ঝরা শিউলি
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
‘ইট’স টু লেইট’ বাক্যটাই মূলত আমাদের এইজিয়াজমকে নাড়া দিয়ে যায়। আমাদের ইনসিকিউরিটি, ল্যাক অফ কনফিডেন্স’কে প্রকাশ করে। আমরা নিজেরাই নিজেদের সাথে বোঝাপড়ায় গড়মিল করে ফেলি। ভুলে যাই সাফল্যের নতুনপথে যাত্রা, কখনো’টু লেইট’ হয়না। অন্তত আমার জন্য হয়নি।
জন্ম আমার সাংস্কৃতিমনা পরিবার ও সমাজে। এসব পরিবার-সমাজে বেড়ে উঠা মানুষগুলো, বিশেষ করে মেয়েগুলোর জন্য মুক্তমনা হওয়া কঠিন। তাদের প্রগতিশীল ভাবনা, নির্মাণ, চিন্তা, পরিবর্তন, সৃজনশীলতায় জন্ম থেকেই একটা সীমাবদ্ধতা থাকে।একটা নির্দিষ্ট দেয়াল তুলে দেয়া হয় তাদের সামনে। সে দেয়াল টপকে বাহিরে যাবার ক্ষমতা অনেকের থাকেনা। যাদের থাকে, তাঁরা সমালোচিত, ব্যতিক্রম।
ব্যতিক্রমী হওয়া সাহসের ব্যাপার। আত্মবিশ্বাস, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাবার মনোবল দরকার। সেটা বোধকরি আমার মাঝে ছিল। ওই যে বললাম, নতুন পথে যাত্রা, কখনো ‘টু লেইট’ হয়না। জন্মালাম। দেখলাম। সৃষ্টি, নির্মাণ, পরিবর্তনে অস্তিত্ব রেখে গেলামনা, এ কেমন জন্ম! মানুষ পরিবর্তনশীল, সবাই জানি। কিন্তু সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস ক’জন বদলাতে পারে?
আর তাই তো সেদিন আমি এক টগবগে তরুণী বেরিয়ে পড়েছিলাম শতবছরের পারিবারিক মূল্যবোধ, সমাজ-সংস্কৃতির গা মাড়িয়ে। সংসারের সকল দায়বদ্ধতা ছেড়ে। মায়ার পিছুটানে জ্বলজ সংসারের প্রেম, ঘৃণা, সমঝোতা সব গলা টিপে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। পায়ে-পায়ে সাপলুডু খেলা কম তো হলো না। খেলায় খেলায় বেলা কম ঢলেনি, তবু হেরেই গিয়েছিলাম। কী দরকার ছিল এমন ক্ষুধা পেটে খোঁপায় টকটকে গোলাপ গাঁথার?
মিথ্যে মিথ্যে, ভণ্ডামি যতসব সমাজের চোখে কেবল নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। সুদানের দূর্ভিক্ষে কঙ্কালসার ক্ষুধার্থ শিশুটাকে বাঁচাতে না পারার অনুতাপে কেভিন কার্টারও মরেছিল একদিন। অথচ কী আশ্চর্য! সেদিন সংসার বাঁচাতে না পারায় আমার কোন অনুতাপ ছিলনা।
কেননা, আমি পরিবর্তন চেয়েছি।
বলেছিলাম তাঁকে শেষবার, ‘মারো কেন? ভালোবাসো। দলিল চুক্তিনামায় তাই তো ছিল।’
বুঝেছিল কী? মধ্যরাতের শীৎকার ভুলে চিৎকার যার সুখ তুলে, সে কি বুঝে ভালোবাসার সংজ্ঞা?
কম তো সমঝোতা করিনি। তবু কেন যেন মানুষটা কখনোই আমার সাথে সন্ধিতে আসেনি। বরং এতগুলো বছর আমিই করেগিয়েছি। সুঁই সুতোই টিকে থাকার উপকরণগুলো ফুঁড়েছি কত না যত্নে, সে কেবল আজ আমার নেতিয়ে পড়া অসুস্থ্য-তর্জনীই জানে।
সেদিন আমি ছিলাম এক অনন্য যৌবনা কিশোরী। কলি মেলা সদ্য প্রস্ফূটিত হলদে গোলাপ। নাহ! গোলাপ বলা যায়না, গোলাপের নিজস্ব কোন সৌরভ নেই। বলা যায় গার্ডেনিয়া। দেখতে অনেকটা জবা ফুলের মত, স্বচ্ছ।
খোলা আকাশের নীচে মুক্ত পাখীর মত ডানা ঝাপটে ওড়াই হয়নি তখন। কারো জন্য বুকের ধুকপুক, হাতে হাত রাখার শিহরণ, চোখে চোখে মধ্যাকর্ষণে ঘূর্ণয়ন, ঠোঁটে ঠোঁটে রেড ভেলভেট কেইক ভাগ করে নেয়া, কিছুই বুঝতাম না। আকাশের বুকে ভালবাসা নয়, নাটাই ঘুড়ি দেখা কিশোরী কতটাই বা বুঝে তখন!
মনে পড়ে, বাড়ির পাশের খোলা মাঠে বন্ধুদের সাথে যখন স্কুল শেষে ইচিং বিচিং খেলতে যেতাম, দাদীমা তেড়ে আসতেন। মা’কে ডেকে বলতেন, ওই দেখ! তোর মাইয়া কেমনে দুই ঠ্যাং ফাঁক কইরা ইচিং বিচিং খেলতাসে! মাইয়া সামলা, নাইলে পরে বিয়া দিতে পারবিনা!
দাদীমার কথা শুনে আমার নিরীহ মা মুখ কালো করে ফেলতেন। তখন আমি বুঝতাম না, দাদীমার হুশিয়ারীর কারণ। না বুঝেই পা দুটো জমা করে নিতাম, পাশাপাশি।
আজ যখন বুঝতে পারি দাদীমা কি বলতেন, কেনই বা বলতেন, তখন ক্ষোভে ফেটে পড়ি। দাদীমা’র কথায় নয়, এ ক্ষোভ লক্ষ-কোটি কিশোরী, তরুণীর জীবন শুরু করার আগেই নোংরা সংস্কৃতির বীজ মগজে পুঁতে দেয়া সমাজের প্রতি। কন্যাসন্তান জন্মদিয়েই তাঁরা কন্যার যোনীপথ সযত্নে রাখার চেষ্টায় বিচলিত হতেন অচেনা এক পুরুষের জন্য। কী জঘন্য! কী জঘন্য!
সেদিন বংশের প্রথম নিয়ম খণ্ডানো, দেয়াল টপকানো মেয়েটি ছিলাম আমি। সেদিন ছিলাম আমি একা। একেবারেই একা।ভীষণ ক্ষরতাপে পুড়ে পুড়ে বর্ষার জলে পা ভেজাতে তৎপর হলাম। মা বললেন, আরেকবার ভেবে দেখ। প্রতাপশালী ভাইদের মাথা নত হল সমাজে। প্রতিবেশীরা বলল, মেনে নিলেই তো হতো! আহা! সমাজের সে কী মাথা ব্যথা গো!
কুইন্সের পথঘাট ঠিকমত না চেনা মেয়েটি সেদিন সেভেন চ্রেইন ধরে কতবার যে নেমে পড়েছিল ভুল স্টেশনে! পাশে ছিল অবুঝ দু’টি শিশু। অবাক বিস্ময়ে মায়ের হাত ধরে খুঁজে নিত তাঁরা বেঁচে থাকার আশ্বাস। ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে বুকে শক্ত করে ধরে রাখতাম শিশু দু’টোকে। শুধু মনে হতো, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে একা; ওদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আমাকে পারতেই হবে।
‘মা! বাবা কই? বাবা কেন আসেনা?’
মায়ের হাত ধরে আতঙ্ক নিয়ে খুঁজে ফিরত তাঁরা বাবাকে। তাদের কখনোই বলা হতোনা, দায়িত্বহীন মানুষটা তোমাদের ছেড়ে পালিয়ে গেছে। বলতাম, ‘বাবা বেড়াতে গেছে।’
একসময় সে ফিরতে চেয়েছিল। ততদিনে কিছুটা বুক টান করে দাঁড়াতে শিখে গেছি। অর্থহীন মনে হল। যে মানুষ একবার ছুঁড়ে ফেলে যায়, তাঁকে পূনরায় বিশ্বাস করা বোকামী।
হতভম্ব সহায়হীন মানুষ তবু লড়ে। নিজ মনোবলে লড়ে। আমিও লড়েছি। তাদের চারটি হাত ছিল আমার শক্তিশালী অস্ত্র। সে অস্ত্র কখনো কোমরে বেঁধে, কখনো বুকে জড়িয়ে আমি লড়েছি। একা।
পৃথিবীর ঘূর্ণায়নে রোজ ভোরে পূর্ব আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে সূর্য বেরিয়ে আসে। সে আভায় পৃথিবী আলোকিত হয়। আবার সন্ধ্যার মুখে নিত্যকার নিয়মে পৃথিবীকে আঁধারে ঢেকে সূর্য বিদায় নেয়। বিমর্ষ গোধূলীলগ্নে কখনো কখনো মনে হত আর বুঝি আলো দেখা হবেনা। কিন্তু চিরসত্য যা, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেতে যেতে সূর্যরশ্মি পৃথিবীকে জানান দিয়ে যায়, আমি শেষ হয়ে যাইনি, আমি চিরযৌবনা।
তাই শেষ বলে কিছু ছিলনা আমার জন্য। প্রতিটা দিন আমি নতুন করে শুরু করেছি, সূর্যের আভায় পৃথিবী নয়; নিজেকে, পরিবারকে আলোকিত করবো বলে।
পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে মানুষও যে যেদিকে পারছে ছুটছে। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলেই আশাহত মানুষ ধরে নেয়, কাল বলে কিছু নেই।ধারণার সাথে দৃষ্টির প্রখরতার যদি সমন্বয় থাকে, তবে নতুনরূপে কাল আবির্ভাব ঘটাবেই। যেখানেই শেষ, সেখানেই শুরু।
এভাবেই আমি শুরু করেছি। কণ্টকময় পথে গন্তব্যে পৌঁছুতে গিয়ে বহুবার রক্তাক্ত পায়ে ব্যথার আবির্ভাব হয়েছে। তারপর ভিন্নপথ খুঁজে নিয়েছি। সে পথও আমার জন্য, সন্তানদের জন্য নির্মল, স্বচ্ছ, সহজ ছিলনা। প্রতিবন্ধকতা পথ আটকে দিতে চেয়েছে বহুবার। থেঁতলে যেতে যেতে তবু উঠে দাঁড়িয়েছি।
শেষমেষ মা বলেছিলেন, সামনে দীর্ঘপথ বাঁকি! পারবি তো?
বলেছিলাম, পারতেই হবে।
আজ এতগুলো বছর পরও মা’কে দেখি বিচলিত হতে। অসহনীয় ব্যথা শরীরে পুষে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে দেখা আমাকে মায়ের কাছে আগন্তুক মনে হয়। কেঁদে বুক ভাসান। তারপর একই প্রশ্ন, পারবি তো?
এবারো বলি, পারতেই হবে।
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..