আহারে জীবন

ফাহ্‌মিদা বারী
গল্প
আহারে জীবন

দরজাটার কড়া নড়ে চলেছে সেই কতক্ষণ ধরে!

আওয়াজটা হয়ত বাড়ির প্রত্যকেরই কানে আসছে, কিন্তু উঠে গিয়ে কেউ যে খুলে দেবে দরজাটা এই শক্তিটুকু আর কারো মধ্যে অবশিষ্ট নেই।

না থাকারই কথা! রাতের পরে রাত জেগে কারই বা আর শক্তিতে কুলায়! সবারই তো শরীর!

সাবের সাহেব বহু কষ্টে বালিশের ওপর থেকে মাথাটা একটুখানি উঁচু করলেন। পাশেই স্ত্রী রিমা প্রায় অচেতনের মতো পড়ে আছে। যদিও সাবের সাহেব ভালোভাবেই জানেন রিমা জেগেই আছে।

ইদানীং প্রচণ্ড রকম চাপের কারণেই কী না কে জানে, রিমা একেবারেই ঘুমাতে পারছে না। আধো তন্দ্রা আর আধো জাগরণের মাঝামাঝি একটা কোন অবস্থায় থাকছে সব সময়। গভীর ক্লান্তিতে চোখের নীচে কালি পরেছে। সারা মুখে অবসাদ আর রাত্রি জাগরণের নানাবিধ চিহ্ন প্রকট হয়ে ফুটে ঊঠেছে।

ছুটির দিন বলে আজ সাবের সাহেবও বাসাতেই আছেন। এখন যতটা সময় বাসায় থাকা যায়, তিনি তাই থাকার চেষ্টা করেন। রিমা আর কাজের মেয়েটা আর কতই বা করবে? তিনি বাসায় থাকলে তবু কিছুটা ওদের সাহায্য হয়।

আগে অবশ্য ছুটির দিনগুলোতেও তাকে বাসায় পাওয়া যেত না। বন্ধুবান্ধবরা মিলে পাড়ার ক্লাবঘরে জম্পেশ তাসের আসর জমাতেন। সেই সাথে চলতো পাড়ার বজলুর দোকানের গরম সিঙ্গারা আর কন্ডেন্সড মিল্কের প্রচণ্ড মিষ্টি চা। ডায়াবেটিস এখনো দেহঘরে বাসা বাঁধতে পারেনি দেখে কাপের পরে কাপ সেই চা সেঁটে দিতেন তারা। বজলুর দোকানের এসিস্টেন্ট ছেলেটাই দু’ঘণ্টা অন্তর অন্তর তাদের চা আর সিঙ্গারার যোগান দিত।

সেসব এখন অতীতের কথা। সুদূর নয়, নিকট অতীতেরই কথা…তবু সেসব দিন আর কখনো বর্তমানে ফিরে আসবে এই সুখভাবনায় তিনি আর ডুবে যেতে পারেন না।

আজ প্রায় ছ’সাত মাস যাবত সাবের সাহেবের মা হাজেরা বেগম পুরোপুরি শয্যাশায়ী। সামান্য বাতের ব্যথা বাড়তে বাড়তে এই পর্যায়ে এসেছে যে, তিনি আর বিছানা থেকে উঠে বসতেও পারেন না। গোসল করানোর জন্য একরকম পাঁজাকোলা করে তাকে ওঠাতে হয়। বেডপ্যান দেওয়া হচ্ছে সেই প্রথম থেকেই।

পা দুটোও প্রায় প্যারালাইজডের মতোই। তেমন একটা নাড়াতে চাড়াতে পারেন না।

সাবের সাহেবের ছোট একটা বোন আছে। সে থাকে ঢাকার বাইরে। মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে ঢাকায় ভাইয়ের বাসায় এসে কিছুদিন থেকে গেছে। সে যতদিন ছিল, রিমার অনেকটা সাহায্য হয়েছে। মায়ের সবরকম দেখভালের কাজ সেই সময়টুকুতে সাবের সাহবের বোনই করেছে। কিন্তু তারও তো স্বামী, সন্তান, সংসার আছে! দিনের পরে দিন তার পক্ষেই বা কীভাবে থাকা সম্ভব!

সাবের সাহেব খুব অস্বস্তিতে থাকেন সব সময়। রিমা যদিও মুখ ফুটে অসন্তোষের কথা কখনো বলেনি, কিন্ত যদি বলে ফেলে! যদি মুখ ঘুরিয়ে ফেলে তার মা’র দিক থেকে! ওকে কি তাহলে দোষ দেওয়া যাবে?

এমন শুয়ে থাকা রোগীর দেখাশোনা করা যথেষ্ট ধৈর্যের ব্যাপার। কষ্টসাধ্য তো বটেই! তাছাড়া সবচেয়ে বড় সত্যি যেটা, সেটা হলো হাজেরা বেগম রিমার শাশুড়ি…মা নয়। দুজনে খুব যে মিল মহব্বতে মিশে ছিল এতগুলো দিন, তা মোটেও নয়। মাঝে মাঝে হাজেরা বেগমের দিক থেকে বাড়াবাড়ি হয়ে যেত, মাঝে মাঝে রিমার দিক থেকে। কেউই কারো কথা মাটিতে পড়তে দিত না। বউ শাশুড়ির দ্বন্দ্ব যুদ্ধে কার পক্ষ নেবেন, সেই ভয়ে সাবের সাহেব দিশাহারা হয়ে যেতেন মাঝে মাঝে।

সেই হাজেরা বেগম শয্যাশায়ী হয়ে যাওয়ার পরে সাবের সাহেব নিজে থেকেই বলেছিলেন,

‘মা’র জন্য একজন ট্রেইনড নার্স রেখে দিই। আজকাল খোঁজ করলে বেশ ভালো নার্স পাওয়া যায় যারা চব্বিশ ঘণ্টার জন্য এমন রোগীর দেখাশোনা করে।’

রিমা কঠিন মুখে বলেছিল,

‘কেন আমার ওপরে ভরসা পাচ্ছো না নাকি?’

‘না না…তা কোথায় বললাম?তবে তোমার ওপরে অনেক চাপ পড়ে যাবে!’

রিমা এক কথায় তার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলেছিল,

‘আমার করতে কোন অসুবিধা হবে না। তাছাড়া নাসিমা আছে। ও থাকলে আমি একাই পারবো।’

রিমা বলেছিল ঠিকই, কিন্তু সাবের সাহেব খুব বেশি ভরসা পাননি তার কথায়। হয়ত জেদের বশে জোর দেখাচ্ছে। দু’দিন যেতে না যেতেই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে।

সেই দু’দিনের জায়গায় ছ’সাতমাস হতে চললো। রিমা এখনো অসন্তোষের কথা কিছু বলেনি।

সাবের সাহেবই নিজের গরজে একে ওকে নিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছেন মাঝে মাঝে। তাদের গ্রামের বাড়িতে কিছু দরিদ্র আত্মীয় স্বজন আছে। তাদেরকে টাকার বিনিময়ে নিয়ে এলে বরং খুশিই হবে। অনেকেই আর্থিক প্রয়োজনের কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না। তাদেরকে এভাবে সাহায্য করা গেলে দু’পক্ষেরই উপকার হয়।

কিন্তু রিমা সায় দেয়নি। সাবের সাহেব মাঝে মাঝে ভেবে পান না, সবকিছু একা হাতে করার জেদ কেন চাপলো রিমার মাথায়? সে কি এভাবে নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিতে চাইছে? নাকি এতদিন অনেক আজেবাজে কথা শুনেও যে সে তার মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি সেটা দেখাতে চাইছে? অথবা অনাহুত খরচের ধাক্কা সামলাতে চাইছে? কোনটা?

সাবের সাহেব মনকে তিরস্কার করেন। এর কোনটাই হয়ত ঠিক নয়। রিমা হয়ত সত্যি সত্যিই অসহায় মানুষটার প্রতি সমবেদনা থেকেই এসব করছে।

মানুষের মন অনেক জটিল। সেই মনের গভীরে কখন কোন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া চলে কে তার খবর রাখে?

একদিন যার তিক্ত কথায় তাকে দু’দণ্ড সহ্য করা যেত না, সেই মানুষটাই যখন নিজের শক্তি হারিয়ে অথর্ব হয়ে যায় তখন তার প্রতিই করুণার ধারা বেশি করে উথলে উঠে।

সাবের সাহেব নিজেও যথেষ্ট করছেন। ছেলে হয়ে তো আর মা’র বিশেষ কিছু প্রয়োজনে তিনি হাত দিতে পারেন না, তবু কোন কোন রাতে তিনি জোর করে রিমাকে ঘুমাতে পাঠান।

সেসব রাতে তিনিই জেগে বসে থাকেন মা’র পাশে।

মা ঘুমাতে পারে না। আবোল তাবোল কথা বলে। ডাক্তার বলে ‘ডেলিরিয়াম’। এই বয়সে এমন অসুস্থতায় ডেলিরিয়াম হয়েই থাকে। স্মৃতি বিস্মৃতির মাঝে ঘোরাফেরা করে তার এলোমেলো কথাবার্তা। একেবারে বাচ্চাদের মতো জেদ করে মাঝে মাঝে।

সাবের সাহেব শিশু হয়ে যাওয়া মাকে সেই ছেলেবেলার মতো করে ডাক দেন,

‘মা ও মা… মাগো!’

হাজেরা বেগম হু হা করেন। ছেলের আকুতিভরা ডাক তার কানে পৌঁছায় কী না জানা যায় না।

দুই.

দরজা খুলে সাবের সাহেব দেখলেন, একটা লম্বা খাম হাতে নিয়ে পিওন দাঁড়িয়ে আছে।

বেশ অবাক হলেন তিনি। আজকাল চিঠি আর তেমন একটা আসেই না বলতে গেলে। মোবাইলের যুগে লোকজনের চিঠি লেখার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে সেই কবে!

খাম হাতে নিয়ে দেখলেন ডায়াগনোস্টিক সেন্টার থেকে এসেছে। হয়ত মা’র কোন রিপোর্ট হবে, এই ভেবে চিঠিটা খুলে ফেললেন সাবের সাহেব। আর খুলে ভেতরের রিপোর্ট পড়েই তাজ্জব হয়ে গেলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর্যন্ত তার পা দুটো পুরোপুরি অসার হয়ে রইলো।

রিপোর্টটা রিমার। টেস্টগুলো করিয়েছিলেন প্রায় দশদিন হতে চললো। আশ্চর্য! ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি! মায়ের অসুস্থতা, অফিসের কাজের চাপ… এসবের ভারে এই রিপোর্ট আনতে যাওয়ার কথা আর মনেই আসেনি।

রিমাও তাকে মনে করিয়ে দেয়নি। কে জানে হয়ত অভিমান থেকেই তাকে মনে করিয়ে দেয়নি রিমা। হয়ত দেখতে চেয়েছিল, নিজে থেকে সাবের সাহেবের মনে পড়ে কী না।

এসব ছোটখাট পরীক্ষা রিমা মাঝেমাঝেই করে। হয়ত তার ভালোবাসায় আশ্বস্ত হতে পারে না…হয়ত নিরাপত্তার অভাববোধ। হবে কিছু একটা।

বেশ অনেকদিন ধরেই ঠিকমত ঘুম হয় না রিমার। ভালোভাবে খেতে পারে না। সাবের সাহেব ভেবেছিলেন, এভাবে দিনরাত অসুস্থ মানুষকে দেখাশোনা করতে গিয়েই রিমা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। এসব তারই পার্শব প্রতিক্রিয়া মাত্র। ঘুমের সাইকেল পালটে গেলেও অনেক সময় মানুষ ঘুমাতে পারে না।

কাজেই খুব একটা উদ্বিগ্ন ছিলেন না তিনি। তবু ডাক্তারের কথামত টেস্টগুলো করিয়েছিলেন।

রিপোর্ট হাতে নিয়ে তিনি মূহ্যমান হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। রিমার ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট গুলো বলছে, সে ছয় সপ্তাহের গর্ভবতী।

সাবের সাহেব আর রিমার বিয়ের বয়স এই বছরে আট পূর্ণ হবে। তারা নিঃসন্তান। সাবের সাহেবের মা একমাত্র ছেলের ঘরে নাতি নাতনী দেখার জন্য অনেক হা পিত্যেশ করেছেন। প্রায়ই এটা সেটা পানিপড়া, কবিরাজি ঔষধ…ছেলের বউকে কিছুই খাওয়াতে বাদ রাখেননি তিনি।

রিমা এসবে তেমন বিশ্বাস না করলেও মন রক্ষার্থে খেয়েছে মাঝে মাঝে । কিন্তু কাজ কিছু হয়নি তাতে। রিমার গর্ভে সন্তান আসেনি। সাবের সাহেবের মা’র তার পুত্রবধুর প্রতি নানাবিধ অজানা ক্ষোভের এটাও একটা বড় কারণ। একমাত্র পুত্রের ঘরে আজ অব্দি সন্তান না আসার দুঃখ তিনি কিছুতেই ভুলতে পারতেন না। সুস্থ অবস্থায় প্রায়শঃই বলতেন,

‘আমার আর বাঁচার কি দরকার? কী সুখ দেখনের আশায় বাঁচুম আমি?’

সাবের সাহেব এই হঠাৎ আসা সুখবরের ধাক্কা সামলাতে বেশ অনেকটা সময় নিলেন। তারপরে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন ঘরে।

 বিছানায় একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রয়েছে রিমা। তাকে দেখে এখন ঘুমন্ত বলেই মনে হচ্ছে। বেচারী কত রাত একটু আরাম করে ঘুমাতে পারে না। অথচ এখন এই সময়টাতে তার ঘুমের কী ভীষণ প্রয়োজন!

সাবের সাহেবের মা তার এই অসুস্থতার পরে থেকে রাতে একেবারেই আর ঘুমান না। বলতে গেলে প্রায় সারারাত জেগে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেন আর একে ওকে ডাকাডাকি করতে থাকেন। তাই কাউকে না কাউকে তার পাশে জেগে থাকতেই হয়।

দিনে সবার অন্যান্য কাজকর্ম থাকে। সেগুলোও তো আর ফেলে রাখা যায় না।

তবে এতদিনে সবাই নিজেদের রুটিনটাকেও সুবিধামত পালটে নিয়েছে। রোগী যখন ঘুমিয়ে থাকে সেই সময়ে অন্য কাজকর্ম ফেলে রেখে হলেও সবাই একটু ঘুমিয়ে নেয়।

সাবের সাহেব নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন তার স্ত্রীর দিকে।

এখন কিছুতেই রিমাকে বেশি চাপ দেওয়া যাবে না। যত জেদই দেখাক সে, তার মা’র সেবা শুশ্রুষার জন্য গ্রাম থেকে কাউকে আনতে হবে । অথবা ভালো কোন নার্সের ব্যবস্থা করতে হবে। যেটাই হোক, একটা কিছু করতেই হবে।

নাতি-নাতনি আসার খবর শুনলে আল্লাহ চাইলে তার মাও অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।

মনের মাঝে অনেকগুলো আশার আলো যেন একসাথে জ্বলে ঊঠলো সাবের সাহবের। একটা শিশু অনেক কিছুর বার্তা নিয়ে আসে। অনাগত খুশি, অধরা আনন্দ…সবকিছুর প্রাণকেন্দ্রে থাকে ছোট্ট একটা প্রাণ।

আজ কতদিন ধরে শুধু কষ্ট আর বেদনার দিনরাত্রি কাটাতে কাটাতে তারা প্রত্যেকেই ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেই ক্লান্তির মাঝে এই হঠাৎ আসা খুশির বারতায় দিনটাই যেন একেবারে অন্যরকম হয়ে ঊঠলো।

মনের মধ্যে কিছু একটা যেন আচমকাই বলে গেল, সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে…একেবারে আগের মতো।

তিন.

রিমার শত জেদ সত্ত্বেও সেদিনের পরে থেকে সাবের সাহেব তাকে আর রাত জাগতে দেন না।

সময়মত খাওয়া, ঘুম আর বিশ্রাম…স্ত্রীর স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন তিনি। সেই সাথে নিজের মা’র দেখাশোনার ভারটাও সানন্দে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন সাবের সাহেব।

দিনের সেবাশুশ্রুষার জন্য একজন নার্স রেখে দিয়েছেন। রাতের বেলাটুকুতে তিনিই জেগে বসে থাকেন মা’র পাশে। মা’র হাতটা নিজের হাতে নিয়ে আবেগাপ্লুত গলায় নিজের অনাগত সন্তানের গল্প বলেন।

সাবের সাহবের মা কিছু হয়ত বোঝেন, কিছু বোঝেন না…তবু ছেলের আবেগটুকু হয়ত তাকেও ছুঁয়ে যায়। চুপ করে শুয়ে থাকেন তিনি।

সারাদিন অফিস করে এসে আবার রাতের পরে রাত এই পরিশ্রমের ধকল তিনি অনায়াসেই  সামলে যেতে লাগলেন। মনে তার অগাধ আস্থা। নিশ্চয়ই আবার ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। শুধু একটা আশঙ্কাই মাঝে মাঝে ভর করে মনের মাঝে। মা দেখে যেতে পারবেন তো তার নাতির মুখ!

দেখতে দেখতে আরো ছ’মাস পার হয়ে গেল।

এতদিন পরের প্রেগন্যান্সি, বেশ ভয়ে ছিলেন তারা স্বামী স্ত্রী দুজনে। কী জানি, বাচ্চাটা টিকবে কী না। যদি আশার আলো দেখিয়ে আবার হতাশায় ডুবে যেতে হয়!

রিমার ঔষধ, খাওয়া দাওয়া সবকিছুর দিকেই সাবের সাহেবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আবার মা’র সেবাতেও এতটুকু ক্লান্তি নেই তার। বরং অনেক বেশি আশা আর উদ্যম নিয়ে মার সেবা করে চলেছেন তিনি।

এত বছর পরে তার মা’র মনের আশা পূরণ হতে চলেছে! নাতি নাতনি আসতে চলেছে। সেই নাতি নাতনিকে যেন তার মা প্রাণভরে দেখতে পারেন। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে পারেন। মনের মধ্যে আশা আর আনন্দের বীজ বুনেই চলেছেন তিনি প্রতিনিয়ত।

এদিকে অফিসে কাজের চাপও কিছু কম নয়।

সাবের সাহেব তার সেকশনের হেড। তার নির্দেশ আর তত্ত্বাবধানেই সেকশনের কাজকর্ম পরিচালিত হয়। তিনি একদিন অফিস কামাই করলে কাজও পড়ে থাকে।

তবু সবদিক দেখতে গিয়ে ইদানীং মাঝে মাঝেই অফিস কামাই হয়ে যাচ্ছে তার। অফিসে উপস্থিত থাকলেও পড়ে পড়ে ঝিমাতে থাকেন। এই সুযোগে অধঃস্তনরা কাজে ফাঁকি দেয়। দরকারী ফাইল ফেলে রেখে বাইরের বেসরকারী কাজে মনোনিবেশ করে। প্রাইভেট কাজ করে বোনাস উপার্জন করে।

অবস্থা বেগতিক দেখে গত সপ্তাহে সাবের সাহবের বস তাকে নিজের চেম্বারে ডেকে নিয়েছিলেন। হয়ত শক্ত কিছু কথাবার্তা বলার জন্যই ডেকেছিলেন তাকে। কিন্তু সাবের সাহবের চেহারা দেখে মায়াবশতই কী না কে জানে, সেই শক্ত ভাব আর বজায় রাখতে পারেননি।

কিছুটা নরম গলাতেই বলেছিলেন,

‘সাবের সাহেব, মানুষের পক্ষে তো আর সব কূল একসাথে সামলে চলা সম্ভব নয়। আপনার মা অসুস্থ, রাতে তাকে দেখাশোনা করতে হয়। শুনেছি আপনার স্ত্রীও সন্তানসম্ভবা।

আমি বলি কী, আপনি বরং কিছুদিন ছুটি নিন। শেষ কবে বড় ছুটি নিয়েছেন মনে করে দেখুন তো! এত এত ছুটি জমিয়ে করবেনটা কী? দু-তিন মাসের একটা আর্ন্ড লিভ নিয়ে নিন। আপনার অনুপস্থিতির সময়টুকু আমি আপনার সেকশনের কাজগুলো অন্য সেকশনে দিয়ে রাখবো। কাজগুলো পড়ে না থেকে সময়মত হয়ে যাক।‘

ছুটি নেওয়ার প্রস্তাবে সাবের সাহবের মন খানিক খুশি হয়ে উঠলেও আবার হিসাবনিকাশে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। সামনে এমনিতেই বড় ছুটির প্রয়োজন পড়বে।

বাচ্চা হওয়ার পরে তার বাসায় থাকার প্রয়োজন আরো বাড়বে বৈ কমবে না। সেই সময়টুকুর জন্য ছুটিটা জমিয়ে রাখতে হবে। সাবের সাহেব বিনয়ী কণ্ঠে বলেছেন,

‘সামনে অবশ্যই ছুটি নিব স্যার। তবে আর কিছুদিন পরে। আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। আমি আমার সেকশনের কাজকর্মের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবো। আপনাকে কমপ্লেইন করার আর সুযোগ দিব না স্যার।‘

সাবের সাহেবের বস তবু কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন তার মুখের দিকে। তার মনোভাব বুঝতে পেরেই হয়ত আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করেননি। শুধু ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছেন,

‘ঠিক আছে, দেখেন পারেন কী না। আপনি সৎ পরিশ্রমী মানুষ দেখে আমি এতদিন বেশি কিছু বলিনি। কিন্তু আপনার সেকশনের কাজের প্রগ্রেস খুবই খারাপ। এভাবে চলতে থাকলে আমাকে কিন্তু বাধ্য হয়েই কাজগুলো অন্য সেকশনে দিয়ে দিতে হবে।‘

সেদিনের পরে থেকে অফিসেও আর মন না দিয়ে পারেন না সাবের সাহেব। বেলাইনে চলে যাওয়া অধঃস্তনদের লাইনে ফিরিয়ে আনতেই বেশ অনেকটা সময় দিতে হয়েছে তাকে।

মানুষের প্রকৃতি বড় বিচিত্র! এরাই আগে সাবের সাহবের মুখের কথা পড়ার আগেই কাজ শেষ করে ফেলতো। আর এখন, তার একটুখানি ঢিলেমীর সুযোগেই দায়িত্ব থেকে ফাঁকি মারতে শুরু করে দিয়েছে।

সবদিক সামলাতে গিয়ে ইদানীং খুব ক্লান্ত লাগে সবসময়। তবু আশার আলোকে নিভিয়ে দেন না কখনো।

এই তো আর অল্প কিছুদিন! তাদের সন্তান পৃথিবীতে চলে এলেই সবকিছু পাল্টে যাবে আবার।

একটা ছোট্ট শিশুর অনেক ক্ষমতা, এটা তিনি বিশ্বাস করেন।

চার.

সাবের সাহেবের মা’র অবস্থা এখনো অপরিবর্তিত। শুধু একটা ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। অসংলগ্ন কথাবার্তা এখন অনেকটাই কমে এসেছে।

সাবের সাহেব তার অক্লান্ত পরিশ্রমের কিছুটা সুফল পেয়েছেন। মা’র পাশে কিছু ঘুম কিছু জাগরণে এখনো রাতগুলো কাটছে তার। দিনে অফিসের চাপ, স্ত্রীকে নিয়ে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে দৌঁড়ঝাপ…একা একজন মানুষ কত কীই যে করতে পারে তা সাবের সাহেবকে না দেখলে কে জানতো আগে?

আশেপাশের বাসার প্রতিবেশিনীরা তাদের স্বামীদের কাছে তুলে ধরার জন্য বেশ ভালো একটা উদাহরণ পেয়েছে সবাই। কিছু একটু হলেই সবাই একই কথা বলে,

‘দেখে এসো, সাবের সাহেবকে। বউকেও মাথায় তুলে রেখেছেন, মাকেও ফেলে রাখেননি। পারবে ওরকম হতে?’

অনেক অনুরোধেও সাবের সাহেব কিছুতেই আর স্ত্রীকে রাত জাগতে দেন না। মায়ের পাশে বসে আনন্দিত মুখে গল্প করেন,

‘এই আর অল্প কিছুদিন গো মা! আসছে তোমার নাতি। এতদিন কত নাতি নাতি করেছো না? প্রাণভরে দেখো নাতিকে।’

হাজেরা বেগম চুপ করে ছেলের উচ্ছ্বাস দেখেন। কখনোবা দু’একটা কথাও জুড়ে দেন।

‘তুইও তো কদ্দিন পরে বাপ হবি!’

হাজেরা বেগমের বিছানার সাথে মিশে যাওয়া শরীরটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে যান সাবের সাহেব।

মা তার নাতিকে দেখে যেতে পারবে তো! তার আগেই যদি কিছু হয়ে যায় মার!

সাবের সাহেব ব্যাকুল মনে দিন গোনেন। নামাজের শেষে আল্লাহর কাছে হাত ওঠান,

‘হে আল্লাহ্‌, আমার মা’র হায়াত বাড়িয়ে দাও। তাকে তার নাতিকে দেখার সুযোগটুকু অন্তত তুমি দিও।‘

দেখতে দেখতে স্ত্রী রিমার ডেলিভারীর দিন ঘনিয়ে আসে।

নির্ধারিত দিনের আগেই রিমার পানি ভাঙতে শুরু করে। সাবের সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে ছোটেন হাসপাতালে। ডাক্তার পরিস্থিতি দেখেই রোগীকে সোজা ঢুকিয়ে দেন লেবার রুমে।

সাবের সাহবের ভীষণ অস্থির লাগে কেন যেন। সকাল থেকেই তার মা’র শরীরটা খুব খারাপ করেছে।

শঙ্কা এসে ভর করে মনের কোণে। মা দেখে যেতে পারবে তো তার নাতির মুখ!

ভাবতে ভাবতে বুকের এক পাশে চিনচিনে সূক্ষ্ণ একটা ব্যথা ওঠে। আস্তে আস্তে ব্যথাটা কেমন যেন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

…………………………………………

রিমার কোলে তার বাচ্চাকে এনে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। ফুটফুটে কোমল একটা মুখ। চোখদুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অবাক বিস্ময়ে সে দেখে চলেছে পৃথিবীটাকে। জীবনের খোলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে সে কিছুটা হতবিহবল।

রিমা তার সন্তানকে এক ঝলক দেখে নিয়েই ইতিউতি খুঁজতে থাকে স্নেহশীল একটি মুখ। কোথাও খুঁজে পায় না সে মুখটিকে।

তাকে এখনো জানানো হয়নি, লেবার রুমে তাকে ঢোকানোর অল্প কিছুক্ষণ পরেই তার স্বামীর হঠাৎ কার্ডিয়াক এটাক হয়। খুব তীব্র এটাক। তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

……………………………………

হাজেরা বেগম দীর্ঘদিন ভালো থাকার পরে আজ আবার হঠাৎ অসংলগ্ন কথা বলতে শুরু করেছেন। কাজের মেয়ে নাসিমা তাকে কিছুতেই সামলে রাখতে পারছে না। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেই চলেছেন,

‘ও সাবু…ও বাপ আমার! কই গেলি বাজান! আমার কাছে আয়! তরে দেখবার পাই না কেন বাপ? তুই আমারে ছাইড়া যাস না বাপ আমার…’

ফাহ্‌মিদা বারী। লেখক ও প্রকৌশলী। জন্ম ২৩ শে নভেম্বর। পিতার কর্মসূত্রের সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে। শিক্ষাজীবনের বড় একটা সময় অতিবাহিত হয়েছে রাজশাহীতে। স্কুল ও কলেজজীবন এই শহরেই সমাপ্ত করেছেন। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড থেকে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..