আশার পিদিম

মঈনুল হাসান
গল্প
Bengali
আশার পিদিম

খাঁ পাড়ার বশির মিয়ার মন ভালো নেই কয়েকদিন থেকে। শুধুই অস্থিরতা। ভেতরে ভেতরে কেমন যেন এক ধরনের ছটফটানি। মনটা কিছুতেই থিতু হতে চায় না। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে। প্রকৃতির আজব খামখেয়ালিপনা তাকে মতিহীন বানিয়ে রেখেছে এমন। ফুরফুরে ফাল্গুনী হাওয়াও অসহায় তার কাছে।

ফাল্গুনের মাঝামাঝি সময় এখন। চারদিকে সুন্দর চনমনে রোদ ও বিরামহীন হাওয়ার মাখামাখি। কিন্তু, আকাশের খেয়াল আচানক অন্যরকম হয়ে যায়। কোনো কিছুই হিসাবে মেলে না। আচমকা শুরু হয় মেঘে আর হাওয়ায় পাল্লা। কালো মেঘের শামিয়ানা টানিয়ে উদ্দাম হাওয়া দাপিয়ে বেড়ায় যাদুখালির বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। মেঘের নিনাদ আর উত্তুঙ্গ হাওয়ার সে কী অবিরাম খুনসুটি! ক্ষেতের কাছে কান পাতলে ঝুমঝুমি শোনা যায় শিষের। কিন্তু, সেই বাজনা ছাপিয়ে বাজখাঁই গলায় ডেকে ওঠে বাজ। উন্মদ হাওয়ার সাথে আলোর উজ্জ্বল ঝলকানি চলতে থাকে সব কিছুকে উপেক্ষা করে। খেলাশেষে চারদিক অন্ধকার করে এক সময় মুষল ধারে বাদল নামে শ্যামল গাঁয়ের বুকে।

অবাধ্য আকাশের দিকে তাকিয়ে বশির মিয়া তাই উদাস হয়ে ভাবে, এমন হবার তো কথা নয়। মনে হয় এবার বৃষ্টির ধাতটা একটু বেশি। মাঠে ফসল ভালোই হয়েছে। তাই ক’দিন পরে বৃষ্টিটা হলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত?

যাদুখালির মাঠে মাঠে ফসলের বান দেখলে মনে হয় মাটির গোপন জঠরে লুকিয়ে থাকা সমস্ত ঐশ্বর্য নিংড়ে সোনার ফসল ঢেলে দিয়েছে প্রকৃতি। বিপুল ঐশ্বর্যের ভাণ্ডারে যেন কোনোই কৃপণতা নেই। জৈষ্ঠ্য শেষে আষাঢ়ের ঢলে প্রকৃতি তার রোদে তাতা অবশ ক্লান্ত শরীরটা ভিজিয়ে নিয়ে অবলীলায় স্বস্তি নিতে পারতো। হাঁসফাঁস করা শরীরে নিতো না হয় আকাশসমান দম। উদার আকাশ আর মাটির অংশীজনের সাথে এমনই তো সখ্য ও সমঝোতা ছিল তার। কিন্তু, হঠাৎ অবেলায় মাটির এ প্রবল জলতেষ্টা সবার জন্য কাল হলো। নিরন্ন চাষীকুলও অপেক্ষা করে আছে উপরের দিকে চেয়ে। কিন্তু, উপরে যিনি বসে আছেন তাঁর লীলা কেইবা বুঝে? কারইবা সাধ্য তা খণ্ডন করে।

বশির মিয়া সামান্য চাষী। ভাব-জগতের এইসব নিগূঢ় তত্ত্ব-কথা তার বুঝার কথা নয়। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়াল চিন্তায় আনাও তার জন্য অর্থহীন। তার ভাবনা যে শুধু দু মুঠো অন্নের। বাপ-দাদার রেখে যাওয়া ওই এক খণ্ড ভিটার প্রতি অচ্ছেদ্য মায়াই তার খেয়াল। আর নিজে বাদে পরিবারের বাকী মুখগুলোর ভালোমন্দ দেখ-ভাল ও তাদের নিয়ে অবিরাম বেঁচে থাকা জীবনের একমাত্র অর্থ তার কাছে।

 

দুই

বশির মিয়ার অস্থিরতা শুধু তাকেই কাবু করেনি, ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পরিবারে। তাই সে খিটমিট করে বউ আরজিনার সাথেও। বুড়ো বাপটা সারাদিন দাওয়ায় বসে ছানিলাগা ঝাপসা চোখে উঠানের এদিক ওদিক তাকিয়ে অলস দিন গুজরান করে। সেও বাদ পড়ে না বশির মিয়ার খ্যাংরামুখ থেকে।

আগেই কইছিলাম, গম বুননের দরকার নাই। আমার কথা কে শুনে! খালি লোভ আর লোভ। ধানের ক্ষেতি অনেক ভালা ছিল। আকাশের ভাব গতিক দেখে রাগে গজ গজ করে ওঠে বশির মিয়া।

গতরের কষ্ট আর খরচ দুইই বেশি ধানের আবাদে। এইডা তো এদ্দিন হাড়ে হাড়ে বুঝছি, জবাব দেয় আরজিনা।

আকাশের অবস্থা দেখছস? একটা দানাও মনে হয় আর ঘরে উঠব না। গমে রঙ ধরছে মাত্র। আর কয়দিন পরে বাদলডা নামলে কী এমন হইত? আফসোসের কণ্ঠ শোনা যায় বশিরের গলায়।

কিচ্ছু হইব না। সব ঠিক হইয়া যাইব। আশ্বস্ত করে আরজিনা। আরও কী যেন বলতে গিয়ে বশিরের চোখ-মুখে রাগের আস্ফালন দেখে থেমে যায় সে। মিইয়ে যায় একেবারে।

আরজিনা বরাবরই ওরকম। স্বামীর মুখের উপর বেশি কিছু বলতে পারে না সে। নির্বিষ সাপের মতোই কুণ্ডলী পাকিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখে বশিরের সংসার। বিষ নেই তার আবার কুলোপনা চক্কর। ফণা তুলে ছোবল মারার আগেই বিষের টানে ভাটা পড়ে।

পরিবারে চারখানা মোটে মুখ। সব সয়ে নেয় সে অথবা গা সহা হয়ে যায় এতদিনে। নয় বছর আগে আশ্বিনের এক সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে আসে বশির মিয়া। একটুখানি ছিল তার শরীর, আর ছিল মায়ায় ভরা মুখ। তবে সাংসারিক টানাপড়েনের নির্মম কশাঘাতে সাধ-আহ্লাদ সব গিয়ে ঠেকেছে দশমীর দশায়। তাই সবকিছু ভুলে গিয়ে দৈনিক তেল-নুনের চাহিদা পূরণে অনেকটাই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সে। রঙিন দিনরাত্রিগুলো হয়েছে ভীষণ রকমের সাদাকালো। শামুকের মতো ধীর একটা নিস্তরঙ্গ জীবনের সাদামাটা যাপন চলে খাঁ পাড়ায় এই সংসার নামক খেলায়।

 

সন্ধ্যার পর সাঁঝবাতি জ্বালিয়ে আলোর দমটা কমিয়ে আরজিনা বশিরের ঘনিষ্ঠ হয়। চাটাইয়ের বেড়ার ওপাশ থেকে তাদের একমাত্র সন্তানের পড়ার গুনগুন আওয়াজ ভেসে আসে।

বউ মাথা টাথার ঠিক নাই।

ক্যান কী হইছে, আমারে কও।

বাপজানের কথায় ধান বাদ দিয়া এইবার গম বুনছি। মাঠ ভরা সোনা রঙের গম। আমার মন কয় এইবার ভালো ফসল পামু না।

তুমি বুঝলা ক্যামনে? কিচ্ছু হইব না।

তোমার মনে আছে বউ, যেইবার তোমারে বিয়া কইরা আনছি ওই বছরের কথা? মাঠভরা ফসল। ধান বাদ দিয়া ওইবারই পরথম গম বুনছিলাম বাপজানের কথায়। কিন্তু, গমের পুষ্ট দানা হয় নাই মোটে। এই নিয়া তোমারেও কত কথা কইছিল বাড়ির লোকে।

হ, একটু একটু মনে আছে ওইসব দিনের কথা।

আমার মনে হয়, এইবারও সেই রকম হইব। মাঠের গম এখনও কাঁচা, তবে সোনার রঙ ধরছে। বাপজানের কথা শুইনা কী ভুলটাই না করলাম।

তুমি শান্ত হও। মাথা ঠাণ্ডা কইরা বও। দরকার হইলে করিম ভাই আর তালেবের লগে কথা কও। মফিজের টংঘরের দিকে তালেবরে যাইতে দেখলাম। ওইখানে যাইয়া সবার লগে কথা কও।

কোমরের কাছে লুঙ্গির আলগা হওয়া বানটা শক্ত করে গুঁজে আরজিনাকে সরিয়ে উঠে পড়ে বশির। বন্ধ দরজার হুড়কোটা নামিয়ে দিয়ে টর্চ হাতে পা বাড়ায় অন্ধকার উঠানের দিকে। পাশের ঘর থেকে আসা একটানা পড়ার আওয়াজ ঝিঁঝিঁর ডাকের সাথে মিশে যেতে থাকে। কেমন যেন গুমোট হাওয়া বইছে আবার। কোথাও মনে হয় এক পশলা বৃষ্টিও হয়েছে। সেই শীতল হাওয়ার পরশ গায়ে এসে লাগছে থেকে থেকে।

যাদুখালির একেবারে দক্ষিণে খাঁ পাড়াটা, তারপর মাধবপুরের খালের উপর বাঁশের সাঁকোটা পেরোলেই পুবদিকে গঙ্গানগর গ্রাম। ওদিকের আকাশটা থমথমে কালো হয়ে আছে। ঠাণ্ডা বাতাসটা গায়ে মেখে পুবের থমথমে আকাশের দিকে চোখ মেলে চায় বশির। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের রজত রেখা ফুটে ওঠে সেখানে। কপালে চিন্তার রেখা আরও প্রসারিত হয় তার। উঠানের চৌহদ্দি পেরিয়ে বিশাল গাব গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আরজিনার কথায় আশ্বস্ত হতে চায় সে। মনের ভেতর কথাগুলো অতল বিতল করে। তারপর আশা নিরাশার দোলাচলে স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো মফিজের টংঘরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে সে।

 

তিন

মফিজের টিনের টংঘরের সামনে একটা বাঁশের বেঞ্চি পাতা। সাঁঝের পর পাড়ার সকলেই আড্ডায় জড়ো হয়। দিনশেষের নিখাদ বিনোদনের এন্তেজাম চলতে থাকে সেখানে। সৌর বিদ্যুতের বদৌলতে হারিকেন বা টিমটিমে কুপির পরিবর্তে জ্বলে বৈদ্যুতিক বাতি। টিভি দেখার পাশাপাশি সকলেই গলায় রং চা ঢালে একের পর এক। মফিজের দোকানে না এলে পাড়ার লোকের দিন যেন অসম্পূর্ণই থেকে যায়। বশির মিয়াও ধীর পায়ে এগিয়ে যায় টংঘরের দিকে। সুলেমান, সুবল, তালেব অনেককে দেখা গেলেও করিম ভাইকে দেখা যায় না সেখানে। অনেকের গলাই শুনতে পায় সে। তবে সুবলই উচ্চকণ্ঠ হয় বেশি।

সুলেমান আর তালেব ভাইয়ের কথায় পাঁচ বিঘে জমির পুরোটায় গম বুনছি এইবার। এক দানাও ধানের আবাদ করি নাই। এদিকে আকাশের যেই গতিক! এই জলে ডুবা গম লইয়া কী করুম? গতরের কষ্ট, খরচা সব মনে হয় গলার ফাঁস হইল।

গম আবাদে খাটনি কম তয় লাভ বেশি। তোমার জমি, তুমি না করলে আমরা কীইবা করতে পারতাম। কৈফিয়তের সুরে জানায় তালেব। গতবার ভালা দাম পাইছিলাম। তাই তুমারে পরামর্শ দিছিলাম।

আমিও তো সব জমিতে এই শস্য বুনছি। কিন্তু, এইবার এইরকম দশা হইব আগে ভাবি নাই। তালেবের কথায় সুলেমানও মাথা নাড়িয়ে সমর্থন জানায়।

বশিরকে চিন্তিত মুখে আসতে দেখে কথা থামিয়ে দেয় সবাই। বশির বুঝতে পারে, তার এ মতিভ্রম তা আসলে তার একার নয়। তার মতো সকল চাষীরই ওই এক চিন্তা। দু’ বেলা দু’ মুঠো অন্নের চিন্তা। তাই ধান-গম আবাদের লাভ লোকসানের হিসাব এখানেও চলতে থাকে।

চা খাবা নাকি বশির ভাই, মফিজ শুধায়। সে কথায় কর্ণপাত না করে তেপায়া টুলটা টেনে নিয়ে সবার মধ্যে গিয়ে বসে বশির। গম্ভীর মুখে বলে, আকাশের ভাও দেখছ? সকালে দেখলাম জমিতে এক হাঁটু জল। বুদ্ধিতে আর কুলায় না কিছু।  তোমরা কী নিয়া কথা কও আমি জানি।

বশির কথাটা পারলেই লুফে নেয় তালেব। আমরা সবাই জমির ক্ষেতি নিয়াই কথা কইছিলাম। সময় হওনের আগেই কেমন পাক ধরছে। আবার নামছে অবিরাম ঢল। এখনও ফলন পুষ্ট হয় নাই। কিছুই বুঝবার পারতেছি না। কী যে করি।

চা এর কাপটা মুখে লাগিয়ে নিতান্ত অনিচ্ছায় গলায় রং চা ঢালে বশির। আনমনে এক ঘোরের মধ্যে থেকেই বলে ওঠে, সময় অসময়ে যে রকম বাদল নামতাছে মনে হয় এক দানা ফসলও ঘরে নিবার পারুম না। এই চিন্তায় মেজাজটা খিঁচ হইয়া আছে একদম।

মাথা ঝাঁকিয়ে এই কথায় সায় দিয়ে সবাই একদম চুপ মেরে যায়। নিবিড় মনোযোগে জংধরা টিনের কেতলি থেকে গরম জল ঢেলে নিয়ে কাপে চায়ের পাতি ছেড়ে দেয় মফিজ। টুংটাং শব্দ তুলে একটার পর একটা চা বানাতে থাকে ভীষণ আগ্রহে। চামচের সেই টুংটাং শব্দে আরও ধ্যানগম্ভীর হয়ে যায় বশির মিয়ার মন।

মফিজের টংঘরের প্রতিদিনের চায়ের আড্ডাটা কেমন ঝিম মেরে যায়। ফাল্গুনের রঙধরা বিলাসী বাতাসটাও ঝিম মেরে একটা গুমোট পরিবেশে ডুবে যেতে থাকে। যাদুখালির আকাশে মুহূর্তেই মেঘের ঘনঘটা দেখা যায়। কালো কেশের বিস্তার করে গম্ভীর কালো মেঘ ধেয়ে আসতে থাকে প্রবলভাবে। আঁধি নেমে হঠাৎ গ্রাস করতে চায় সবকিছু। বাজের ছন্দ আর বিদ্যুতের মুহুর্মুহু চমকে অশনির সংকেত নেমে আসে চারিধারে।

বশির ভাই, আকাশের ভাব ভালা না। এ তো দেখি অকালের বাদলা। মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট ফুটে ওঠে মফিজের। টিনের টংঘরের চালে টুপটাপ করে দু’এক ফোঁটা বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগে। বাড়ি ফেরার তাড়া শুরু হয় সবার মাঝে। মফিজ দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে টিনের ঝাঁপ ফেলে দেয়। এক এক করে বাঁশের বেঞ্চি খালি করে বাড়ির দিকে পা চালাতে থাকে বশির, তালেব, সুলেমান, সুবল সকলে।

খাঁ পাড়ার কয়েকশ গজের মধ্যেই সবার বসবাস। টংঘর খালি করে কিছুটা এগিয়ে যেতেই আকাশ ছাপিয়ে অঝোর বৃষ্টি নামে। দৌড়ে গিয়ে বুড়ো বট গাছের নিচে আশ্রয় নেয় সকলে। বৃষ্টিটা ধরে আসার জন্য সবাই অপেক্ষা করে। তবে তার আগে সবাইকে চমকে দিয়ে আকাশ থেকে বড় বড় শিলাখণ্ড পড়তে থাকে। হতভম্ব বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সবাই। মুহূর্তেই সফেদ তুলার মতো বরফের চাদরে ভরে যায় চারিধার। ত্রস্তে তালেবের কাছের গম ক্ষেতের দিকে দৌড়ে যায় সবাই। লাগাতার বৃষ্টিতে আর হঠাৎ শিলার আঘাতে মাটির কাছাকাছি নুয়ে পড়েছে সব ।

কী হইব আমাগো বশির? সমস্ত আশা ভরসা মনে হয় শ্যাষ এইবার। বলে ওঠে তালেব।

বশির এগিয়ে গিয়ে তালেবের কাঁধে সান্ত্বনার হাত রাখে। মাথা ঠাণ্ডা রাখ তালেব। এই ক্ষতি পুষাইতেই হইবো আমাগো। দেখি সকালে কী করণ যায়। সুলেমানের জমি তো কয়েক পা হাঁটলেই। তারপর সুবলের। দেইখা আসি ওইখানে কী অবস্থা! আশ্বস্ত করতে চায় বশির।

ততক্ষণে আকাশ ভেঙে নামা অঝোর বাদল আর সেইসাথে প্রকৃতির রুদ্র তাণ্ডব কিছুটা কমে আসে। সবাই একমত হলে হালকা বৃষ্টির মধ্যেই অন্ধকার আলপথে পা চালায় বশির, তালেব, সুলেমান আর সুবল। পেছন পেছন মফিজও দৌড়ে ছুটে আসে।

অন্ধকারে ফসলের উন্মুক্ত বিস্তারে হারিকেন আর টর্চের আলো ফেলে তারা নিশ্চিত হতে চায় ক্ষতির পরিমাণ। মাপতে চায় অনিশ্চয়তার গভীরতা। কিন্তু, প্রকৃতির কাছে অসহায় তারা।

আশাভঙ্গ মনে পাঁজরভাঙা কষ্ট ও হাহাকার বুকে নিয়ে ফিরে যায় যার যার ঘরে। আকাশের কেটে যাওয়া অন্ধকার নিমেষেই ভর করে সহজ সরল মুখগুলোতে। ঝাপসা আলোতেও তাদের চোখে হতাশা দেখা যায়। ঘনঘোর অন্ধকারের জমাট পাথরটা চেপে বসে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুননের পথে।

 

চার

অন্ধকার মেঘের কালো থাবা কেটে গিয়েছে সপ্তাহখানেক আগে। আবার সেই ঝকমকে চৈতী হাওয়ার দোল। চটক রোদের ঝাঁঝ সবখানে। নিটোল প্রকৃতি নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে আলগোছে। ছাতিফাটা গরমে তেষ্টায় প্রাণ শুকিয়ে যাবার উপক্রম। মাঠের উত্তরে দাঁড়িয়ে থাকা শিরীষ গাছের প্রলম্বিত ছায়ায় বসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় বশির। জীবনকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিঘা তিনেক জমিই এখন শেষ সম্বল তার। মনকে বুঝ দিয়ে ভাবে, কপট প্রকৃতি বঞ্চনা করলেও আবার উঠে দাঁড়াবে সে। প্রকৃতি ছলনা করলেও তার কাছেই ফিরে যাওয়া ছাড়া কারও অন্য গতি নেই। তার এই ভাবনা সংক্ষুব্ধের নয়, বরং প্রকৃতির কাছে সহজ সমর্পণের। বশিরের মতো অন্যদের ভাবনাও কমবেশি তাই।

খাঁ পাড়ার পরিশ্রমী চাষীকুলের বেঁচে থাকার অবলম্বন মাঠের জমিটুকু। এবার আগাম ফলনে যারপরনাই সন্তুষ্ট ছিল তারা। ফাল্গুনের মাঝামাঝিতে জমির সামনে দাঁড়িয়ে অপক্ব শস্যমঞ্জরির হাসি দেখে প্রাণে খুশির বান ডেকেছিল বশিরসহ সকলের মনে।

বাতাসে শিষের বাজনা আর অনাগত ফসলের ঘ্রাণ কল্পনা করে বশিরের মনটাও দুলে উঠেছিল। কেমন কাঁচা সোনার রং ধরেছিল চারদিকে। মিছা এই রং দেখে মনেও তার সোনার রং ধরেছিল। পাক ধরার সময় হয়নি বলে কিছুটা ধন্দও লেগেছিল মনে।

একা একা বসে মনকে আবার বুঝ দিতে চেষ্টা করে বশির। বছর তিনেক ধরে ধানের আবাদ বাদ দিয়েছে সে। কারণ, এতে গতরের খাটুনি ও খরচা অনেক বেশি। অন্যদিকে বিঘে প্রতি ভালো দাম পাওয়ার আশায় গম বুনলেও প্রকৃতি আগে কখনও এতটা বিরূপ হয়নি। সবই নিয়তি। এখন বুকভরা শ্বাস নেওয়ার বদলে গলায় এসে লাগছে গভীর ফাঁস। এই ফলনই আজ যেন গলার কাঁটা।

কিছুদিন আগের হঠাৎ শিলা বৃষ্টি বশিরের মতো সকল গম চাষীর মনে এমনিই চিন্তার ছাপ ফেলে দিয়েছে। একে তো অপরিপক্ব শস্য, তার উপর অসময়ের বাদল। প্রকৃতির এই হঠাৎ বিরুদ্ধাচরণ তাদের হতবুদ্ধি করে দিয়েছে। বশির, তালেব, সুবলদের বিস্তীর্ণ মাঠের ফসলের কাঁচা সোনা রঙ রোদে জলে মাখামাখি হয়ে ধূলিলুণ্ঠিত হয়ে থাকে। সেই পুঞ্জিত নীরবতায় কেবল ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের আকুতিই লেখা থাকে। স্বপ্ন ভাঙার কালে সাত পাঁচ এমন নানান কথা ভাবতে ভাবতে অপরাহ্ণের আলোয় অবশেষে বাড়ির পথ ধরে সে। পেছনে পড়ে থাকে তিন বিঘা জমিসহ সকল স্বপ্ন সাধের চিহ্ন।

পরের দিন অনিশ্চিত এক স্বপ্ন নিয়ে নিত্যদিনের মতো ভোর হয় সকল চাষীর বাড়িতে। পেটে কিছু একটা চালান দিয়েই সবাই চলে যায় যার যার ক্ষেতের প্রান্তে। ফজরের আগে শেষ রাত্তিরের দিকে ঠাণ্ডা হাওয়ায় চোখ দুখানা মুদে আসলে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায় বশিরের। বেলা গড়িয়ে যাওয়ায় পেটে কিছু না দিয়েই ক্ষেতের দিকে হাঁটে সে। সেখানে গিয়ে নাগাল পায় সুলেমান, সুবল আর তালেবের।

দূর থেকে বশিরকে আসতে দেখেই চেঁচিয়ে ওঠে তালেব।

বশির, তাড়াতাড়ি আয় এদিকে।

কী হইছে? অত হাঁকডাক কীসের? কপালে যা ছিল তাই হইব। অত ভাবনার কাম নাই।

সকালে ক্ষেত দেখতে আইসা দেখি কারা যেন আগেই সেইখানে উপস্থিত। এখন তো চৈত্র মাস। পাকা গম কাটনের সময়।

বশির কিছু বলার আগেই তালেব আবার বলে; সুবল, সুলেমান আমাগো সবার ক্ষেত থিকা গমের অনেক শিষ নিয়া গ্যাছে তারা। কী যেন কইছিল নিজেরা। শুনতাছি কী নাকি রোগও হইছে ক্ষেতে। গম পাকলেও কাটন মানা। সামনে মনে হয় আরও বড় কোনো বিপদ আছে আমাগো।

রাজধানীর বড় অফিস থিকা বড় কর্তারাও নাকি আসব। আরও কারা যেন আসব। বশির কিছু বুঝে উঠার আগেই সুবল এগিয়ে এসে হড়বড় করে কথাগুলো বলে।

বশিরসহ সকলে এগিয়ে যায় অনুসন্ধানী দলটির দিকে। তারা বিভিন্ন ক্ষেত থেকে নমুনা সংগ্রহ করছে। কৃষককুলের সাহায্যের জন্যই তারা ছুটে এসেছে। মাঝবয়সী একজন কৃষকদলকে উদ্দেশ্য করে বলে, আমরা কৃষি অফিসের লোক। শুধু বৃষ্টির জন্য নয়, প্রচণ্ড গরম ও অসুখের কারণে এবার অকালে ফসলের এ অবস্থা হয়েছে। তাই ফসল পুষ্ট হবার আগেই পাক ধরেছে। এই ক্ষতির কারণে হৈচৈ পড়ে গেছে সর্বত্র। আশপাশের বেশ কয়েকটা গাঁয়ে এই মড়ক লেগেছে। তাই এখন ফসলে পাক ধরলেও পুড়িয়ে সব ধ্বংস করতে হবে। একটা দানাও ঘরে তোলা যাবে না। কীভাবে এর উপায় খুঁজে বের করা যায় আমরা তাই নিয়ে নিরলস কাজ করছি।

সকলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বলে কী এরা? এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বৃষ্টিতে মাঠ-ঘাট সব জলে ডুবে হয়েছিল থৈ থৈ। সেই জল শুকিয়ে যেতেই লাভ লোকসানের হিসাব কষছিল সবাই। ভীষণ ক্ষতি হলেও ফসল ঘরে তোলার অপেক্ষায় ছিল তারা। আগাম ক্ষেতির স্বপ্ন বুকের ক্ষতে যে প্রলেপ লাগিয়েছিল তাও এখন উধাও। অজানা এই রোগ সারাবে কী দিয়ে? কী দিবে পরিবারকে? অন্ন যোগাবে কোত্থেকে তারা? সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।

সরকারি দপ্তরের কর্তা ব্যক্তিরা পাকা ফসলের দানা সংগ্রহ করে চলে যায়। ক্ষেতের আলের উপর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে বশির আর তালেব। সুলেমান মাথায় হাত দিয়ে নেতানো আলবোরা সাপের মতো সেখানেই গুটিয়ে যায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে। আর সুবল? বয়সে সবার ছোট বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে। কয়েক মাসের কষ্ট মাটি হয়ে গেছে তার। অসময়ের বৃষ্টির মতো চোখের এই অঝোর ধারা আড়াল করে না সে। ধুতির খোঁটে চোখ মুছলেও গালে দাগ রয়ে যায় সে কষ্টের।

 

পাঁচ

পাহাড়সমান কৌতূহল, নানা জিজ্ঞাসা আর একবুক হতাশা নিয়ে সকালের দিকে বশিরসহ সকলে জমায়েত হয় কৃষি অফিসের ফটকে। সেখানে গিয়ে দেখে বড় বড় কর্তা ব্যক্তিরা সদলবলে ভীষণ কর্মব্যস্ত। গাঁয়ের বিভিন্ন ক্ষেত ঘুরে আনা ফসলের নমুনা এনে জড়ো করে রাখা হয়েছে সযত্নে। কী সব গবেষণা হচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আরও অধিক পরীক্ষার জন্য এই নমুনা পাঠানো হবে রাজধানীর বড় পরীক্ষাগারেও। এসব নিয়ে নানা লেখাজোখা হচ্ছে, বক্তব্য-বিবৃতি হচ্ছে দেদার। সাংবাদিকের দল জুটে গিয়ে সেখানেও চলছে তুমুল তুখোড় হট্টগোল।

বশিরদের দিকে তাকানোর ফুরসত নেই তাদের। সুলেমান, তালেবদের ভাবনার বিষয়ে ইতি টেনেছে তারা। তারপরও ক্লান্তিহীন তাদের ছোটাছুটি। ভবিষ্যতের আশার বাণী শোনাচ্ছে কেউ কেউ। কিছুতেই আশ্বস্ত হতে পারে না তারা। প্রকৃতির খেয়ালের কাছে সবাই তালুবন্দি।

ভেতর থেকে কে যেন একজন এসে তাদের পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করে। আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিলে তবেই এ যাত্রায় মুক্তি মিলতে পারে। তবে একমুঠো দানাও ঘরে রাখা যাবে না এমনটাই শর্ত তার। মনকে কোনো রকমে বুঝ দিয়ে ভবিষ্যৎ কল্যাণ আকাঙ্ক্ষার কাছে নিজেদের সম্পূর্ণ সঁপে দিয়ে অবশেষে তারা ফিরে আসে ঘরে। হাল ছেড়ে নয়, বরং সবুজ আশায় বুক বেঁধে তারা নতুন করে স্বপ্নের বীজ বুনে নেয় আবার।

 

সেদিন দুপুরে আকাশের মতিগতি বদলে যায় আবার। শুধু গম্ভীর হয়ে ডাক দিতে থাকে। চৈত্রের মধ্যাহ্নেই কপট সন্ধ্যাটা গভীর হয়ে নামে যাদুখালির বুকে। বেশ আগেই নামে কেমন থমথমে কালো হয়ে। বাড়ির দিকে পা না বাড়িয়ে বশির, তালেব, সুলেমান, সুবল বুক শক্ত করে মাঠের দিকে এগিয়ে যায়। প্রকৃতির কাছে নিজেদের সমর্পণের খেলায় মেতে ওঠে। একটুখানি আফসোস বুকের মধ্যে খচ করে বিঁধে থাকে। আগে যদি জানতে পারতো তবে কম পরিশ্রমের দোহাই আর লাভের হিসাব না কষে বাপ-দাদার আবাদই চালিয়ে নিয়ে যেত তারা। সময় গেলে সাধন করে আর কীইবা লাভ?

খাঁ পাড়ার শেষ সীমানার ফসলের ক্ষেত পেরিয়ে দিগন্ত গিয়ে মিশেছে পাশের গঙ্গানগর গ্রামে। সেখান হতে চৈতালি উৎসবের মৃদুমন্দ আওয়াজ হঠাৎ ভেসে আসে বাতাসে। গ্রামের আনাচে কানাচে সন্ধ্যার আগেই সাঁঝবাতি জ্বালাতে শুরু করে পল্লীবালারা। তার দু’একটা জোনাকির মতো ঝিকমিক করে জ্বলে ওঠে।

মনের খেদ আর চেপে না রেখে এদিকে সোনা রঙ-এর ক্ষেতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় সুবল, সুলেমান। আগপাছ না ভেবে মনের সব রাগ, ক্রোধ ঢেলে দেয় গমের ক্ষেতে। দাউ দাউ করে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। বশিরের ক্ষেতে আগুন এখনও ছড়িয়ে পড়েনি। তার তিন বিঘা জমি একেবারে শেষ প্রান্তে। রোগের বিস্তারও তেমন হয়নি। সে হঠাৎ দৌড়ে যায় তার ক্ষেতের দিকে। কেউই কিছু বুঝতে পারে না।

সুবল, সুলেমানের ক্ষেত পুড়ে আগুন লেগেছে বশিরের ক্ষেতে। সত্যিকারের সন্ধ্যা নেমে আসে আরও কালো হয়ে। বশিরকে কোথাও দেখা যায় না। আগুন সম্পূর্ণ নিভে যাওয়ার আগে দক্ষিণের আকাশটা ভরে যায় চৈতালি উৎসবের ফানুসে। নক্ষত্র ছোঁয়ার আশায় সে আলো আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়।

বশির ভাই… বলে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে সুবল। আচমকা এই ডাকে সবাই সম্বিৎ ফিরে পায়। দৌড়ে ছুটে যায় মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তে। আধবোজা চোখে উপুড় হয়ে জমিতে পড়ে আছে বশির। ধূলিধূসরিত ছাই-কাদা মাখানো শরীরটা পড়ে আছে অর্ধচেতন হয়ে। তার হাতের শক্ত মুঠির বাঁধনে গমের এক ছড়া সোনালি সতেজ শিষ। বশিরের করতলে লেগে থাকা শস্যের ঘ্রাণ মুহূর্তে যাদুখালির প্রান্তর ছাড়িয়ে সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতির বৈরীতা উপেক্ষা করে আকাশ ছোঁয়ার বাসনায় ফানুসের আলো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়। রাতের গাঢ় অন্ধকার নেমে আসার আগে সাঁঝের ওই অস্পষ্ট আলোতে সুবলদের চোখের তারায় নিভে যাওয়া আশার আলোর চকমকি পাথরটা আবারও দপ করে জ্বলে ওঠে।

 

চরিত্রসমূহঃ

বশির মিয়া, আরজিনা, করিম, তালেব, সুলেমান, সুবল, মফিজ।

স্থানসমূহঃ

খাঁ পাড়া, যাদুখালি, মাধবপুর, গঙ্গানগর।

মঈনুল হাসান। কথাসাহিত্যিক ও ছড়াকার। ১৯৭৮ সালের ৪ আগস্ট (বাংলা ২০ শ্রাবণ, ১৩৮৪ বঙ্গাব্দ), ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার তেজগাঁওয়ে শৈশব কাটলেও পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী জেলায়। বাবা মরহুম মোঃ আব্দুল আউয়াল এবং মা বেগম শামসুন নাহার। বটমলী হোম বালিকা...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..