প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
আমাকে রুমি বলে দিল, সে আমাকে কোনোদিনই ভালবাসে নি। বলল, ভালবাসা দূরের কথা, কোনোদিন নাকি সেভাবে আমার দিকে তাকিয়েই দেখেনি।
চোখ বুজলেই মনে পড়ে বেলেঘাটার সরকার বাজারের গলিটা। আমি যেন এখনো চোখ বুজেই ওই গলি বেয়ে হেঁটে পৌঁছে যেতে পারি টালির চালের সেই বাড়িটায়। এখন নিশ্চয়ই ওখানে আর কোনো অমন টালির চালের বাড়ি নেই। এখন সমস্ত গলিটার দুপাশে ঘিঞ্জি ফ্ল্যাট। বস্তির মতোই, তবে কমপক্ষে চারতলা বস্তি। কলকাতা কর্পোরেশন এখন এই রকম। আমি বড় পুকুরটার পাশ দিয়ে যাচ্ছি। রুমিদের মামাবাড়ি এসে গেল। আমাকে ওই মামাবাড়িতে কেউ পছন্দ করেন না। আমি এসেছি টের পেলে মামা মামী সামনে থেকে সরে যান। বৃদ্ধা এক দিদিমা আছেন রুমির। ওপার বাংলা থেকে আসা জল ঝড় সয়ে যা হোক করে টিঁকে থাকা বৃদ্ধার চেহারা। চশমার ঘোলা কাচের মধ্য থেকে আমাকে চেয়ে দেখেন। কিছু বলেন না।
রুমি গুরুদাস কলেজে পড়ে। রসায়নের ছাত্রী সে। আমি কমার্স নিয়ে পড়ছিলাম। ভাল নম্বর নিয়ে পাশ করতে পারি নি। যাহোক করে উৎরে গিয়েছি। রুমি সেটা জানে।
আমি কবিতা লিখি। আমার কবিতা লেখার প্রধান উৎসাহদাত্রী এই রুমি। আমার কবিতার প্রথম পাঠক সে। আমার কবিতা নিয়ে সে যা খুশি বকে যায়। আমি শুনি। কিন্তু আমার কবিতার লাইন রুমির কথায় বদলায় না।
কবিরা কেন কবিতা লেখেন, এটা আমার বাড়ির লোকজন ভাল বোঝেন না। বাবা মনে করেন ছন্দ মিলিয়ে, নীতিমালার কথা নিয়ে দু চারটি পদ্য লেখা খারাপ কিছু নয়। কিন্তু দিনরাত্রি উচাটন হয়ে কবিতা লিখে যেতে হবে, তাও আধুনিক কবিতা, মানে যার চরণে চরণে অন্ত্যমিল নেই, তা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। শুধু মাত্র অপ্রয়োজনীয় নয়, ওসব লেখা সময়ের নিতান্তই অপচয়। বাবার সঙ্গে ইদানীং আমার কথাবার্তাই হয় না। আমিই বাবাকে এড়িয়ে চলি। সকালে সন্ধ্যায় টিউশনি করি। টিউশনি করেই নিজের হাতখরচ জোটাই। বাড়িতে দুবেলা ভাত ধরে দেবার সময় মা কান্নাকাটি করেন। বলেন একটা কিছু কাজ খুঁজে নিতে। কাজ যে কি করে খুঁজে পেতে হয়, সে সব আমি জানি না। আমাকে কেউ বলেও না। সবাই বলে আমি বেকার। আমি জানি আমি বেকার নই। আমি টিউশনি করে নিজের হাতখরচ চালাই। আঠারো পার হয়ে যাওয়া ইস্তক এ রকমটাই চলছে। এখন আমার কুড়ি বছর বয়স। মাঝে মধ্যেই কবিতা লিখি। আধুনিক কবিতা লেখার সুবিধা আছে। লোকজন তাই মনে করে। যখন ইচ্ছা কতকগুলো কথা লিখে ফেলা শুরু করুন। সাম্প্রতিক যেসব খবর পড়েছেন, বা শুনেছেন, তার কিছু কিছু বোঝা, কিছু না বোঝা, চটপট লিখে ফেলুন। আপনার কবিতায় দু চারটে শক্ত শক্ত শব্দ থাকবে। লোকে সেগুলোর মানে জানে না বলে আলো অন্ধকারে হাতড়াবে। আর ক্লান্তি বোধ করলেই সেইখানে কবিতার ইতি টেনে দিন।
এসব আমার চারপাশের লোকের ধারণা। আমার কবিতা এ রকম নয়। যতক্ষণ না ভীষণ রকম ইচ্ছে হয়, আমাকে ভিতর থেকে চুলের মুঠি ধরে লিখতে না বসিয়ে দেয়, আমি মোটেও লিখি না। আমি পারতপক্ষে শক্ত শব্দ ব্যবহার করি না। সত্যি কথা বলতে আমার কবিতা ঠিক আমি লিখি না। ভেতরের অন্য একটা মানুষ লেখে। আমি দেখি।
রুমিই একমাত্র মানুষ যে আমার কবিতাকে তার আর আমার দুজনের জিনিস মনে করে। অন্য কেউই আমার সামনে আমার কবিতার প্রশংসা করার দরকার অনুভব করেন নি। যেচে কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করলে বলেছেন, খুব খারাপ হয় নি। ওঁদের কথা শুনলে মনে হয়, আমার কবিতা খুব খারাপ হবারই কথা ছিল। ঘটনাচক্রে অতটা খারাপ হয় নি।
কিন্তু, আমি কোনো কাল্পনিক মহিলার নাম কবি হিসেবে উল্লেখ করে আমার নিজের কবিতা ছাপিয়ে দেখেছি, লোকে উপচে পড়ে সে কবিতার প্রশংসা করেছেন। এতে লাভ হয়েছে একটা, তা হল, আমার লেখা কবিতা জানলে যাদের আমার কবিতা ভাল লাগে না, কোনো মহিলার নামে লেখাটা বেরোলে সে লেখা তাঁদের যথেষ্ট পরিমাণে ভাল লাগে, এটা আমি জেনে ফেলেছিলাম।
রুমি যে আমার কবিতা খুব বুঝতে পারত, তা কিন্তু নয়। আর কবিতা, কবিতার ইতিহাস নিয়েও গভীর পড়াশুনা তার ছিল না। সে ছিল গ্রাম থেকে উঠে আসা এক ছাত্রী। যে খুব মুখস্থ করে ফেলার দৌলতে মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল নম্বর করে ফেলেছিল। আশির দশকের শেষ দিকে স্কুলে স্কুলে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে থাকত, যারা মোটের উপর ভাল নম্বর পেত। তারপরে স্নাতক স্তরে এসে তারা বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে হাবুডুবু খেত।
আমি বড় লেখকদের কবিতা কিছু কিছু পড়তাম। বিদেশের কবিদের কিছু লেখাও অনুবাদে পড়ে ফেলেছিলাম। তবে কবিতা লেখার উপাদান হিসেবে আমি অন্য কবির কবিতা পড়ে ফেলা প্রয়োজন মনে করতাম না। আমি পড়তাম বার্ট্রান্ড রাসেল, বার্নার্ড শ, রম্যাঁ রলাঁ আর আইনস্টাইনের কথা। আর কার্ল মার্কস নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল। এঁদের কয়জনকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার যা লিখতে ইচ্ছে করত, আমি তাই লিখতাম। আমার ভাবনাগুলোও রুমিকে তার বাড়ি গিয়ে বলতাম, আর চিঠিতে লিখতাম।
রুমি, বছর ঊনিশের মেয়েটি যে কুড়ি বছরের একটা যুবকের থেকে এসব শুনে খুব বুঝতে পারত, তা নয়। কিন্তু আমার উপস্থিতি তার মধ্যে একটা অন্য রকম প্রভাব ফেলত।
আমি যতক্ষণ ওর মামাবাড়িতে থাকতাম, ততক্ষণ সেই ঘরে কেউ আসত না। দরজা খোলা থাকত। কোনো কারণেই কোনোদিন দরজা বন্ধ করে গল্প করার তাগিদ অনুভব করি নি। শারীরিক স্পর্শেও আমার আগ্রহ ছিল না। আমার চাহিদা ছিল একটাই, আমার কথাটা কেউ ধৈর্য ধরে শুনুক। রুমি আমার সেই ইচ্ছে পূরণ করত।
রুমি আবার আমাকে চিঠিও লিখত। ইনল্যান্ড লেটারে, অথবা খামে। তার হাতের লেখা মোটেও ভাল ছিল না। কিন্তু, ওই যে চিঠিতে সে আবদার করত, তার জন্য কোনো একটা বিষয়ে আমাকে কবিতা লিখতে হবে, সেটা আমার ভাল লাগত। সেই ভাল লাগা থেকে রুমির চিঠি এসে পৌঁছলে আমি অজস্রবার পড়তাম। আমি অবশ্য কবিতা লিখলে নিজের খেয়াল খুশিতে লিখতাম। যা ইচ্ছে হত, সেটাই লিখতাম, সেই নির্দিষ্ট লেখাটার জন্য আলাদা করে পড়াশুনা করতাম না। আমি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কথাটায় বিশ্বাস করতাম, পোয়েট্রি ইজ় দি স্পনটেনিয়াস ওভারফ্লো অফ পাওয়ার ফুল ফিলিংস: ইট টেকস ইটস অরিজিন ফ্রম ইমোশন রিকালেকটেড ইন ট্রানকুইলিটি।
কবিতা লিখে আমাকে নামী লোক বনতে হবে, খেতাব পেতে হবে, এমন কোনো উচ্চাশা আমার ছিল না। কাজেই তীব্র ইচ্ছে হলে তবেই আমি কবিতার জন্য কলম ধরতাম। কিন্তু রুমির কথায় কবিতা লিখছি ভাবতে আমার ভাল লাগত। সনেটের পেত্রার্ক এর কথা মনে পড়ত।
এক এপ্রিলে পেত্রার্ক পুরোহিতের কাজ ছেড়ে দিলেন। কেননা, তিনি লরাকে মনে মনে ভালবেসে ফেলেছিলেন। আর সেকালের পুরোহিতের পক্ষে প্রেম করাটা বড়ই দৃষ্টিকটু। কিন্তু বিস্তর পুরোহিত গোপনে নারীশরীরের স্বাদ নিতেন। নারীশরীরের স্বাদ নেওয়া এক, আর নারীকে ভালবাসা আরেক রকম ব্যাপার। পেত্রার্ক লরাকে শুধু দেখেছিলেন। কোনো কথাবার্তা বা ব্যক্তিগত যোগাযোগ দুজনের হয় নি। তবু পেত্রার্ক জানতেন লরাকে তিনি ভালবাসেন। আর একতরফা হলেও পেত্রার্ক এর সেই ভালবাসা ইতিহাসের কষ্টিপাথরে অক্ষয় হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটি মেয়ে ভালবেসে ফেলেছিল। সম্পর্কিত দেবরের সঙ্গে দেহস্পর্শের গোপন খেলায় জড়িয়ে পড়ার পর, স্বামীর হাতে ধরা পড়ে তার বিবাহিত জীবন চুরমার হয়ে যায়। অথছ স্বামীবিচ্ছিন্না মেয়েটি যথেষ্ট বিদুষী ছিলেন। একাকিত্বের কষ্ট আর অপরাধবোধের জ্বালা থেকে মুক্তি পেতে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি ফরাসি ভাষার অনুবাদে পড়ে ফেলেন আর কবিকে মনে মনে ভালবেসে ফেলেন। তাঁর আবদারে কবিকে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে যেতে হল। বিশ্ববিখ্যাত কবির আদর যত্নের অভাব যাতে না হয়, তাই নিজের দামি অলঙ্কার বেচে টাকা যোগাড় করেছিলেন মেয়েটি। রাতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতেন কবির রুদ্ধ শয়নকক্ষের বাইরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
শয়ন ছেড়ে উঠে তখন
খুলে দিলেম দ্বার —
হায় রে, ধূলায় বিছিয়ে গেছে
যূথীর মালা কার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্ধেক বয়সী মেয়েটি। তিনি নোবেলজয়ী। তবু বিবাহ বিচ্ছিন্না মেয়ের হালচাল সম্ভ্রান্ত ঘরের পিতামাতার পছন্দসই না হবার কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেয়েটিকে নিয়ে কবিতা লিখতে লিখতে বাড়ি ফেরার জাহাজে চড়লেন। যে চেয়ারে বসে হেসে হেসে গল্প করতেন কবি, ভালবেসে সেই চেয়ারটিই জাহাজে করে পাঠিয়ে দিলেন মেয়েটি। অনেক কাল আগে কবির নতুন বউঠান এক কবিকে আপন ভেবে সাধের আসন বুনে তাতে কবিতার পংক্তি লিখে দিয়েছিলেন। “হে যোগেন্দ্র যোগাসনে ঢুলুঢুলু দুনয়নে…”
আর সাগরপারের এই মেয়ে পাঠালো চেয়ার। কবি তার নতুন নাম দিলেন বিজয়া। “পূরবী” নামে কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করলেন তাঁকে। সে মেয়ে যোগাড়যন্ত্র করে কবির আঁকা ছবি নিয়ে প্রদর্শনী করলেন ফ্রান্সের রাজধানী শহর পারীতে। কবির আঁকা ছবির সেই প্রথম প্রদর্শনী।
দান্তের ছিলেন বিয়াত্রিচে। এক উজ্জ্বল সোনালি রোদমাখা দিনে নয় বৎসরের বালিকা বিয়াত্রিচেকে প্রথম দেখেছিলেন বারো বছরের দান্তে, আর প্রথমবারের দেখাতেই গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন। তার পর আবার দুজনে দেখা হল বছর ছয়েক পরে। পনেরো বছর বয়সেই বিয়াত্রিচে অসামান্য রূপবতী। কবি দান্তে ততদিনে বিবাহিত। এই মেয়েটিকে নিয়ে স্বপ্নের ঘোর লাগল দান্তের চোখে। একটির পর একটি উৎকৃষ্ট সনেট লিখে চললেন বিয়াত্রিচেকে নিয়ে। কিন্তু বিয়ে করা বউকে নিয়ে কবিতা কেন, তেমন কোনো কিছুই লেখেননি দান্তে। তাঁর গর্ভে শুধু কয়েকটি সন্তান উৎপাদন করেছিলেন। আঠাশ বৎসর বয়সে বিয়াত্রিচের জীবনদীপ নিভে গেল। তাঁকে নিয়ে লিখতে লিখতে কবি বাঁচবেন ছাপ্পান্ন বছর বয়স অবধি। দান্তে বিয়াত্রিচের ভালবাসা কবিতার জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে রইল।
এইসব কথা বলতে বলতে রুমির সঙ্গে পথ হাঁটতাম। আমার যে তাকে কফি হাউসে নিয়ে যাবার সামর্থ্য ছিল না। খুব গরিবানার মধ্যে দিন কাটাতাম। কয়েকটি স্টপেজ হাঁটলে বাসভাড়া সামান্য কম পড়ে বলে হাঁটতাম। কবিতার কাগজ ছেপে দিয়েছে প্রেস থেকে। সে কাগজ বাড়িতে স্টেপল করে নেব। ছাপানো কাগজের রিম কাঁখে নিয়ে হাঁটছি। আমার সঙ্গে হাঁটছে রুমি। শাড়ি পরেছে। আমার পায়ের হাওয়াই চপ্পলের স্ট্র্যাপ হঠাৎ করেই ছিঁড়ে গেল। আমি আকাশ চোখো ছেলেটা আগে তো খেয়াল করে বদলে নিইনি। পকেটে যেটুকু রেস্ত ছিল, সবটুকু উজাড় করে দিয়ে এসেছি প্রেসে। পকেটে কেবল বাসভাড়াটুকুই পড়ে আছে। করুণাময়ী বুকের ব্লাউজ থেকে একটা সেফটিপিন খুলে দিল। তাই দিয়ে স্ট্র্যাপ জুড়ে পথ চলতে লাগলাম। আমার পায়ের আঙুলের ফাঁকে সেফটিপিন, না কারো লাল টুকটুকে হৃদয়!
রুমি আমার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে এল। ওকে আমাদের বাড়িতে ঘুরতে ফিরতে দেখে আমার খুব ভাল লাগছিল। ও নিজের খুশিতে আমাদের জামা কাপড়ের আলনা গোছাচ্ছিল। বিছানার চাদর টানটান করে গুছিয়ে দিতে আনন্দ পাচ্ছিল।
কিছু দিন আগে ও একটা কবিতার মতো কিছু লেখার চেষ্টা করেছিল। ও মাত্রাবৃত্ত স্বরবৃত্ত কিছুই জানত না, মনে হয় মাত্রা ও দল সম্পর্কে ওর কোনো ধারণা পর্যন্ত ছিল না। কেবল কোনো মতে একটা অন্ত্যমিল দিলেই কবিতা খাড়া হয়, ওর ধারণা ছিল এই গোছের। ও আমাদের সদ্যোতারুণ্যের সময়কার এক বিপথগামীকে নিয়ে লিখে পাঠাল “হে চার্লস গুরমুখ শোভরাজ,
শৈশবে পিতামাতার আদর না পাইয়া হইয়াছ তুমি ডাকাত দলের মহারাজ।”
ওই প্রথম দুই পংক্তি আমি ভুলতে পারি নি। ওইটুকু মনে রয়ে গিয়েছে। এরপর ওকে আর কবিতার ভিতরকথা কিছু বোঝানোর চেষ্টা করি নি। আমার মন বলত, সে সব অপাত্রে দান হবে।
কিন্তু সে যখন ইনল্যাণ্ড লেটার কার্ডে লিখে পাঠাত অমুক দিন স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ির পাশের গলিতে অমুক সময় তোমাকে দর্শন দিতে হবে, তখন আমি পুলকিত না হয়ে পারতাম না। তার অনালঙ্কৃত হস্তলিপির ওই দর্শন কথাটা আমাকে ভাবুক করে দিত। যত অসুবিধাই থাক না কেন, তা অতিক্রম করে যেতে আমার বাধত না। কলেজে পড়ার সূত্রে পাশ আমি না করলেও রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে আমার আগ্রহ গজিয়েছিল, এবং আমার মনে হত, দেশ ও দশের প্রতি তরুণ সমাজের দায় ও দায়িত্ব, দুটোই আছে।
আমি রুমিকে বলতাম ফরাসি বিপ্লবের কথা, আমেরিকার স্বাধীনতা প্রচেষ্টার কথা আর সোভিয়েত বিপ্লবের কথা। ওই সঙ্গেই আমার মনে পড়ত, ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সে ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ অবধি মোটে কয়েকটি বৎসর স্থায়ী হয়েছিল। তারপর ফ্রান্স চলে গেল এক সম্রাটের হাতে। তিনি নেপোলিয়ন বোনাপার্টি। আর ফরাসি বিপ্লবের তথাকথিত সাফল্যের পর সন্ত্রাসের রাজত্ব আর গিলোটিনে মুণ্ডচ্ছেদ। ষোড়শ লুই আর তার নারী মারি আঁতোয়ানেৎ এর যেমন গিলোটিনে মুণ্ডচ্ছেদ হয়েছিল, তেমনই বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা জর্জ জ্যাকস দাঁতো আর ম্যাকসিমিলিয়েন রোবসপীয়ের এর মুণ্ডচ্ছেদও হয়েছিল গিলোটিনে।
সম্রাট নেপোলিয়নের শেষ অবধি মৃত্যু হয় নির্বাসনে, সেন্ট হেলেনা দ্বীপে, বেশি মাত্রার আর্সেনিক দূষণে।
রাশিয়ার সম্রাট জার নিকোলাস টু কে সপরিবারে খুন করে সফল হওয়া সোভিয়েত বিপ্লবের পরে পরেই ফ্যানি কাপলান নামে এক মেয়ে লেনিনকে গুলি করে। সেই গুলির আঘাতে লেনিন তখনই মারা যান নি। কিন্তু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি আত্মহত্যা করার কথা ভাবতেন তিনি। লেনিনের অসুস্থতার সুযোগে সহকর্মী বিপ্লবী নেতাদের খুন করিয়ে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ফেললেন স্ট্যালিন।
চীনের মাও সে তুং এর কৃতিত্ব কিছু কম ছিল না। বিরাশি বছরের জীবনের শেষ দশটা বছর তিনি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে অন্তত দশ লক্ষ মানুষকে খুন করিয়েছিলেন।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা মনে পড়ত আমার:
“সূর্য যদি কেবলি দিনের জন্ম দিয়ে যায়, রাত্রি যদি শুধু নক্ষত্রের, মানুষ কেবলি যদি সমাজের জন্ম দেয়, সমাজ অস্পষ্ট বিপ্লবের, বিপ্লব নির্মম আবেশের, তাহলে শ্রীজ্ঞান কিছু চেয়েছিলো?”
আমি হতাশার কথাগুলো রুমিকে বলতাম না। কিন্তু সে খুব ভাল করে জানত যে, আমি প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ভাষাশিক্ষার সমর্থক আর বাসভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছাত্রীদের উপর শারীরিক নির্যাতনের বিপক্ষে।
একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের লোকজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। তারা জানত আমি রুমির সঙ্গে মিশি। তাতেই তারা ধরে নিল যে রুমিকে রাজনৈতিক দলের মধ্যে এনে ফেলার পূর্ণ অধিকার তাদের আছে। এই রাজনৈতিক দলের নতুন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করার একটা অসাধারণ আর্ট ছিল। আর এই সময়টিতেই আমি দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যে ভোটের হিসেবের ছক দেখতে পেয়ে নিজের চারদিকে একটা বর্ম গড়ে তুলছি।
এই রাজনৈতিক দলের লোকজন বলত যে গণ আন্দোলন চলতে চলতে ভোট এসে পড়লে, যেহেতু মানুষ ভোটের সময় রাজনীতির কথা শুনতে ইচ্ছুক হয়, তাই ভোটে অংশগ্রহণ করতে হবে। অথচ আসলে তারা গোটা বছর ধরে ভোটের অঙ্ক কষেই রাজনীতিটা করত। ভোটের স্বার্থে নানা ধরনের সম্ভাবনার অঙ্ক কষে চিত্রবিচিত্র জোট বানাতে তারা সমস্ত শক্তি নিয়োগ করত।
এই দলের লোকজন কারখানার রাষ্ট্রীয়করণকে সমর্থন করতেন, আবার দেয়ালে লিখতেন, রাষ্ট্রীয় পুঁজি ফ্যাসিবাদ গড়ে তোলে। দুটো জিনিসের মধ্যে বড় রকম অসঙ্গতি লক্ষ্য করে প্রশ্ন তুললে আমি তাঁদের বিরাগভাজন হলাম। বিরাগভাজন হতে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু তাঁরা আমাকে লুকিয়ে রুমির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, এটা আমি বেশ টের পেয়ে গেলাম।
এই সময়েই একদিন রুমি গল্পে গল্পে আমাকে বলল যে সে তার বোনের সঙ্গে তর্ক করেছে যে, একটি বেকার ছেলেকে ভালবাসা উচিত কি না। তর্কের বিষয় শুনে আমি খুব মর্মাহত হলাম। আমার মনে হল যেন আমারই বেকারত্ব নিয়ে সকলে কুমন্তব্য করছে। একজনকে ভালবাসতে হলে, তার চরিত্র ও মনুষ্যত্ব দেখেই ভালবাসা উচিত। সে রোজগেরে না বেকার, তা নিয়ে আলোচনার কোনো মানেই নেই।
রুমির আলোচনার সূত্রে আমি গুম হয়ে রইলাম। তারপর আমার মনে হল, আমাকে নিয়ে লোকেরা আলোচনা করলে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কেননা, লোকজন কিছু না কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করবেই। তাতে বাধা দেবার চেষ্টার কোনো মানে নেই। এমন সময় একদিন রুমিদের বাড়ি যেতে তার মা আমাদের বাড়ি আসতে চাইলেন। আমি সানন্দে মা মেয়েকে নিয়ে এলাম। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, যে তার মা আমাদের বাড়িতে অন্নগ্রহণ করলেন না। ওঁর এই আচরণটা আমার কাছে কুসংস্কার বলেই মনে হল। কিন্তু, সে নিয়ে আমি কিছু বলা সঙ্গত বলে মনে করলাম না। তিনি নিজের ইচ্ছায় আমাদের বাড়ি এলেন, এবং এসে যদি অন্নগ্রহণ করতে তাঁর অরুচি হয়, সেখানে জোর করার মতো জোর আমার ভেতরে আমি খুঁজে পাই নি। এরপর একদিন রুমির বাড়িতে গেলে তার বাবার সঙ্গে আমার দেখা হল। তার বাবা হিন্দুস্তান কেবলস কারখানায় কাজ করতেন। ভারতে সরকারি মালিকানার কারখানায় দক্ষ কারিগরের বেতন খুব একটা কম হত না। তার উপর ছিল ওভারটাইম। ভদ্রলোক কি জানি কেন আমাকে নিজের কর্মস্থলে আর্থিক প্রাপ্তিযোগের গল্প বলতে শুরু করলে আমি খুব অস্বস্তিতে পড়লাম। যে ব্যক্তির সঙ্গে আমার আগে কোনোদিনই সরাসরি আলাপ হয়নি, শুধুমাত্র জানি তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পিতা, তিনি বেমক্কা নিজের টাকা পয়সা ও মাইনে কড়ির গল্প শুরু করলে আশ্চর্য লাগে বইকি। এখন আমার মনে হয়, ভদ্রলোকের অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা করার দক্ষতাটাই ছিল না। অথবা তিনি আমাকে বোঝাতে চাইছিলেন, আমার মেয়ের দায়িত্ব নিতে গেলে তোমার পক্ষে আমার আর্থিক স্ট্যাটাসটা জেনে রাখা ভাল।
আমি নীরবে ওঁর কথাবার্তা সহ্য করতে লাগলাম। খানিকটা সময় পরে আমি বিদায় নিলাম। রুমির সঙ্গে কথা বলা হল না। আমার জন্য চা বিস্কুটের বেশি কোনোদিন কিছু তার মামাবাড়িতে এসেছে বলে মনে পড়ে না। এদিন সে সবের কথাও কেউ তুলল না।
আমার এখন মনে হয়, নিম্নবিত্ত স্বল্পশিক্ষিত পরিবারে, যেখানে রুচি সংস্কৃতির উচ্চমান প্রতিষ্ঠিত নয়, সেখানে মেয়ে মানে একটা দায়। এইসব পরিবারের লোকজন ভাবতেই পারেন না যে একটি নিঃসম্পর্কিত ছেলে মেয়ের মধ্যে যৌনতা ছাড়া আর কোনো কিছু আলোচনা হতে পারে। এবং ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্বটা আসলে একটা ছল। অভিভাবকেরা মনে করতেন, ও আসলে যৌনসম্পর্কে পৌঁছনোর একটা প্রেল্যুড মাত্র।
আমি বেশ বুঝতে পারলাম, সেদিন রুমির মা আমাদের বাড়ি গিয়ে আমাদের ঘরদোর আসবাবপত্র দেখে এসেছেন। আজ ওর বাবা ওদের আর্থিক অবস্থাটা আমাকে জানিয়ে দিলেন। আমি নেহাত ভদ্রলোকের ছেলে বলে আমাকে আসতে বারণ করতে পারছেন না। একটা সমবয়সী ছেলে ও মেয়ের সম্পর্ক শুধুমাত্র একটা যৌনসম্পর্কে গিয়ে ঠেকে যাবে কেন, এটা আমি কিছুতেই ভেবে পেতাম না। আর বিয়ে, এই প্রতিষ্ঠানটাকেও আমি আদৌ শ্রদ্ধা করতাম না। আমি আবছা আবছা ভাবে জাঁ পল সার্ত্র ও সিমোন দ্য বুভুয়ার কথা জানতাম। আমার জন্মের কয়েকটি বছর আগে ১৯৬৪ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু সেই প্রথম একজন নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন। সার্ত্র বলেছিলেন, যে আমি সর্বদাই প্রতিষ্ঠানকে এত অপছন্দ করি, নোবেল সম্মান নিয়ে সেই রকম প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাতে আমার লেখার ধার ও ভার, দুইই কমে যেতে পারে। এই সার্ত্র বুভুয়াকে প্রথাসিদ্ধ মতে বিয়ে না করেও জীবনসঙ্গিনী হিসেবেই মর্যাদা দিতেন। পরে আরো জেনেছি যে বুভুয়ার সঙ্গে আরো দু একজন ইন্টেলেকচুয়ালের শারীরিক মানসিক নৈকট্য ছিল। আমার মনে হত, বন্ধুত্ব এতটাই বড় একটা জিনিস, তা থাকলে আর সম্পর্কটাকে দাম্পত্যের খোঁটায় বাঁধতে হয় না। আমি লেনিন আর স্ক্রুপস্কায়ার কথা জানতাম। দুই নির্বাসিত বস্তুবাদী রাজনৈতিক কর্মী একই এলাকায় বন্দিত্বসূত্রে পরস্পরের কাছে আসেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহের কোনো প্রয়োজন ওঁরা উপলব্ধি করেন নি। ওঁদের কোনো সন্তানাদিও ছিল না। তবে তা স্ক্রুপস্কায়ার অসুস্থতার কারণেও ঘটে থাকতে পারে। তবে শুনেছিলাম, পরবর্তীতে লেনিন আরো একটি মেয়েকে ভালবেসেছিলেন। নাম তাঁর ইনেসা আরমান্দ। তিনি গান বাজনায় খুব পারদর্শী ছিলেন, এবং তাতে লেনিনের মন কেড়েছিলেন।
আমি ভাবতে পারতাম না, দাম্পত্যের মধ্যেই সব রকম সুখ। জানতাম যে অসাধারণ জ্ঞানী সক্রেটিসের বিবাহিত জীবন সুখের ছিল না বলেই মনে হয়। তাঁর নামে একটা মজার কথা জানতাম, সক্রেটিস নাকি বলেছিলেন, যে করে হোক বিয়ে করো। যদি তোমার বৌ ভাল হয়, তাহলে তোমার জীবন সুখে কাটবে। আর যদি বৌ পাজি হয়, তাহলে তুমি দার্শনিক হয়ে যাবে।
আমি শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত তন্নতন্ন করে পড়ে নরনারীর সম্পর্ক ও দাম্পত্য জীবন নিয়ে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছিলাম। টগর বোষ্টমী আর নন্দ মিস্ত্রির দাম্পত্য নিয়ে কৌতুকের ছলে লিখলেও শরৎচন্দ্র নরনারীর ভিতরের সম্পর্ক নিয়ে আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন।
আমি ভেবে উঠতে পারছিলাম না, আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কারণে রুমি তার বাবা মায়ের কাছে বকুনি খায় কি না। আর সেই কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হচ্ছিলাম।
আমি জীবনানন্দ দাশের কবিতা খুব পছন্দ করতাম আর আমার মুখে জীবনানন্দ শুনতে রুমি বেশ পছন্দ করত। তার সঙ্গে পথ হাঁটতে হাঁটতে আমি স্মৃতি থেকে দুটি তিনটি কবিতা বলতাম। বনলতা সেন আর সুচেতনা বলা আমার পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকত। আর রূপসী বাংলা থেকে গোটা দুয়েক। বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, আর আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে।
এর মধ্যে সে আমাকে ওই বনলতা সেন কবিতার বইটির একটি কপি উপহার দিল। তার প্রথমের পাতায় হালকা পেনসিলে লিখল ‘ক্ষুদ্র তবু ক্ষুদ্র নয়’। বইটির মুদ্রিত মূল্য ছিল ছয় টাকা। কলেজ স্ট্রিটে আমাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল বলে ধরে নিচ্ছি, সে কমিশন পেয়ে সাড়ে চার টাকাতেই বইটি যোগাড় করতে পেরেছিল। তবুও একজন ছাত্রী তার হাতখরচ থেকে বাঁচিয়ে বইটি সংগ্রহ করেছে এবং আমাকে উপহার দিয়েছে, এটা ভেবেই আমার খুব ভাল লাগল। হালকা পেনসিলে ‘ক্ষুদ্র তবু ক্ষুদ্র নয়’ লেখাটার নিচে সে নাম স্বাক্ষর করে নি, তারিখটা পর্যন্ত লেখেনি, তবুও আমার কাছে ওই উপহার কোনোমতেই নগণ্য ছিল না।
রাজনৈতিক দলের লোকজন লক্ষ্য রাখত আমার ভাবনা কোন্ পথে চলেছে। আমার অ্যাকাউন্টেনসি ভাল লাগত না। অডিট আর ইনকাম ট্যাকসও ভাল লাগত না। আর সত্যি বলতে কি, কমার্স বিষয়টায় আমি কিছুমাত্র আগ্রহ অনুভব করি নি। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক গোষ্ঠী থেকে আমার কাছে প্রস্তাব এল যে দলের একটি কোচিং সেন্টারে পড়াতে হবে। এই দলটি শিক্ষা সংস্কৃতি নিয়ে নিয়মিত আন্দোলন করত। কিন্তু কোচিং সেন্টারে দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করাতে আমার উৎসাহ জাগল। শিয়ালদহের কাছে জগৎ সিনেমা। অদূরে একটি জীর্ণ সরকার পোষিত বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে সন্ধ্যাবেলায় কোচিং সেন্টার খোলা হত। এই দলের এক পলিটব্যুরো নেতার কন্যা কোচিং সেন্টারের দায়ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি আমার চাইতে বয়সে খানিকটা বড় হলেও তাঁর সাথে আমার চমৎকার একটা সম্পর্ক ছিল। আমাদের মধ্যে কোনো রকম ব্যক্তিগত আলাপ হত না। ব্যক্তিগত কোনো আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়েও আলোচনা হত না। নিজের অ্যাকাডেমিক পড়াশুনায় দুর্বল ছাত্র হলেও আসলে তো আমি ততটা খারাপ ছাত্র ছিলাম না। আমাকে দেওয়া হল পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ানোর দায়িত্ব। আমার কাছে শুনে রুমিও কোচিংএ পড়াতে উৎসাহী হল। তবে সে বিজ্ঞান বিভাগে গ্রাজুয়েশন পড়ছিল বলে নবম দশম শ্রেণিতে তার বিজ্ঞান পড়ানোর সুযোগ মিলল। আমাকে নিচের ক্লাসের বাচ্চাদের পড়ানো নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল।
আমি তখন বুঝতে পারি নি যে, নিচুক্লাসেই বাচ্চাদের পড়াশুনায় আগ্রহী করে গড়ে তোলাটা শক্ত। ওটাই যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। উঁচু ক্লাসে উঠে গেলে তার বাড়ির লোকের কিছুটা সহযোগিতা কাজ করতে থাকে। ছাত্র ছাত্রীদের নিজেদের সচেতনতাও সক্রিয় হয়ে ওঠে।
এই দলের লোকজন কারখানার রাষ্ট্রীয়করণকে সমর্থন করতেন, আবার দেয়ালে লিখতেন রাষ্ট্রীয় পুঁজি ফ্যাসিবাদ গড়ে তোলে। দুটো জিনিসের মধ্যে বড় রকম অসঙ্গতি লক্ষ্য করে আমি প্রশ্ন তুললে আমি তাঁদের বিরাগভাজন হলাম। বিরাগভাজন হতে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু তাঁরা আমাকে লুকিয়ে রুমির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, এটা আমি বেশ টের পেয়ে গেলাম।
কোচিং সেন্টারে পড়ানোর পর আমরা একসাথে ফিরতে ভালবাসতাম। কারো ক্লাস আগে শেষ হলে আমরা একে অপরটির জন্য অপেক্ষা করতাম। দৈবাৎ কোনোদিন রুমির তাড়া থাকলে সে আগে বেরিয়ে পড়লে, আমার মুখ দেখে সবাই অনেক কিছু বুঝতে পারত।
এর মধ্যে একবার রুমি কোচিং এ পড়াতে আসা বন্ধ করে দিল। তার কয়েকটি দিন পরে আমাকে ইনল্যাণ্ড লেটারে চিঠি লিখে সে জানাল, আমি যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করার আর কোনো চেষ্টা না করি।
আমি জানতাম, আমি চাকরি করি না বলে আমার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব তার বাবা মায়ের পছন্দসই নয়। কিন্তু আমিও তো রুমিকে বিয়ের জন্য কোনো প্রস্তাব দিই নি। এমনকি আমি এই বাইশ বছর বয়সে নিজের বিয়ে নিয়ে কোনো কথাই ভাবি নি। এমনও নয় যে তার সঙ্গে আমার ন্যূনতম কোনো শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যার প্রেক্ষিতে বিয়ে না করলে মেয়ে হিসেবে রুমি শারীরিক ভাবে বিপদে পড়বে। আমি তো ওর হাতটা ধরেও কোনোদিন হাঁটি নি। আর বাইশ বছর বয়সেই কাউকে বেকার বলে দাগিয়ে দেবার কোনো মানে নেই। চাকরি পাবার জন্য যথেষ্ট সময় আমার আছে।
আমি ধরেই নিলাম বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে রুমি দারুণ চাপে পড়েছে। তার পর মুহূর্তে আমার মনে হল, বাবা মা চাপ দিলে সেটা দুজনে মিলে মোকাবিলা করা যায়। আর যেখানে কেউ কাউকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় নি, সেখানে একজন বেকার বলে বন্ধুত্ব না রাখতে চাওয়ার কারণ কী? বন্ধুত্বের প্রথম শর্ত কি আর্থিক নিরাপত্তা যোগাতে পারা?
অবশ্য, এমনও হতে পারে যে আমার একটি রাজনৈতিক দলের পরিমণ্ডলে যাতায়াতের কথা রুমির বাবা মায়ের কানে উঠেছে, এবং সেটা তাঁদের ভাল লাগে নি।
আমার মনে হল, নিতান্তই মেরুদণ্ডহীন লোক না হলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা থাকবে না, এটা হতেই পারে না। আর রুমি একজন অ্যাডাল্ট মেয়ে হয়ে বাবা মাকে বোঝাতে পারত, যে রাজনৈতিক বোধ বুদ্ধি মানুষের থাকাটাই স্বাভাবিক।
যাই হোক, বাবা মায়ের চাপের প্রতিক্রিয়ায় রুমি আমাকে চিঠি লিখে কোনো রকম যোগাযোগ রাখতে বারণ করে দিল বলে, আমার ভীষণ অভিমান হল। একে তো পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে বসে আছি বলে বাড়িতে কেউ ভালবাসে না। আবার যে রাজনৈতিক দলের লোকেরা একটু ভালবাসতেন, আমার নানারকম উল্টাপাল্টা প্রশ্ন শুনে তাঁরা ভাবছেন আমি বিগড়ে গিয়েছি। এমন সময়ে রুমিই ছিল আমার মন খুলে কথা বলার মানুষ। সে কোনো রকম আলাপ আলোচনার সুযোগ না দিয়েই একেবারে একতরফাভাবে যোগাযোগ বন্ধ করার ফরমান দিতে আমার বেশ কষ্ট হল।
আমি সেই কষ্ট বুকে চেপে সকালে উঠে টিউশনি পড়াতে যেতাম আর সন্ধ্যায় যেতাম ফ্রি কোচিং সেন্টারে পড়াতে। সুজাতা দির সাথে দৈবাৎ দেখা হত। কেননা তিনি দলের নির্দেশে অন্য কোনো জায়গায় সংগঠন গড়ছিলেন। কোচিং দেখাশুনার দায়িত্ব নিয়েছিল অন্যেরা, যাদের সঙ্গে আমার তত হৃদ্যতা ছিল না। এমনটি কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে চলতে হঠাৎ করে পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে চিঠি পাঠিয়ে জানানো হল, তাঁদের কাছে গিয়ে আমি যে পরীক্ষা দিয়ে এসেছিলাম, তাতে আমি বাছাই হয়ে চাকরি পেতে চলেছি।
এই চিঠিটি পড়ে আমি রেখে দিলাম। বাণিজ্য নিয়ে পড়তে যাওয়া আমার মোটেও সুবিবেচনার কাজ হয় নি। আমার ভাল লাগে ইতিহাস, ভাল লাগে রাষ্ট্রবিজ্ঞান। এসব নিয়ে পড়লেই ভাল করতাম।
চাকরি পেলে লোকে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয়, আমি নাস্তিক মানুষটি তা দিলাম না। ঈশ্বরের সঙ্গে কোনো প্রকার সম্বন্ধ আমার নেই। চাকরি পেয়ে লোকে বন্ধু বান্ধব আত্মীয় পরিজনকে খাওয়ায়। আমি তা করলাম না। ওভাবে পয়সা নষ্ট করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাইনি।
আমার চাকরি পাবার খবর পেয়ে সাংঘাতিক রাগ করলেন রাজনৈতিক দলটির গুরুঠাকুররা। তাঁরা কৈফিয়ত চাইলেন, কেন আমি চাকরির পরীক্ষা দেবার আগে তাঁদের কাছে অনুমতি নিই নি। আমি ছিলাম প্রচণ্ড তার্কিক। আমার কোনো ভয়ডরও ছিল না। আমি দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাকে বললাম, তিনটি কারণে অনুমতি নিইনি। এক দলের সংবিধানে এহেন ব্যবস্থা ছাপার অক্ষরে নেই। দুই, আমি দলের মেম্বারশিপ পাইনি। আর তিন, পরীক্ষা যখন দিয়েছিলাম, তখন এই দলের সঙ্গে আমার ন্যূনতম যোগাযোগ টুকুও তৈরি হয় নি। নেতাটি আমার কথার ভঙ্গিতে অবাক হয়ে গেলেন। ওঁর ধারণা ছিল দলের কর্মীরা ওঁকে ভীষণ ভক্তি করে, ভয় মেশানো ভক্তি। উনি নিজের কানে শুনলেন, আমি ওঁকে ভয়ও করি না, ভক্তিও না। আমিও বুঝলাম, এরপরে আমার সামনে দলের দরজা সংকীর্ণ হতে হতে বন্ধ হয়ে যাবে। তবু নিভে যাবার আগে কেন যেন জ্বলে উঠতে চায় দীপ। অফিসে জয়েন করার অল্পদিনের মধ্যেই দলটির একটি প্রোগ্রাম ছিল কলকাতার রাস্তায়। মহামিছিল। আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে সেই মিছিলে থাকতে চেয়ে হঠাৎ করেই দেখতে পেয়ে গেলাম রুমিকে। মিছিলে সেও হাঁটছিল। আর সে যে আমাকে ভালভাবেই খেয়াল করেছে, সেটা বুঝলাম ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকায়। আমি কষ্ট পেলাম। কি দোষ করেছি আমি?
মহামিছিল থেকে ফিরে ওই সন্ধ্যাতেই দলের প্রতিষ্ঠাতা নেতার বাণীর প্রদর্শনী। কলেজ স্কোয়ারের একটি সভাকক্ষে। প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলাম। সমবয়সী পুরোনো পরিচিতরা কেউ কেউ হাসিমুখ করছেন। একটি ছাত্র সংগঠক, ওর নাম আমার আজও মনে আছে, তাপস, এগিয়ে এসে বলল, কি চাকুরিজীবী, চাকরি কেমন লাগছে? খাওয়াতে হবে কিন্তু। হাসলাম। খুব অল্পদিন হল চাকরি পেয়েছি। বেতন পাবার সময় হয়নি। তবুও বললাম, খাওয়াব। রুমি ধারে পাশেই ছিল। কান খাড়া ছিল আমার দিকে। তাপস আমাকে চাকুরিজীবী বলে সম্ভাষণ করতেই সে চলে এল আমার সামনে। চোখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, চাকরি পেয়ে গেছ না কি? স্বীকার করতে হল, বলতে হল, হ্যাঁ। দেখলাম, ক মাস আগেই যে লিখিত ভাবে বলেছে, তুমি আমার সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ রাখবে না; আজও কয়েক ঘণ্টা আগে যে আমাকে চিনতে চায় নি, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে থেকেছে, চাকরি পেয়ে গিয়েছি শুনে কি সহজভাবে গল্প করতে চাইল সে মেয়ে। কে বলবে, আজ কয়েকটি ঘণ্টা আগেও সে আমাকে দেখে অচেনার ভঙ্গি করে অন্য দিকে তাকিয়েছিল! একটা সামান্য শব্দ ‘চাকরি’ এ মেয়ের ভাবসাব বদলে দিয়েছে। খুব অসম্মানিত বোধ করলাম। রুমি, তুমি কি আমার বন্ধু ছিলে? আমি চাকরি যতদিন পাইনি, ততদিন আমাকে চিনেছ বেকার বলে। সম্পর্ক ছিঁড়তে চাইলে একতরফাভাবে। আর যেই চাকরি পেয়েছি শুনলে, সেই সম্পর্ক আবার তড়িঘড়ি জুড়তে চাইলে। আমাকে নয়, তুমি আসলে আমার সদ্য পাওয়া চাকরির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইছ রুমি। ভদ্রতা করে কিছু বলতে পারলাম না। বাড়ি ফিরলাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কিজানি কেন পায়ের গোড়ালিতে ভীষণরকম ব্যথা করছে। পরদিনই দুপুরে আমাকে অবাক করে আমার অফিসে এসে হাজির রুমি। ঝাঁ চকচকে অফিস, তিন তিনটি লিফট আর আলো হাওয়ায় চমৎকার বসার ব্যবস্থা দেখে রুমি খুব খুশি। কিন্তু আমি খুশি হতে পারছি না। আমারে নহে গো, ভালবাসো মোর চাকরি। অথচ আমি ভদ্রতা করে তার কথার উত্তর দিই। কিন্তু আমার নিজের সেই সব কথা রোজা লুকসেমবার্গ, ক্লারা জেটকিন, স্ক্রুপস্কায়া, সিমোন দ্য বুভুয়া সব থমকে গেছে। এখন রুমি কথা বলে। আমি শোনার অভিনয় করি। লেনিন সরণিতে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা বাস মিস করে রুমি ইচ্ছা করে। কেন রুমি, কেন আমার এত দেরি করিয়ে দাও! রুমি মাঝে মাঝেই এসে দেখা করে যেতে লাগল। আমার ঠোঁটে শক্ত কথাটা যোগাত না।
এদিকে আমার অফিসে সবাই আমাকে বললেন, তুমি ডবল্যু বিসিএস দাও। দিলেই তুমি অফিসারের চাকরি পাবে। কথাটা আমার মনে ধরল। আমি পরীক্ষার ফরম ভরলাম। আর সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে ফ্রি কোচিং এ পড়ানো বন্ধ করব স্থির করলাম। এখন আমার নিজের জন্য পড়াশুনা দরকার। কোচিং এ গিয়ে বাচ্চাদের সেকথা বলতে তারা কান্নাকাটি শুরু করল। আমি বুঝলাম, নিচু ক্লাসে পড়ালেও আমি কোনোভাবে তাদের মনের তারে ঘা দিতে পেরেছিলাম। এরমধ্যে রুমি একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে হুমকির সুরে বলল, আমাদের বিয়েটা কবে হবে?
আমি ভেতরে ভেতরে শক্ত করেছি নিজেকে। বললাম, আমার এখন মোটে সাড়ে বাইশ বছর বয়স। আমি এখন আরো ভালো একটা চাকরির কথা ভাবছি। বিয়ের জন্য আমার কোনো চিন্তা এখন নেই। তারপর রেজাল্ট বেরিয়েছে শুনে কলেজে গেলাম ফেল করার মার্কশীট আনতে। অনার্স কেটে গিয়েছে। শুধুমাত্র পাশ গ্র্যাজুয়েট হয়ে রইলাম। উচ্চশিক্ষার দুয়ার বন্ধ। তার পরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। আমি ফেল করার মার্কশীট আনার পর একটার পর একটা পরীক্ষায় ভালো ভাবে পাশ করতে লাগলাম। কিন্তু এমন একটাও দিন গেল না যে গোটা দিনে একবারও তাকে মনে করি নি। অথচ তার সেই চিঠির লেখাটা আমার আর তার মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা তৈরি করে দিয়েছিল। অবশেষে বছর দুয়েক পরে সে নিজের পছন্দসই মানুষকে বিয়ে করেছে জেনে ভারি স্বস্তি পেয়েছিলাম।
নিরঞ্জন লোকটা কেমন ছিল, রুমির সঙ্গে কিভাবে তার যোগাযোগ, আর কতদিনের সম্পর্ক, তার কোনোকিছুই আমি জানতাম না। শুধুমাত্র এটুকুই শুনেছিলাম, সে রুমিদের এলাকার মানুষ। পরে জেনেছিলাম, পৈতৃক পরিবারকে অন্ধকারে রেখেই রুমি তাকে বিয়ে করেছিল। বিয়ের পর রুমি টের পেল যে নিরঞ্জনের আর্থিক অবস্থা বেশ নড়বড়ে। তখন সে নার্সিং পড়ার চেষ্টা করেছিল। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বেশ ভাল নম্বর ছিল বলেই রুমির সেখানে পড়ার সুযোগ পেতে অসুবিধা হয় নি। সে সময় নার্সিং পড়তে মেয়েদের মুচলেকা দিতে হত যে সে সিঙ্গল। এমন নিয়ম অযৌক্তিক আর হাস্যকর, তবুও এমন উদ্ভট নিয়ম আমাদের দেশে ছিল। আর্থিক নিরাপত্তাহীন নিরঞ্জনের খপ্পর থেকে রুমি সরে পড়তে চেয়ে, নিজেকে অবিবাহিত হিসেবে লিখিতভাবে ঘোষণা করে নার্সিং পড়ার সুযোগ নিয়েছিল। কিন্তু নিরঞ্জন আর যাই হোক, সে রেজিস্ট্রি করেই বিয়ে করেছিল। আর সেই কাগজ নিজের কাছে মজুত রেখেছিল। পালিয়ে যাওয়া বৌয়ের খোঁজ করতে করতে সে নার্সিং কলেজে পৌঁছে গিয়েছিল। তারপর কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে ওই বিয়ের কাগজ জমা করে সকলের সামনে রুমিকে চুলের মুঠি ধরে টেনে হোস্টেল থেকে বের করে নিয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে রুমিকে আবার ফিরে যেতে হয় নিরঞ্জনের ঘরে। তার পরে রুমিকে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিতে হয়। আরো কিছুদিন পর আবারও গর্ভবতী হওয়ার পর নিরঞ্জনের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করে পিতৃগৃহে আশ্রয় নিয়ে ছিল রুমি। এরমধ্যে কয়লাখনি থেকে অবৈধভাবে কয়লা তোলার সিণ্ডিকেটে জড়িয়ে বেশ পয়সা করেছিল নিরঞ্জন। বরের বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে বধূনির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিল রুমি। তারপর মিউচুয়াল ডিভোর্স এর পথে ওদের মধ্যে পুরোপুরি ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ততদিনে রুমির ছেলে হয়েছে, আর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষকতার চাকরি জুটে গিয়েছিল। ছেলেমেয়েদের দেখাশুনা বাবদে সে নিরঞ্জনের কাছ থেকে অনেক টাকা আদায় করে নিয়েছিল।
রুমির জীবনটা একটু স্থিতিশীল হতে আমি আমার স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে তার পিতৃগৃহে গিয়েছিলাম। আমি একটানা ভাবে চেষ্টা করে গিয়েছিলাম যাতে তার সঙ্গে পুরোনো দিনের মতো সহজ সম্পর্ক ফিরে আসে। কিন্তু রুমির তাতে সায় ছিল না। সে হৃদ্যতার দিনগুলো ফিরিয়ে আনতে চায় নি। আমি যখন তাকে বললাম, আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে একদিন তুমি একটার পর একটা বাস ছেড়ে দিতে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে চলত, তুমি নড়তে চাইতে না। অমনি টপ করে সে বলে দিল, হতেই পারে না, আমি তোমার মুখের দিকে কোনোদিন ভাল করে নজর করে দেখিই নি।
এই পৃথিবীতে আলো আর অন্ধকার মেশানো। সত্য আর মিথ্যা এখানে হাত ধরাধরি করেই চলে। তুমি যখন বলছ, তুমি আমার দিকে চেয়েই দ্যাখো নি, তখন আমি জানি, আমার সঙ্গে তুমি কতপথ হেঁটেছিলে। এমন সময়ে আমার পায়ের কাছে স্মৃতি সরণি বেয়ে সেই হাওয়াই চটির স্ট্র্যাপের সেফটিপিন নড়েচড়ে উঠল। বোধহয় তার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..