খানিক সময় হাঁটি। এক পাশে পুকুর অন্যপাশে পতিত জমি। পুকুর পাড়ে মসজিদ। মসজিদের সামনে বকুল ফুল গাছ। প্রথমে আমরা দু’জন পুকুর পাড়ের সিঁড়ির উপর বসি। সম্রাট ভাই তাঁর ব্যাগ থেকে দুটো আম বের করে বললেন, ‘গাছের আম, আপনার জন্য এনেছিলাম, নেন, ধুয়ে নেন।’সম্রাট ভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে পুকুরের জলে আম ধুয়ে সিঁড়িতে সম্রাট ভায়ের সঙ্গে বসি। আম দুটো সম্রাট ভাযের হাতে দিই। সম্রাট ভাই অবাক হলেন না। পুকুরের জলে ভেসে থাকা বকুল ফুলের পাতার দিকে তাকিয়ে কাব্যিক ঢঙে বললেন, ‘আজো তার লাগি আম খান না? আমের কিইবা দোষ, হৃদয় নিয়েছে যে বীণা তাঁরই তো নেই হুঁশ।’‘ওর নাম কি বীণা ছিল?’ খানিক পরে আমি বলি।
সম্রাট ভাই হেসে হেসে বলেন, ‘যার নামও জানেন না, তার জন্য এই ত্যাগ।’
‘নাম জানেন আপনি?’-আবার প্রশ্ন করি।
সম্রাট ভাই আমের খোসা ছড়াতে ছড়াতে বলেন, ‘আমিও তাঁর নাম জানি না।’
‘কত বছর হয়ে গেল না?’ আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সম্রাট ভাই ফের প্রশ্ন করেন।
‘হ্যাঁ, সাত বছর তিন মাস কুড়ি দিন ছ ঘণ্টা।’বললাম আমি।
আমার হিসেব দেখে সম্রাট ভায়ের অবাক হওয়ার কথা ছিল। বাহ বলার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সেসব কিছু না করে বললেন, ‘ভাবী কি জানেন আম কাহিনি?’
মাথা নেড়ে বলি, ‘হ্যাঁ, বিয়ের দ্বিতীয় রাত্রিতেই জানিয়েছি।’
আমার চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তিনি আবারো বললেন, ‘বাচ্চারা জিজ্ঞেস করে না আম না খাওয়ার কাহিনি?’
হাসতে চেষ্টা করে বলি-‘জিজ্ঞেস করলে মিথ্যা বলি না।’
-‘সত্য বলেন?’
-‘সত্যও বলি না।
-‘তবে?’
-“বলি, অনেক দিন আগে একজন আম খেতে দিয়েছিল। সেদিন ছিল সোমবার। আষাঢ়ের প্রথম দিকের সময়। খুব রোদ ছিল। গরমে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। সেদিন তোমার সম্রাট আংকেলের সঙ্গে একটা মিটিংয়ে গিয়েছিলাম। মিটিং শেষ করে যখন ফিরে আসি তখনই ঘটে ঘটনাটা। একজন বসতে বলল। উঁনার দিকে তাকিয়ে না বসতে ইচ্ছে হল না। অল্প সময় পরে উঁনি আম কেটে নিয়ে এলেন। আমি উঁনার চোখের দিকে তাকিয়ে একটা সুন্দর পুষ্প বাগান দেখি। সে বাগানে অনেক পাখি। শাদা পাখি, সবুজ পাখি। উঁনি যখন বললেন-‘আম খান।’আমি শুনিনি কিছু। তোমার সম্রাট আঙ্কেলও বললেন। দু’বার। শুনিনি। আমি তো পুষ্প বাগান দেখি। সে বাগানে পাখিদের ওড়াউড়ি দেখি। তোমার সম্রাট আঙ্কেল ধাক্কা দিলেন। তখন ঘোর ভাঙে এবং বলি, ‘আম খাব না।’সেও বলল, ‘খুব সুস্বাদু আম, খেয়ে দেখেন।’আমি মাথা নেড়ে না করি। মেয়েটি আমার কোলে মাথা রেখে মিহি গলায় প্রশ্ন করে, ‘কিন্তু আম খেলে না কেন আব্বু?’ আমি হেসে উত্তর দিই, ‘সে ছিল আমার অপিরিচত। অপিরিচিত কারো থেকে কিছু খাওয়া কি ঠিক? তুমি কি কখনো খাও? এই যে দেখো নেত্রকোনায় কেমন একটা ঘটনা ঘটে গেল।’
ফাতেহা আমার প্রশ্নের জবাব দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে- ‘তা ঠিক না, আমিও খাই না, কিন্তু সম্রাট আঙ্কেলের তো পরিচিত। সে হিসেবে তুমি খেতে পারতে, না?’
-‘সে সময় তো এমন করে ভাবিনি আম্মাজান।’
-‘কিন্তু এখন খাও না কেন?’
আমি ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলি, -‘তুমি তো বুড়ি আম্মাজান। তোমার বুঝতে পারার কথা।’
ফাতেহা খিলখিল করে হেসে বলে, -‘বুঝতে পারছি। আম সামনে এলেই তুমি পুষ্প বাগান আর পাখি দেখ, তাই না, আব্বা?’
আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, -‘ঠিক বুঝতে পারছ। কিন্তু আম্মাজান তোমার এই যে এত বছর হল, বুড়ি হলে তোমার চুল তো পাকেনি?’
ফাতেহা আমার দিকে তাকায়, গলায় হাত রাখে, -‘আমি কি দাদির মত বুড়ি হয়েছি নাকি? দাদি হলেন বড় বুড়ি আমি ছোট বুড়ি। ছোট বুড়িদের চুল যে পাকে না তাও জানো না, কি যে বোকা তুমি।”
আমার কথা শেষে সম্রাট ভাইও হাসেন। -‘খুব পাকনা বুড়ি হয়েছে আপনার আম্মাজান। কিন্তু সেদিন আপনার আম না খাওয়ার রহস্য কি?’
-‘কি বলব ভাই, সাত বছর আগের এক দুপুরের কথা। আমার আটাশ বছরের জীবনে সেদিনই প্রথম মুগ্ধ হই। এর আগে গল্পে উপন্যাসে মুগ্ধ হওয়ার কথা জেনেছি। কিন্তু মুগ্ধতা আসলে কি যে ভয়াবহ যন্ত্র সেদিনই প্রথম বুঝতে পারি। বুঝতে পারি বুকের ভিতর একটা নারীমুখ চিরদিনের মত বন্দি হয়ে গেছে। তাকে আর কখনই কোন ভাবে সরানো যাবে না। চারপাশে তাঁর হাসি সুঘ্রাণ বকুল ফুলের মত ছড়াবে। কিন্তু বুঝিনি এমন একটা নিষ্ঠুর বেদনা হাহাকার করে আমাকে পোড়তে থাকবে।’
আমার কাঁধে হাত রেখে সম্রাট ভাই বললেন, -‘আম খাননি কেন সেটা বলেন?’
দাঁড়িয়ে বকুল ফুলের ঢেউ খেলানো পাতায় হালকা টান দিয়ে তিনটি ছোট তারার মত ফুল হাতে নিয়ে ঘ্রাণ নিই- ‘আমার কাছে মনে হয় বিষয়টা এমন-একবার কোন এক ফেরেশতা বেহেশতের নারীকে দেখে জ্ঞান হারিয়েছিলেন- ঠিক সে সময়ে আমিও ফেরেশতার মত হয়ে গিয়েছিলাম। যখন আমার জ্ঞান ফিরে আমি আর সে আমি থাকতে পারি না। আমার ভিতর কি যে প্রবেশ করে, ভালো থাকার মত ওষুধ কিংবা বেদনার মত কাঁটা অথবা বিদ্যুতের আলোর মত ঝকমকে এক টুকরো সুখ অথবা মৃত্যুর মত হারানোর ভয়। তখন আমি যেন আমি ছিলাম না। আমাকে যেন নিয়ন্ত্রণ করেছিল অন্য কেউ। হয়তো সে। হয়ত তার হাসি। হয়ত তার চোখের বাগান বা উড়তে থাকা সেসব পাখিরা। আমি তখন আম খাব কেমন করে? যখন আমাকেই খাচ্ছিল অন্য কেউ?’
সম্রাট ভাই খানিক্ষণ চুপ করে থাকেন। কি যেন ভাবেন। সে মুহূর্তে আমাদের পাশে দুটো বাচ্চাকে দাঁড়াতে দেখলাম। সম্রাট ভাই ওদের নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, -‘উঁনি কবি।’আমার দুটো বই বের হয়েছে ও অলসল্প লিখি সম্রাট ভাই বেশ ভালো করে জানতেন। কারণ তিনি আমার লেখা মাঝে মধ্যে পড়েন। আমার একটা গল্পের বই পড়ে শেষ করেছেন। প্রথম ও শেষের পৃষ্ঠা মুখস্তও করেছেন। বাচ্চাদের একজন বলল, -‘নজরুলের মত লম্বা চুল ও রবীন্দ্রনাথের মত দাঁড়ি। দু’কবি একজনের ভিতর। একটা কবিতা শুনান।’
ওদের কথা খুব ভালো লাগলো এই কারণে যে, ওরা বুড়ো খাটাশদের মত লম্বা চুল ও দাঁড়ি দেখে আলবদর বা জঙ্গির মত কোন উপমা প্রয়োগ করেনি। এই জন্যই বোধয় ওদের ফেরেশতার সঙ্গে তুলনা করা হয়। যারা নিষ্পাপ। যন্ত্রণা দিতে জানে না। অথচ দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এই ফুলের মত, ফেরেশতার মত শিশুদের একটা শ্রেণি ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছে। বাচ্চারা তো সুন্দরের নক্ষত্র, অতি আদরের, ভালোবাসার, চোখের মণি, হৃদয়ের অস্তিত্ব। আমার দুটো বাচ্চা আছে তা আমি বুঝতে পারি। ভয় লাগে এই রকম একটি দেশে সন্তানের নিরাপত্তার আশংকা নিয়ে বেচেঁ থাকতে হয়। এদেশ উন্নয়নের দেশ। অগ্রগতির দেশ। চারপাশে বর্ষার জলের মত উন্নয়ন ছড়িয়ে পড়ছে। আইন সবল। সুবিচারের আস্থা যে আছে পদে পদে বুঝতে পারা যায়। কিন্তু যারা পদ্মা সেতুর দোহাই দিয়ে ব্যাগে করে কল্লা নিয়ে ঘুরে সেটাকে গুজব বলে। এটা কেমনে বলে বোধ করতে পারি না। আর এসব দেখে রাষ্ট্র কেমন যন্ত্রের মত স্বাভাবিক থাকে তাও বুঝতে পারি না। কল্লা না হয় ব্রিজের জন্য লাগলো না কিন্তু বাচ্চাদের কল্লাহীন হওয়ার সূত্র যে বের করতে হবে এ উদ্বেগ কারো নাই। আজব রাষ্ট্র। বাচ্চাদের দিকে তাকাই। বলি- ‘কবিতা আমি কম লিখি। গল্প আমার প্রিয়। কবিতার চেয়ে গল্প লিখতে ভালোবাসি বেশি। অল্প সময়ে তো গল্প পাঠ করে শেষ করতে পারব না।’বাচ্চারা আড়দৃষ্টে আমাকে দেখল। একজন জিজ্ঞেস করল, -‘তবে।’
আমি ম্লান গলায় বললাম, ‘গান করি একটা, কি বলো?’
দু’জন হো হো হেসে বলল- ‘খুব ভালো।’
এমনিতেই ওর কথা মনে করে বুকের ভিতরটা হঠাৎ যেন সমুদ্রের নোনা জলে ভরে গেছে। যে জল যেকোন সময় চোখ দিয়ে বৃষ্টির মত ঝরে পড়বে। তখন কী হবে। সম্রাট ভাই নিশ্চয় ভালো দৃষ্টিতে দেখবেন না। মন্দ ধারণা করবেন। পাঁচ বছর সংসার ও দু’সন্তানের জনক হয়েও সাত বছর আগের আম খাওয়ার ঘটনা স্মরণ করে যে মানুষে চোখে পানির বন্যা হয় সে অবশ্যই খারাপ একটা মানুষ। এমন ধারণা হওয়া তো স্বাভাবিক। তাই, নিজেকে আশ্বস্ত করলাম, কেঁদো না মজনু। শান্ত হও। যখন একা হবে যত ইচ্ছে কেঁদো। চোখ ভরে জল ফেলো। একটা নদী বানিয়ে সাঁতার কেটো। কিন্তু এখন হাসো। কিছু হয়নি এমন ভান করো। মুচকি হেসে ওদের দিকে তাকালাম, নাম জিজ্ঞেস করে বললাম,- ‘একটা সাঁওতালি গান শুনাই?’
ওরা দু’জন একসঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, -‘তবে দারুণ মজা হবে।’
ওদের দেখে আমার পথের পাঁচালি উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। দু’জন যেন দূর্গা ও অপুর প্রতিচ্ছবি। ভাবলাম, অল্প সময় যদি ওদের হাসাতে পারি নিশ্চয় এই সময়টির হিসাব সৃষ্টিকর্তা নিবেন না। এই সময়টুকু কেন্দ্র করে নিশ্চয় আমার জন্য অল্প ভালো সময় আসবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল, ওদের হাসাতে পারলাম। তাতে আমার ভেতরটাও হাসবে।‘যেহেতু বকুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছি তাই বকুল ফুলের একটা গান শোনাই?’
দুজনে একসঙ্গে বলল, -‘সোনা দিয়া দাঁত কেন বান্ধাইলা এই গান বলেন।’
একটা আম ওদের দিকে দিয়ে বললাম, -‘দুজনে মিলে একটি আম খাও। আর আমি গান শুনাই।’
আমার গলা অসুন্দর। তবুও ওদের আনন্দ দিয়ে নিজে আনন্দ পাওয়ার লোভে বীভৎস গলায় গান শুরু করলাম। গান শেষ করে ওদের কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করি -‘কেমন লাগছে?’
দু’জন খিলখিল করে হেসে বলে, -‘হেব্বি ভালো লাগছে। মজা পাইছি।’
ওদের থেকে বিদায় নিয়ে মিটিংয়ের উদ্দেশ্যে যেতে শুরু করি। সম্রাট ভাই জিজ্ঞেস করলেন, -‘আপনার মন ওর প্রতি এত আকর্ষণ করতো জানাননি তো কখনো। আমাকে জানাতেন তখন।’বলি- ‘বেশ কয়েক মাস ওর খোঁজ নিয়েছি। জিজ্ঞেস করেছি অনেককে। যেহেতু তাঁর নাম জানতাম না। তাই সঠিকভাবে জিজ্ঞেস করতে পারতাম না কিছু। তখন ওখানের অনেকদের সঙ্গে মোটামুটি বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপন করি। তাতে লাভ হয় নি কিছু। সঠিকভাবে ওরা কিছু বলতে পারত না আমি তাদের বুঝাতে পারতাম। তবুও কেউ যখন বলল, ওর বাড়ি তো নওগাঁ। এখানে বেড়াতে এসেছিল। আমি জিজ্ঞেস করি নওগাঁর কোথায়? ওরা সঠিকভাবে কিছুই জানাতে পারেনি। তবুও নওগাঁ গিয়েছিলাম। মিঠাইপুর গ্রামে। পাইনি ওকে। আবার এখানে এসে সন্ধান করে ব্যর্থ হই। মানুষের তো একটা পরিচয় থাকে। পরিচয় ছাড়া বিশ্লেষণ দিয়ে মানুষ পাওয়া সম্ভব নয়। দেড় বছরে আমার অবয়ব পাল্টে গিয়েছিল। রাতে ঘুম না হওয়ার দরুণ মাথাও কেমন যেন করতো। আমার মুখ আশ্চর্য রকম কালো হয়ে গিয়েছিল। শরীর ভেঙে এক অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আব্বা আমার দিকে ফিরলেন। বুঝতে ও বুঝাতে চেষ্টা করলেন এবং আমাকে বাধ্য করলেন বিয়ে করতে। তখন আর কি করার ছিল আমার? কি করতে পারতাম?’
সম্রাট ভাই অবাক হয়ে পিছনে ফিরে আমাকে দেখলেন- ‘এত পাগল হয়েছিলেন বুঝতে পারিনি এত কাছাকাছি থেকেও। ওর জন্য মন আজোও কাঁদে আপনার, না?’
বলি -‘না, ও ছিল আমার প্রথম মুগ্ধ হওয়ার বাগান। প্রথম ভালো লাগার ঠিকানা। সেই আটাশ বছরে যখন আমাকে পৃথিবীর কিছু ভালো লাগাতে পারেনি। কোন নারী স্পর্শ করাতে পারেনি ঠিক সে সময়ে সেই হয়ে গিয়েছিল আমার সব কিছুর প্রথম। অথচ তাকে একবারের অধিক দেখার সুযোগ হয়নি। আমার হৃদয় যার এক টুকরো হাসি দেখার জন্য সাত বছর ধরে ছটফট করে, যার বিরহে আজো আমি গভীর ঘোরে ডুবে থাকি তাঁর জন্য আমার হৃদয় কাঁদে না। উন্মাদের মত তার দর্শন চায়। ভাদ্রের কাঠফাটা রোদে মানুষ যেমন শীতল হাওয়া চায়, প্রচুর যন্ত্রণায় মানুষ যেমন ব্যথা মুক্ত হতে চায়, আমার হৃদয় তেমনি তাকে একবার দেখতে চায়। আমার হৃদয় কাঁদে না । শূন্য হৃদয় কখনো কাঁদতে জানে না।’
-‘তবুও তো সংসার নিয়ে বেশ আছেন।’
-‘তা আছি। ভালো লাগার বেদনা এমনই এর ভাগ একজনকে নিতে হয়। অন্য কাউকে বুঝতে দেওয়া যায় না।’
সম্রাট ভাই অনেক সময় কথা বলেন না। আমিও চুপ করে থাকি। রাস্তার দু’পাশের বিল দেখি। মিটিংয়ের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে কোম্পানির দুজন অফিসারের সঙ্গে দেখা করি। একজন বলল- ‘এত দেরি করে এলেন যে সব মানুষ তো চলে গেল। নামাজের পর মিটিং শুরু হবে। চলেন নামাজ পড়ে আসি।’
এখানে আহলে হাদিস বেশি। যোহরের নামাজ ওরা বিশ মিনিট আগে পড়ে। তাই বিলম্ব না করে মসজিদের পথে যাচ্ছি। ঠিক সে মুহূর্তে তাকে দেখলাম। সেই তাকে। সাত বছর আগে যাকে দেখেছিলাম। ঠিক একি রকম। অপরূপ। হাসল তেমনি করে। যে হাসি অচিন জগতের। যে হাসি এক নিমিষে খুন করতে পারে। প্রাণ দিতে পারে। কপালে অনুস্বারের মত ঘাম যেন মুক্তার। আমি তাকে দেখলাম সাত বছর পর। হাসছে সে। যার মুখের দিকে তাকালে পৃথিবীতে বসন্ত শুরু হয়। আনন্দেরা ভিড় করে। যার চোখে পুষ্পের বাগান। সে বাগানে পাখিরা উড়ে উড়ে বহু দূরে যায়। দাঁড়িয়ে থাকলাম। সে দাঁড়াল। দুজন মুখোমুখি। এ দৃষ্টি কি কোনদিন ফেরাতে পারব? ফেরানো সম্ভব কি?
-‘আম খাবেন? সাত বছর ধরে আমি আম খাই না। আপনার জন্য। আম খাবেন?’
কে কথা বলছে? পাখির কণ্ঠে? কে? নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করি। সাত আসমানের উপর থেকে কেউ নাকি সাত সমুদ্রের ওপাড় থেকে কেউ নাকি স্বর্গ গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে কেউ? বজ্রপাতে মানুষ যেমন স্থির হয়ে যায় আমি তেমনি হই। ভুলে যাই কে আমি, কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। সে আবার বলল, -‘এই যে আমি আপনার জন্য দাঁড়িয়ে আছি সাত বছর ধরে। বিশ্বাস করেন সাত বছরে আমার হৃদয়ে আপনি ছাড়া কেউ আসেনি। সেদিন আপনি আম খেলেন না কেন? আহা-যদি খেতেন।’আমি কথা বলতে চেষ্টা করেও পারলাম না। যেন বোবা হয়ে গেছি। আমার জিভ কোন পাথরের সঙ্গে যেন আটকে গেছে। সে আবার রিনরিনে গলায় সাত বছর পর বলল-‘আম খাবেন? খুব মিষ্টি আম।’
অনেক চেষ্টা করেও আমি কথা বলতে পারলাম না। জিহ্বা এক বিন্দু নাড়াতে পারলাম না। আমার শরীরের সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে।দৃষ্টি একদিকে স্থির হয়ে গেছে।
সম্রাট ভাই আমার পিঠে মৃদু থাপড় দিয়ে বললেন, -‘এইতো সেই, যার জন্য সাত বছর অপেক্ষায় আছেন। আম খাবেন নাকি জিজ্ঞেস করছে। আজও কি আম খাবেন না?’
আমি যেন নড়তেও পারছি না। নিজেকে মনে হচ্ছে জীবন্ত ভাস্বর্য। যে সবকিছু শুনতে পায়, দেখতে পায় কিন্তু নড়তে পারে না, কথা বলতে পারে না। অথচ তার কত কথা বলার আছে। বুকের ভিতর উষ্ণ বরফের বিক্রিয়া হওয়ার কথা। সাত বছরের জমানো কথা, বেদনার কথা, প্রেমের কথা, ভালো লাগার কথা, আম না খাওয়ার কথা ।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..