আলপনা

মনিজা রহমান
গল্প
Bengali
আলপনা

সাদেককে ছাড়া বিয়ে বাড়ীর কোন কাজ ঠিকমতো হয় না। অথচ ওর আসার কোন খবর নেই।

সাইদা বেগমের মেজাজ সকাল থেকে খুব খারাপ।  সাদেক ছেলেটার মোবাইল বন্ধ কেন? ও কি তবে আজ আসছে না? এই জন্য ইচ্ছা করে মোবাইল অফ করে রেখেছে?

বড় মেয়ে লোপা এসে কয়েকবার ঘুরে গেছে। সবার মুখে এক প্রশ্ন, সাদেক ভাই কবে আসবে?

সাইদা বেগমের পাঁচ মেয়ের মধ্যে সবার ছোট টুপার আজ বিয়ে। লোপা, দীপা, রিপা, নীপার বিয়ে দিয়েছেন অনেকদিন হল। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ভালোই আছে মেয়েরা। চর্তুথ মেয়ে নীপাকে নিয়ে একটু দুশ্চিন্তা আছে। মুখে কিছু বলে না মেয়েটা । ওর কোন সন্তান নেই। বিয়ে হয়েছে ৩ বছরের বেশী। স্বামী নামকরা ডাক্তার। বেশ ভালো পশার। টাকা পয়সার দিক থেকে সব বোনদের তুলনায় ভালো অবস্থায় আছে ও। তবু কেন যেন সব সময় নীপার মুখ মলিন থাকে। সাইদা বেগমের খুব দুশ্চিন্তা হয়। কিছু বলেনি নীপা। তবু সাইদা বেগমের মনে হয়, সাংসারিক জীবনে সুখী নয় মেয়েটা!

ছোট মেয়ে টুপার বিয়েতে সাইদা বেগম আর ভুল করেননি। মেয়ের পছন্দের ছেলের সঙ্গে দিয়েছেন। কোন তাড়াহুড়া করেননি। ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’ এভাবে এগোননি। বড় দুই মেয়ের বেলা তো পাত্র পক্ষ দেখতে এসেছে সন্ধ্যায়। ওই রাতেই কাজী ডেকে বিয়ে পড়ানো হয়েছে। স্বামী নাই। ছেলে নাই। তাই মেয়ের বিয়েতে দেরী করতে চাননি সাইদা বেগম। ভালো পাত্র পাওয়া মাত্র দ্বিতীয় চিন্তা না করে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।

টুপার বিয়েতে দেখেশুনে এগিয়েছেন। আর এই তো শেষ  মেয়ে। ও চলে গেলে পুরো বাসা ফাঁকা। এনগেজমেন্টের পরে ছেলেকে বাসায় বেড়াতে আসার সুযোগ দিয়েছেন। মেয়ে তো আগে থেকে চেনে। নিজেও যাচাই করে নিলেন।

টুপার বিয়ের পরে সাইদা বেগম ভাবছেন লোপার মেয়ে আফরিদাকে নিজের বাসায় এনে রাখবেন। রংপুরে থাকে বড় মেয়ে। ওখানকার চেয়ে ঢাকায় লেখাপড়ার সুযোগ সুবিধা অনেক বেশী। বড় মেয়ে জামাই দেলোয়ারকে দুই একদিনের মধ্যে এই নিয়ে বলবেন। মনে হয় দেলোয়ার রাজী হবে। তাড়াহুড়া করলেও বড় মেয়ের জামাই ভালো হয়েছে। খুব আদব কায়দা। লোক দেখানো নয়। আসলেই মনটা বেশ ভালো দেলোয়ারের। অনেক ক্ষেত্রে বড় ছেলের অভাব পূর্ণ করেছে। মেয়ে দেখানো পর্ব থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সব কাজে দারুণ সাহায্য করছে দেলোয়ার। সরকারী চাকুরে জামাই এক সপ্তাহ ছুটি নিয়েছেন ছোট শালীর বিয়ে উপলক্ষে। আগের শালীদের সময়ও এটা করেছে ও । মেজ ও সেজ মেয়ের জামাইও আমুদে, সামাজিক। দেলোয়ারের মতো অতটা নাহলেও বেশ ভালো। তারাও সবাই জমায়েত হয়েছে বাসায়।

নীপার স্বামী রেজাউলের কেবল কোন খবর নাই। এত রোগী-রোগীনিদের ছেড়ে চট্টগ্রাম থেকে বিয়ের দিনেও আসতে পারবে কিনা সন্দেহ। নীপাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করলে ভালো করে কোন উত্তর দেয় না। এই যে সাদেক আসছে না বলে সবার এত প্রশ্ন, নীপা কিন্তু একদম নীরব। অথচ এক সময় সাদেকের সঙ্গে ওরই বেশী সখ্য ছিল।

বছর দশেক আগে বাসার দেখাশুনার জন্য সাইদা বেগম শ্বশুরবাড়ী সম্পর্কিত ভাতিজা সাদেককে এনেছিলেন  বাসায়। এমন বিনয়ী, বিশ্বস্ত আর করিৎকর্মা ছেলে এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে বলে বিশ্বাস হয় না সাইদা বেগমের। কোন কাজ বললে কখনও মুখে ‘না’ নেই। স্বামীর রেখে যাওয়া দুই তলা বাড়ীটি চারতলা করেছেন তিনি। সাদেক না থাকলে এই কাজে নামার সাহস পেতেন না। রড-সিমেন্ট কেনা, দাঁড়িয়ে থেকে মিস্ত্রিদের কাজের তদারকি করায় ওর মতো আর কে পারে! মেয়েলি কাজেও ওর নিপুণতা বিস্ময়কর। কোটা বাছা রান্না করতে বললেও সাদেক এক পায়ে খাড়া।

‘সাদেক ভাই কখন আসবে? এখনও আলপনা আঁকা শুরু করতে পারছিনা।’ দীপা এসে অনুযোগ করে মায়ের কাছে।

সাদেক শিল্পী নয়। ছবি আঁকায় কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই ওর। কিন্তু এমন অসাধারণ সুন্দর আলপনা আঁকতে পারে যে ভাবাই যায় না। এই কাজে সাদেকের সৃজনশীলতা ওর অন্যান্য সমস্ত গুনকে হার মানিয়ে দিতে পারে। আগে ঈদে-শবে বরাতে বোনদের হাতে মেহেদীর আলপনা আঁকতো ও। স্কুল-কলেজে বান্ধবীরা খুব প্রশংসা করতো সেই আলপনার।

‘কি করব, সেই তখন থেকে ছেলেটার মোবাইল বন্ধ পাচ্ছি।’ দীপার কথার উত্তর দেন সাইদা বেগম। ‘ইচ্ছা করে মোবাইল বন্ধ রাখার ছেলে তো সাদেক নয়। কোন বিপদ হল কিনা বুঝতে পারছি না।’

বড় মেয়ে লোপার ক্লাসে নাইনে পড়া ছেলে জুনায়েদ মহাচিন্তিত বাসা সাজানো নিয়ে। সারা বাড়ীতে লাইটিং করতে হবে। গেট সাজাতে হবে। ওর বাবা নাকি এসব কিছুই চেনে না। এখন ছোট খালামনির বিয়েতে কি দিয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না জুনায়েদ।

হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ। লোপারা সব বোন, মামাতো, খালাতো, চাচাতো, ফুফাতো সব ভাই, বোন-ভাবীরা উড়ে যায় দরজার কাছে। সবার উদ্বীগ্ন মুখে স্বস্তির প্রলেপ বুলিয়ে হাসিমুখে ভেতরে ঢোকে সাদেক। সাইদা বেগম বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে শোকর জানান পরম করুনাময়ের কাছে।

সাদেকের পিছনে লালের ওপর ছোট ফুল ছাপা বোরকা পরা একটা মেয়ে ঢোকে। দুইজনের মুখে লাজুক হাসি।

সাইদা বেগম এগিয়ে আসতেই সাদেক ছুটে গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে। দেখাদেখি বোরকা পরা মেয়েটাও।

দেরীতে আসার জন্য সবার প্রশ্নের জবাবে কেবল হাসে সাদেক। সাইদা বেগমের সামনে গিয়ে এবার মুখ খোলে।

‘চাচী আম্মা ভালো আছেন? মাফ করবেন আপনাকে একটা খবর দেয়া হয়নি। আমি গত মাসে গফরগাঁওয়ে বিয়ে করেছি। এই আমার স্ত্রী মিনারা।’

কেউ ভাই, কেউ বা সাদেক কাকু.. কেউ সাদেক মামা বলে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, ’তুমি বিয়ে করেছ। আমাদের জানাও নি কেন?’

সাদেক মাথা বুকে নামিয়ে নিয়ে আবারও লজ্জ্বার হাসি হাসে।

‘হঠাৎ করে বিয়েটা হয়ে গেল। বাজারে আমার আর ওর ভাইয়ের দোকান পাশাপাশি। ভাইটা ধরল, বাপ-মা মরা মেয়েটাকে উদ্ধার করার জন্য। তারপর রাজী হয়ে গেলাম।’ সাদেক সব কথা চোখ নামিয়ে বলে। হেসে ওঠে সবাই। বিয়ের আলোচনা ওখানে শেষ। কত কাজের ফিরিস্তি সাদেকের কাছে। কত কাজের আলোচনা ওর সঙ্গে।

মিনারার দিকে আর কেউ ফিরে তাকায় না। বিশাল এই বাড়ীতে এতগুলি নতুন মানুষের মধ্যে ও কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। স্যুটকেস হাতে  নিয়ে এক কোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। পুরো সময় নীরব  নীপা এসে মিনারার হাত ধরে।

‘ভালো আছ মিনারা? আসতে কষ্ট হয়নি তো?’ নীপা প্রশ্ন করে।

‘এমনিতে কোন কষ্ট হয়নি। তবে তেনার মোবাইলটা ভেঙ্গে গেছে।’ মিনারা চটপট উত্তর দেয়। নীপা বুঝতে পারে গ্রামের মানুষ বলে মেয়েটা জবুথবু নয়।’

‘কিভাবে ভাঙ্গল?’

‘বাসে উঠতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে গেছে। কম দামী মোবাইল তো সঙ্গে সঙ্গে দুই টুকরা।  বুঝলেন নীপা আপা আপনাগো সাদেক ভাইয়ের মোবাইল ভাগ্যই খারাপ। এর আগে একবার..’ আরও কিসব বলে যায় মিনারা কিন্তু কিছুই নীপার কানে ঢোকে না। ও চমকে ওঠে। মেয়েটা ওর নাম জানল কিভাবে। প্রশ্ন করবে কি করবে না ভাবতে থাকে।

‘তুমি আমার নাম জানলে কিভাবে?’ নীপা ধীরে ধীরে জানতে চায়।

‘আপনার কথা গত এক মাসে আমার স্বামীর কাছে কতবার শুনেছি যে বলার নয়। আপনার চোখের নীচে একটা আঁচিল মতো আছে, এই খবর সে বিয়ের রাতেই বলেছে। তাই চিনতে সমস্যা হয়নি।’

নীপার মলিন মুখে রক্তিমাভা দেখা যায়।

ড্রইং রুম-ডাইনিং রুম, বারান্দা, সিঁড়ি সব জায়গার আলপনা আঁকে সাদেক একাই। সবাই হা করে দেখে ওর শিল্পকর্ম। এতদিন চর্চা নেই। তবু কি সুন্দর! বড় জামাই দেলোয়ার আলপনার ছবি ক্যামেরায় বন্দি করে।

গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান হবে ছাদে। প্যান্ডেল টাঙ্গিয়ে সবার বসার ব্যবস্থা হবে। তিন বছর হল এই পাড়া ছেড়েছে সাদেক। তবু পরিচিত ডেকোরেটর খুঁজে পেতে দেরী হয় না। জুনায়েদ জানায়, খুব কম টাকায় বাড়ীর লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ও এত কম আশা করেনি। বাড়ীতে রান্নার ঝামেলা করবেন না সাইদা বেগম। খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করতেও সাদেকের দেরী হয় না। ওর মেন্যু নির্বাচন নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না।

দোতলার বাসার পুরো জায়গায় সাদেক আলপনা এঁকেছে। বাসার সামনের পাকা জায়গা থেকে শুরু করে এক তলা থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত ওর শিল্পীত হাতের ছোয়া পায়। ছাদে গায়ে হলুদের মঞ্চ করা হবে যেখানে, তার সামনে বিশাল এক আলপনা আঁকে সাদেক।

এই ছাদটা ঘিরে ওর অনেক স্মৃতি আছে। ছাদের এক কোনে ছোট্ট চিলেকোঠায় থাকতো ও। ফজরের আজানের আগে আকাশ পরিস্কার হতেই ঘুম থেকে উঠে পড়তো। ব্যায়াম করার অভ্যাস ছিল না সাদেকের। আসলে ও এত দৌড়াদৌড়ি করতো যে ব্যায়ামের প্রয়োজন পড়ত না। সকালে ছাদে হাঁটতো আর গান গাইতো সাদেক। ‘ও নদী রে.. একটি কথা শোনাই শুধু তোমারে ..’ হেমন্তের গাওয়া এই গানটা ছিল ওর খুব প্রিয়। এখনও কোথায় গানটা বাজতে শুনলে সাদেকের ছাদের সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায়।

মেয়েরা এবেলা ওবেলা মার্কেটে দৌড়াচ্ছে। এত কেনাকাটা, তবু যেন প্রয়োজনীয় জিনিষ শেষ হয় না। গায়ে হলুদের দিন ছেলের বাসায় বড় আকারের মাছ পাঠাতে হবে। সাইদা বেগম ভাবনায় পড়ে যান। সাদেক অনেকদিন ঢাকায় নেই। আগে হলে ও ব্যবস্থা করতে পারতো। কিন্তু এখন …

– বিশাল মাছ পাঠাতে হবে। কি করা যায় বলতো? নিজের ঘরে সাদেককে ডেকে বলেন তিনি।

– দেখি চাচি কি করা যায়? সাদেক উত্তর দেয়।

পরদিন ভোর থেকে সাদেকের কোন খবর নেই। ওর স্ত্রী মিনারা বলল ফজরের আজানের পরে বের হয়ে গেছে ও।

নয়টার সময় সবাই তখন নাস্তার টেবিলে। কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খোলার পরে জুনায়েদের ‘ওয়াও’ ধ্বনি শেষ হতে চায় না। বিশাল মাছ কিনে এনেছে সাদেক।

– এত বড় মাছ সাদেক মামা। নিজের চোখে তো দূরের কথা, টিভিতেও এত বড় মাছ দেখি নাই। এ যেন তিমি মাছ!

জুনায়েদের হৈ চৈয়ে সবাই ছুটে আসে। প্রত্যেকে বিস্মিত মাছের আকার দেখে। স্থানীয় এক মাছওয়ালাকে নিয়ে যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে গিয়েছিল সাদেক সেই ভোরবেলায়। আগেই বলে রাখা হয়েছিল। আড়তের সবচেয়ে বিশাল মাছটা কিনে আনে সাদেক। কত টাকা লেগেছে জানতে চান সাইদা বেগম। সাদেক কোনভাবে বলবে না। ছোট বোন টুপার বিয়েতে এটাই নাকি ওর উপহার।

সেই মাছের শরীরেও অদ্ভুত সুন্দর আলপনা আঁকে সাদেক। মাছ নিয়ে আবার ও নিজেই ছোটে টুপার হবু শ্বশুরবাড়ীতে। সঙ্গে জুনায়েদও যায়। বাড়ীতে ঢুকেই জুনায়েদ উত্তেজিত কণ্ঠে সবাইকে বলে, ওখানে সবাই ভীষণ অবাক বিশাল মাছ দেখে। টুপাকে মোবাইলে ওর হবু স্বামী সজল ফোন করে মাছের প্রশংসা করে। এত বড় মাছ! তার গায়ে চমৎকার সুন্দর আলপনা। মাছটা না কেটে মনে হয় যেন দেয়ালে বাধিয়ে রাখি! বিয়ে বাড়ীতে সাদেকের কদর বেড়ে যায় আরও এক ধাপ।

সব কাজে সাদেকের ডাক। এক মিনিট বিশ্রাম নেবার সময় পায় না ছেলেটা। এজন্য অবশ্য মুখে কোন অভিযোগ নেই। সব সময়ই হাসি মুখ। কোন কাজে বিরক্তি নেই। স্বামীর ঠিক উল্টো অবস্থা মিনারার। সারাদিন বলতে গেলে কোন কাজ নেই ওর। ঘরের একোনায় ওকোনায় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকে। কত কিছু কেনাকাটা হয়। ওকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনা। কোন কাজ না পেয়ে রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মিনারা। কোটা-বাছা করে দিন কাটায় ও। শহুরে রান্না বানার ধরন বুঝতে পারে না।

রাতেও স্বামীর নাগাল পায় না মিনারা। বাসায় এত মানুষ যে  শোয়ার কোন ঠিক নাই। মহিলারা ওপরে-নীচে করে শোয় এক রুমে। অন্য রুমে পুরুষরা ভাগাভাগি করে শোয়। সাদেকের তো বরাবর পরের দুঃখে কাতর মন। একটু বসার জায়গা পেলেই সেখানে ঘুমিয়ে নেয়। আসলে ওকে কেউ ঘুমাতে দেখে না। সবার পরে ঘুমাতে যায়। সবার আগে ওঠে।

সাদেকের নামে ধন্যি ধন্যি চারদিকে। পাত্র পক্ষের বাড়ীতে গিয়েছে কদিন। সেখানেও সবাইকে মুগ্ধ করে রেখে এসেছে। বড়রা ওর পরামর্শ ছাড়া চলতে পারে না। ছোটদের সমস্ত আবদার সাদেক মামার কাছে।

অভিযোগ যদি কারো থাকতো, তবে সেটা হত মিনারার। সারাদিন-সারারাত সে স্বামীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগও পায় না।

‘আপনি এখানে আইসা একদম বদলাইয়্যা গেছেন!’ মিনারা মন্তব্য করে।

সাদেক মাথা নীচু করে হাসে। কথার কোন উত্তর দেয় না। উত্তর দিলে সেই কথার সূত্র ধরে আরেকটা মন্তব্য করতে পারে মিনারা। সাদেক স্ত্রীকে সেই সুযোগ দেয় না।

‘এমন জনপ্রিয়তা আপনার, সামনের বছর চেয়ারম্যান ইলেকশন করতে পারবেন।’ মিনারা রনে ভঙ্গ দেয়।

কথাগুলি মিনারা টিপ্পনির সুরে বলে তা কিন্তু নয়! এত বড় বাড়ী.. সেখানে কত সুবেশ মানুষজন, তাদের কাছে ওর স্বামীর জনপ্রিয়তা দেখে মিনারাও মনে মনে গর্বিত। রান্না ঘরে কাজ করলেও সেখানে সবাই ওর স্বামীভাগ্য নিয়ে কথা বলে। তখন বুকের মধ্যে কেমন যেন গর্ববোধ হয়। মিনারাও কম যায় না। ও ধীরে ধীরে বাড়ীতে নিজের অবস্থান তৈরী করে নিয়েছে। রান্না বান্না যাই করুক, নানা ধরনের ভর্তা তৈরীতে জুড়ি নেই ওর। সবাই এখন তিন বেলাতেই খাবার টেবিলে বসে মিনারার হাতে তৈরী ভর্তা খোঁজে।

গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এখন গানবাজনার আয়োজন আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নয়ত যেন অনুষ্ঠান জমে না। কনে বসে থাকবে মঞ্চে। অতিথিরা হলুদ দেবার পাশাপাশি গান শুনবে। কেউ কেউ গানের তালে নাচবে।

আফরিদা চেয়েছিল কয়েকজন মিলে নাচের কয়েকটি আইটেম করতে। সমস্যা বেধেছে সঙ্গী নিয়ে। তাই পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়। ব্যান্ড শো করা যায় কিনা সেই নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জুনায়েদ খুব জোরাজুরি করে ব্যান্ড শো নিয়ে। কিন্তু সাইদা বেগমের আপত্তির মুখে সেই জোর টিকল না। তিনি অতি আওয়াজের বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত সব কাজের কাজী সাদেক সমস্যার সমাধান দিল। ওর এলাকার এক মেয়ে ঢাকায় গান করে নাম করেছে। এক টিভি চ্যানেলে প্রতিভা অন্বেষণ প্রোগামে শেষ দশে উত্তীর্ণ হয়ে দেশ ব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। এলাকার মানুষের কাছে ভোট চাইতে গিয়েছিল তিন্নি নামের সেই মেয়ে। ভোট সংগ্রহের জন্য সাদেক ওকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছুটেছে। খুব খেটেছিল ও বরাবরের মতো বিনা পারিশ্রমিকে।

সেই তিন্নি আসে টুপার গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠানের গায়িকা হয়ে। নানা ধরনের জনপ্রিয় গান গেয়ে শোনায়। খুব আকর্ষণীয় হয় অনুষ্ঠান। সাইদা বেগম খুশী হন আয়োজনে। টুপার শ্বশুরবাড়ীর লোকজনও খুশী, উঠতি এক গায়িকার গান স্বচক্ষে উপভোগ করতে পেরে। গানবাজনা, চমৎকার খাওয়া দাওয়ার মধ্যেও সবার চোখ এড়ায় না হলুদের মঞ্চের সামনে আঁকা আলপনা। এত নিখুঁত, এমন অভিনব। সবাই শিল্পীকে খোঁজে।

মিনারার কাছে সব কিছু সিনেমার মতো মনে হয়। মফস্বলে বেড়ে ওঠা এক মেয়ের কাছে বিয়ের এসব আনুষ্ঠানিকতা টিভিতে দেখা হিন্দি সিরিয়ালের কাহিনীর মতো। মিনারার মুগ্ধ হবার আরও কারন আছে। সব গুরুত্বপূর্ণ কাজের পিছনে ওর স্বামীর হাত আছে। সবার মুখে এত প্রশংসা সাদেকের। মিনারার কাছে ওর স্বামী স্থান পায় অন্যরকম উচ্চতায়।

অনেক রাতে টুপার মোবাইলে সজলের ফোন আসে। সজল মানে ওর হবু স্বামী তৌফিকুর রহমান।

– কি ঘুমিয়ে পড়েছ?

– ১২ টা বেজে গেছে, ঘুমাবো না? টুপা উল্টো প্রশ্ন করে।

– তোমাদের তো একজন সাদেক ভাই আছে, কোন চিন্তা নাই। আমার তো শত কাজের ভাবনা।

সজলের কথা শুনে টুপার হাসি পায়। বিয়ের আয়োজন করতে গিয়ে বেচারা নার্ভাস হয়ে পড়েছে।

– এত কাজের মধ্যে আমার কথা ভাব তো?

– সারাক্ষণই ভাবি। কখন তুমি আমার ঘরে আসবে, সেই ভাবনায় মগ্ন থাকি প্রতি মুহূর্ত, প্রতিক্ষণ।

– এজন্যেই তো কোন কাজ ঠিক মতো করতে পার না। টুপা হাসতে হাসতে বলে।

– কি করব, চাইলেই কি তোমার কথা মাথা থেকে সরানো যায়? সজল প্রশ্ন করে।

মাকে রুমে ঢুকতে দেখে টুপা।

– ঠিক আছে কাল কথা হবে। তোমার এত প্রশংসা সাদেক ভাইকে পৌছে দেব।

মোবাইল কেটে দেয় টুপা।

সাইদা বেগম বুঝতে পারেন সজল ফোন করেছে। তিনি কিছু বলেন না। মেয়ের হাসি মুখ দেখেন। তাঁর স্থির বিশ্বাস ছোট মেয়েটা খুব সুখী হবে দাম্পত্য জীবনে।

– মা আমি আজ তোমার সঙ্গে ঘুমাবো। টুপা আবদার করে।

– অবশ্যই ঘুমাবি। একদিন পরেই তো তুই পরের বাড়ীর মেয়ে। আর কি তোকে পাওয়া যাবে?

সাইদা বেগমের কথার মাঝে ঘরে ঢোকে নীপা। কেমন যেন অচেনা মলিন ছায়া ওর মুখ জুড়ে।

– মা তোমাকে আগেই বলে রাখি, আমি কাল ছেলের বাড়ী হলুদে যাব না।

– কেন যাবি না?

– যাব না এমনিই।

কথা শেষ করেই ঘর ছেড়ে চলে যায় নীপা। হতভম্ব মুখে বসে থাকেন সাইদা বেগম ও টুপা।

সকালে উঠে সাদেকের কাছে সজলের প্রশংসা পৌছে দিতে দেরী করে না টুপা। সাদেকের চেয়ে বেশী খুশী হয় যেন মিনারা।

– টুপা আপা আমি তো ওনারে বলছি আগামী বার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে।

মিনারার কথায় আশে পাশে দাঁড়ানো সবাই হেসে ওঠে। মিনারার মনে আনন্দের শেষ নেই। লাল রঙের সুন্দর একটা জামদানী শাড়ী ওকে কিনে দিয়েছেন সাইদা বেগম। আজ ছেলে হলুদে পরবে। বিয়েতে পরার জন্য কাতান শাড়ী পেয়েছে। ওর সব শাড়ী মিলিয়েও এই কাতানের দামের সমান হবে না। বিয়ের দিন সবাই বিউটি পার্লারে যাবে সাজতে। মিনারার ইচ্ছা ওখানে যাবার। তার আগে আজকের দিনের সাজ সজ্জা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ওদিকে সাদেক ব্যস্ত গায়ের হলুদের ডালা-কুলা সাজানো নিয়ে।

ছেলের বাড়ী পৌছানোর অনেকক্ষণ পরে সাদেক টের পায় নীপা আসেনি। ও কিছুক্ষণ এদিক সেদিক খোঁজ করে। তারপর সাইদা বেগমের কাছে জানতে চায়। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি জানান, আসেনি নীপা।

সবার অগোচরে ওখান থেকে চলে আসে সাদেক। বাড়ীতে ফিরে কোন রুমে নীপাকে দেখতে পায় না। খুঁজতে খুঁজতে ছাদে চলে আসে। ওই তো নীপা। ছাদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে আনমনা। আগেও যেভাবে থাকতো।

সাদেকের পায়ের আওয়াজ পেয়ে নীপা ফিরে থাকায়। কোন প্রশ্ন করে না। সাদেকও কিছু জানতে চায় না। চুপচাপ পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ নিঃশব্দতা ভেঙ্গে কথা বলে ওঠে নীপা।

– সাদেক ভাই, তুমি তো এত সুন্দর আলপনা আঁকলে, সবার হাতে মেহেদী পরালে, কই আমার হাত তো খালি। বিষাদমাখা সুরে কথাগুলি বলে নীপা।

– দেখ তোর জন্য আলাদা করে একটা টিউব মেহেদী কিনে তিন দিন ধরে পকেটে নিয়ে ঘুরছি।

প্যান্টের পকেট থেকে জিনিষটা বের করে দেখায় সাদেক। নীপা হাসে। ক্রমশ শব্দ বাড়তে থাকে ওর হাসির। সাদেক তাকিয়ে দেখে। এক সময় থামে নীপা।

–    আমার বিয়ের দিন তুমি যে গ্রামে চলে গেলে কাউকে না জানিয়ে, কারণটা কেউ না জানলেও আমি কিন্তু জানি!

হঠাৎ করে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে কোন কথা বলে না সাদেক। ওর চেহারায় বেদনার ছাপ। সেদিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলকে উপলব্ধি করে নীপা।

– আচ্ছা সাদেক ভাই, হাতের রেখা আলপনা এঁকে বদলে ফেলা যায় না?

মনিজা রহমান।  লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম ৯ মার্চ, ঢাকার গেন্ডারিয়ায়; বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাস। অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।  ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। দৈনিক মানবজমিন, দৈনিক জনকণ্ঠ ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভিতে কাজ করেছেন দীর্ঘ প্রায়...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..