আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ

শেলী সেনগুপ্তা
গল্প
Bengali
আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ

ভাদ্রের সূর্যটা দক্ষিণে সরে গেলে সাবেরা বেগমের ঘরে আরো বেশ আলো আসে। সাবেরা বেগমের শোয়ার ঘরটা দক্ষিণ দিকে। শরতের স্নিগ্ধ আলো, সোনা রোদ্দুর কার না ভালো লাগে। ইদানিং সাবেরা বেগমের শরীরটা একদম ভালো যাচ্ছে না । আলো দেখলেই মুখ লুকাতে ইচ্ছে করে। ভালো লাগে না আলোতে অবগাহণ করতে।  ভালো লাগেনা বলেই সারাদিন ঘরের মধ্যে মুখ বুঝে পড়ে থাকে।

একসময়  ঘরের পর্দা গুলি লাগিয়েছিলো ধবধবে সাদা। মনে হলো এই সাদা পর্দার কারণেই আলোটা চোখে বেশি লাগছে। তাই পর্দার রঙ পাল্টিয়ে ঘনসবুজ পর্দা লাগালো। যেন খরতাপেও সবুজ গাছের শীতল ছায়া পাই। কিন্তু তাতেও বিন্দুমাত্র কোন কিছুর পরিবর্তন হলো না। সেই আলোকিত ঘর আর ওর কষ্টের সময়।

সাবেরা বেগম সারাদিন নিজের ঘরে বসে থাকে। বই পড়া ছাড়া আর কোন কাজ করে না। অয়ন কলেজ থেকে ফিরেই মা’র কাছে চলে আসে। মা ওর সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দেয়। কপালে চুমু দেয়। মায়ের আদরে ওর শরীর জুড়িয়ে যায়।

আর অয়নের বাবা নেয়াজ চৌধুরী নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাবা যদি ঢাকায় থাকে তাহলে ওর সাথে সারাদিনে একবার দেখা হয় সকালে। তারপর যার যার কাজে সে সে বের হয়ে যায়। টাকা লাগলে বললেই দিয়ে দেয়। কখনো জানতে চায় না, কেন এবং কোথায় খরচ করবে। অয়নের মনে হয় এটা একটু বেশি রকমের প্রশ্রয়।

ওর অন্য বন্ধুরা ওদের বাবা সম্পর্কে বলে ‘খাটাস’। মাঝে মাঝে ওরও বলতে ইচ্ছা করে, কিন্তু পারে না। কিভাবে বলবে, না চাইতেই যে বাবা সব দিয়ে দেয়, শুধু দেয় না সময়। আর যদি সে দেখতো বাবা আর মা একঘরে বসবাস করছে তাহলেও ওর ভালো লাগতো। ও কখনো মাকে বাবার ঘরে যেতে দেখে নি। ওদের দেখলে সবসময় মনে হয়েছে দু’জন দু’দ্বীপের বাসিন্দা।

আজ সকালে অয়ন বাবার সাথে ব্র্যাকফাষ্ট করেই মা’র ঘরে আসলো। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মা আকাশ দেখছে। ও যে  চুপি চুপি পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা বুঝতেই পারে নি। ‘ধাপ্পা’ বলে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরার পর  সাবেরা বেগম ভীষণভাবে চমকে উঠলো, তারপর অয়নকে জড়িয়ে ধরে সে কি হাসি। অয়ন অবাক হয়ে মা’র দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে ‘ আমার মা কত সুন্দর, কি সুন্দর করে হাসে’।

সাবেরা বেগম ওর কপালে চুমু দিয়ে বললো

: কি দেখছিস এমন অবাক হয়ে?

: তোমাকে দেখছি মা, তুমি কি সুন্দর করে হাসো, সবসময় কেন হাসো না এভাবে?

: দূর বোকা, সবসময় কি হাসা যায়? যখন মন চায় তখনই হাসতে হয়।

: তোমার মন কেন সবসময় হাসতে চায় না?

সাবেরা বেগম অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে আমার ছেলেটা এতো বড় হয়ে গেলো কখন। কোন জবাব না পেয়ে অথবা জবাবের আশা না করে অয়ন মাকে জড়িয়ে ধরলো। কোলের মধ্যে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। সাবেরা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অনেক দূরে চলে গেলো।

একটা সুন্দর ছোট্ট গ্রাম, পাখি ডাকা, শ্যামল ছায়ায় ঘেরা, নদীর পাড় ঘেষা একটা গ্রাম। সে গ্রামের পাশ দিয়ে নদী বয়ে যেতো। ছোট ছোট নৌকা বয়ে যেতো। সে গ্রামের মেয়ে সাবেরা, মায়ের আদরের সাবু, দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেলো। হাত পায়ের লোম বিন্যস্ত হতে শুরু করতেই গ্রামের মাতবরের ছেলের চোখে পড়ে গেলো। অথচ সাবুর মনে শরৎ এনেছে ওর দূরসম্পর্কের মামাতো ভাই রাজন। রাজনের কথা মনে হলেই ওর মনের মধ্যে সাদা মেঘের ঘনঘটা হয়, হঠাত বাতাস এসে ওকে দুলিয়ে দেয়, অজান্তেই লজ্জা পেয়ে কিশোরী আঁচলে মুখ লুকোয় সে।

পাশের গ্রামেই রাজন থাকে। মাঝে মাঝে সাবেরাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতো। তখন থেকেই সাবেরা রাজনের পথ চেয়ে থাকতো। রাজনের এই আসা যে শুধু সাবেরার জন্য আসা তা বুঝতে পারতো সে। রাজনও এ গ্রামে আসার জন্য নানা অজুহাত খুঁজে নিতো।

যখন ওরা পরস্পরের স্বপ্ন ভাগ করে নেয়ার কথা ভাবছে তখন ডাক এলো যার যা আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার। অনেকের মতো রাজনও পারলো না সে ডাক এড়াতে, ছুটে গেলো। যাওয়ার আগে কিশোরী সাবেরার সাথে দেখা করে গেলো। দু’হাত ধরে অনুরোধ করে গেলো ওর অপেক্ষা করার। সাবেরাও রাজনকে বীরবেশে দেখার ইচ্ছে নিয়ে অশ্রু লুকিয়ে বিদায় দিলো।

ওরা বুঝে নি অন্তরাল থেকে কেউ তাদের খেয়াল করছিলো। রাজন যাওয়ার পর থেকে সাবেরারদের উঠোনে এক শকুনের আগমন ঘটলো। সে গ্রামের ছেলে নেয়াজ মোহাম্মদ এখন সময় পেলেই ওদের বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। কোন না কোনভাবে সাবেরার সামনে চলে আসে আর বাজার চলতি গানের কয়েক কলি গেয়ে শোনায়। একসময় দেশের পরিস্থিতি খারাপ, এই অজুহাতে সাবেরাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দেয়। ওর স্কুল শিক্ষক বাবা আলাউদ্দিন হোসেন সরাসরি নিষেধ করে দিলো। সেটা নেয়াজ মোহাম্মদ মেনে নিতে পারলো না। এবার নানাভাবে ভয় দেখাতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে সাবেরার বড়ভাই সোহানকে ডেকে নিয়ে নানাধরণের প্রশ্ন করতো। জানতে চাইতো, ‘ওর সাথে মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগ আছে কিনা? ওদের বাড়িতে কে কে আসে? কখন আসে?’ কখনো কখনো ডেকে নিয়ে সারাদিন বসিয়ে রাখতো। শেষে ওকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বললো। সোহানের চোখের মধ্যে ইটভাটার আগুন, যা দেখে নেয়াজ মোহাম্মদ বেশ মজা পেলো। তা আর একটু উসকে সোহানকে ছেড়ে দিলো।

বাড়ি ফিরে বাবাকে জানাতেই তিনি সে রাতেই সোহানকে ম্নুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে বললেন। সে অনেক আগে থেকেই যেতে চাইছিলো। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যদের দেখাশুনার জন্য বাবা ওকে যেতে দিতে চাইছিলো না। এবার নিজের উদ্যোগে পাশের গ্রামের একজনের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য পাঠিয়ে দিলো। অনেক রাতে ছেলেকে বিদায় দিয়ে এসে আলাউদ্দিন হোসেন আর তাঁর স্ত্রী অঝোরে কাঁদলো। সাবেরাকে বুকের মধ্যে নিয়ে সান্ত্বনা পেতে চাইলো।

সোহান যাওয়ার পর পরিবারটা বেশ অসহায় হয়ে গেলো। বাবার শরীর খারাপ করলো। চিন্তাভাবনায় আকুল হয়ে মা একদিন চুলার পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। সাবেরা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। ঠিক সে সময় নেয়াজ মোহাম্মদ এর  সাঙ্গপাঙ্গরা আশেপাশে ছিলো। তারা সাথে সাথে দলের লিডার এর কাছে খবর পৌঁছিয়ে দিলো। নেয়াজ মোহাম্মদ কোনভাবেই সুযোগটা হাতছাড়া করলো না। ছুটে গেলো সাহায্য করতে। জোর করেই  নিজের কাঁধে সাবেরাদের পরিবারের দেখাশুনার দায়িত্ব নিলো।

কখনো ভয় দেখিয়ে কখনো সহানুভূতি দেখিয়ে যতই ওর কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে, ততই সে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

একদিন সন্ধ্যাবেলা রাজন এলো ওর সাথে দেখা করার জন্য। ক্লান্তশ্রান্ত রাজনকে  রান্নাঘরে বসিয়ে খেতে দিলো। এমন সময় নেয়াজ এলো। বদ্ধঘরের দরজায় বারবার কড়া নাড়ছে। বিপদের কথা ভেবে অভূক্ত অবস্থায় রাজন চলে গেলো। পরে রইলো ভাতের থালা আর সাবেরার চোখের জল।

নেয়াজ ঘরে ঢুকেই খাবারের থালা দেখে একটা ক্রূর হাসি দিলো। এতো নিষ্ঠুর মুখ কেউ কখনো দেখেনি। সেদিনই সে সাবেরারকে জানিয়ে দিলো যদি নেয়াজকে বিয়ে না করে তাহলে রাজন আর সোহান কেউ প্রাণে বাঁচবে না।

তিনদিন পর সাবেরা নেয়াজের বঊ হয়ে গেলো। কিছুদিনের মধ্যে দেশও স্বাধীন হলো। স্বাধীন হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে নেয়াজ মোহাম্মদ হয়ে গেলো বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেয়াজ চৌধুরী।

সোহান এবং রাজনের কোন খবর পাওয়া গেলো না। জানা গেলো  সোহান এনং রাজন গ্রামের কাছাকাছি একটা জায়গা থেকে একসাথে রাজাকারদের হাতে  ধরা পড়েছে এবং  ওদের চরম নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে।

স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার আগেই সাবেরার বাবা এবং মা দু’জনই মারা গেলো।

নেয়াজ চৌধুরী পরিবার নিয়ে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করলো। ততদিনে অয়ন চলে এসেছে মায়ের কোলজুড়ে। সাবেরা সংসারের সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে একটা ঘরের মধ্যে বন্দী করে ফেলেছে। ওর যা কথা শুধু অয়নের সাথে।

কলেজ থেকে ফিরে মায়ের কাছে চলে এলো। মা’র কোলে শুয়ে শুয়ে আদর খেতে খেতে বললো,

: মামনি, আমার একটা পাঞ্জাবীতে কি কাজ করে করে দেবে?

: কি কাজ বাবা?

: আমার লাল পাঞ্জাবীতে তুমি সবুজ সূতো দিয়ে কাজ করে দাও যেন লালসবুজ পতাকার  ডিজাইন হয়।

: হঠাত এরকম পাঞ্জাবী পরতে হবে কেন?

: ওমা , তুমি বুঝি জানো না  ক’দিন পরেই বিজয় দিবস। সেদিন আমাদের কলেজে একটা নাটক হবে, আমি অভিনয় করবো।

: তুমি কি চরিত্রে অভিনয় করবে?

: আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করবো।

সাবেরা ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো।

অয়ন মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

: পাগলী মা আমার , কাঁদে না। আচ্ছা বলতো তুমি কাঁদছো কেন? আমিতো ভালো কাজ করছি। এখানে কান্নার কি হলো?

: আমি খুব খুশি হলাম বাবা। প্রকৃতির  এ কি বিচার! আমার খুব ভালো লাগছে বাবা।

: তাহলে কান্নাকাটি বন্ধ করো মামনি।

অয়ন সাবেরার চোখের জল মুছে দিলো।

আজ অনেকদিন পর সাবেরা  ঘরের বাইরে এসেছে। প্রথম সারিতে বসে অভিনয় দেখছে। চোখ বড় বড় করে ছেলের অভিনয় দেখছে। দেখতে দেখতে চোখের পলকও ফেলছে না।

মায়ের হাতের কাজের পাঞ্জাবী পরে অয়ন অভিনয় করতে উঠলো। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রজব আলী প্রধান অতিথি হয়ে এসেছে।

অভিনয়ে অয়ন প্রথম হয়েছে। আনন্দে সাবেরা হাত তালি দিয়ে উঠলো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করে দিলো।

অয়নকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার নেয়ার জন্য মনে ডাকলো।  বীর মুক্তিযোদ্ধা রজব আলীর হাত থেকে পুরষ্কার নেয়ার জন্য মঞ্চে যাওয়ার সময় মাকে সাথে নিলো। মঞ্চে উঠেই সে জানালো, ওর সব কাজের অনুপ্রেরণা ওর মা, তাই মা’র হাত থেকে পুরষ্কার নিতে চায়। রজব আলী আনন্দের সাথে সম্মত হলেন। উদ্যোক্তারা রজব আলীর হাতে ট্রফিটা দিলো অয়নের মা সাবেরার হাতে দেয়ার জন্য। রজব আলী দু’একপা এগিয়ে থমকে গেলো। এক দৃষ্টিতে সাবেরার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু দেখে নিয়েই বললো,

: তুমি আলাউদ্দিন স্যারের মেয়ে সাবেরা না?

সাবেরা ছলছল চোখে তাকিয়ে মাথাটা নিচু করে বললো,

: হ্যাঁ আমি সাবেরা।

: আমাকে চিনতে পারছো? আমি রজব আলী , আলাউদ্দিন স্যারের ছাত্র।

: রজব আলী ভাই , আমি আপনাকে চিনেছি।

: অয়ন তোমার ছেলে!

: হ্যাঁ, অয়ন আমার ছেলে।

: শুনেছি তোমার বিয়ে হয়েছিলো নেয়াজ মোহাম্মদ এর সাথে?

সাবেরা একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,

: ঠিক শুনেছেন ভাইয়া, এ বিষয়ে আমরা পরে কথা বলি?

রজব আলী গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন,

: বেশ, এটা নিয়ে আর কথা বলার কিছুই নেই।

ট্রফি নিয়ে ফিরে এলো অয়ন। মা’র হাত ধরে বাসায় চলে এলো। কিন্তু ওর মনের মধ্যে একটা কথা কাঁটা বার বার খচ খচ করছে। ওর বাবার নাম নেয়াজ চৌধুরী, তাহলে রজব আলী স্যার নেয়াজ মোহাম্মদ বললো কেন?

ভাবতে ভাবতে সারারাত ঘুম হলো না। ভোর রাতের দিকে একটু ঘুম এলো কি এলো না বাবার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠে দরজা খুলে দিলো। ওর জন্য নতুন মোবাইল ফোন এনেছে। অয়নের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে মোবাইলটা হাতে দিলো। আজ আর উপহারে মন নেই ওর। বাবার দিকে স্থির চোখে তালিয়ে বললো,
: বাবা, তোমার নাম কি নেয়াজ মোহাম্মাদ?

নেয়াজ চৌধুরী চমকে উঠলো। ছিটকে দূরে সরে গেলো। ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

: কে বলেছে তোমাকে?

: যে ই বলুক, বল তোমার নাম কি নেয়াজ মোহাম্মদ?

: এ বিষয়ে তোমার সাথে পরে কথা বললো।

নেয়াজ চৌধুরী তাড়া খাওয়া  কুকুরের মতো ছুটে বের হয়ে গেলো। সাবেরার ঘরের সামনে দিয়ে যেতে যেতে অগ্নিদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। তখন কি সাবেরার ঠোঁটে কি বিদ্রুপের হাসি ছিলো?

অয়ন স্থানুর মতো বিছানায় বসে আছে। ওর কিছুই ভালো লাগছে না। মোবাইলটা হাতে নিতে ইচ্ছে করছে না। বিছানা থেকে নেমে একটা সার্ট গায়ে দিয়ে বের হয়ে গেলো।

সাবেরা ছেলের পেছনে পেছনে এসেও কথা বলতে পারলো না। চিন্তিত মনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

সারা দুপুর অয়ন ঘরে ফিরলো না। সাবেরা একবার দরজার কাছে যায় আর একবার ঘরে ঢোকে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে আছে। অয়ন আসছে না। সাবেরার মন খারাপ লাগছে।

নেয়াজ চৌধুরীও  সেই সকালে বের হয়ে গেছে। সাবেরা যেন একটা ঝড়ের আভাস পাচ্ছে। চুপচাপ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। আকাশে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি। অনেক ওপর দিয়ে একটা চিল অলস ভঙ্গীতে উড়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে মনটাকে সেই চিলের ডানায় উড়িয়ে দিলো। ফিরে যাচ্ছে অনেক দূরে।

নেয়াজ মোহাম্মদ ওকে ভয় দেখিয়ে বিয়ে করলো, কিন্তু ও একদিনের জন্যও নেয়াজ মোহাম্মদকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারে নি। এর মধ্যে অয়ন হলো। সাবেরার বন্দী জীবন আরো মজবুত হলো। অয়নের জন্য ওকে এখানে থেকে যেতে হলো। চারদিকের সব দরজা বন্ধ করে শুধু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সাবেরা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখলো।

নেয়াজ মোহাম্মদ যখন সাবেরাকে বিয়ে করার জন্য তোড়জোড় করছিলো  তখন রাজন আর সোহান পাশের জেলাতে অপারেশনে ব্যস্ত ছিলো। ওরা যখন প্রাণপনে যুদ্ধ করছে তখন ওদের কাছে খবর পাঠানো হলো সাবেরাদের পরিবার বিপদে আছে। দু’জনই আর যুদ্ধে মনোনিবেশ করতে পারলো না। একজন তার পরিবার আর আরেকজন প্রেমিকা ও প্রেমিকার পরিবারের জন্য ছুটে এলো। ভাবলো ওদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে রেখে আবার যুদ্ধে যাবে। তা আর হলো না। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। গ্রামে ঢোকার সাথে সাথে ওদের ধরে ফেললো নেয়াজ মোহাম্মদের দল। তারপর পাকিস্তানী আর্মির হাতে তুলে দিলো। ওদের যখন প্রচন্ড নির্যাতন করা হচ্ছিলো তখন নেয়াজ মোহাম্মদ সাবেরাকে বিয়ে করলো। এর মধ্যে ওর মা বাবা মারা গেলো। আর প্রচন্ড নির্যাতন করে রাজন আর সোহানকে হত্যা করা হলো।

দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প আগেই নেয়াজ মোহাম্মদ ভোল পালটে হয়ে গেলো প্রখ্যাত ব্যবসায়ী নেয়াজ চোধুরী।

শহরের অভিজাত এলাকায় বাড়ি করে বসবাস করতে শুরু করলো। সাবেরাতে আর মন নেই, ওর  সাথে সংসার শুধু অয়নের জন্য। এখন নেয়াজ চৌধুরীর আশে পাশে মক্ষীরানীদের অভাব নেই। সাবেরাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

সাবেরা বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। এখনো অয়ন ফিরে আসে নি। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা সকালেও কিছু খায় নি। কি করছে  কে জানে? সাবেরাও খায় নি কিছুই, অয়ন না আসা পর্যন্ত ওর মুখে খাওয়া রুচবে না।

সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় ঝড়ো কাকের মতো অয়ন এলো। কাজের লোক দরজা খুলে দিতেই সাবেরা ছুটে গেলো। অয়নকে কাছে টেনে নিতে গেলেই মাকে সে দূরে সরিয়ে দিলো। হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেলো। ধাম করে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলো।

সাবেরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে চলে এলো। বিছানায় শুয়ে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে। অয়নের অসহায়তা ওকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। ছেলেটা কি সব সত্য জেনে গেলো? পারবে তো সব সামলে নিয়ে বেঁচে থাকতে? ভাবতে ভাবতে ডুকরে কেঁদে উঠলো।

কলিং বেল বেজে উঠলো। কাজের লোক দরজা খুলে দিলো। এলোমেলো পায়ের শব্দে বুঝলো নেয়াজ চৌধুরী ফিরে এসেছে। সাবেরা চিবুক শক্ত হয়ে গেলো। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে গর্জে উঠতে। এমন সময় অয়নের গলার আওয়াজ শোনা গেলো।

সাবেরা রুম থেকে ছুটে বের হলো। ছেলের পাশে দাঁড়াতে হবে। যার জন্য এতো বছর এতো কিছু মেনে নিয়েছে , আজ  ওর জন্যই প্রতিবাদী হবে।

অয়ন দাঁড়িয়ে আছে নেয়াজ চৌধুরীর মুখোমুখি। একটুও পলক ফেলছে না। দু’জন উচ্চতায় সমান সমান। কিন্তু অয়নের দৃঢ়তার কাছে নেয়াজ চৌধুরীকে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। অয়ন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নেয়াজ চৌধুরীর দিকে , চোখের পলক ফেলছে না।

সাবেরা ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নেয়াজ চৌধুরী  অয়নের দৃষ্টির তীব্রতা সহ্য করতে পারছে না। সাবেরার দিকে দেখছে বার বার। পারলে ওকে এখনই ভষ্ম করে দিতো। কঠিন কন্ঠে অয়ন জানতে চাইলো,

: তোমার নামতো নেয়াজ চৌধুরী, তাহলে নেয়াজ মোহাম্মদ কে?

: আমি জানি না।

: শুনেছি নেয়াজ মোহাম্মদ নামে একজন কুখ্যাত রাজাকার ছিলো, সে এখন কোথায়?

: জানি না।

: আমি জানি।

: কি জানো?

: আমি জেনেছি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কুখ্যাত রাজাকার নেয়াজ মোহাম্মদ বেঁচে আছে, বহাল  তবিয়তে বেঁচে আছে, সে এখন নেয়াজ চৌধুরী নামে ঢাকায় ব্যবসা করছে।

: চুপ কর।

নেয়াজ চৌধুরী চেঁচিয়ে উঠলো।

: চিৎকার করবে না। আমি সব জেনে গেছি। তুমি তোমার গ্রামের দু’জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছো। ওরা তো শহীদের মর্যাদা পেলো, তোমার কি হবে? আমি তো তোমাকে পিতার মর্যাদা থেকে নামিয়ে দিলাম।

: কি বলছো তুমি?

: আজ থেকে তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই, তোমাকে আমি ত্যাগ করলাম। আমি আমার সব কিছু থেকে তোমার নাম মুছে ফেলবো।

: রক্ত থেকে কি করে মুছবে?

: আমার রক্তে রয়েছে আমার মা এবং মামার রক্তও। তাই তোমার  রক্তের দুষিত অংশ এমনিতেই বিশুদ্ধ হয়ে গেছে। আমি তোমার সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছি।

: কোথায় যাচ্ছো?

: দু’চোখ যেদিকে যায় সেদিকে যাবো। মুজিব এর বাংলার কোথাও না কোথাও আমার  ঠাঁই হবেই।

সাবেরা অয়নকে জড়িয়ে ধরে বললো,

: আমাকেও নিয়ে চল বাবা, এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।

: চল মা, তোমাকে আমি রাজাকারের কারাগারে রেখে যাবো না।

নেয়াজ চৌধুরী চেঁচিয়ে উঠলো,

: অয়ন, এসব ভালো হচ্ছে না কিন্তু।

: রাজাকার নেয়াজ মোহাম্মদ, তুমি তোমার বিত্ত বৈভব নিয়ে থাকো। আমি চললাম আমার মাকে নিয়ে। জেনেশুনে আমি একজন রাজাকারের সাথে সম্পর্ক রাখবো না। তবে আমি সব মনে রাখবো। আরেকটা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও তুমি।

নেয়াজ মোহাম্মদের বিস্ফোরিত চোখের সামনে দিয়ে মায়ের হাত ধরে অয়ন বের হয়ে গেলো। নেয়াজ মোহাম্মদ কেঁপে উঠলো, সে এখন চোখের সামনে যেন সোহান আর রাজনকে দেখতে পাচ্ছে।

শেলী সেনগুপ্তা। কবি, গল্পকার ও শিশু সাহিত্যিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পর পেশাগত জীবনে কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে অবসর গ্রহণ করে লেখালিখি ও সংসার দেখাশুনা করে সময় কাটান। শেলী সেনগুপ্তা তার ভাবনায় ও রচনায় কাব্য...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..