আর্জেন্টিনার বইমেলায় প্রথম বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন

মৌ মধুবন্তী
ভ্রমণ
Bengali
আর্জেন্টিনার বইমেলায় প্রথম বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন

আর্জেন্টিনার বই মেলায় প্রথম বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন ও আমার অংশগ্রহণ

৪৫তম বুয়েনেস এয়ার্স আন্তর্জাতিক বই মেলা ২০১৯ (ছবি-১)। ২২শে এপ্রিল থেকে ১৩মে।  বৃহত্তম ল্যাটিন ভাষার বইমেলায় বাংগালী কবিদের কি কাজ? প্রশ্ন বটে। কিন্তু এটাও সত্য আমরা বাস করছি গ্লোবাল বেস্টনীতে। ভাষাও সেখানে পরস্পরের সাথে সখ্যতা করছে অনায়াসে। ভালোবেসে। তার উপর আছে মিঃ গুগুল ট্রান্সলেশান। কিছু তো হেল্প পাওয়া যায়ই। নয় কি? শুধু কি তাই? সুদূর আর্জেন্টিনায় রয়েছে বাংগালী ব্যবসায়ী এবং দক্ষ স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলার জন্য দুইশ থেকে তিনশ বাংলাদেশী ভাইবোনেরা। আজকের লেখায় বইমেলার অভিজ্ঞতাই লিখব। অন্য আরেকটি গল্পে তাদের জীবন যাপন আলোচনা করব।

ছবি-২

এই মেলায় আমি মৌ মধুবন্তী কবি হিসাবে কানাডা থেকে আর আমেরিকা থেকে ডঃ রওনক আফরোজ এবিসিসিআই এর আমন্ত্রিত অতিথি কবি হিসাবে যোগ দেই (ছবি-২)।  সেই  ৪৫তম বুয়েনেস এয়ার্স আন্তর্জাতিক বইমেলা ২০১৯ এ  ৪৩১ (ছবি-৩) নাম্বার স্টল ছিল বাংলাদেশ প্যাভেলিয়ন। পুরো মেলায় ছিল আমার দেখায় ৪৫০০ স্টল নাম্বার (ছবি-৪)। বস্তুত স্টল সংখ্যা ছিল ৪৭১৫ টি।  একেকটা স্টলের সাজ সজ্জা আলোকোজ্জ্বল ডেকোরেশান ও বইয়ের আড়ম্বর মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত (ছবি-৫)। এই ডিজিটাল যুগেও এতো হার্ড কপি বইয়ের মেলা। ভাবাই যায়না।  মোট ১১টি  ভিন্ন ভিন্ন প্যাভেলিয়নে সাজানো হয়েছে এইসব স্টল। এতে এক অংশে ছিল কালচারাল অনুষ্ঠানের মঞ্চ। যারাই অনুষ্ঠান করতে চেয়েছে, তারা প্রত্যেকে দেড় ঘন্টা করে সময় পেয়েছে। এই বছর এই মেলা চলেছে ২২ শে এপ্রিল থেকে ১৩মে পর্যন্ত। মোট ভিজিটরের সংখ্যা ছিল ১,১৮০, ০০০। ৪৭১৫টি বইয়ের প্রফেশানাল  স্টল (পাবলিশার্স, বুকসেলার্স, ডিস্ট্রিবিউটর, ইলাস্ট্রেটর, ট্রান্সলেটর), এবং ৩০টি দেশের পাব্লিশার্সের অংশগ্রহণ ছিল, যেমন জার্মানী, আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, বলিভিয়া,ব্রাজিল, আমাদের কানাডা, চিলি, চায়না, কলোম্বিয়া, কোস্টারিকা, কিউবা, একুয়েডর, ইউনাইটেড এরাব এমিরাত, গ্রীস, গুয়েতেমালা, ইটালি, জাপান, ম্যাক্সিকো, নিকারাগুয়া, প্যারাগুয়ে, পেরু, পুয়েটোরিকো, ইউনাইটেড কিংডম, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, উরুগুয়ে, ভেনিজুয়েলা এবং আরো অনেক । মোট এগারটি হলে ইভেন্ট চলছিল একই সাথে। ছিল  নয়টি সেমি ওপেন অডিটোরিয়ামঃ চিল্ড্রেন এরিয়া, (লাইব্রেরী, স্টোরিটেলিং, ওয়ার্কশপ) ফিউচার জোন, এক্সপ্লোরেশান জোন, ডিজিটাল স্পেস, ফেডারেল স্পেস/ ফাংশানাল ডাইভার্সিটি এন্ড ডিসেবিলিটি/ ফেডারেল স্পেস, প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস এন্ড অটোগ্রাফ,ড্রোম/ ফেয়ার ইমেজ।

ছবি-৩-৪
ছবি-৫
ছবি- ৬ ও ১৩

আটটি প্যাভিলিয়ন ছিল। এদের নাম ছিল, ওর্চার, ফ্রেরস, ব্লু, গ্রীন, ইয়েলো, রেড, হোয়াইট, পা। আমাদের স্টল ছিল অর্চার প্যাভিলিয়নে লা রুরালে। (ছবি-৬)

ছবি- ৭

এবার আসি আমার অভিজ্ঞতার ভান্ডার নিয়ে। ২২শে এপ্রিল পৌঁছালাম বুয়েনেস এয়ার্স  আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে। বেলা ১টা বাজে। পনের ঘন্টার জার্নি টরন্টো এয়ারপোর্ট থেকে এয়ার কানাডায় টু  চিলি সান্টিয়াগো এয়ারপোর্ট (ছবি-৭)। সেখানে দুই ঘন্টা বিরতি। এই বিরতিতে আমাদের সবাইকে প্লেন থেকে নেমে আবার সিকিউরিটি পার হয়ে এসে নতুন প্যাসেঞ্জারদের সাথে  উঠতে হলো একই প্লেনে। হালকামত কান ধরার মত । জাস্ট ইউটার্ন আর কি? শুরু হলো ভাষার সমস্যা। আর তুমুল হাসাহাসি। বলে নেয়া ভালো, আরেক কবি ডঃ রওনক আফরোজ ও তার স্বামী নজ্রুল ইসলাম ভাই,ওহাইও থেকে কানেক্টিং ফ্লাইট ধরে এলো, পিয়ারসন্স ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্ট,টরন্টোতে। এর মুল কারন, ঐ অচেনা দেশে আমরা তিনজন একসাথেই ল্যান্ড করতে চাইলাম। তো দেখা হলো, বন্ধুর সাথে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে । দেখার সাথে সাথেই সেলফি হয়ে গেল (ছবি-৮) । খিলখিল হাসিতে ভরে গেলো এয়ারপোর্টের লাউঞ্জ। তারপর নজ্রুল ভাইয়ের ক্যামেরায় ঝটপট আরো কিছু ছবি। দারুণ ব্যাপার আমি যেমন ছবি তোলার জন্য ক্রেজী, রওনক ও সেই রকম। কবিতে কবিতে মেলবন্ধন। সেলফোনে নয়। নজরুল ভাইয়ের সেই নিক্কন SLR  ক্যামেরায়। তারপর প্রথম আপ্যায়ন স্টারবাক্সের কফি। হোস্ট নজরুল ইসলাম ওরফে দুলাভাই।

ছবি- ৮

আমার সীট ছিল আলাদা। তারা স্বামী স্ত্রী আমার থেকে বেশ দূরে। বলাই ছিল যার পাশে সীট খালি থাকবে,তার পাশেই আমরা গিয়ে সীট চেঞ্জ করে একসাথে বসব।

আমার পাশে মাঝের সীট খালি (ছবি-৯)। আইলের পাশে বসেছে মন্ট্রিয়াল থেকে নোরা। ওর বয়ফেন্ড থাকে বুয়েনেস এয়ার্সে। সে একজন ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লায়ার। ভাষার সমস্যা নিয়ে আমরা বেশ কিছু আলোচনা করলাম। সে তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে অনেক গল্প করলো। প্রতিবারে সে যাবার পর তারা একটা নতুন জায়গায় যায়, এবারের প্ল্যান ছিল সাউথ আর্জেন্টিনাতে যাবার। হাইকিং তার সখ। এই লং ডিস্টেন্স রিলেশান কেমন কষ্ট দেয়, কেমন আনন্দ দেয় সেটাও জানলাম। তবে লং ডিস্টেন্স রিলেশানের মেইন্টান্যান্স কস্ট রিয়েলি হাই। এইসব নানাবিধ গল্প করতে করতে এক সময় সে চোখ রাখে একটা বইয়ের পাতায়। তারপর সে ঘুম। রাত গভীর হতে থাকে।

ছবি- ৯

এরই মাঝে কবি  রওনক উঠে এসে বললো, বন্ধু চলে এসো জায়গা আছে। ব্যস আমিও সব রেখে উঠে গেলাম তাদের সারিতে। আন্তরিক, বন্ধু বৎসল একজন ডাক্তার। মনোবিজ্ঞানী।  তাই বোধ হয় আমাকে একা থাকতে দেয় নি। তাদের সঙ্গ দিয়ে উতফুল্ল করে রাখার চেষ্টা ছিল সবসময়।

সমস্যা হলো, খাবার নিয়ে। আমার ডায়াবেটিক খাবার সার্ভ করা হয়, আমার সীটে, আর আমি বসেছি অন্য সীটে, সেখানে রেগুলার খাবার পাই। এটাতো মাথায় ছিলো না। রাতে একবার উঠে ব্যাগ আনতে গিয়ে দেখি আমার সীটের টেবিলে খাবার। চিন্তা করলাম কি হলো ব্যাপারটা? হাতে নিয়ে দেখি লেখা  আছে ডায়াবেটিক মীল। হু। এই হলো ব্যাপার। ডাবল খাবার পেলাম। তবে যাবার পথে এয়ার কানাডার খাবার এতো জঘন্য ছিল যে আমার মত শুধু নুন দিয়ে সেদ্ধ খাবার যে খেতে পারে তার ও পছন্দ হয় নি। চিলি এয়ারপোর্টে গিয়ে খাবার কিনব। সে আশায় পড়লো বালি। কারণ দুইঘন্টা তো হাঁটতেই চলে গেলো। প্লেনে যেটা আজকাল মজা হয়, ডিজিটাল লাইভ ম্যাপ দেখা। প্লেন কোন পথে কোন দেশের উপর দিয়ে যাচ্ছে কত উপর দিয়ে কোন ডিরেকশানে ইত্যাদি দেখার আনন্দই আলাদা। আমি সাধারণত প্লেনে উঠেই মুভি দেখতে বসি। যত ইচ্ছা মুভি দেখার জন্য উতকৃষ্ট সময় । কিন্তু এবার সেটা না করে বেশীর ভাগ সময় লাইভ ম্যাপ দেখলাম। চিলি থেকে দুইঘন্টার জার্নি বুয়েনেস এয়ার্সে।

ছবি- ১০

২৩শে এপ্রিল, ৪৫তম বুয়েনেস এয়ার্স বইমেলায় নিয়ে গেলো আমাদেরকে এবিসিসিআই এর প্রেসিডেন্ট তালুকদার আলীম আল রাজী। একজন হোলসেল ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যবসায়ী। ইয়ং একজন বাংলাদেশী ব্যবসায়ী। চটপটে এবং তুখোড় স্প্যানিশ বলতে পারে। আন্ডারগ্রাউন্ডে পার্ক করে আমরা লম্বা একটা ট্যারেস পার হয়ে বের হলাম একটা গলি রাস্তায়। সেখানে কোলাকোলার সৌজন্যে সব খাবারের দোকান সাজানো। সেই রাস্তা পার হয়ে এবার আমরা প্রবেশ করলাম আসল বইমেলার বিরাট এক চত্বরে। ওর্চার্ড প্যাভিলিয়নে।  আমাদের সিএনই এর মত বিশাল। জীবনে প্রথম এই রকম বিশাল আকারের একটি বইমেলায় আমার প্রবেশ। সারি সারি সাজানো দোকান। তখনো উদবোধন হয়নি। আমরা গেলাম বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নকে সাজাতে। আমাদের আগেই দোকানে এসে উপস্থিত ছিল এবিসিসিআই এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্গারিটা পেকোরা। অবশ্যই সে আর্জেন্টিনাবাসী। ভাষা না বুঝলেও হৃদয় উজাড় করা হাসি দিয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলাম এবং নামগুলো উচ্চারন করাতে সাহায্য করলো আলীম। আমি সাথে নিয়ে গেছি আমার লেখা কবিতার বই, রক্তনদী একা, বাতাসে বৃক্ষপ্রেম, অধরা আইফোন, মন পুরাণে ম্যারিলিন মনরো, মন ওড়ে কলাবতী রাগে আর নুনের দুঃখ (ছবি-১০)। এ ছাড়াও আমার সাথে ছিল বন্ধু ডঃ ধঞ্জনয় সাহার কবিতার বই, প্রেম পাথরের কারখানা। আর টরন্টোর নতুন কবি (২০১৯) হোস্নে আরা জেমীর বই বৃষ্টি করে নেব। আর আরজ আলী মাতুব্বরের সত্যে অন্বেষণে।  বাংলাদেশের নামকরা একজন কবি,সম্পাদক ও প্রকাশক কবি বদরুল হায়দারের বই, নিস্বার্থের জানালা খুলে । রওনক তার বই বের করলো। প্রতিটি স্টলে একটি করে লকড স্টোর রুম ছিল। আমরা সব ব্যানার পোস্টার লাগিয়ে, ফেসবুকে লাইভ দিলাম। সবার সাথে ছবি তুললাম (ছবি-১১)। আশেপাশের সব দোকানে গিয়ে দেখলাম । ছবি তুললাম। কিন্তু কেউ তো ইংরেজীর  ই- ও বলে না। এমনটা একদম আশা করিনি। ভেবেছিলাম, হালকা পাতলা ইংরেজী জানলেও একটা ভাব বিনিময় করা যাবে। আমাদের ব্যাপক পরিকল্পনা ছিল, পাব্লিশার্সদের সাথে কথা বলা, কবিদের সাথে আড্ডা দেয়া। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি।

ছবি- ১১
ছবি- ১২

বিস্ময়ের বিষয় হলো, কবিরাই আমাদের প্যাভেলিয়ন এসেছে খোঁজ নিতে (ছবি-১২)।  কে কবি, তাদের সাথে দেখা করতে। রবীন্দ্রনাথের দেশের মানুষ আমরা এটাই একটা বিশাল ব্যাপার অনেকের কাছে। কারণ তারা জানে কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে আমাদের নোবেল বিজয়ী কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা আত্মিক সম্পর্ক ছিল। আলীমের  ইন্টারপ্রিটেশানে  কিছুটা আলাপ হলেও, বেশী দূর এগুনো যায়নি। সাহিত্যের ভাষা আলীম জানে না। তা ছাড়া সে ব্যবসায়ী। সারাক্ষন স্টলে থাকে না। আমরা গুগল ভাইকে জিজ্ঞেস করে করে কত আর কথা বলতে পারি? শুভ সন্ধ্যা-বুয়েনেস নোচেচ হাউ আর ইউ-কোম এস্টাস। গ্ল্যাড টু মীট ইউ-এনচান্তাদো ডি কোনোচার্তে। মেনি  মেনি থাঙ্কস-মুছো গ্রাসিয়াস। বাই-আদিওস এই রকম টাইপ। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতায় ছিল এইটুকুই।

উদবোধন হয়েছে ২৫ এপ্রিল। কিন্তু কোথাও কোন আড়ম্বর দেখিনি। আমরা অনুষ্ঠান সূচী দেখে দেখে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি কোথায় উদবোধন হচ্ছে, মিনিস্টার আসবে না কি হবে ,তুমুল একটা বক্তৃতা হবে। দুপুর দুইটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত খুঁজেও কোন হদিস মিললো না। এরই মাঝে কত জনের কাছে ইনফরমেশানের জন্য হেল্প নিলাম। আন্তরিকভাবে সবাই চেষ্টা করলো, এমনকি রেডিও  বুয়েনেস এয়ার্সের স্টাফরাও চেষ্টা করলো। হায় তাতো, অবশেষে জানলাম, এই উদবোধন এমন কিছু আহামরি কিছু নয়। মানে হলো মেলা শুরু হয়েছে। ফিতা কাটা নেই। মন্ত্রী নেই। কোন পুস্প নেই। ঢাক ঢোল নেই। ধ্যাত এতো দূর থেকে আসলাম । একটা জম্পেশ উদবোধন দেখব,  না হলো না। একটা মঞ্চ আছে যেখানে অনবরত ইন্টারভিউ নিচ্ছে বিভিন্ন কবিদের। চেষ্টা করলাম সেখানে নামের তালিকায় নাম লেখাতে। কিন্তু ইন্টারপ্রিটার পাওয়া গেলো না বলে তা আর হলো  না। মনটা বিষন্ন হলো। ২২ তারিখে পৌঁছালেও আমরা মুলত পঁচিশ তারিখের পর থেকেই  মেলায় যাতায়াত শুরু করলাম।এর মাঝে একদিন উরুগুয়ে গিয়ে ঘুরে আসলাম। সে কাহিনী আরেকদিন বলবো। প্রতিদিন বেলা দুইটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত মেলা চলছিল। এতো বৃহৎ পরিসর যে মেলায় কোন ভিড়ই চোখে পড়েনি। ভিড় কেমন হচ্ছে তা বোঝা যায় গাড়ি পার্ক করার সময় এবং গেট দিয়ে ঢোকার সময়। হাই সিকিউরিটি পার হয়ে গেটে ঢুকতে হয় (ছবি-১৩)। বাম দিকের প্যাভেলিয়নে ছিল রেড কার্পেট এন্ট্রেন্স,এর নাম ছিল রেড। তার পেছনে ছিল ব্যাপক এক্সিভিশান সেন্টার। প্রাচীন বই ও বর্ণমালা, ছাপা খানা  ইত্যাদি যন্ত্রপাতির এক্সিভিশান। আমার চোখ ছিল কত নাম্বার পর্যন্ত আমি স্টল দেখতে পারি। ৪৫০০ পর্যন্ত আমি দেখেছি আর ২১৭টি স্টল আমি দেখতে পারিনি। প্রতিটি স্টলের সাজানোর ধরন আলাদা এবং রুচিশীল স্টাইলের ছাপ স্পষ্ট।

ছবি- ১৪

স্প্যানিশ ভাষায় আমাদের ওস্তাদি বলছি, কফি শপে গিয়ে কফি কিনব, তো কি করি, গুগুলকে জিজ্ঞেস করলাম, হট কফি উইথ মিল্ক।  গুগল বললো, , কালিয়ান্তে ক্যাফে কন লিচে। কিন্তু তারা আমাদের এক্সেন্ট বোঝেনা। আরে একদিনেই কি জিহবায় সব সেট হয়? তো কি আর করা সেলফোন এগিয়ে দেই তারা ট্রান্সলেশান পড়ে আমাদেরকে সার্ভিস দিল। এবার এলো সাইজ। কোন সাইজের কফি? দাম লেখা আছে বোর্ডে। কাপ হাতে নিয়ে দেখালাম । ছোট কাপ এমন ছোট যে হেসেই আমি খুন। সম্ভবত দুই আউন্সের কাপ। আমার আবার ছোট ছোট জিনিসের প্রতি একটা আকর্ষন আছে। তাই আমি স্মল কফি নিলাম,  রওনক আর নজ্রুল ভাই  নিলো মিডিয়াম। কফির বৈশিষ্ট্য হলো, স্মোকি গন্ধ, অতিরিক্ত কড়া। দুধ মিশালেও সেই কড়া তেতো  ভাব যায় না। যেমন কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না। আহা টিমহর্টন্স ।  তাকে কত মিস করেছি।

এবার বলি, বাংলাদেশ প্যাভেলিয়নের কথা, কয়েকজন বাংলাদেশী এলো বৌ বাচ্চা নিয়ে। একটি বাচ্চা বেশ চটপটে। বয়েস পাঁচ বছর। ছেলে বাচ্চাটি নিজে থেকেই আমার বই হাতে নিয়ে বললো, আপনার সাথে ছবি তুলবো (ছবি-১৪)। বাহ! এমনটা তো আশাই করিনি। তখন অন্যান্য সব বাচ্চারাও যোগ দিল। সবার হাতে আমাদের বইগুলো এক এক করে তুলে দিলাম। আর বাহাদুর বলে একজন ইয়ং লোক এগিয়ে এসে বললো, বইয়ের দাম কত?  রওনক তড়িঘড়ি করে বললো পাঁচ ডলার। তিনি ৩০০ পেসো করে দুটো বই নিলো রওনকের আর আমার দুটো বই নিলো।৬০০ পেসো আয় হলো।   বই তো নিয়েছি অল্প কয়েকটা। বিক্রি করলে দোকান খালি হয়ে যাবে। বাংলাদেশ থেকে যে সব পাব্লিশার্স বই নিয়ে আসার কথা তারা কেউ আসতে পারলো না ভিসা পায়নি বলে। ওদের ভরষায় আমরাও বেশী বই নেইনি সাথে করে। বাংলাদেশ থেকে তারাই আমাদের বই নিয়ে আসার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই অল্প সংখ্যক বাংগালীর মধ্যেও দলাদলি আর ভাগাভাগি আছে। বই বিক্রি বাদ দিয়ে দোকানে সাজানোর জন্যই বই রেখে দিলাম।

ছবি- ১৫

আঠাশে এপ্রিল, বাংলাদেশ নাইট। বইমেলার মুল প্যাভেলিয়নের একপাশে স্টেজ সাজানো আছে। অনেক ভলান্টিয়ার আছে। চেয়ার পাতা আছে। ১১৪৭টি কালচারাল প্রোগ্রাম হয়েছে। যখন যার স্লট তখন তাদের ব্যানার ঝুলিয়ে দিচ্ছে। রাত আটটায় শুরু হয়েছে বাংলাদেশ নাইট (ছবি-১৫)। সময় দেড় ঘণ্টা। আমার কবিতার বই নুনের দুঃখের মোড়ক উন্মোচন হবে।  রওনক আফরোজের কবিতা শিরোনামে কবি রওনকের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে।  র‍্যাপিং পেপার কিনতে দোকান খুজে পাইনি বলে, পোস্টার দিয়ে বইকে মোড়কিত করা হলো। কিন্তু লাস্ট মিনিটে একজন ভদ্রলোক বাংলাদেশের  দুটো পতাকা দিয়ে আমাদের বই দুটোকে মুড়ে দিলেন। বস্তুত এটাই আমার তীব্র ইচ্ছা ছিল। ইচ্ছা পুরোন হলো। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে  এবিসিসিআই এর প্রেসিডেন্ট তালুকদার আলীম আল রাজী ও সেক্রেটারি অফ ফরেন মিনিস্ট্রি মি. মাতিয়াস কাস্টেশা নো। মনটা চাঙ্গা থাকার কথা।

ছবি- ১৭

কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পাব্লিশার্সরা আসতে পারেনি বলে, সবাই এমন এক মানসিক যন্ত্রনায় ছিল যে আমরা দুজন কবি তাদের অলংকার হলেও তাদের মানসিক অবস্থা দেখে আমরা খুবই অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আমাদেরকে তারা  ভালো হোটেলেই রেখেছিল, হোটেল এস্টোরিয়া। সেন্টার সিটি। এখান  থেকে যে কোন কিছু হাতের নাগালে ছিল । এভিনিউ দা মেইসো। এর এক প্রান্তে পার্লাম্যান্ট ভবন। সে বিষয়ে পরে বলব। মেলাতেই থাকি। আমার ও রওনকের লেখা বাংলা কবিতার স্প্যানিশ ট্রান্সলেশান আগেই করা ছিল। সেটা পাঠ করল, এবিসিসিআই এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্গারিটা পেকোরা। স্প্যানিশ ভাষায় অনুষ্ঠান উপস্থাপনা হচ্ছিল যেহেতু অনেক আর্জেন্টিনাইন সেখানে উপস্থিত ছিল। আমি আমার লেখা কবিতা আবৃত্তি করলাম।

বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে কিছু কথা বলার সুযোগ পেলাম। অনুষ্ঠানের শুরু হয় বাংলাদেশের ও আর্জেন্টিনার জাতীয় সংগীত বাজিয়ে। ভীষণ ভালো লাগার বিষয় ছিল আমার লেখা দেশের গান “চন্দ্রাবতী মধুবন্তী” অহর্নিশ অডিও ইউটিউব চ্যানেল থেকে বাজানো হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে  উপস্থিত ছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট অফ কাস্টমস কমিশন মিস গ্রাসিয়েলা নাস। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছে ABCCI এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্গারিটা পেকোরা। আমাদের পরিচিতি পড়েছে স্প্যানিশ ভাষায়। শুধু নিজের নামটুকু শুনেই মঞ্চে গিয়েছি।

ছবি- ১৬

অনুষ্ঠানে কবি  ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে আমাদের নোবেল লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে প্রগ্রাঢ় বন্ধুত্ব ছিল, তার উপর একটি ডকুম্যান্টারী দেখানো হয়। এই ডকুম্যানটারী তৈরী করেন আর্জেন্টিনার প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পরিচালক পাবলো সিসার। দেড় ঘন্টার এই আয়োজনে আরো ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া সেই বিখ্যাত গান। আমি বাংলায় গান গাই, মন মোর মেঘের সংগীতে, ও মুই না যাইমু না যাইমু ইত্যাদি গানের সাথে তুমুল তুখোড় নৃত্য প্রদর্শন করে দুজন বলিভিয়ান নাগরিক, ওরা হলো গ্রাবিয়েল সালাসার এবং রোসিও বাস্কেস এবং জেমি পিনোস কলোম্বীয়ান নাগরিক।  অতি সাবলিলভাবে বাংলা গানের সাথে নাচ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। নাচের পোশাক পরিকল্পনা এবং মেকয়াপে ছিলেন শামীমা তালুকদার। বাংলা গানের সাথে কি সাবলীল নাচ করলো বাংগালী ড্রেস পরে, সেটা সত্যি মনে রাখার মত। পুরো অনুষ্ঠানের ছবি তোলা ও ভিডিও ধারন করেন আমেরিকা প্রবাসী মি. মোঃ নজরুল ইসলাম এবং ABCCI এর কমিটি মেম্বার মি.মেহেদি হাসান। অনুষ%

মৌ মধুবন্তী। কবি ও উদ্যোক্তা। পঁচিশ বছরের বেশী দেশ ছেড়ে উত্তর আমেরিকায় বাস। আবৃত্তি ধারণ করেন অন্তরের অন্তঃস্থলে। কবিতা লিখেন বাংলা ও ইংরেজি দুই মাধ্যমেই। তিনি মনে করেন, কাব্য ছাড়া কবির কোন পরিচয় থাকেনা। তাই আত্ম সমালোচনায় প্রত্যয়ী। কবিতাকে ভালোবেসেই...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..