প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
ঘড়ির কাঁটা ছুঁয়ে বুঝতে পারলাম ট্রেন ঠিক সময়েই ছাড়ছে। ব্যক্তিগত কাজে বর্ধমানে এসেছিলাম,একটা পঁচিশের লোকালটা না পেলে খুব অসুবিধায় পড়তাম। বন্ধু মানস বাইকে পৌঁছে দেওয়াতে বেশ কিছু আগে স্টেশনে এসে একেবারে জানালার পাশে সিট পেয়ে গেছি। শেষ সময়ে এক দম্পতি তাদের মেয়েকে ট্রেনে তুলে দিলেন। দরজা থেকেই একেবারে নিখুঁতভাবে ডিরেকশান দিয়ে মেয়েকে ভেতরে পৌঁছে দিলেন। জানলা দিয়ে হাত বার না করা থেকে,অসুবিধা হলে পাশের সহযাত্রীর কাছ থেকে সাহায্য নেওয়া পর্যন্ত নানা রকম উপদেশ গিলে নিয়ে শেষমেশ যে এল সে যে ঠিক আমারই পাশে জায়গা নেবে ভাবতে পারি নি। আমি জানালার দিকটা ছেড়ে দেব কিনা ভাবতে ভাবতেও কেন জানিনা আত্মত্যাগের কোন উদ্যোগ নিয়ে উঠতে পারলাম না। দরজা থেকে হেঁটে আসার সময় বুঝতে পারলাম,ওর পায়ে নুপুর বাঁধা আছে যদিও তা দেখতে পাইনি। ‘আচ্ছা ঠিক আছে’,‘চিন্তা করো না’- জাতীয় টুকরো বাক্যে ওর বয়স আন্দাজ করতে পারি,কুড়ি একুশের বেশি নয়। ছোট্ট ছোট্ট ঠিন ঠিন শব্দ তুলে ওর বাবার নির্দেশ মত আমার পাশের খালি জায়গায় বসার জন্য ও এগিয়ে এল। মেয়েদের পায়ের নুপুরের সঙ্গে ঘুঙুরের শব্দ বেশ কিছুটা আলাদা। আমি বেশ বুঝতে পারি এমন ছোট ছোট আরও কিছু শব্দের পার্থক্য। মেয়েটার পোশাক থেকে খুব সুন্দর একটা সেন্টের গন্ধ পাচ্ছি,মেয়েরা সুগন্ধী ব্যবহার করলে আমার বেশ লাগে। আমার অনেক সময় এমনও মনে হয় যে এই জিনিসটায় মেয়েদেরই একচেটিয়া অধিকার থাকা উচিত। ওর শাড়ীর খসখস,হাতের চুড়ির ঠিনঠিন ওর প্রতি আমার আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছিল। পাশে বসা মেয়েটার সঙ্গে কীভাবে কথা শুরু করা যায় ভাবতে ভাবতে মেয়েটাই আমাকে মুক্তি দিল।
– আরেকটু জায়গা দেবেন,যদি অসুবিধা না হয় আপনার।
আমি জানালার দিকে আরও একটু সরে গুছিয়ে বসি। কারও কথার মধ্যে যদি সুর ঘোরে ফেরে,তাকে না বলব এমন বেহায়া আমি নই। আবারও কথা বলে মেয়েটি।
– বড্ড গুমোট,বাইরে মেঘ করেছে বোধহয়।
– হলেও খুব বেশি নয়,মানে বৃষ্টি আসার মত নয়,তবে বিকেলের দিকে হতে পারে। পরপর কয়েকদিন যা গেল!
– এমা,এমন দুঃখ করে বলছেন কেন,বৃষ্টি ভাল লাগে না আপনার?
– লাগে তো,কিন্তু বাইরে থাকার সময় নয়। বেশ ছুটির দিনে জানালার পাশটিতে বসে আমার সামনের বাড়ির গ্যারেজের ছাদে বৃষ্টির শব্দ শুনতে দারুণ লাগে। ভাগ্যিস ছাদটা টিনের,আমাদের দেশের বাড়ীর কথা মনে পড়ে যায়।
– বাবা,গল্প-কবিতা লেখেন নাকি? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে কিন্তু,আপনার ভেতরে আছে।
– আছে তো, কিন্তু অন্য কেউ বিশ্বাস করলে তবে না-
– কী তবে?
– ও কিছু না,পাগলের প্রালাপ ধরে নিন না,সব কিছুতে এত পাত্তা দিতে নেই।
আমি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকি,আমার কালো চশমার কাঁচে গাছপালা,বাড়ি ঘর উল্টোদিকে ছোটে। একটু পরে ঝালমুড়িওয়ালা আসতে আমি ওর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করি – চলবে নাকি? অন্যমনস্ক গলায় উত্তর দেয় ও – আমি বাইরে কিছু খাই না,তাছাড়া একটু আগে ভাত খেয়ে উঠলাম তো, এখন মুড়ি খেতে ভাল লাগবে না,আপনি খান না।
– কোথায় যাবেন?
– পানাগড়,ওখানে আমার মাসীর বাড়ি। মাসী স্টেশনে আসবে আমাকে নিতে। আর আপনি?
– আরেকটু দূরে,দর্গাপুর।
– ওখানে চাকরী করেন বুঝি?
– হ্যাঁ,সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে,অ্যাসিস্টেন্ট লাইব্রেরিয়ান।
– ও বাবা,তাহলে তো আপনি শুধু পড়াশোনা করা লোক,আপনাকে সমীহ করে চলতে হয়।
– দু-হাতে আর পায়ে দশটা করে আঙুল নিয়ে আমি এক অতি সাধারণ মানুষ,আমাকে সমীহ করার তো কিছু নেই। আর বই পড়তে ভালবাসতাম ছোটবেলা থেকেই,ফলে চাকরীটা খুব পছন্দ হয়ে গেল। এখন শুধু অক্ষর ছুঁয়ে থাকা। অবশ্য আর কোথাও তেমন সুযোগও ছিল না। চারপাশে এখন বেশ ভাল ভাল বইমেলা হচ্ছে,যাবার ইচ্ছে আছে নাকি আপনার?
– নতুন বইয়ের পাতার গন্ধ শুঁকতে কী ভাল লাগে তাই না। কিন্তু সব দিক সামলে কীভাবে যে সময় বার করি,তাই আমার এখন যাওয়া হয় না। অথচ এক সময় ঠিক দুর্গা পুজোর সকালের মত আগ্রহ নিয়ে বইমেলায় যেতাম। এখন মনে পড়লে এত কষ্ট লাগে!
আমি মনে মনে একটু কুঁকড়ে যাই। ইলেক্ট্রিক শেভিং মেশিনে আমার রোজ কামানো গালের মসৃণতা পরীক্ষা করতে থাকি। মেয়েটার পরনে শাড়ী না সালোয়ার কামিজ? তার রঙটা কি লাল না ম্যাজেন্টা নাকি হালকা গোলাপী অথবা নীল – আমি খুঁজতে থাকি,ঠিক কোন রঙের শাড়ী বা সালোয়ারে ওকে সবচেয়ে বেশি মানাবে। নিজের জন্য আমি বরাবর হালকা ক্যাজুয়াল সার্টের সঙ্গে ডার্ক ব্ল্যাক অথবা ব্রাউন ট্রাউজার পছন্দ করি,আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
– অনেকদিন আছেন দুর্গাপুরে, না যাতায়াত করেন বর্ধমান থেকেই?
– না, যাতায়াত করি,তবে যাতায়াত করলেও ডেলি পাষন্ড নই।
– মানে?
– মানে যারা ডেলি প্যাসেঞ্জারি বা রোজ যাতায়াত করে,অন্য সহযাত্রীকে বসার জায়গা না দেওয়াটাকে পৈত্রিক অধিকার বলে ভাবে –আমি তাদের দলে পড়ি না,এই আর কী
১
– বাঃ,বেশ কথা বলেন তো আপনি।
– বিজ্ঞাপনের কথা মনে রেখেই বলি,আমার স্ত্রী ভাগ্যে ইস্ত্রি ঘষা আছে কিন্তু আমার বন্ধুরাও একই কথা বলে।
– বুঝেছি,অর্জুন চক্রবর্তীর বোরোলিন,অনেক আগের বিজ্ঞাপন,এত মনে রাখেন কী করে।
– লাইব্রেরিতে কাজ করতে করতে এসব খুব সহজেই অভ্যেস হয়ে যায়।
– তার মানে আপনি খুব পড়াশোনা করেন,তাই না?
– মাথা খারাপ,এতদিনে তাহলে পারফেক্ট বাঙালী হয়ে যেতাম না?
– এখন কি তবে আপনি আধা বাঙালী?
– না, তা ঠিক নয়। ওই, ঝালে –ঝোলে – অম্বলে,সবেতেই মিলে মিশে কোনরকমে আছি আর কী।
– আহা এভাবে বলছেন কেন,ঈশ্বর যাকে যেভাবে রেখেছেন তার তো সেখানে থেকেই কাজ করে যেতে হবে।
– ও,আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তাহলে!
– কেন আপনি করেন না?
– না করি না,নিজেকে বিশ্বাস করি।
– নিজেকে বিশ্বাস করলে,কাজ করলেই তো ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখা হল,আলাদা করে অন্য কিছুতে আবার বিশ্বাস করার কী আছে?
– ওরে বাবা,এ তো ঘোর তত্ত্ব কথা হয়ে গেল,আপনি কী করেন বলুন তো?
– একটা স্কুলে ছোট ছোট বাচ্চাদের গান শেখাই।
– তাই বলুন,তখন থেকে ভাবছি, কী করে হয়!
– কী হয়?
– গলায় সুর না থাকলে, স্বর এত মিষ্টি কী করে হয়।
– যাঃ,মোটেই না।
– আমার জগতটা কিন্তু শব্দকে আশ্রয় করে,প্রতিটা শব্দকে আলাদা করে চিনে নেওয়ার একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা আমার আছে। সুতরাং আমাকে ফাঁকি দেওয়া এত সহজ নয়।
– আমি মোটেই ফাঁকি দেওয়ার কথা বলিনি। আপনি বেশ বাড়িয়ে বলছেন তাই আমি ওকথা বললাম।
– আচ্ছা আপনি গানের মানুষ। আপনি ঐ গানটা জানেন,ঐ যে – বাড়িয়ে দাও তোমার হাত…..,একটু শোনাবেন,আমার খুব প্রিয় গান এটা।
– অনুপম রায়,ওমা ট্রেনের মধ্যে ওরকম গান শুনে সবাই যদি সত্যিই বাড়িয়ে দেয় হাত,খুব একটা কিছু করার থাকবে কি,যদি ভুল হাতে হাত রেখে ফেলি,সঠিক ভরসা জোগানো হাতটা যদি ভিড়ের মাঝখান থেকে এলোমেলো হারিয়ে ফেলি,তার চেয়ে আজীবন বরং খুঁজে যাওয়া এটাই তো ভাল।
– ওঃ,আবার সেই দিদিমনিগিরি,অদ্ভুৎ অভ্যেস হয়ে যায় আপনাদের না?
– কেন কিছু ভুল বললাম কি?
– না ভুল যে বলেছেন তা দাবী করছি না,তবে বোঝার ক্ষমতা থাকলে মানুষ ঠিক বুঝে নেয় কোন হাতটা ভরসার,আর কোনটাইবা ঠকে যাওয়ার।
– কোথায় এল বলুন তো?
আমার উল্টোদিকের সিটে বসা ভদ্রলোক তড়িঘড়ি বলেন – পানাগড় ঢুকছে। মনে হল ভদ্রলোক অনেকক্ষণ থেকে আমার পাশের সিটটা দখলের চেষ্টায় আছেন,একবার সেট হতে পারলে কেল্লা ফতে,আমি নামলেই জানালার পাশের সিট – সব মানুষের চাহিদা যদি এত সামান্য হত!
– আসি তাহলে, পারলে একবার আমাদের স্কুলে আসুন না,সর্ব মঙ্গলা গার্লস,স্টেশন থেকে রিক্সায় মিনিট দশেক,আপনার মত মানুষের সাথে বাচ্চাগুলো আলাপ করতে পারলে ওদের মনের আলো জ্বলবেই। নমস্কার।
আমি বুকের কাছে দুহাত জড়ো করি। বুঝতে পারি,সময় শেষ। কালো চশমার আড়াল থেকে আমার দুচোখের সীমাহীন অন্ধকার কোনভাবে ওকে আঘাত করেনি তো,ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। ওর নিমন্ত্রণ রাখব এ কথা বলার আগেই আবার ওর পায়ের নুপুর বাজে,দরোজার দিকে এগোয় ভিড় ঠেলে। ট্রেনটা স্লো হতেই বোধ হল ওর মাসীর গলা পাই – চিন্টু ,এই যে এদিকে। আস্তে আস্তে নামবি,আমার হাতটা ধর।
আমার পাশের সিটে এসে বসেছেন উল্টোদিকের ভদ্রলোক। প্ল্যাটফর্ম থেকে চা কিনলেন। প্রথম চুমুকের পর একটা তৃপ্তির আওয়াজ তুলে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন,আপনার পাশে এসে বসে আপনাকে বিরক্ত করলাম না তো। – না না, বিরক্ত করবেন কেন,বসুন না,আমি তো সামনেই নামব।
– না,মানে বেশ দুজনে গল্পগাছা করছিলেন দেখলাম,আমি আবার খুব একটা বকবক করতে পারি না,বুয়েচেন। আমি মাথা নেড়ে বলি,আচ্ছা যিনি এইমাত্র
নেমে গেলেন,তাকে দেখতে কেমন?
– কেমন আবার, যেমন হয়,অতশত লক্ষ্য করিনি মোয়াই।
– আচ্ছা ওর চোখ দুটো? নিশ্চয় খুব সুন্দর?
– দূর মোয়াই,ফিউসড্ বালব্ আবার কোন কাজে লাগবে?
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..