ইচ্ছেগাও

মিতালী মুখোপাধ্যায়
ভ্রমণ
ইচ্ছেগাও

এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দৌড়ে ছুটে চলেছে মেয়েটি। পরনে পুরনো একটা জিন্স। টি শার্ট টাইট ফিটিংস। মাথায় করে বয়ে আনছে গুচ্ছের বাক্স। একটা মাথায়, পিঠে ব্যাগপ্যাক আর ডানহাতে আরেকটা। ওর কাজই এই টুরিস্ট এলেই দৌড়ঝাপ করে মালপত্তর পাহাড়ের ঢালু পথ দিয়ে তুলে আনা আর বিদায়কালে নামিয়ে গাড়ি পর্যন্ত পৌছে আসা।

মিষ্টি নাম এই জায়গাটার, ইচ্ছেগাও। পূর্ব সিকিমে। আমাদের দশদিনের ট্যুরের শেষ আস্তানা। আর যে মেয়েটার কথা বললাম, সে পুকুলি।

ছোট করে কাটা চুল, গোল মুখখানায় কপালে অযথা গোটাকয়েক বলিরেখা। যা ওর কাজেকর্মের সাথে একেবারেই মানায় না।

পুকুলি চা কখন পাবো?

এই ত এক্ষুণি, জলখাবার এর সাথে।

পুকুটি, ঘরে একটা আলো জ্বলছেনা যে।

আসছি ম্যাম।

আরে ও পুকুলি যে। ভুল নামে ডেকেছি তোমায়। কিছু মনে করো না।

না, ম্যাম।

ওপাশের ঘর থেকে এত বাসন নিয়ে এল, ওদের জলখাবারের। এক কলি গান করতে করতে মিলিয়ে গেল পাহাড়ের ঢালুতে।

এবার আমাদের খাবারের পালা।

পাহাড়ি ঢালের গায়ে দশ বারো ফুট জায়গা বার করে, সেখানে প্লাস্টিকের টেবিল চেয়ার পাতা। মাথায় রঙিন ছাতা। একটু আগেই একপশলা দিয়ে গেছে মেঘ। এখন আবার ঝকঝকে। অগত্যা আবার ডাক, পুকুলি চেয়ার মুছতে হবে যে।

আসিইইই ম্যাম। অদৃশ্য হয়েও জানান দিলো সে।

মিনিট খানেকের মধ্যেই হাজির গান করতে করতে।

এই এখানে সিগারেট পাওয়া যাবে?

হ্যাঁ, সব আছে।

বলার সাথে সাথেই আবার অদৃশ্য।

সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠলে ওর গলার আওয়াজ পাওয়া যায়, গান হচ্ছে তখন ও। সন্ধ্যায় সে তুমুল সক্রিয়। কাঠ জ্বালিয়ে ফায়ার ক্যাম্প করা থেকে শুরু করে আগুন নেভানো পর্যন্ত। তার মধ্যে মোবাইলে সবার নাচের ভিডিও তোলা। কিছুই ওকে বলে দিতে হচ্ছেনা। ফাঁকেফাঁকে নিজেও নাচে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে। দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামের দর্শকদেরও রেহাই নেই, টেনে হিচড়ে নাচ করিয়েই ছাড়ছে।

সিকিমে জনসংখ্যার অনুপাত বেশ কম। পুরুষ বেশি মেয়েদের তুলনায়। ১৯৭৫ সালের পর থেকেই সিকিম ভারতের ২২ তম শাখা রাজ্যে পরিণত হয়েছে।

বাবা মন্দির নাথান পাস ভারতীয়দের যাবার অধিকার আছে।

উওর পশ্চিম দিকে ভারত- চীন তিব্বত, পুবে ভুটান সীমান্ত থাকার ফলে বেশ অনেকাংশ ভারতীয় মিলিটারিদের ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। নেপাল পশ্চিমে।

নাথান ভ্যালীতে আমাদের সারাদিন শুধু ওদের মহড়ার গুলতান শুনতে হয়েছে। সিকিমের অধিভাষী মূলত নেপালি বংশোদ্ভূত । শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্য ৮৩ শতাংশ। ১১ টি ভাষা সরকারী।  ক্যাম্পিং ফায়ারে সুরার সাথে অতিরিক্ত ইচ্ছাপূরণ দেশী মুর্গীর ঠ্যাং ভাজা। বাঙালি কোন অনুষ্ঠান বাদ দেয় না। সঠিক ভাবেই পালন করে।

রাতে খাবার ব্যবস্থা শুরু করে দিল পুকুলি। আবার সেই পাশে সরিয়ে রাখা চেয়ার টেবিল এনে, দুহাতে ট্রে ভরে খাবার নিয়ে হাজির।

মে মাসে এই ইচ্ছেগাও এ ‘হোম স্টে‘র আঠাশটা ঘরই বুক, জানাল লক্ষণ। এর ঘরেই আমরা ছিলাম। মেয়ে কলেজে পড়ে, আর বাবার ‘হোম স্টে‘ ব্যবসার নেটের বুকিং সংক্রান্ত সব কাগজপত্রের দেখভাল করে। লক্ষণের বউ গীতা তিনবেলা খাবারের দিকটা দেখে।

ছবির মত সাজানো গোছানো পাহাড়। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইউস মি করে ঝুলিয়ে রাখা আছে ময়লা ফেলার ব্যবস্থা। সিকিম পেরিয়ে বেংগলে ঢুললেই পার্থক্যটা চোখে পড়ে। এই হোম স্টে এখানে যিনি চালু করেছেন, তার নাম সেবাস্তিয়ান প্রধান।

পশ্চিমা কায়দায় টয়লেট আছে, খাবারঘর আছে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর। অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহার। কী হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে, তবু মুখে হাসি লেগে আছে অকৃত্রিম। সারাটা পথ পুকুলির কথা মনে পড়ছে। এত জীবনিশক্তি মেয়েটা পায় কোথা থেকে।

 

মিতালী মুখোপাধ্যায়। কবি, সংস্কৃতিকর্মী ও শিক্ষক।   লেখকের প্রকাশিত বইসমূহ:      

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..