আশিরনখর ধর্ষিতা আমি

অন্তরা দাঁ
মুক্তগদ্য
Bengali
আশিরনখর ধর্ষিতা আমি

ধর্ষণ শব্দটা আমায় প্রায় প্রতিদিন ছুঁয়ে থাকে, গড়পড়তা সকাল সন্ধে, দশটা পাঁচটার প্রাত্যহিকীতে এক লহমার জন্যও যেন কোথাও ওর স্পর্শ এড়ানোর উপায় নেই আমাদের, মেয়েদের। সে জমিদার থেকে জমাদার যে আদলের পুরুষই হোক না কেন! আমার অদ্ভুত লাগে এই বিকৃতিটাই কিন্তু আদতে আকৃতি, আদল এ সমাজের।

খুব স্পর্শকাতর একটা বিষয়ের অবতারণা করছি, জানি অনেকে সহমত হবেন বা হবেন না, অনেকে আবার আক্রমণটা এমন একটা স্তরে নিয়ে যাবেন যে ভবিষ্যতে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সৎ সাহসের টুঁটি চেপে ধরে আর কিছু লেখার জোরটুকুও খুঁজে পাবো না আর। হ্যাঁ, আমি এই বিষয় নিয়েই কথা বলছি তবুও। এই যে কোনকিছু লেখার পর তাকে কাটাছেঁড়া করে বেশ পাতে দেওয়ার যোগ্য করে তোলা হয় সেটাও একপ্রকার ধর্ষণ, তার লেখাকে ধর্ষণ করা। ‘মেয়েরা আবার লিখতে পারে নাকি! ‘বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব এই ধরনের মন্তব্য করেছেন, এটা একরকম মানসিক ব্যধি, এরকম মানুষ আগেও ছিলেন এখনো এরা সমাজের মান্যগণ্য, এঁদের শিল্পকর্ম ও সৃজনকে শ্রদ্ধা করলেও ব্যক্তিমানুষটিকে বারবার কতখানি শ্রদ্ধার জায়গায় রাখা যায় এ বিষয়ে দ্বিধার মুখোমুখি হয়েছি। অথচ এরাই নিয়ামক, এরাই ঠিক করে দেন মেয়েদের ঠিক কতটা বলা উচিত, কতটা নয়। যেসব ঘটনা ঘটছে চারদিকে সেসব নিয়ে বলতে গেলে, লিখতে গেলেই শুনতে হয়  ‘মেয়েটি বড় লাউড’! যাচ্চলে! অথচ আমাদের বাকস্বাধীনতা বা মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধানের কোন ধারা অনুযায়ী আলাদা আছে বলে তো জানিনা। তবে? এই ঘোমটার নিচে খেমটার মানেটা কী! একটার পর একটা খুন হচ্ছে, ধর্ষণ হচ্ছে চারদিকে, নড়েচড়ে বসছে মিডিয়া, মানবাধিকার কমিশন, সাধ্যমত সাহায্যের আশ্বাস দিচ্ছেন মন্ত্রী আমলা, তারপর মোমবাতি মিছিল, জমায়েত ব্যস! আবার একটা অপেক্ষা পরের ধর্ষণের জন্য।

প্রতিটি নারীকে প্রায় রোজ ধর্ষিত হতে হচ্ছে। পরিবার থেকে শুরু করে কর্মজীবন, বাজারে-হাটে, শপিংমলে ট্রেনে-বাসে সর্বত্র। সেই ধর্ষণগুলো? সেগুলো কী? হালকা মজা? মিনিবাসে কলেজফেরত তরুণীর পাছায় চাপ দেওয়া কি ধর্ষণ নয়? কিম্বা স্কুলবাস থেকে নামবার সময় যে ড্রাইভারকাকু কোন অছিলায় ছুঁয়ে দেয় ক্লাস সেভেনের বাড়ন্ত গড়নের গোলগাল মেয়েটির কুসুমকলি! যে মেয়ে বাপ-দাদাকে স্যানিটারি ন্যাপকিন আনতে দিতে লজ্জা পায় সেই ষোড়শী কিশোরীকে পাড়ার ওষুধের দোকানের মদনদা বলে ‘তোর এখনি এক্সট্রা লার্জ লাগে? ‘ নির্ভয়াকাণ্ডের জন্য মিটিং মিছিল করে এসে জনৈক অমুকবাবু মেয়ের কোচিং থেকে ফেরার খবর নেন, স্ত্রী গেছেন মোমবাতি মিছিলে, এই অবসরে অপুষ্ট কিশোরী কাজের মেয়ের জন্য সহানুভূতি উথলে পড়ে, ব্রা’র স্ট্র‍্যাপ থেকে হাত নামে তলপেটে, কুঁকড়ে যায় মেয়েটি, চকচকে একশটাকা হাতে মেয়েটি রাস্তায় নামে, খুঁড়িয়ে হাঁটে, কাকে বলবে? অসুস্থ মা বাড়িতে, নেশাখোর বাপ। ধর্ষকাম পুরুষের একান্ত শৌখিনতা।

সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন এক অধ্যাপক যেন সেদিন মন্তব্য করেছেন ‘যা করেছে করেছে, খুন করতে গেল কেন’? মানে? রোজ রোজ একটু একটু করে যে খুনগুলো ঘটে যাচ্ছে জনান্তিকে, রোজ যে ধর্ষণগুলো তাড়িয়ে তাড়িয়ে চাটছে মেল শভিনিজমের লোভী বেড়াল, সেই লাগাতার ধর্ষণগুলো? এর কোন ধর্মভেদ নেই, জাতপাত বর্ণ নির্বিশেষে ধর্ষিতা হচ্ছে মেয়েরা। এই যা খুশি করার অধিকার কে দিল পুরুষকে? গায়ের জোর বেশি বলে আজীবন মেয়েরা বঞ্চিত হবে? তবে যে বর্বর পেশীশক্তির বিরুদ্ধে বড় বড় সেমিনার হয়, হাততালি উপচে পড়ে, খবরের কাগজ কভার করে সেসব ছবি, স্টোরি।

আশিরনখর রক্তাক্ত এই মন, এই দেহ, এ দায় কার? ধর্ষণ মানে শুধু যৌনাঙ্গের পীড়ন নয়, শরীর-মন নির্বিশেষে সম্ভ্রমের ধর্ষণের এক্তিয়ারভুক্ত। পুরুষের একচ্ছত্র দখলদারির নিজস্ব চারণভূমির নাম বুঝি নারী? মেয়ে বললে যথাযোগ্য মর্যাদায় কম পড়তো তাই হ্যাশট্যাগের মত ছেলে জুড়ে ‘মেয়েছেলে’ ছিঃ। নারী একটি আলাদা গোত্র নয় নারীও মানুষ। ওদেরও ইচ্ছে হয়। কোনোদিন কোথাও দেখেছেন নাকি খুব এক্সেপশনাল বা বিকৃতমস্তিষ্ক ছাড়া কোন মেয়ে কোন ছেলেকে উত্যক্ত করেছে, তার প্যান্টের চেন টেনে দিয়েছে? তার পাছা চাপড়ে বলেছে ‘হেব্বি জিনিস’। না, হয়নি। তাহলে কি উত্থিত দণ্ড সামলাতে না পেরে আকস্মিক বোধবুদ্ধি হারায় পুরুষ নামক স্পেসিমেনটি! কিছু কিছু উদারমনা পুরুষ আবার পরিবারকেন্দ্রিক, অন্যনারীতে এরা অরুচিবোধ করেন, তুতো বোন, ভাইয়ের বউ দিয়ে রিপ্লেস করানো হয় একরকম জোর করে। এগুলোও তো ধর্ষণের খণ্ডচিত্র।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই পুরুষেরা আস্তিন গুটিয়ে রে রে করে উঠেছেন আমায় হেঁটেকাঁটা দেবেন বলে। পুরুষবিদ্বেষী ত্যাঁদড় মেয়ের আস্পর্ধায় চমকে উঠেছেন, বিশ্বাস করুন আমি নারীবাদী, কিন্তু কোথাও এতটুকু পুরুষবিদ্বেষী নই। আমার বাবা, ভালোবাসার পুরুষ, আমার সন্তান এরা সবাই পুংদণ্ডবিশিষ্ট, কিন্তু তা বলে অন্যায়কে তো অন্যায়ই বলবো। বাপ-সোহাগী বলে মা’র সম্ভ্রমের কথা ভাববো না? তা কি করে হয়!

সমস্ত পুরুষকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবেসে, আদর সোহাগ করে বলছি, রাগ করে, সাবধান করে বলছি, অভিমান আর যন্ত্রণা নিয়ে বলছি ধর্ষিতা নারীর শরীর থেকে রক্তাক্ত যৌনাঙ্গ টেনে বের করে যখন পৌরষিক পরিতৃপ্তির ঢেকুর তোলেন, তাকিয়ে দেখবেন একবার, থ্যাঁতলানো যৌনাঙ্গ নিয়ে হাঁ করে পড়ে থাকা মেয়েটাকে আপনার ভারতবর্ষ বলে মনে হবে, ওর রক্তমাখা ওড়নার দিকে তাকিয়ে আমরা ছাব্বিশে জানুয়ারির শীত শীত ভোরে গেয়ে উঠবো ‘বন্দে মাতরম…’

ততক্ষণ অবধি অপেক্ষায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ