প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
বাসা থেকে বেরিয়ে বাস স্টপ পর্যন্ত পৌঁছুবার আগেই ভিজে একসা হয়ে গেলো আরকান আলি। প্রচন্ড রাগে দুঃখে সে বিড়বিড় করে বললো,
– শালার বৃষ্টি!
এরকম একটা অশালীন শব্দ তার মুখ থেকে বেরুবার কথা না। কারণ আরকান আলি একজন মুসল্লি মানুষ। তার বয়স ছেচল্লিশ বছর। মুখে লম্বা সাদা কালো দাড়ি। পরনে আরবীয় পোষাক। মাথায় নকশাদার গোল টুপি। গা থেকে আতরের সুবাস বেরিয়ে চারপাশ ম ম করে তুলেছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সময় মতো আদায় করা মানুষ আরকান আলি। এরকম একজন মানুষের মুখ থেকে এরকম অশালীন শব্দ বের হওয়া মানে ঘোরতর কিছু ঘটে যাওয়া। ঘটেছেও তাই।
বাসা থেকে বের হবার আগে আরকান আলি জানালা দিয়ে ভালো করে চেয়ে দেখল বাইরে প্রখর রোদ। আকাশে মেঘের কোন ইঙ্গিত নেই। জুন মাস। বেশ গরমও পড়েছে। তবুও বেরুবার আগে জানালা দিয়ে হাত বের করে আরকান আলি পরীক্ষা করল ঠান্ডা কেমন! এটা তার অভ্যাস। বছরের প্রতিটি দিন সে বাসা থেকে বের হবার আগে এরকম জানালা দিয়ে হাত বের করে দেখে বাইরে ঠান্ডা না গরম। আজও দেখেছিল। রোদ দেখে ছাতা ছাড়াই বের হয়েছিল। লিফট দিয়ে উনিশ তলা থেকে নীচে নামতে সময় তিন মিনিটও লাগেনি। এরই মধ্যে রোদ হারিয়ে গেল!
গল্পটির অডিও শুনুন এইখানে-
আরকান আলি দেখল দিনটা কেমন মেঘলা হয়ে গেছে মুহূর্তের মধ্যে। বাস স্টপ কাছেই। সে ভাবল বৃষ্টি নামার আগেই বাস স্টপে পৌঁছে যাবে। সে পা বাড়াল। কয়েক কদম যেতে না যেতে ঝুম করে বৃষ্টি নামল। ইয়া মাবুদে এলাহী! সে কী বৃষ্টি! মুহূর্তে সে ভিজে জবজবে হয়ে গেল। এ অবস্থায় তার মুখ দিয়ে সেই অশালীন শব্দটাই বেরিয়ে আসলো।
কী আর করবে আরকান আলি? বিড়বিড় করে বললো,
– হে পরোয়ার দেগার, অধীনকে পাপী লবজের জন্য ক্ষমা করে দিও।
আরকান আলি বাস স্টপের ইলেকট্রিক বোর্ডে দেখল তার চব্বিশ নাম্বার বাস দুমিনিটের মধ্যে আসবে। এখন যদি সে বাসায় ফেরত যায় কাপড় বদলাতে, তাহলে বাসটা মিস হয়ে যাবে। আর এই বাস মিস করলে তার কাজে যেতে অনেক দেরি হবে।
আরকান আলি বাসায় বাসায় গিয়ে বাচ্চাদের আরবী শিক্ষা দান করে। প্রায় বিশটির মতো বাসায় সে প্রতি সপ্তাহে গিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের আরবী শিক্ষা দান করে আসে। আজ যেতে হবে ছয়টি বাসায়। ভেজা কাপড় বদলাতে গিয়ে এখন যদি বাস মিস হয়ে যায়, তাহলে সব কটি বাসায় যেতে দেরী হবে। তাছাড়া এখন সে যে বাসায় যাবে তিনটি ছাত্রকে পড়াতে তাদের মা বড়ো মুখটান মহিলা। একবার আরকান আলির দশমিনিট দেরি হওয়ায় ইনিয়ে বিনিয়ে প্রায় বিশ মিনিট ধরে কি কথাইনা শোনালো! বাবারে বাবা, কী জোরালো গলার আওয়াজ তার!
না, আরকান আলি সেই আওয়াজ আর শুনতে চায়না। সে ঠিক করলো বাস মিস করবেনা। ভেজা কাপড়েই যাবে। বৃষ্টি থেমে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ। আরকান আলি বোর্ডের দিকে চেয়ে দেখলো বাস টাইম ডিউ হয়ে আছে। যে কোন মূহুর্তে বাস এসে যাবে। ভেজা কাপড়ের, ভেজা শরীরের অস্বস্তি নিয়ে সে, বাস যে দিক দিয়ে আসবে সেই দিকে তাকিয়ে রইল।
কিন্তু বাসতো দেখা যাচ্ছেনা। হয়তো আজই বাস দেরি করে আসবে! আরকান আলি বৃষ্টির কৃপায় নিজের উপর প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে বেশ রেগে আছে। আর এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে তার মুখে শুধু থুতু জমে। উল্টা পাল্টা কতো কিছু মনে আসে!
তবে এমূহূর্তে, বাসের টেনশানে ঐ বাসার ছাত্র তিনটির মায়ের মারমুখো মুখটাই তার চোখে ভেসে উঠছে। কী মহিলারে বাবা! ঐ মহিলার কথা ভোলার জন্য আরকান আলি অন্য কিছু ভাববার চেস্টা করল।মহিলার স্বামীকে সে দুএকবার দেখেছে। নিরীহ টাইপের লোক। বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে শেফের কাজ করে বোধহয়। তার চেহারা চোখে আনার চেস্টা করলো আরকান আলি। কিন্তু পারল না। বরং অন্য আরেকজনের চেহারা তার চোখে ভেসে উঠল। ঐ লোকটাকে প্রায়ই সে ঐ বাসায় দেখে এবং সে লক্ষ্য করেছে ঐ লোকটার সঙ্গে ঐ মহিলা খুব সুন্দর করে মিহি স্বরে কথা বলে। হাসি ঠাট্টা করে। সম্পর্কে ঐ লোকটা তাদের কে হয় সেটা জানার চেস্টা করেছে আরকান আলি। পারেনি। ছাত্রদের একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল। তারা বলেছে আংকেল। কী ধরণের আংকেল? মামা? চাচা? বাবার বন্ধু? না, তারা আর কিছু বলতে পারেনি। তারা জানে শুধুই আংকেল।
এটা আরকান আলির বিষয় না। এটা সম্পুর্ণ ঐ মহিলার ব্যক্তিগত বিষয়। এ নিয়ে সে মাথা ঘামাতে চায়ও না। বাচ্চাদের আরবী শিক্ষা দান তার কাজ এবং সেটাই তার করা উচিত। তা সে করেও। তারপরও কৌতুহলের একটা ব্যাপার আছে। তাছাড়া বেশরিয়তি একটা ব্যাপার ঐ বাসায় ঘটছে সেটা সে মোটামুটি আঁচ করতে পারছিল। একদিনের ঘটনায় সেটাও পরিস্কার হয়ে গেল।
সেদিন বিনা নোটিশে আরেকটি বাসার শিক্ষা দান বাতিল হয়ে যাওয়ায় প্রায় আধঘন্টা আগে ঐ বাসায় গিয়ে হাজির হলো আরকান আলি। তার ছাত্ররা ড্রয়িংরুমে খেলছিল হয়তো। তাদেরই একজন দরজা খুলে দিল। একজন গিয়ে মাকে ডাকতে লাগল। কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর বেডরুমের দরজা খুলে ঐ মহিলা বের হল। তার পেছন পেছন গেন্জি গায়ে ঐ লোকটাও। আছতাগফিরুল্লাহ। আরকান আলি এটা কী দেখল? তার গা শিউরে উঠল। শরীরের সব লোম খাড়া হয়ে উঠল। সে মনে মনে বলল, হে পরোয়ার দেগার আমাকে তুমি এ কীসের সাক্ষী বানিয়ে রাখলে!
আরকান আলি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে বাসায় এরকম বেশরিয়তি কাজ কারবার চলে সে বাসায় আর কখনো আরবী শিক্ষা দান করতে যাবে না। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারল না আরকান আলি। ঐ বাসায় সপ্তাহে এক ঘন্টা আরবী শিক্ষা দান করে পঞ্চাশ পাউন্ড পায়। পঞ্চাশ পাউন্ড এক ঘন্টায়? সামান্য ব্যাপার না।
আরকান আলি লোভ সামলাতে পারে নি। সে ঐ বাসায় আরবী শিক্ষা দানে বহাল রইল। তার চোখকে বলল, চোখ তুই বেশরিয়তি কিছু দেখিস না। কানকে বলল, কান তুই বেশরিয়তি কিছু শুনিস না। সে এতোসব বাসায় আরবী শিক্ষা দান করতে যায় যে সব বাসার সব কিছু সে জানতেই পারেনা। তার তো জানার প্রয়োজনও নাই। সে সব বাসায় নিশ্চয় কোন না কোন বেশরিয়তি কাজ কারবার হচ্ছে। তাতে তার কিছু যেমন যায় আসে না, তেমনি ঐ মহিলার বেশরিয়তি কর্ম দেখলেও তার কিছু যায় আসে না। তার কাজ ছাত্র ছাত্রীদের আরবী শিক্ষা দান করে নগদ বেতন ঘরে নিয়ে আসা। আরকান আলি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। চৌত্রিশ মিনিট সে দাঁড়িয়ে আছে। চব্বিশ নাম্বার বাসের দেখাই নেই। অথচ এসেই বোর্ডে দেখেছিল, বাস আসবে দুমিনিটের মধ্যে।
আরকান আলির বিরক্তির সীমা রইল না। ভেজা কাপড়, ভেজা শরীর, অস্বস্তি ত্রুমেই বাড়তে লাগল।
সে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর স্থির করল- আর না। এবার বাসায় গিয়ে ভেজা কাপড় বদলিয়ে আসবে। আজ আর ঐ মহিলার বাসায় যাবে না। এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঐ বাসায় গেলে আজ অন্য সব বাসায় যেতেও দেরি হয়ে যাবে। এক বাসার জন্য আরও পাঁচ বাসায় দেরি করে যাবার কোন মানে হয় না।
আরকান আলি নিজের বাসার দিকে পা বাড়াল। বাসায় গিয়ে ঐ বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিবে আজ সে যাচ্ছে না।
বাসায় ঢুকে খানিকটা বিস্মিত হলো আরকান আলি।
স্ত্রী আর পাঁচ বছর বয়সি এক কন্যা নিয়ে তার ছিমছাম সুন্দর সংসার। মুসল্লি হলেও সে অনেকগুলো সন্তান জন্ম দেয়ার বিরোধী। ফলে ঐ একটি কন্যা সন্তানেই মহান আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত স্বীকার করে সে সন্তুষ্ট হয়ে আছে।
এই একটি কন্যাই হইচই করে ছোট্ট বাসাটা মাতিয়ে রাখে। সে যতক্ষণ স্কুলে থাকে বাসাটা বড়ো নিষ্প্রাণ, নিরিবিলি হয়ে থাকে। এখন যেমন আছে।
নিরিবিলি বাসায় ঢুকে আরকান আলি তার বেডরুমের দরজা বন্ধ দেখে বিস্মিত হল। তার স্ত্রীরতো এখন ঘুমিয়ে পড়ার কথা না!
বিস্মিত আরকান আলি দরজা খুলে যা দেখল তাতে তার দুনিয়া উলট-পালট হয়ে গেল। আসমান নীচে আর মাটি যেন উপরে উঠে গেল। হে পরোয়ার আজ কি কিয়ামতের আগের দিন? সে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রশ্ন রাখল।
আল্লাহকে প্রশ্ন করা গুনাহর কাজ। আরকান আলি তা জানে। তারপরও নিজের ঘরে বেশরিয়তি কারবার দেখে, নিজের স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিছানায় দেখে রাগে, দুঃখে অন্ধ হয়ে গেল সে। প্রচন্ড ঘৃণায় গা শিউরে বমি করতে লাগল। ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে আরকান আলি তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারিয়ে কার্পেটে লুটিয়ে পড়ল।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..