আহা জীবন জলে ভাসা পদ্ম যেমন

এইচ বি রিতা
ছোটগল্প
Bengali
আহা জীবন জলে ভাসা পদ্ম যেমন

গত তিন দিন যাবত শুয়ে থাকায় এবার সত্যিই রাবেয়ার পিঠে ব্যথা শুরু হয়েছে। পিঠ সোজা রেখে বসার নির্দেশ দিয়েছেন ডাক্তার প্রায় তিন বছর আগে। মেরুদণ্ডের কর্ড পেছনের দিকে কিছুটা বেঁকে গিয়েছিল বিধায় হাত-পায়ের নড়াচড়ায় ব্যথা হতো। মাঝেমাঝে জ্বালাপোড়া করা সহ মিনমিন করার মতো অস্বাভাবিক একটা অনুভূতিও হতো।  কী কারণে কর্ড বেঁকে গেলো, তার সঠিক কোন তথ্য ডাক্তারের কাছে ছিল না। কতগুলো ওষুধ শুধু ধরিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে আজও রাবেয়া দীর্ঘক্ষণ বসতে বা শুয়ে থাকতে পারে না, ভারী কিছু তুলতে পারে না।

ঘরে মায়ের কাছে রেখে এসেছে আইয়ান আর নাবিলাকে। তারা এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয় পার করেনি। পড়াশুনায় অত্যন্ত মেধাবী, স্বভাবে খুবই শান্ত ও নমনীয় হওয়ায় রাবেয়াকে কখনোই ওদের নিয়ে ঘাম ঝরাতে হয়নি। তাছাড়া, কথায় আছে, যার কেউ নেই তার আল্লাহ্ আছেন-বয়সে ছোট হলেও চিন্তা-ভাবনা, বোঝাপরায় আইয়ান আর নাবিলা একদম যেনো পরিবারের বয়স্ক কেউ, বিশেষ তরে নাবিলা। মাঝেমাঝে রাবেয়া বলে, তোমরা আমার আরেক বাবা-মা। তোমরা না থাকলে হয়তো আজকের আমি এখানে থাকতাম না।

ছোট আইয়ান তার কথার অর্থ তেমন না বুঝলেও খুশি হয়ে যায়। সাত বছরের বাচ্চা কতটুকুই বা বোঝে!

তবে নয় বছরের নাবিলা তার মা’কে খুব বোঝে। স্কুল থেকে ফিরেই মা’কে ঘরের কাজে সাহায্য করতে মরিয়া হয়ে উঠে। কতশত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় কারণে অকারণে। জানালার পাশে কফির কাপ হাতে মা’কে চুপ করে বসে গান শুনতে দেখলেই নানান প্রশ্ন করে নাবিলা।

সারাদিনের ঘরের কাজ, দায়িত্বগুলোর সাথে ভাড়াটিয়াদের নানান সমস্যা নিয়ে ভাবাও রাবেয়ার নিত্যদিনের কাজ। আজ মটর নষ্ট তো কাল বিদ্যুত সংযোগের সমস্যা। ভাড়াটিয়াদের মধ্যে কথা কাটাকাটি, অভিযোগ তো আছেই। সবই দেখতে হয় রাবেয়াকে। ভাড়া দিয়েই যে তাকে চলতে হয়। বিদায়কালে স্বামীর রেখে যাওয়া দুতলা বিল্ডিং আর বাজারে দুটো মুদি দোকান, এই তো তার বাকি জীবন সংসার টেনে নেবার একমাত্র উপায়।

তবু নিজের জন্য দিনের কিছুটা সময় আলাদা করে রাখে রাবেয়া। সে সময়টুকু শুধুই তার একান্ত নিজের। জানালার পাশে বসে কখনো নজরুল সংগীত, কখনো বা বেহালার ঝাঁঝালো করুণ সুর শুনে শুনে পার করে দেয় অনেকটুকু সময়।

এমনই এক সন্ধ্যায় রাবেয়া তার প্রিয় বেহালার তাল সুরে যখন মুগ্ধ হচ্ছিল, তখন আহত মুখাবয়বে নাবিলা এসে উপস্থিত হয়। রাবেয়ার গা ঘেঁষে বসে হঠাৎ বলে উঠে, মা! তোমার কোন বন্ধু নেই কেন?

মেয়ের এমন প্রশ্নে রাবেয়া চিন্তিত হয়। সে জানে এখন তাকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, মিথ্যা বলতে হবে।

সে বলে, কে বলল আমার বন্ধু নেই? এই যে তুমি, আইয়ান! তোমরা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।

নাবিলা বিরক্ত হয়। একই কথা দিনের পর দিন সে আর শুনতে রাজি নয়। ভ্রু কুঁচকে বলে,

-মা! আমাদের একটা দরকার। তাহলে তোমাকে সব কাজ একা করতে হবে না, তুমি-আমি, আমরা সবাই মিলে অনেক ঘুরতে পারবো, রেস্টুরেন্টে যেতে পারবো।

মেয়ের এমন সব আবদার আজ নতুন নয়। আগেও বহুবার মেয়ে তাকে বিয়ে করার কথা বলেছে। রাবেয়া এড়িয়ে গিয়েছে বার বার। ছোট বাচ্চা মেয়ে, কতটাই বা বুঝে। রাবেয়া বলে,

-নাবিলা! দুইদিন পর পর এসব কথা কে মাথায় ঢুকায় তোমার? একই কথা কেন বার বার বলতে হবে?

-তুমি একা, এতো কিছু করতে হয়। একটা আঙ্কেল থাকলে কত সাহায্য করতো তোমাকে। তোমার অসুখ হলে ওসুধ খাইয়ে দিতে।

-তুমি আর আইয়ান আছো তো।

-আমরা বড় হচ্ছি না? পরে আমাদের যদি পড়াশুনা করতে দূরে যেতে হয়? তখন কী হবে?

রাবেয়া হতাশ হয়। প্রতিবেশী চাচাদের মৌখিক নির্যাতন সম্পর্কে নাবিলার কিছুটা হলেও ধারণা আছে। তবু জেদ ধরে। নাবিলার চাচারা কখনোই রাবেয়াকে এই সুযোগ দিবে না। পারলে সবটুকু কেড়ে নেয়।

হঠাৎ উৎসুক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকায় নাবিলা। তারপর হাতটি ধরে বলে,

-মা! তাহলে একটা বয়ফ্রেন্ড হলে কেমন হয়? কেউ জানবে না। তুমি আর আমরা সবাই লুকিয়ে নতুন আঙ্কেলের সাথে বেড়াতে যাবো! আর তোমাকেও একা একা গান শুনতে হবে না। কাঁদতে হবে না।

হুট করেই যেনো সামান্য আতঙ্ক ছেয়ে গেলো রাবেয়ার মনে। এ মেয়ে কান্নার কথা বলছে কেন? তবে কি নাবিলা সব দেখে, সব বুঝতে শিখেছে…. অথচ এখনো তো ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে সে!

মেয়েটা হয়েছে ঠিক তার বাবার মতো। ইঁচড়ে পাকা। সেদিন স্কুল শিক্ষকও বলল, তার আইকিউ লেভেল নাকি বেশ উন্নত। বয়সের তুলতায় চিন্তাশক্তি, বোঝার ক্ষমতা নাবিলার সেই দুই বছর বয়স থেকেই বেশি। নাবিলার বাবা তাকে শেষবার কোলে নিয়েছিল যখন তার বয়স তিন। মেয়ে পাগল ছিল সে, প্রায়ই বলতো, এই মেয়ে আমার একদিন আকাশ ছোঁবে, দেখে নিও রাবেয়া।

তারপর আর মেয়ের আকাশ ছোঁয়া দেখা হল না তার, হঠাৎ একদিন কি হলো, কিছু না বলেই চলে গেলো। ডাক্তার জানালেন, লিভার সিরোসিস।

রাবেয়ার বয়স আজ ৩১। দুই সন্তানের জননী।  ২৫ বছর বয়সে বিধবা হওয়া রাবেয়া তার দুই সন্তান নিয়ে স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়ি ভাড়া দিয়ে কোন রকমে সংসার চালান। দৈন্য প্রায়ই হানা দেয় তার দুয়ারে। শশুর বাড়ির লোকজন কোন সাহায্য করেন না। বরং কোন বিপদে সাহায্য চাইতে গেলে, ভাসুরদের কাছ থেকে কুপ্রস্তাব পান। সেই ভয়ে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে একা একাই দিন পার করছে রাবেয়া। আবারো বিয়ে করার কথা ভাবতে পারছে না কারণ বাচ্চা দুটো এখনো ছোট! বিয়ে করলে শ্বশুর পক্ষ তাকে এক কাপড়ে সন্তান সহ ভিটে মাটি ছাড়া করবেন। স্বামীর রেখে যাওয়া সামান্য ঘর-বাড়িটুকুও বাচ্চারা পাবে না, কিছুই যে রাবেয়ার নামে রেখে যায়নি সে। তাছাড়া, দ্বিতীয় স্বামীও যে তাকে ও তার সন্তানদের সঠিক দায়িত্ব নিবেন, তারই বা নিশ্চয়তা কী!

হ্যাঁ! ছোট মেয়ে নাবিলা ভুল বলেনি, রাবেয়ার কাউকে সত্যিই দরকার। রোজকার লড়াইয়ে দিন দিন তার মন ভেঙে পড়ছে। ভেতরের যন্ত্রণা প্রায়ই গলা পর্যন্ত এসে আঁটকে যায়। বলা হয় না। কাউকে তো বলতে হয় কিছু, ভাগ করে নিতে হয় সুখ-দুঃখ। কারো হাতটি ধরে তো হাঁটার জন্য মন ব্যগ্র হয়, লোমশ বুকে মধ্যরাতে নাকটি ঘষে দিতে শরীর ফুঁসে উঠা- একত্রিশ সংখ্যার সময়ের দাবী। একে উপেক্ষা করা যায় কি?

প্রায়শই মধ্যরাতে রাবেয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। উষ্ণ শরীরে জরায়ু প্রসারিত হয়, স্তন গোলাপি ছাপে ফুলে যায়, বোঁটা শক্ত হয়ে উঠে। এ শরীর কাউকে চায়, তবু গায়ে কাঁথা মুড়িয়ে রাবেয়া সব চেপে যায়। শরীর শীতল করতে মনের উপর অত্যাচার চালায়। আহত হয়, কষ্টে পুড়ে যায়, আবার স্বাভাবিকও হয়।

পেটের ক্ষুধার মতোই যৌনতাও একটি ক্ষুধা নয় কি! এটিকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সব ক্ষুধাই  জৈবিক প্রয়োজন বা তথাকথিত প্রতিক্রিয়াশীল মন এবং শারীরিক আবেগ, যা বিশ্বের সবকিছুকে অসংলগ্ন এবং মিথ্যা করে তোলে। যে কোন ক্ষুধা মিটাতেই হয়, হোক শরীর কি মনের, তা না হলে ক্ষুধা কল্যাণের সুক্ষ্ম বোধকে ধ্বংস করে দেয়।  সভ্যতার সৃষ্টির পর থেকে মানুষ ক্রমাগত ক্ষুধা মেটানোর জন্যই সংগ্রাম করছে। তবে শুধু রাবেয়াই বা বাদ যাবে কেন?

গত চার বছর যাবত রাবেয়ার অনিয়মিত পিরিয়ড চলছে। ডাক্তার বলেছিল ওভারিতে সিস্ট হওয়ার কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হচ্ছে। দুই, তিন মাস পর পর যখনই পিরিয়ড হয়, রাবেয়া অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রচন্ড তলপেট ব্যথা শুরু হয় তখন, সাথে বমি। এই অনিয়মিত রক্তস্রাব বন্ধের জন্য গাইনি চিকিৎসক তাকে শুরুতেই নানান ওষুধ খেতে দেন, তাতেও কাজ না হলে দুইবার সিস্ট রিমুভ করা হয়।

এই সমস্যার চিকিৎসায় প্রথমে যখন রাবেয়াকে বার্থ কনট্রোল পিল দেয়া হলো, রাবেয়া ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। সেই চিন্তা আতঙ্কে পরিণত হল যখন তার প্রতিবেশী ভাড়াটিয়া মহিলা একদিন সন্ধ্যায় তাকে পিল নিতে দেখলো।

প্রচন্ড সন্দেহজনক মনে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আফা, আপনে এই বড়ি খান কেন?’

রাবেয়া বলেছিল সমস্যা ও ডাক্তারের কথা। তবু যেন ভাড়াটিয়া মহিলার সন্দেহ কাটে না। মটর কল, বিদ্যুৎ ঠিক করতে কোন পুরুষ লোক যদি সিঁড়ি ডিঙিয়ে দুতলায় যেতে, সেই ভাড়াটিয়া মরিয়া উৎকণ্ঠা নিয়ে একতলা থেকে ছাদ পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করতো। সেই থেকে রাবেয়া লুকিয়ে পিল নিতো। তবু কাজ হয়নি। দিন দিন সিস্টের আকৃতি বাড়তেই লাগলো।

গাইনি বিশেষজ্ঞ বলেছিল সেদিন, রাবেয়া আপনি বিয়ে করছেন না কেন? বয়স এতো কম!

বিস্ময় চোখে বলেছিল রাবেয়া, আমার এই সমস্যার সাথে বিয়ের কথা কেন আসছে ঠিক বুঝতে পারছি না!

তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন য়ৌনতার সাথে শরীর ও মনের সংযোগ এবং ধারাবাহিক পার্শপ্রতিক্রিয়ার কথা। বলেছিলেন, হঠাৎ করে যৌনকাজ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে নারীর জরায়ু ও ওভারিতে অনেক সঙ্কটের উদ্ভব হতে পারে।

আরো অনেক কিছুই বলেছিলেন। সব শুনে অবাক হওয়া ছাড়া রাবেয়ার কিছুই করার ছিল না। জীবন তো এমনই, চলতি পথে থমকে দাঁড়ায়। কিছু করার নেই।

রাবেয়া ভাবে, কাকে বলা যায় এসব! কে শুনতে চাইবে তার প্রতিটা দিনের লড়াইয়ের কথা! কেউ কি জানে, মাঝরাতে জেগে উঠা দেহের উত্তাপ ঠিকই বালিশ চাপা দিতে জানে সে? হ্যাঁ, রাবেয়া জানে সংসারী দেনা পাওনার হিসেব বড্ড বেহায়া। মন পুড়িয়ে দেহের বিনাশ কতটা ঝাঁজালো হতে পারে, তাও জানে সে। জানে, দায়বদ্ধতার আড়ালে শরীর ভিজিয়ে ভালবাসার প্রার্থনা নিছক বোকামি। আর তাই পুনর্জন্মের আশায় দেহ-মন কাঁটাতারে ঝুলিয়ে অবলীলায় চোখ বেঁধে গুছিয়ে নেয় সংসার।

ভাবনার ছেঁদ কাটিয়ে অনুমতি ছাড়াই কক্ষে প্রবেশ করলো ডিউটিতে থাকা নার্সটি। রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, আপনার নাকফুল আর কানের দুল জোড়া এখনই খুলে ফেললে ভালো হয়। নিরাপদে ব্যাগে রেখে দিতে পারবেন।

রাবেয়া বলল, ঠিক আছে।

গত চারমাস হয় রাবেয়ার অনবরত ব্লিডিং হচ্ছে। সিস্টের আকৃতি স্বাভাবিকের থেকে বেশ অনেকটাই বড় হয়েছে। অসহনীয় ব্যথা। ডাক্তার জানালেন, এন্ডোমেট্রিওসিস, কোন ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। এবার শেষ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

পিজি হাসপাতালের গাইনি বিভাগে জায়গা দখল করে আছে রাবেয়া আজ তিন দিন। কিছুক্ষণ পরই হয়তো অপারেশন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হবে। আজ রাবেয়ার জরায়ু অপসারণ করা হবে। শরীরের একটা অংশ ছাড়া বাকি দিনগুলোতে বেঁচে থাকা কেমন হতে পারে? রাবেয়ার কোন ধারণা নেই।

এই মুহূর্তে ছোট মেয়ে নাবিলার কথাগুলো তার কানে ভাসছে বার বার-‘

“মা! তুমি একা, এতো কিছু করতে হয়। একটা আঙ্কেল থাকলে কত সাহায্য করতো তোমাকে। তোমার অসুখ হলে ওষুধ খাইয়ে দিতে।…… ”

 

এইচ বি রিতা। কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক। জন্ম বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায়। বর্তমান নিবাস কুইন্স, নিউইয়র্ক। তিনি নিউইয়র্ক সিটি পাবলিক স্কুল শিক্ষকতায় জড়িত রয়েছেন দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে। পাশাপাশি কাজ করছেন দৈনিক প্রথম আলোর উত্তর আমেরিকা ভার্সনে। এছাড়াও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ