প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
ইচ্ছেনদীর রঙ ঝিলিক ঝিলিক রূপালী। ইমন বসে আছে সন্ধ্যার নির্জন ঘাটে। ইনকা সভ্যতার মতো ম্লান অন্ধকার ধীরে ধীরে নামছে …… !
ইমন বাড়ী থেকে পালিয়ে এসেছে। বিরক্তি আর রাগে। প্রাইভেট টিউশনে যাবার কথা। কাহাতক ভালো লাগে এই স্কুল, পড়াশোনা, প্রাইভেট মাস্টার। বাবা মা এই ছোট বয়েস থেকেই লেগে পড়েছে। ইমনকে বড়ো হলে ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার বানাবে। ও জানে, এবারে স্কুলের হাফ-ইয়ার্লিতে ইংলিশ আর ম্যাথসে ফেল মারবে। বাড়ীতে আবার বকা। ইমনের মন একদম ভালো নেই।
পালিয়ে বসে আছে নদীর পাড়ে। একটা নির্জন ঘাটে। এখানে এখন কেউ আসে না। বহু দূরে দেখা যাচ্ছে নদীর আড়াআড়ি একটা বাঁধ। সেটা দিয়ে কচিৎ কখনো দু’একটা স্কুটার। সেগুলোর অস্পষ্ট হেডলাইট।
নির্জন ঘাটটার পেছনেই বড় বড় বট, আম আর শালের জঙ্গল। একটা শিরীষগাছের উপর থাকে দুটো পাখি, – ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী। ওরা এখানকার পুরানো বাসিন্দা।
ব্যাঙ্গমী বললো,- আহা! দ্যাখো, দ্যাখো। নদীর ঘাটে এই সন্ধ্যায় একলা বসে আছে কি সুন্দর একটা বালক!
ব্যাঙ্গমা বললো, আমাদের ঘরেও যদি এরকম একটা ছানা থাকতো!
ব্যাঙ্গমী চেঁচিয়ে বললো, বালক! তোমার কি খুব দুঃখ? এই নদীর নাম ইচ্ছেনদী। যা কিছু ইচ্ছে, তুমি চাইতে পারো এই নদীর কাছে!
ব্যাঙ্গমাও গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, – ইচ্ছেনদী! ইচ্ছেনদী! এই নদীর নাম ইচ্ছেনদী! বালক, তোমার যা কিছু ইচ্ছা, এর কাছে চাও। নদী তোমায় সবকিছু দেবে! তুমি যেমনটা চাও, তোমার জীবনটা তেম্নিই হবে!
তখন আকাশে চাঁদ উঠেছে। নদীর ছোট্ট ছোট্ট ঢেউএ আলোরা নাচছে।
ইমন ধীরে ধীরে বললো,- ইচ্ছেনদী! ও ইচ্ছেনদী! তুমি কি শুনছো? আমার একদম ভালো লাগে না ইস্কুল, টিউশনি। বই-পত্তর, বাড়ী-ঘর!
তারপর আবার ভূতুড়ে নির্জনতা। চারদিক থমথমে। সময় এগোচ্ছে। ইমনের এবার একটু ভয় ভয় লাগছে। ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীরাও ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত্রির প্রথম প্রহর পেরিয়ে গেলো। সারা দিনের ক্লান্তিতে ছেলেটার দুচোখে নেমে আসছে ঘুম।
জোছনার আলোয় ইমন দেখল। নদীর মাঝ বরাবর জলস্রোতটা লাট্টুর মতো পাক খাচ্ছে – একটা ঘূর্নি, আর একটা হিস হিস আওয়াজ! নদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে একটা সুন্দরী মেয়ে। অপরূপ তার মুখ! তার পিঠের কাছে পাখির মতো দুটো ডানা। মেয়েটা জলের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে এলো। তার কাছে দাঁড়ালো।
মেয়েটি ইমনের চিবুকে হাত দিয়ে বললো, – আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে দেখছি। এখানে চুপটি করে একলা একলা বসে আছো। আমার নাম জলকন্যা। তুমি কি যেন বলছিলে? তোমার কিচ্ছু ভালো লাগে না! এবার আমাকে বলো, সত্যি সত্যি তোমার কি কি ভালো লাগে?
ইমন বললো,- আমাকে রূপকথার দেশে নিয়ে চলো।
জলকন্যা বললো, – সত্যিই যাবে? আসো। তাহলে আমার পিছু পিছু চলে এসো।
ইমন দেখলো, নদীর জল দুভাগ হয়ে যাচ্ছে। তার মাঝ বরাবর রাস্তা!
জলকন্যার পেছন পেছন ইমন হেঁটে চলেছে। নদীর মাঝ বরাবর একটা শুখা রাস্তা ঢালু হয়ে পাতালের দিকে চলে গেছে। রাস্তার দুপাশে গাছপালা, ফুল, পাখি!
জলকন্যাকে ইমনের খুব পছন্দ হলো। বললো, – আমি তোমাকে দিদি ডাকবো! আমার তো কোনো দিদি নেই!
জলকন্যা ওর হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে বললো,- বেশ বেশ, তাই ডেকো। যা বলছিলাম, এই নদীর নাম ইচ্ছেনদী। অনেক অনেক বছর আগে এই নদীর দুপাশে ছিল অনেক মানুষ, বাড়ী ঘর, বিশাল জনপদ, শহর। কিন্তু মানুষগুলো নদীকে ভালোবাসতো না। তাই রাগ করে নদী ভাসিয়ে দিল জনপদ। এল দত্যির মতো উঁচু উঁচু হড়কা বাণ। তারপরে একদিন এলো ভূমিকম্প! দুনিয়াটা থরথর করে নেচে কুঁদে উঠলো। বাড়ীঘর সব কিছু মাটির নীচে ডুবে গেল।
ইমনের চোখে বিস্ময়! রাস্তা দিয়ে যেতে দেখলো, পথের দুপাশে প্রবাল পাথরের ছোট ছোট ঢিবি – তার ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসছে চারটে ডানায়ালা রঙিন রঙিন হাঁস! উঁকি মারছে উড়ুক্কু মাছেদের ছোট্ট ছোট্ট লাল নীল শরীর!
জলকন্যা বললো, – এখানেই নদীর নীচেই আছে প্রাচীন ইতিহাস। ইনকা সভ্যতার আদলে এখানেও এককালে গড়ে উঠেছিল সুন্দর একটা সভ্যতা! এই রাস্তাটাই সিধা চলে গেছে রূপকথার দেশে !
রাস্তাটা শেষ হতেই একটা সুড়ঙ্গ! তারপর আবার রাস্তা। দুপাশে ঘন গাছপালা।
হাঁটতে হাঁটতে ইমনের চোখে পড়লো, রাস্তার দুধারে ভূতদের কঙ্কাল! গাছগুলোর সঙ্গে ঠেক দিয়ে লটকানো! বীভৎস সে দৃশ্য!
ইমন ভয়ে আৎকে উঠলো।
জলকন্যা বললো,- ভয় পেয়ো না। ওরা এক কালে ছিল লোভী হিংস্র জলদস্যু! মানুষদের ঘরে ঘরে, শহরে, গ্রামে লুটপাট করে ওরা ফিরছিল। এই নদীপথে, বড়ো বড়ো পুষ্পক-নৌকায় করে । ওদিকে সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষগুলো বুক চাপড়াচ্ছে, কেঁদে কেটে নালিশ জানাচ্ছে! হাওয়ায় ভেসে সে খবর এসে পৌঁছালো ইচ্ছেনদীর কানে। তখনই নদীর জল গোল গোল পাক খেতে লাগলো, তেড়ে এলো ঘূর্ণি ঝড়! নদীর চোরা স্রোতে লোকগুলো হারিয়ে গেলো। ওই যে সব ভাঙ্গাচোরা হাড় গোড় দেখছো, গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে রাখা যত মানুষের কঙ্কাল – ওরা সব পাপী, ওরা খুনী, ওরা জলদস্যু!
এরপর রাস্তার দুধারে সুন্দর সুন্দর ফুল আর ফলের গাছ! সোনালী রঙের আপেল আর নীল নীল টসটসে আঙ্গুর ঝুলছে! জলকন্যা দিদিটা বললো, – ইমন, ভয় পেয়ো না। এগিয়ে যাও। আমি এখন যাচ্ছি। ওই যে বড় মহলটা দেখছো, ওখানেই তোমার রূপকথার দেশ! ভয় পেয়ো না, একা একাই এগিয়ে যাও! যখন ডাকবে, আমি তোমায় আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসবো।
দিদিটা ফুস করে কোথায় যে মিলিয়ে গেলো! এত সুন্দর দিদিটাকে ছাড়তে কষ্ট হচ্ছিল বৈ কি। কি আর করা। ইমন এগিয়ে গেল একা একা, নতুন একটা দেশে!
ওর নাকে এসে লাগলো সুন্দর সুন্দর ফুলের গন্ধ! ওর মা যে সেন্ট ওকে মাখিয়ে দেয়, এই সুন্দর গন্ধটা তার থেকেও তীব্র, খুব আলাদা!
একটা বিশাল মহল! গেটটার কাছে দুটো কচি কচি মেয়ে, গালদুটো তাদের আপেল, হাতগুলোয় তাদের গোলাপের রঙ – ওরা ইমনকে এগিয়ে দিল সুস্বাদু পানীয়!
ওরা বললো,- ইচ্ছেনদী তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে? তুমি জলকন্যার সঙ্গে এসেছো? এসো, এসো, ভেতরে এসো!
অনেকগুলো ঘর। ওরই মতো ছোট ছোট বাচ্চা, কিশোর কিশোরী। কেউ গান করছে, কেউ ছবি আঁকছে, কেউ নাচছে। কয়েকজন দল বেঁধে খেলছে। সবাই খুব খুশী!
ঘরের ভেতরে একজন ওর হাত ধরে বললো,- তোমার নামটা তো ভারী সুন্দর – ইমন! এটা একটা সংগীতের রাগ! আমরাও মন খারাপ হলে সন্ধ্যের পর ওই রাগটাই বাজাই।
ভেসে এলো ইমনের সুর। ওর মা বাবা এতো সুন্দর নামটা রেখেছে, অথচ কখনোই ইমনকে গানের এই সুরটা শোনায় নি!
নদীর নীচে একটা রূপকথার শহর! এখানে আছে আরো অনেক কিছু! ও ঢুকে গেল জ্যোৎস্নার মতো আলোকিত একটা নিস্তব্ধ গুহায়! দেয়ালের গায়ে প্রাচীন চিত্র। প্রাচীন কালে দূরদেশে ইনকা সভ্যতা যখন রাজত্ব করছিল, তখন তাদের আদলে এখানেও একটা ইনকা-সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এদের রাজাগুলো ছিল ভারী বদমাস! তাই সে সময়েও এসেছিল বিশাল ভূমিকম্প! নদীর হড়কা জলের বাণ! এ দেশের ভূখন্ড থেকে সেই সুন্দর ইনকা-সভ্যতাটাই হারিয়ে গেল। মাটি আর জলের নীচে।
ইমন হাঁটছে, হাঁটছে। আরো অনেকগুলো সাজানো গোছানো পরিপাটি ঘর। ঘরগুলো উজ্জ্বল, এখানে ইলেকট্রিক লাইট নেই। অথচ পুরো সময়তেই অলৌকিক আলোর রোশনাই। ওখানেই ওর অনেকগুলো বন্ধু জুটে গেল। সবাই ওরই বয়েসী। রূপকথার দেশে ওর জন্যে শ্বেত পাথরের থালায় এলো পায়েস। যে সঙ্গিনীটি ওর জন্যে খাবারের থালা এনে দিলো, তার গলায় ঝিনুকের মালা, শ্যাওলা দিয়ে বোনা নরম সবুজ ঘাঘরা।
ইচ্ছেনদীর নীচে সব পাওয়া যায়। মানুষেরা সেসব কথা জানে না, জানবার চেষ্টাও করে না।
এজন্যেই ইচ্ছেনদীর খুব অভিমান! ইমন ভাবলো, তাই নদী কখনো কখনো কাঁদে, কখনো রেগে যায়। এজন্যেই সে মানুষদের সঙ্গে কথা বলে না।
জলের নীচে রূপকথার দেশে কতক্ষণ সময় কাটিয়েছে, সে সব ঘড়ির হিসেব ইমনের মনে নেই। আবার সেই জলদিদিটা ফিরে এলো। তার হাতে হাত রেখে নদীর বুক-চেরা সেই মায়াবী রাস্তাটা ধরে ইমন আবার পৌঁছে গেল সেই নির্জন নদীর ঘাটে।
ইমন বললো,- দিদি, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে বাড়ীর থেকে বেরিয়েছি তো!
জলকন্যা বললো,- ঘুমাও। আরাম করে ঘুমাও। যত খুশী। এখানে তোমার কোন ভয় নেই।
রাত্রির শেষ প্রহর। শিরীষগাছের উপর ঘুমাচ্ছিল পাখিদুটো। ওদের ঘুম ভাঙতেই ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী দেখলো, সেই বালক তখনো নদীর নির্জন ঘাটে ঘুমিয়ে আছে।
ব্যাঙ্গমী বললো, – আহা, বাছাধন কাদের ছেলে গো? জুতোর পাশে মোজাজোড়া পড়ে আছে। কর্তা, দ্যাখো তো, মোজার গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারো কিনা- এ বালক কোন গাঁয়ে থাকে? আহা রে, বাছাধন সারা রাত এখানেই শুয়ে আছে, ঘরে ফেরে নি!
ব্যাঙ্গমা বললো,- বউ, চিন্তা করো না, একটু বাদেই চাঁদ যখন আমবনের নীচে ডুবে যাবে, রামুজেলে নৌকা আর জাল নিয়ে এখানে পৌঁছে যাবে। ও এলে ছেলেটার একটা হিল্লে হয়ে যাবে!
সূয্যি ওঠে নি। সকাল হবো হবো। নৌকায় ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করতে করতে রামুজেলে এগিয়ে আসছে। নৌকায় মাছধরার জাল। ঘাটের কাছে নৌকা থেকে নেমে রামু যখন বিড়ি ধরাতে যাবে, তখন দেখে একটা ছোট্ট ছেলে নদীর ঘাটে শুয়ে আছে।
ওমা! কাদের ঘরের ছেলে গো? রাতভর একা একা পড়ে আছে নদীর ঘাটে। জিন্দা আছে তো? কেউ মেরে এখানে ফেলে যায় নি তো!
একটু ঠ্যালা দিতেই বালকটা নড়ে চড়ে উঠলো। চোখ রগড়ে উঠে বসে দেখলো রাত্রের নদীর চেহারাটা হারিয়ে গেছে। সকালে অন্য আরেক রকম চেহারা।
– তুমি কে? কোথা থেকে এসেছো? এখানে কেন ঘুমোচ্ছিলে?
রামুকে উত্তর না দিয়ে ইমন পাল্টা প্রশ্ন করলো, – ইচ্ছেনদীই কি এতো সকাল সকাল তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে? তোমার গায়ের রঙ এতো কালো কেন? তুমি কে? তোমার মুখের থেকে ওষুধের গন্ধ? তুমি কি এই সকালেই বড়োদের মতো ড্রিঙ্কস করে এসেছো?
ছেলেটার কথা শুনে রামুর খুব ভালো লাগলো, বিশেষ করে ওর দেয়া এই ইচ্ছেনদী নামটা।
– হ্যাগো ভালো মানুষের ছেলে। খুব সুন্দর বললে তো! আমরা এই নদীকে বলি ইরাবতী। তুমি এর নাম দিয়েছো ইচ্ছেনদী! ভালো, ভালো! কিন্তু তোমার নাম তো বললে না? কেন সারা রাত এখানে শুয়ে ছিলে? কোন গায়ে তোমার বাড়ী?
– আমার নাম ইমন। থাকি কল্যাণগড়। তবে আমি ঘরে যাবো না। তুমি কি এই ইচ্ছেনদীতেই থাকো? নৌকায় ঘুরে ঘুরে মাছ ধরো? শুনেছি এখানে সোনার মাছও পাওয়া যায়? কালকে জলদিদিটা বলছিল!
– ঠিক বলেছো ভালো মানুষের ছেলে! এই নদী আমাদের যা দেয় তা সোনার চেয়েও দামী। রূপার চাইতেও উজ্জ্বল।
– চলো তোমার সাথে সাথে আমিও নদীতে নদীতে ঘুরবো! ইচ্ছেনদীকে আমার খুব ভালো লেগেছে!
– নৌকায় ঘুরবে? সাঁতার জানো? ভয় পাবে না?
– সাঁতার জানি না। তবে ভয় পাবো না। আমি বাড়ী ফিরতে চাই না।
রামুজেলে ওকে নৌকায় তুলে নিল। বয়ার মতো হাওয়া ফুলানো ঢাউস একটা রাবারের টিউবের পাশে ওকে বসিয়ে দিলো।
নৌকা জলে ভাসছে। সূর্য উঠে গেছে। দূরে এদিকে ওদিকে নদীর বুকে আরো কতগুলো জেলেনৌকা। চাঁদের আলোমাখা নদীটা রাতের মতো এখন আর ততটা মায়াবী নয়!
নৌকার সাথে সাথে ভেসে যাছে জাল। তাতে আটকে যাচ্ছে ধবধবে পুঁটি, খয়রা, মৌরালা, বাটা মাছ।
রামু জাল তুলে তুলে বালকটাকে দেখায় চাঁদির মতো উজ্জ্বল সব মাছ। এই যে দেখছো না, জালে ফাঁসা মাছ, এসব তো সোনার চেয়েও দামী!
নদী পেরিয়ে এলো মহামায়া ঘাট, সাজন বদ্যির ঘাট। ব্যস্ত এই ঘাটগুলোতে লোকজন চান করছে, দুচারটে নৌকা আশে পাশে। কিছু উটকো লোক নদীর ঘাটে অলস বসে আছে। সাজন বদ্যির ঘাটে নাপিতের হাতে একটা লোক বেল মুন্ডি হচ্ছে, পাশেই একটা পুরুত গোছের লোক আসন পেতে প্রদীপ জ্বালিয়ে পুজো করছে, তার মন্ত্র পড়ার জোরালো উচ্চারণ ভেসে আসছে বাতাসে বাতাসে। অবাক হয়ে ইমন দেখছে নদীর দুপাশের দৃশ্য। রামুজেলে ওকে সস্নেহে অনেককিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে। অভাবনীয় এমন একটা সকাল ওর জীবনে কোনদিনও আসে নি!
ইমন জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা রামুমামু, এই ইচ্ছেনদীর কাছে সবাই তো সবকিছু চায়। তোমরা কিছু চাও না?
– নদীর কাছে আমরাও চাই। যাতে দুবেলা খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারি।
নদীর দুপাশে সবুজ সবুজ ধানের ক্ষেত। ওদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে রামু বলে – এই যে দেখছো না সবুজ ক্ষেত, ওইসব চাষীরা ইচ্ছেনদীর কাছে জল মাঙে। আর চায় খেত ভরা ফসল। নদী ওদের ইচ্ছে পুরণ করে, নালির মধ্য দিয়ে, নয়তো মাটির পরত চুইয়ে চুইয়ে জল পৌঁছে যায় ক্ষেতে। জল পেয়েই ডাগর হয়ে ওঠে ধান ক্ষেত। ধান থেকে চাল হয়। আমরা দুবেলা পেট পুরে ভাত খাই।
অবাক বিস্ময়ে ইমন চারপাশটা দেখে। নদীর স্রোত বেয়ে নৌকা এগিয়ে যায়। আরো কিছুটা যাওয়ার পরে স্পষ্ট দেখা যায় নদীর উপর বাঁধটা। বাঁধ মানে এনিকট। তার উপর দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে, সেখানে একটা গাড়ীর মতো বিরাট মেশিন দাঁড়িয়ে।
ইমন জিজ্ঞেস করলো,- আচ্ছা রামুমামা, ওটা কি? ওই যে ওখানে, আকাশ ছোঁয়া হাতীর মতো শুঁড়!
– ওটা একটা ক্রেন।
– ক্রেন দিয়ে কি হবে? ওটা ওখানে কেন দাঁড়িয়ে আছে?
– গতকালের কথা। বাঁধের উপর রাস্তাটা দিয়ে একটা গাড়ী খুব স্পীডে যাচ্ছিল। যাবার সময় গাড়ীটা নদীতে পড়ে গেছে।
– কেন পড়ে গেছে?
– ওরা নেশা করার জিনিষপত্তর বাক্সে বাক্সে ভরে নিয়ে এই বাঁধের রাস্তা ধরে শর্টকাটে কোথাও যাচ্ছিল। গাড়ীতে দুজন লোক ছিল। ওরা বদমাস দলের লোক। নেশা করে খুব জোরে গাড়ী চালাচ্ছিল। তখন ভর দুপুরবেলা। তাল সামলাতে না পেরে রাস্তা থেকে গাড়ী উল্টে পড়লো জলে, আর সঙ্গে সঙ্গেই ডুবে গেলো। এই নদী বদমাস লোকেদের সহ্য করতে পারে না, তাই জল নিমেষেই ওদের গিলে খেলো!
– তুমি ভুল বললে রামুমামু। ওই লোকগুলো মরবে বলেই ইচ্ছে করে অত বেশী নেশা করেছিল, তাই অতো স্পীডে গাড়ী চালাচ্ছিল। ঐ লোকগুলো নদীর কাছে মৃত্যুই চেয়েছিল। তুমি তো জানো, এই নদীর নাম ইচ্ছেনদী। নদী ওদের ইচ্ছেটাই রেখেছে।
– হবে হয়তো। যারা বড়ো বেশী নেশা করে, তারা দুনিয়াতে বেশীদিন বেঁচে থাকতে চায় না। হয়তো ওরা নদীর কাছে ওই মরণই চেয়েছিল। তা ঐ যে দেখছো হাতীর সুড়ের মতো ডান্ডা – ওগুলো সেচ দপ্তরের ক্রেন। ওটা দিয়ে ডুবে যাওয়া গাড়ীটাকে এখন টেনে তোলা হচ্ছে। যদিও কেউ বেঁচে নেই।
-আচ্ছা, মরে যাওয়া বদমাস মানুষদুটোকে দেখে অন্য লোকগুলোও কি ভালো হয়ে যাবে?
রামু বললো,- তা কি বলা যায়? এটা ঠিক প্রতিজ্ঞা করে বলা যায় না, ওদের দেখে সব মানুষ ভালো হয়ে যাবে! তবে এটা ঠিক, মানুষ যদি বদমায়েসী না ছাড়ে, যদি ভালো হবার চেষ্টা না করে, তবে তারা নির্ঘাত এম্নিই নদীতে ডুবে মরবে! নদী মানুষকে ঠিক চিনে নেয়!
– নদী কথা শুনতে পারে। তোমার আমার মতোই। নদী মানুষকে ভালোবাসে। আবার রেগে গেলে হড়কা বান আসে, নইলে চোরা স্রোত। সেই যে বছরটায় যুদ্ধের সময় বোম পড়েছিল, সে বছরটাতেই তো ভীষণ বন্যা- নদী রেগে গিয়ে অনেক বাড়ী ঘর ভাসিয়ে নিয়েছিল।
– নদীকে আমরা ভালোবাসি। নদীকে আমরা পূজো করি। এই রূপালী রঙের ঝাঁকঝাঁক মাছ, এরা নদীর সন্তান! রাতে কেউ যদি নদীর কিনারে আসে, সে শুনতে পায় নদীর গান, নদীর দীর্ঘশ্বাস!
এতকিছু শোনার পরে ইমন মুখ খুললো – রামুমামু, তুমি ঠিক বলেছো। আমিও শুনেছি নদী গান গায়। নদীর নীচে দারুন একটা লুকানো-জায়গা আছে, গত রাতে আমি দেখে এসেছি!
রামুর মাথায় ঘুরতে থাকে, কি করে এই ছেলেটাকে ওর বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়া যায়। তাই জাল টানতে টানতে জিজ্ঞেস করে, – ইমন, তুমি বাড়ী যাবেনা? গতকাল বিকেলে তুমি এখানে এসেছো? তা বললে নাতো, তুমি কি ভাবে এলে?
– ক্যানো? আরো অনেক লোক ছিলো। আমিও ওদের সঙ্গে টেম্পোতে বসে পড়লাম। তারপর একটা লোকের সাইকেলের পেছনে বসে কিছুটা এসেছি। তারপর অনেকটা হেঁটে হেঁটে এই নদীর কিনারে। তোমায় সত্যি করে বলি, কাউকে বলবে নাতো? আমি ইস্কুলে যেতে চাইনা। আমি সারাদিন ইচ্ছেনদীর কাছে প্রার্থনা করবো, যেন আমায় স্কুলে যেতে না হয়, টিউশ্যনি যেতে না হয়। আমি বড় হয়ে ইঞ্জিনীয়ার-ডাক্তার, কোন কিছুই হতে চাই না। পরীক্ষায় বসতে আমার খুব ভয়!
রামু বললো,- সে দেখা যাবে। এবার তুমি আমাদের বাড়ীতেই চলো। সেখান থেকে তোমাকে কল্যাণগড় শহরে পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত করবো।
ইমন কোন কথা বললো না। মুখ ভার করে বসে রইলো। রামু ভাবলো, ওদের কোন সন্তান নেই। বৌ এই সুন্দর ছেলেটাকে দেখলে খুব খুশী হবে। আজ সকালে একটা সুন্দর বালককে এই নদীই ওদের কাছে এনে দিয়েছে। ইমন ঠিকই বলেছে- এই নদীটার নাম ইচ্ছেনদী।
রামু ওকে প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে বের করে খেতে দিলো কড়কড়ে ভাজা মাছ। আর দিল রঙচটা ফ্লাস্কে রাখা গরম গরম চা। ইমন প্রাণ ভরে চানাচুরের মতো চিবিয়ে চিবিয়ে খেলো কড়া-ভাজা নোনতা নোনতা কুচো মাছ, আর চা।
ওদিকে সেই নির্জন ঘাটটার পারে, শিরীষের মগডালে বসে থাকা ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী দেখলো, সারা রাত্তির চাতালে শুয়ে থাকা সেই বালকটা তখনো ফেরে নি। পড়ে আছে ওর পায়ের ফুলকাটা নীল নীল মোজাদুটো। ছেলেটাকে রামুজেলে তুলে নিয়ে গেছে তার নৌকায়।
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী দুজনে মিলে ঠোঁটে করে তুলে নিয়ে এলো ঘাটের চাতালে পড়ে থাকা নীল মোজা দুটো।
ব্যাঙ্গমী বললো, এ জীবনে আমরা তো ভালো কাজ ত্যামন কিছু করি নি। চলো, দুজনে মিলে ওই ছেলেটার বাড়ীতে গিয়ে খবর দিয়ে আসি, বালক বেঁচে আছে, সময় হলেই ঘরে ফিরবে।
ব্যাঙ্গমার ঠোঁটে একটা মুজো, ব্যাঙ্গমীর ঠোঁটে আরেকটা। ওরা আকাশে উড়তে উড়তে মুজোর গন্ধ আর হাওয়ার গন্ধ শুকে বুঝতে চেষ্টা করলো কোন দিকে ছেলেটার বাড়ী।
অনেকক্ষণ আকাশে উড়তে উড়তে চক্কোর খেতে খেতে একসময় ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী হাওয়ার গন্ধ শুঁকে বুঝে গেল – ঐটাই ছেলেটার বাড়ী!
ব্যাঙ্গমা বললো, – ওই দেখছিস না! বালকের বাপটা কেমন চিন্তায় আছে, এক্ষুনিই থানা থেকে ফিরলো, ছেলে হারিয়ে গেছে! বাপটা খুব মোটাসোটা, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে মালদার, মুখটা বদমাস আর হিংসুটে!
ব্যাঙ্গমী বললো, -চল, বাড়ীর বারান্দায় মোজাদুটোকে ফেলে রাখি।
পাখিদুটো ফুলফুল ডিজাইন আঁকা নীল মোজা দুটো ওদের উঠোনে ফেলে দিয়ে ফিরে এলো। সেই ইরাবতী নদীর তীরে – না, না , ইচ্ছেনদীর ঘাটে – ওদের আস্তানায়- সেই শিরীষ গাছের মগডালে।
ওই বাড়ীতে ইতিমধ্যে হৈ হট্টোগোল লেগে গেছে – এই তো উঠোনে ইমনের দুপায়ের দুটো মোজা পাওয়া গেছে! কিন্তু ইমন কই?
ওরা তো জানে না, ইমন তখন মনের খুশীতে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা ইচ্ছেনদীর বুকে!
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..